২০০৯ সালে সাকিব আল হাসান

‘এমন কেউ হতে চাই, যাকে সারা বিশ্ব এক নামে চিনছে’

উৎপল শুভ্র

২৪ মার্চ ২০২১

‘এমন কেউ হতে চাই, যাকে সারা বিশ্ব এক নামে চিনছে’

সাকিব আল হাসান

বাংলাদেশের পক্ষে টেস্টে সবচেয়ে বেশি রান ও উইকেট, সঙ্গে ওয়ানডেতেও উজ্জ্বল পারফরম্যান্স। আগের বছরের সেরা উদীয়মান সাকিব ২০০৮ সালে প্রথম আলো-গ্রামীণ ফোন বর্ষসেরা ক্রীড়াবিদ। সেই উপলক্ষেই নেওয়া এই সাক্ষাৎকারটা আলাদা হয়ে আছে এতে ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের উঠে আসার গল্পটা আছে বলে।

প্রথম প্রকাশ: ৪ জুলাই ২০০৯। প্রথম আলো।

উৎপল শুভ্র: এই তো ২০০৬ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আপনার অভিষেক। এই অল্প সময়ের মধ্যেই অনেক কিছু পেয়েছেন। বিশেষ করে গত এক বছরে বাংলাদেশের পক্ষে সেরা বোলিংয়ের রেকর্ড, টেস্ট-ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ রান, ওয়ানডে র্যাঙ্কিংয়ে এক নম্বর অলরাউন্ডার—মাঝে মাঝে কি স্বপ্ন বলে মনে হয়?

সাকিব আল হাসান: একা একা যখন চিন্তা করি, সে রকমই মনে হয়। আসলে আমি কিন্তু ক্রিকেট খেলাও বেশিদিন শুরু করিনি। ক্রিকেট বলে খেলা শুরু করেছি ২০০২ সালের শুরুর দিকে, প্রথম অনূর্ধ্ব-১৫ দলে খেলতে বেশ কষ্ট করতে হয়েছে। এরপর সরাসরি অনূর্ধ্ব-১৭ খেলেছি, পরেই অনূর্ধ্ব-১৯ খেলেছি। আবার ‘এ’ দলে খেলেই জাতীয় দলে খেলে ফেলেছি। মানে একটা জায়গায় আটকে আছি বা হচ্ছে না; এমন হয়নি। আর ভাগ্যটা খুব ভালো ছিল, প্রতিটি জায়গায় প্রথম সুযোগেই পারফরম্যান্স ভালো ছিল। মনে আছে অনূর্ধ্ব-১৫-এর একটা খেলায়, ঢাকা মেট্রো ব্লুজ বা গ্রিনের হয়ে খেলছিলাম, প্রথম ম্যাচেই ৫২ বলে ১০২ করলাম। এরপর অনূর্ধ্ব-১৫ দলে ডাকল ৪৫ নাকি ৬০ জন। একেবারে প্রথম দিন দেখেই কোচ পছন্দ করল। এরপর ২০ জনের দলে এলাম, প্রধান কোচ ছিলেন ফাহিম স্যার। এক দিন ব্যাটিং দেখেই ফাহিম স্যার পছন্দ করে ফেললেন। এরপর অনূর্ধ্ব-১৫ দলের হয়ে কলকাতা সফরে প্রথম ম্যাচেই ৭২ করলাম। এর পরও চিন্তাই করিনি, সরাসরি অনূর্ধ্ব-১৭-তে খেলব!

