তিনি ফেডেরার বলেই...

উৎপল শুভ্র

৬ মার্চ ২০২১

তিনি ফেডেরার বলেই...

রজার ফেডেরার: আরও একটি গ্র্যান্ড স্লাম জয়ের পর

টেনিসটা ফেদেরারের মতো করে আর কেউ খেলেছেন বলে বিশ্বাস হতে চায় না। সবকিছুতেই এমন অনায়াস একটা ভঙ্গি, বলতে পারেন অলস সৌন্দর্য, পাওয়ার টেনিসের এই যুগে ফেদেরার চোখের জন্য অনাবিল এক প্রশান্তি।

প্রথম প্রকাশ: ২৭ জানুয়ারি,২০১৭। প্রথম আলো।

রজার ফেডেরার ম্যাচ পয়েন্টটা জিততেই হাততালি দিয়ে উঠলেন প্রথম আলোর উপ-ক্রীড়া সম্পাদক। ক্রীড়া বিভাগেই একটা আনন্দের হুল্লোড় উঠল। তা এটা এমন ঘটা করে বলার কী আছে?

আছে, আছে। ব্যাপারটা যে রীতিমতো ব্যতিক্রমী। খেলাই নেশা, খেলাই পেশা; কখনো দেখে, কখনো বা না-দেখে খেলা নিয়ে লেখাই যাঁদের কাজ, আবেগ-টাবেগ তাঁদের খুব একটা স্পর্শ করে না। কিন্তু ফেদেরার এমনই এক ভালো লাগার নাম যে, পেশাদার সাংবাদিকের আবেগের তন্ত্রীতেও তা টোকা দিয়ে যায়।

অনুমান করি, প্রথম আলোর ক্রীড়া বিভাগে ওঠা ওই আনন্দের হুল্লোড়টা আসলে বিশ্বজুড়েই উঠেছে। স্তান ভাভরিঙ্কা, তাঁর কোচিং স্টাফ ও আত্মীয়স্বজন ছাড়া আর কেউ কি ছিলেন, যিনি ফেডেরারের জয় কামনা করেননি! এমন একটা অবাস্তব চিন্তাও মাথায় আসছে, ফেডেরারের কাছে হেরেছেন বলে ভাভরিঙ্কাও বোধ হয় খুব বেশি মন খারাপ করেননি! যেমনটা করতেন অন্য কারও কাছে হারলে।

১৭ নম্বর গ্র্যান্ড স্লামটা জিতেছেন প্রায় পাঁচ বছর আগে। এর পর থেকেই ‘১৮’ লুকোচুরি খেলছে ফেডেরারের সঙ্গে। সেই খেলা যেন শেষ হয়, এটি শুধু ফেডেরারেরই চাওয়া নয়। তা বিশ্বজনীন চাওয়ায় রূপান্তরিত। ম্যাজিকটা কী? ফেডেরার গ্র্যান্ড স্লামে নামলেই কেন সবাই তাঁর হাতে আরেকটি গ্র্যান্ড স্লাম দেখার ইচ্ছায় এক কাতারে দাঁড়িয়ে যান!

টেনিসটা তিনি যেভাবে খেলেন, সেটি তো অবশ্যই কারণ। তবে শুধুই কি খেলা? আরও কিছু বোধ হয় আছে। কোর্টে, কোর্টের বাইরে কথাবার্তায়, আচার-আচরণে নিষ্কলুষ যে পবিত্রতার প্রতীক ফেডেরার, সেটিও বড় ভূমিকা রেখেছে তাঁকে এমন ‘পিপলস চ্যাম্পিয়ন’ বানানোয়।

গ্র্যান্ড স্লাম শিরোপার দিক দিয়ে ছাড়িয়ে গেছেন, তারপরও সর্বকালের সেরা নিয়ে আলোচনায় ফেডেরারের সঙ্গে রড লেভারের নামও উচ্চারিত হয়। এই তর্কের রায় দিয়ে দেওয়ার মতো জ্ঞানগম্যি এই লেখকের নেই। রড লেভারের খেলা সেভাবে দেখিওনি। তারপরও বলে দিই, টেনিসটা ফেডেরারের মতো করে আর কেউ খেলেছেন বলে বিশ্বাস হতে চায় না। সবকিছুতেই এমন অনায়াস একটা ভঙ্গি, বলতে পারেন অলস সৌন্দর্য, পাওয়ার টেনিসের এই যুগে ফেডেরার চোখের জন্য অনাবিল এক প্রশান্তি। বোর্গ-ম্যাকেনরো-কোনর্সকে রেকর্ডেড দেখেছি। স্যাটেলাইট টিভির কল্যাণে সরাসরি দেখার সুযোগ হয়েছে সাম্প্রাস-আগাসিদের। এর আগে লেন্ডল-বেকার-এডবার্গকেও। তত দিন সেরা মনে হতো পিট সাম্প্রাসকেই। সাম্প্রাস যখন সেরা সময়ে, মনে হতো, টেনিসে এর চেয়ে ভালো আর কী হতে পারে!

‘কী হতে পারে’ সেই উত্তর নিয়ে এলেন রজার ফেডেরার। কাকতালীয়ভাবে উইম্বলডনে সাম্প্রাসকে হারিয়েই জানিয়েছিলেন তাঁর আগমনী বার্তা। রাজা যেন তাঁর উত্তরাধিকারীর মাথায় নিজেই পরিয়ে দিলেন মুকুট। আর কোনো খেলায় এমন ঘটেছে বলে মনে হয় না। টেনিসেও কি আগে এমন হয়েছে কখনো!