অনূর্ধ্ব-১৭ দলে ডাক পাওয়ার পরও ভাবলাম, দলে সুযোগ তো পাব না। দেখি, কিছু ভালো অনুশীলন হবে। অথচ প্রথম অনুশীলন ম্যাচ খেলার পরই আমার ব্যাপারে কোচ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে আমাকে ম্যাচ রেফারি বানিয়ে দিল। বলল, কার কী হচ্ছে না হচ্ছে তুমি বলবে। এরপর ‘এ’ দলের হয়ে জিম্বাবুয়েতে গেছি, প্রথম ম্যাচেই ৫ উইকেট। জাতীয় দলের হয়ে প্রথম ম্যাচে ১০ ওভারে ৩৮ রানে ১ উইকেট, খারাপ না। ব্যাটিংয়ে ৩০ নটআউট, টিম জিতেছে। আমার লাকটা খুব ভালো, সব জায়গায়ই প্রথম ম্যাচে কিছু না কিছু করেছি।

শুভ্র: এটা কি শুধুই ভাগ্য? নাকি শুরুর নার্ভাসনেসটা আপনার মধ্যে কাজ করে না?

সাকিব: খানিকটা ঠিক। আবার একেবারে নার্ভাসনেস কাজ করে না, তাও না। জাতীয় দলের হয়ে প্রথম ম্যাচে বোলিংয়ের সময় নার্ভাস ছিলাম না। তবে ব্যাটিংয়ের সময় বুঝতে পেরেছি নার্ভাস কাকে বলে! আমি প্রথম যে বলটা ফেস করেছিলাম, একেবারে সোজা, ওর চেয়ে আরামের বল বোধহয় আর হয় না। ওই বল ডিফেন্স করতে গিয়ে কাঞ্চি লাগল, পায়ে লাগলে এলবিডব্লু হয়ে যেতাম। ওইদিন গায়ের জোরে বল মারি, মিড অন পর্যন্ত যায় না। বয়সভিত্তিক দলে নার্ভাসনেস খুব একটা কাজ করেনি। আসলে আমাদের বয়সভিত্তিক দলের যে গ্রুপটা একেবারে অনূর্ধ্ব-১৫ থেকে শুরু করে অনূর্ধ্ব-১৯ পর্যন্ত খেলেছি, আমাদের পারফরম্যান্স খুব ভালো ছিল। তখন কোনো টিমকেই টিম মনে হতো না। কী আছে, আসবে... খেলব।

শুভ্র: আপনার ছেলেবেলার গল্পটা একটু শুনি। ক্রিকেটার হওয়ার কোনো স্বপ্ন তো ছিল না। কিন্তু খেলা নিয়ে মাতামাতি তো ছিলই, না কী?

সাকিব: হ্যাঁ, তা তো ছিলই। ভাইয়ার খেলা দেখতে যেতাম। আব্বু নিয়ে যেত। আব্বু নিজেও ফুটবল খেলেছে জেলা দলে। আমার কাজিন মেহেদী হাসান উজ্জ্বল তো জাতীয় দলেও খেলেছে। ফুটবলের প্রতিই আগ্রহটা বেশি ছিল। পাড়ায় ফুটবল খেলতাম। স্কুলে খেলেছি, ৪ ফুট ১০ ইঞ্চিতেও খেলেছি। তারপর একসময় ক্রিকেট খুব জমজমাট হয়ে গেল। শীতের সময় ক্রিকেটই খেলতাম। গরমে যখন ছুটি থাকত সকালে ফুটবল খেলতাম, বিকেলে ক্রিকেট। কোথাও একটা টুর্নামেন্ট হচ্ছে, ওখানে টিম নিয়েছে, গেলাম খেলতে। এভাবে চলতে চলতে একবার পাশের একটা গ্রামে গেলাম ক্রিকেট খেলতে। ওখানে একজন আম্পায়ার ছিলেন, ওনার মাগুরায় একটা ক্লাব আছে। আমার খেলা দেখে বললেন, খেলব কিনা। বললাম, ঠিক আছে। আমি কিন্তু তখনো ক্রিকেট বল ধরিনি। উনি বললেন, আসিস, অমুক দিন প্র্যাকটিস আছে। গেলাম, প্রথম দিন পেস বোলিং করলাম। দ্বিতীয় দিন স্পিন করার পর উনি বললেন, তোর পেস বোলিং করে কাজ নেই, স্পিন কর। দুই দিন অনুশীলন করলাম, তার পরই ম্যাচ। ম্যাচে আমার ফার্স্ব ওভারের ফার্স্ট বলেই উইকেট, বোল্ড। মানে, ক্রিকেট বলে ম্যাচে প্রথম যে বলটা করেছি তাতেই উইকেট পেয়েছি। ওভাবেই শুরু।

শুভ্র: ওটা কি মাগুরা ক্রিকেট লিগ ছিল?

সাকিব: হ্যাঁ, নাম ইকোনো ক্রিকেট লিগ। তো ওইখানে ৪ ম্যাচে ১২ উইকেট পাওয়ার পর মাগুরা জেলা পর্যায়ে খেলার জন্য অনূর্ধ্ব-১৯ দলে ডাক পেলাম। ওখানে তেমন কোনো পারফরম্যান্স ছিল না। এরপর বিকেএসপি থেকে প্রতিভা অন্বেষণ ক্যাম্প হবে। খুলনা বিভাগের ক্রিকেটার বাছাই করতে ওরা মাগুরায় এল। গেলাম।

শুভ্র: ওইখানে যাওয়ার রহস্যটা কী? আপনি তো তখনো ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্নে আক্রান্ত নন, তাই না?

সাকিব: তা নয়, তবে খেলাটা শুরু করেছি। একটু মজাও পাচ্ছি। আব্বুর অত ইচ্ছা ছিল না। তার পরও গেলাম, যাওয়ার পর এক দিনেই নির্বাচিত হলাম। ছয়টা জেলা থেকে বোধহয় ২৫ জনের একটা দল করে নড়াইলে এক মাসের ক্যাম্প করল। বাসা থেকে বলল, ঠিক আছে, এক মাসই তো, কী আর এমন সমস্যা, যাক। কোচ ছিলেন বাপ্পী স্যার, ওনার বাড়িও মাগুরায়। ওনাকে বাসার সবাই বলল, কী, দেব নাকি? উনি বললেন, দেন, দেখি কেমন করে।
তো এক মাসের ক্যাম্পের ২০ দিনই বোধহয় অসুস্থ ছিলাম। বাকি ১০ দিন যা করেছি, তা-ই এনাফ ছিল। (হাসি) তখন মাশরাফি ভাই আসত, অনুশীলন করতে। তখন উনি অলরেডি জাতীয় দলে খেলেছেন। উনি আসতেন, স্যারেরও একটু হেল্প হতো, ওনারও অনুশীলন হতো। ওনাকে দেখে আসলে অনেক অনুপ্রাণিত হয়েছি। ১০ দিন সুস্থ থাকলেও ম্যাচগুলো মিস করিনি, ভালোও করেছি। তাতে মনে হচ্ছিল, বিকেএসপিতে ছয় মাসের ক্যাম্পে ডাক পাচ্ছি। যখন পেলাম, তখন আবার একটু ঝামেলা। স্যারকে আব্বু বলল, ছয় মাসে পড়াশোনায় তো অনেক ঝামেলা হয়ে যাবে। স্যার বলল, মামা, আপনি দেন, ওর ভালো সম্ভাবনা আছে। গেলাম ছয় মাসের ক্যাম্পে। ক্যাম্প করলাম।

মোহাম্মদ রফিকের সঙ্গে। ছবি: শামসুল হক টেংকু

শুভ্র: এটা তো বিকেএসপিতে...