ফেডেরার যা কিছু করেন, তাতেই একটা পেলব ব্যাপার থাকে। এমনকি তাঁর এইসও যেন মায়াবী! টেনিসে ফেডেরারের মতো আর কাউকে খুঁজে পাই না। তুলনা খুঁজতে হলে অন্য খেলায় যেতে হয়। সেখানে দুজনের কথা বলতে পারি। ক্রিকেটের মার্ক ওয়াহ ও ফুটবলের জিনেদিন জিদান। ফেডেরারের মতোই যাঁদের খেলা সম্পর্কে ‘রেশমি পরশ’, ‘পেলব’, ‘মায়াবী’ এই শব্দগুলো অনায়াসে ব্যবহার করা যায়। যদিও একই কারণে তাঁদের সম্পর্কে ভুল বোঝার অবকাশ থাকে। কারও ক্ষেত্রে টেনিস, কারও ক্ষেত্রে ফুটবল, কারও বা ক্রিকেট—তবে অভিন্ন একটা অনুভূতি তিন ক্ষেত্রেই সত্যি। খেলাটা যেন কত সহজ! আসলে যা শুধুই বিভ্রম। অন্য কারও চেয়ে তাঁদেরও কম ঘাম ঝরে না। কোর্টে বা মাঠে আমরা যা দেখি, আপাত-অনায়াস সেই দক্ষতার পেছনে বাকি সবার মতোই লুকিয়ে হাড়ভাঙা খাটুনি।

ফেডেরারের ম্যাজিক তো শুধুই খেলায় নয়। এত বছর ধরে পেশাদার টেনিস খেলে যাচ্ছেন, বিতর্কের লেশমাত্র নেই। আদর্শ এক স্পোর্টসম্যানের এর চেয়ে বড় উদাহরণ আর হতে পারে বলে মনে হয় না। কাছাকাছি আসতে পারেন ক্রিকেটের শচীন টেন্ডুলকার। কে জানে, হয়তো টেন্ডুলকারও নন। টেন্ডুলকারকে ওয়ান টু ওয়ান ইন্টারভিউ করেছি, সংবাদ সম্মেলনে থেকেছি অসংখ্যবার। কখনো দেখিনি, একের পর এক সাংবাদিক প্রশ্ন করার আগে বলে নিচ্ছেন, ‘আমি কিন্তু আপনার খুব বড় ভক্ত।’

আমিও একটা প্রশ্ন করেছিলাম। এমন একটা প্রশ্ন, যেটি ফেডেরারের মতো চ্যাম্পিয়নের অহমে লাগার মতো। এই অলিম্পিকে সবচেয়ে বড় তারকা কে—উসাইন বোল্ট, মাইকেল ফেল্‌প্‌স না রজার ফেডেরার?

যা দেখেছি ফেডেরারের সংবাদ সম্মেলনে। সেটিও এমন নয় যে, সেই সংবাদ সম্মেলন হচ্ছে বাংলাদেশের মতো টেনিসের তৃতীয় বিশ্বের কোনো দেশে। ফেডেরারকে নিয়ে সাংবাদিকদের মুগ্ধতার এমন অকৃত্রিম প্রকাশ অলিম্পিকের মতো মহাযজ্ঞে। ২০১২ সালে লন্ডন অলিম্পিকে সেই সংবাদ সম্মেলন। যেটি শেষ হওয়ার পর ফেডেরার-ভক্ত সাংবাদিকেরা আরও বড় ভক্তে পরিণত। কথাবার্তায় এমন পরিশীলিত, এমনই উপচে পড়া বিনয় যে, মানুষ ফেডেরার যেন খেলোয়াড় ফেডেরারকেও হারিয়ে দিয়েছেন। আমিও একটা প্রশ্ন করেছিলাম। এমন একটা প্রশ্ন, যেটি ফেডেরারের মতো চ্যাম্পিয়নের অহমে লাগার মতো। এই অলিম্পিকে সবচেয়ে বড় তারকা কে—উসাইন বোল্ট, মাইকেল ফেল্‌প্‌স না রজার ফেডেরার?

প্রশ্নটাতে ফেডেরার বিরক্ত তো হনইনি, উল্টো মুখে মৃদু হাসি ফুটিয়ে প্রথমেই বললেন, ‘নট মি’।

কেন নয়?

‘এখানে আরও কত গ্রেট অলিম্পিয়ান আছেন। কতজন কত পদক জিতেছেন! সবচেয়ে বড় তারকা উসাইন বোল্ট, মাইকেল ফেল্‌প্‌স বা এনবিএ-য়ের কেউ।’

কথাটা হয়তো সত্যি। কিন্তু ফেডেরারের বলার ভঙ্গিটা যাঁদের কথা বললেন, তাঁদের চেয়ে বড় বানিয়ে দিল তাঁকে। লেখাটা এত দূর যদি পড়ে থাকেন, তাহলে বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, রোববারের অস্ট্রেলিয়ান ওপেন ফাইনালে আমি কার জয় চেয়ে টেলিভিশনের সামনে বসব। ফেডেরারের জয় ছাড়াও চাওয়ার আছে আরেকটি। ফাইনালের জয়টা যেন রাফায়েল নাদালের বিপক্ষে হয়। দুই উইলিয়ামস বোনের ফাইনাল যেমন নস্টালজিয়ার আরেক নাম, ফেডেরার-নাদাল ফাইনালও তো তা-ই। ঘোর বর্তমান, তবে টাইম মেশিনে চড়ে একটু অতীতে ফিরে যাওয়াও কি নয়!

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×