সাকিব: হ্যাঁ, এটা ওই যে ছয় বিভাগে যে ২৫ জন করে নিয়ে ক্যাম্প হলো তাদের মধ্য থেকে ২৫ জনকে নিয়ে ছয় মাসের ক্যাম্প। ওই ক্যাম্প শেষে চিঠি দেওয়ার আগেই কোচরা জানালেন, তোমরা এই সাতজন-আটজন চান্স পেয়েছ। এরপর তো বাসায় চলে গেলাম। ঝামেলা হলো, আমি তখন নবম শ্রেণীতে পড়ি। রেজিস্ট্রেশনের সময় পার হয়ে গেছে। তার মানে বিকেএসপিতে ভর্তি হলে আমাকে আবার অষ্টম শ্রেণীতে শুরু করতে হবে। মানে প্রায় দুই বছরের গ্যাপ। অনেক বড় ডিসিশন। আব্বু আর স্যার মিলে অনেক আলোচনা করল। আব্বু হয়তো ভাবল, খেলার যখন এত শখ, যাক। এর আগে তো খেলার জন্য অনেক মারও খাইছি। মামারা ব্যাট কিনে দিত, আর আব্বু ব্যাট কেটে দিত। আম্মুও কেটেছে দু-একটা। শেষ পর্যন্ত আব্বু-আম্মু রাজি হওয়ায় বিকেএসপিতে চলে এলাম। প্রথম দুই-তিন মাস খুব কষ্টে কাটল। মানে, যারা আগে থেকে আছে, তাদের সমান সুযোগ পেতাম না। আমি তো বাইরের ছেলে, ওরা আগে থেকে আছে। এরপর আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে গেছে। যখনই খেলার সুযোগ পেলাম, ওই যে বলেছি, সুযোগ পেলেই তা কাজে লাগিয়েছি।

শুভ্র: বয়সভিত্তিক সব দলেই তো খেলেছেন। কিন্তু জাতীয় দলের ড্রেসিংরুম তো অন্য ব্যাপার। 

সাকিব: একেবারেই অন্য ব্যাপার। আমার কাছে সবচেয়ে যেটা মজার ছিল, এখন অনেকেই হয়তো এই মজাটা পায় না। আমি এসে দলে মোহাম্মদ রফিক, হাবিবুল বাশার, পাইলট ভাই, জাভেদ ওমর ওনাদের পেয়েছি। ওনারা টিমে থাকা অন্য রকম একটা ব্যাপার। চিন্তা করতে হতো, কী বলব না বলব। এখন যারা আছি বা যারা আসছে আমরা কিন্তু প্রায় একই বয়সী। আমি জানি না নতুনেরা কী মনে করে। তবে ওনাদের সঙ্গে থাকাটা খুব মজার অভিজ্ঞতা ছিল। আবার ঝামেলাও ছিল কিছু। যেমন, সব কথা বলা যাবে না। মজাটা হলো, ওনারা অনেক জায়গায় ঘুরেছেন, ওসব অভিজ্ঞতা...। সেসব কাহিনী বলতেন, অভিজ্ঞতা বলতেন। আর সবচেয়ে ভালো জিনিস ছিল, খুবই সাহায্য পেয়েছি। বিশেষ করে বাশার ভাই, পাইলট ভাই খুবই হেল্প করেছেন। আর সালাউদ্দিন স্যার তো ছিলেনই। বিকেএসপিতে ছাত্র থাকতেই উনি আমার গাইড। এখানেও ড্রেসিংরুমে কী করতে হবে, টুয়েলভ্থ ম্যান থাকলে কী করব, খেললে কী করব, না খেললে কী... সবই শিখিয়ে-পড়িয়ে দিয়েছেন তিনি।

শুভ্র: এটা তো এখন বাংলাদেশ দলের একটা বড় সমস্যা। এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে অভিজ্ঞতা বিলিয়ে দেওয়ার ব্যাপারটা তো বলতে গেলে নেই-ই।

সাকিব: হ্যাঁ, আমার কাছেও এটা মনে হয়। আপনি একটা জিনিস চিন্তা করেন, আমাদের এই টিমটাই যদি চার-পাঁচ বছর একসঙ্গে খেলি, কত অভিজ্ঞতা হবে! সবাই কমপক্ষে ৭০-৮০টা ওয়ানডে খেলে ফেলবে। আমরা হয়তো এক শ, আবার আশরাফুল ভাইরা হয়তো দুই শ ম্যাচ খেলে ফেলবে। তখন কিন্তু অনেক বড় অভিজ্ঞতা হবে। আসলে দুই শ ম্যাচের অভিজ্ঞতার সঙ্গে দুই ম্যাচের অভিজ্ঞতার তুলনা হয় না। কেউ দুই ম্যাচে দুটি সেঞ্চুরি করলে বা দশ-দশ বিশটা উইকেট নিলেও না। এই অভিজ্ঞতাটা আমরা মিস করছি। ২০০৭ বিশ্বকাপে আমাদের ভালো করার পেছনে আমার বড় একটা কারণ বলে মনে হয়, দলে রফিক ভাই-বাশার ভাই-রাজিন ভাইয়ের মতো অভিজ্ঞ খেলোয়াড়ের সঙ্গে মাশরাফি-রাজ ভাইয়ের মতো মাঝারি অভিজ্ঞ খেলোয়াড় ছিল, আবার আমি-তামিম ছিলাম একদম নতুন। আর এখন দেখা যাচ্ছে আমরাই সিনিয়র। সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলেছেন আশরাফুল ভাই, মাশরাফি ভাই, রাজ ভাই, তার পরই আমি। ২২ বছর বয়সে সিনিয়র হয়ে গেছি (হাসি)। অথচ অন্তত ছয় বছর খেললে তারপর সিনিয়র হওয়ার কথা আসে। আর আমাদের এখনই সেই দায়িত্বটা চলে এসেছে।

শুভ্র: আপনার অভিষেক তো হাবিবুল বাশারের অধিনায়কত্বে। শুরুর দিকে আপনাকে অনেক মেন্টাল সাপোর্ট দিয়েছেন বলছিলেন। হাবিবুল তো বাংলাদেশের সফলতম অধিনায়কও। আপনার চোখে কেমন অধিনায়ক ছিলেন হাবিবুল?

সাকিব: আমার কাছে মনে হয়, ওনার সফল হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে, উনি সোজা একটা লাইনে চলার চেষ্টা করতেন। কোনো এক্সট্রা-অর্ডিনারি কিছু করার চেষ্টা করতেন না। নরমাল ফিল্ড সাজাতেন, বেশি অ্যাটাকিং বা বেশি ডিফেন্সিভ না। ওনার আর ডেভের মধ্যে ভালো একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিং ছিল। দুজন মিলে যা ভাবতেন, সেটা খুব কাজে দিত। আর উনি আসলে এমন এক ক্যাপ্টেন, আমার মনে হতো, যার জন্য আপনার ভালো খেলতে ইচ্ছে করবে। মানে উনি এমনভাবে কথা বলতেন যে মনে হতো, না, ওনার জন্য হলেও কিছু একটা করি। এটা ওনার ভেতর ছিল।

মোহাম্মদ আশরাফুলের সঙ্গে। ছবি: আবদুল হান্নান

শুভ্র: আর মোহাম্মদ আশরাফুল?

সাকিব: আমি তো আশরাফুল ভাইয়ের শুরু থেকেই দেখছি ওনার অধিনায়কত্ব। প্রথম ছয় মাস আর পরের এক বছরে অনেক পার্থক্য। আসলে অধিনায়কত্ব অন্য রকম ব্যাপার, বুঝতে সময় লাগে। আর ন্যাশনাল টিমের ক্যাপ্টেনের ওপর অনেক দায়িত্ব। প্রেস হ্যান্ডল করা, ক্রাউড হ্যান্ডল করা, বোর্ড অফিশিয়াল হ্যান্ডল করা, টিম হ্যান্ডল করা—এগুলো আলাদা রকম ব্যাপার। আপনি খুব গভীরভাবে চিন্তা করলেও হয়তো আংশিক একটা ধারণা আসতে পারে, পুরোপুরি না। এটা যে করে, সে-ই শুধু বুঝতে পারে। ওনার আসলে বুঝতে একটু সময় লেগেছে। এখন বুঝে ফেলেছেন। আমি মনে করি, ওনার ক্যাপ্টেন্সিতে কোনো সমস্যা নেই। এমন না যে ভুল ডিসিশন নিচ্ছেন। আর যে ডিসিশনগুলোকে ভুল বলা হয়, তা তো মাশরাফি ভাই, আমি, মুশফিক ভাই সবাই আলোচনা করেই নিই। যেমন ধরেন, সবাই বলছে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে (গত জানুয়ারিতে ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালে) শেষ ওভারটা কেন রুবেলকে দেওয়া হলো। রুবেল ছাড়া বোলার কে ছিল? রিয়াদ (মাহমুদউল্লাহ) ভাইয়ের কথা বলেছেন অনেকে। অথচ তখন (ফারভিজ) মাহারুফ ছিল উইকেটে। মুরালি একটা সিঙ্গল নিয়ে ওকে স্ট্রাইক দিলে ও হয়তো তিন ছক্কায় খেলা শেষ করে দিত। তখন রিয়াদ ভাই ভালো বোলিংও করছিল না, এখন যদিও খুব ভালো করছে। আমরা সবাই ভেবেছি রুবেল পারবে।

শুভ্র: ওই ম্যাচের পর দর্শকদের প্রতিক্রিয়া তো খুবই আপত্তিকর ছিল। আমাদের দর্শকেরা কি তাহলে বেশি অধৈর্য?
সাকিব: আমাদের দর্শকদের কথা আর কী বলব, ওদের অবস্থা হলো মন চাইল দে গালি বা মন চাইল দে তালি। একজন একটা কিছু করলে সবাই তা করে। তবে যারা সত্যিই বোঝে, তারা এমন করে না।

শুভ্র: আবার একটু ২০০৭ বিশ্বকাপে ফিরে যাই। বাংলাদেশের জন্য এটি তো ছিল রীতিমতো স্বপ্নযাত্রার মতো ব্যাপার। তবে সেই বিশ্বকাপকে সবাই যেমন বাংলাদেশের ক্রিকেটে নতুন যুগের শুরু বলে স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা কিন্তু হয়নি।

সাকিব: আসলেই বিশ্বকাপটা স্বপ্নের মতো গেছে। আমরা ৬৭ দিন ছিলাম, আমাদের সবচেয়ে লম্বা ট্যুর। অথচ ফেরার সময় মনে হয়েছে, একি, চলে যাচ্ছি! এর কারণ, পারফরম্যান্স ভালো ছিল। আর এর পরের কথা যেটা বললেন, মাঝখানে একটু খারাপ গেছে। তবে আমার মনে হয় আমরা আবার আগের জায়গায় চলে এসেছি। হয়তো রেজাল্টে খুব প্রমাণ নেই। কিন্তু চিন্তা করেন, নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে টেস্ট সিরিজটা হিসাবে তো আমরাই জিতি। ওয়ানডে সিরিজটাও আমাদেরই ছিল। ও-রকম ফ্ল্যাট উইকেটে আমরা ২০০ রান চেজ করতে পারিনি! নিউজিল্যান্ডের মতো দলের সঙ্গে টেস্ট-ওয়ানডে সিরিজ জেতার অবস্থা। এরপর শ্রীলঙ্কার সঙ্গেও টেস্টে আমরা খারাপ করিনি। অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে শেষ ওয়ানডেটা জেতার অবস্থায় ছিলাম। এ রকম অনেক ম্যাচে আমরা জয়ের কাছ থেকে ফিরে এসেছি। এগুলোর অর্ধেকও আমাদের পক্ষে এলে আমাদের ক্রিকেটকে এখন অন্য লেভেলের বলে মনে হতো। আমার কাছে তা-ই মনে হয়, আমরা আবার ২০০৭-এর অবস্থায় চলে এসেছি। এখান থেকে এখন এগোনোর পালা।

ওয়ানডেতে আগে থেকেই কার্যকর সাকিব ২০০৮ সালে টেস্টেও আবির্ভূত হলেন স্ট্রাইক বোলার হিসাবে। ছবি: শামসুল হক টেংকু

শুভ্র: ২০০৮ সালে আপনার অনেক কীর্তির মধ্যে সবচেয়ে চমকপ্রদ বলতে হবে, বোলার হিসেবে সাকিব আল হাসানের নবরূপে আবির্ভাব। হঠা‌ৎই দলের প্রধান স্ট্রাইকিং বোলার হয়ে যাওয়া, টেস্টে বাংলাদেশের পক্ষে সেরা বোলিং...

সাকিব: আমি টেস্টে ভালো বোলিং করার ব্যাপারে খুব আত্মবিশ্বাসী ছিলাম না। কারণ আমার ভ্যারিয়েশন কম। ভালো বলতে ভালো জায়গায় বল রাখতে পারি। এরপর রফিক ভাই চলে গেল, রাজ ভাইয়ের পারফরম্যান্স একটু খারাপ। ওই সময় আমাকে স্পিনারদের মধ্যে স্ট্রাইকিং বোলার হতে হয়েছে। চ্যালেঞ্জ নিতে প্রস্তুত ছিলাম। তবে বোলার হিসেবে প্রথম টেস্ট খেলেই সেরা বোলিং... ওটা আমি ভাবিনি।

শুভ্র: বাংলাদেশের পক্ষে সেরা বোলিংয়ের রেকর্ডটাকে আপনি কীভাবে দেখেন? এটা তো অনেক বড় মাইলফলক...

সাকিব: আমার টেস্ট ক্যারিয়ারের বড় টার্নিং পয়েন্ট এটি। সেটির আগে টেস্টে আমার কিন্তু ভালো পারফরম্যান্স ছিল না। ৭ উইকেট নেওয়ার পরের ইনিংসেই প্রথম ফিফটি পেয়েছি। ওই বোলিংটা ব্যাটিংয়েও আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছে। এর পর থেকেই  ব্যাটিং-বোলিং দুটিতেই ভালো করতে শুরু করেছি।

শুভ্র: সেরা বোলিংয়ের রেকর্ডটা তো আগে ছিল এনামুল হক জুনিয়রের। এনাম কী বলেছে?

সাকিব: আসলে আমরা খেলোয়াড়েরা যখন কথা বলি, খেলার কথা কম হয়। ফাজলামো বেশি হয়।

শুভ্র: এটা নিয়ে আলাদা কথা হয়নি?

সাকিব: না, সে রকম না। অবশ্য উনি আমাকে একটা ট্রাউজার গিফট করেছেন (হাসি)।

শুভ্র: ক্যারিয়ারের সবচেয়ে স্মরণীয় ম্যাচ কোনটি?

সাকিব: ব্যক্তিগত হলে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৯২ রানের ওই ইনিংস, ওটাতে ম্যাচ জিতেছিলাম আমরা। আর স্মরণীয় ম্যাচ বলতে এখনো ওই ২০০৭ সালের বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে যে ম্যাচটা জিতলাম। 

শুভ্র: ওটা তো অন্য রকম একটা আবহ...

সাকিব: আর কাদের সঙ্গে খেলছিলাম...গাঙ্গুলী, শচীন, দ্রাবিড়—ক্রিকেটের সব লিজেন্ডের সঙ্গে। সারা জীবন ওদের খেলা দেখছি, আর ওদের সঙ্গে খেলছি। তার ওপর এটা ছিল বিশ্বকাপে আমাদের প্রথম ম্যাচ। সেটিতে রান করলাম। ওটা জেতার পর বাঙালিদের যে রিসেপশন পেলাম, অন্য রকম ব্যাপার।

শুভ্র: সবচেয়ে কষ্টের ম্যাচ?

সাকিব: এই তো কদিন আগে (২০০৯ সালের জানুয়ারিতে) শ্রীলঙ্কার সঙ্গে টেস্ট আর ট্রাইনেশনের ফাইনালটা। এর আগে আর...আর...না, এ দুইটাই। বিশেষত ফাইনালটা। লাস্ট তিনটা ওভার বাদে তো ম্যাচটা আমাদেরই ছিল।

শুভ্র: খেলা শুরু করার সময় কি কোনো আইডল ছিল?

সাকিব: ও-রকম কেউ ছিল না। পাকিস্তানকে সাপোর্ট করতাম। সাঈদ আনোয়ারের ব্যাটিংটা অসম্ভব ভালো লাগত। ওর ব্যাটিং দেখার জন্য বসে থাকতাম। ওয়াসিম আকরামের বোলিং ভালো লাগত, সাকলায়েনের বোলিং। এই তিনজনের খেলা খুব ভালো লাগত। 

শুভ্র: আপনি নাকি আন্তর্জাতিক ফুটবলের পোকা। নিয়মিত দেখেন ইউরোপিয়ান লিগ?

সাকিব: হ্যাঁ, ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ, স্প্যানিশ লিগ, চ্যাম্পিয়নস লিগ সব দেখি। বার্সেলোনোকে সাপোর্ট করি। কারণ ওরা ভালো ফুটবল খেলে, অ্যাটাকিং ফুটবল খেলে। রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে থাকতে চাওয়াটাও একটা কারণ। কারণ বেশির ভাগ লোক দেখতাম রিয়ালের সাপোর্টার। আমার আবার একটা ব্যাপার আছে, সবাই যাকে বেস্ট বলে আমি তাঁর বদলে অন্য কাউকে সাপোর্ট করি। সবাই ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে সেরা বলে, আমার ওকে দেখতেই ইচ্ছে করে না। রেসলিংয়ে সবাই যখন রককে সাপোর্ট করত, আমি করতাম ট্রিপল এইচকে। একই কথা শচীন-সাঈদ আনোয়ারের ক্ষেত্রেও। ওই চিন্তা থেকেই বার্সেলোনাকে সাপোর্ট করি। ম্যানইউকে সাপোর্ট না করে করি চেলসিকে। এবার চ্যাম্পিয়নস লিগে আবার সেমিফাইনালে দেখা হয়ে গেল এই দুদলের। কাকে সাপোর্ট করব বুঝতে পারছিলাম না। চেলসি গোল করার পর মনে হলো, বার্সেলোনাই জিতুক। আবার বার্সেলোনা গোল করার পর মনে হল, ইস্, চেলসি একটা ট্রফিও পেল না! এফএ কাপের ফাইনালটা অবশ্য বাকি।

শুভ্র: বাব্বা, ফুটবলের তো অনেক খোঁজখবর রাখেন!

সাকিব:  হ্যাঁ, রাখি তো! প্লে-স্টেশনে নিজে টিম বানিয়ে খেলি না!

শুভ্র: অবসরে কী করেন?

সাকিব: আগে তো টিভি দেখে, প্লে-স্টেশনে খেলে সময় কাটত। এখন বেশ ঘুরতে ইচ্ছে করে। বাইরে গেলেও এখন বেশ ঘোরা হয়। আগে তো ট্যুরে গেলেও সারাক্ষণ প্লে-স্টেশনে থাকতাম। এখন ঘুরতে যাই।

শুভ্র: গল্পের বই পড়েন?

সাকিব: না, একদমই অভ্যেস নেই।

শুভ্র: আপনার স্বপ্নের দিন কেমন?

সাকিব: বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচ। আমি ম্যান অব দ্য ম্যাচ। টিম জিতেছে। 

শুভ্র: এটা কত সালের বিশ্বকাপ?

সাকিব: ২০১৫। মোটামুটি তখন একটা ভালো অবস্থায় থাকব।

শুভ্র: ক্যারিয়ারের শেষে নিজেকে কোথায় দেখতে চান?

সাকিব: আমি আসলে এত দূরের কথা ভাবি না। তাতে লাইফটা খুব কঠিন মনে হয়। কাল কী হবে, আমি তাই ভাবি। তার পরও ইচ্ছা তো থাকেই। এমন কেউ হতে পারলে ভালো লাগবে, যে পৃথিবী রুল করছে। এমন কেউ, যাকে সারা বিশ্ব এক নামে চিনছে।

 

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×