অধিনায়ক সাকিব

উৎপল শুভ্র

২৪ মার্চ ২০২১

অধিনায়ক সাকিব

মাত্রই ঠিক হয়েছে ২০১১ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের স্বপ্নযাত্রার সারথি তিনি। পূরণ হয়েছে দীর্ঘ মেয়াদে অধিনায়কত্ব পাওয়ার দাবিও। অধিনায়ক সাকিব আল হাসানকে বুঝতে এবং তাঁর অধিনায়কত্ব-দর্শন জানতে নেওয়া হয়েছিল এই দীর্ঘ সাক্ষাৎকার। যাতে বলেছিলেন, বাংলাদেশ দল নিয়ে তাঁর পরিকল্পনা ও স্বপ্নের কথা। 

প্রথম প্রকাশ: ৯ জানুয়ারি ২০১১। প্রথম আলো।

উৎপল শুভ্র: যেকোনো কাজেরই একটা ‘জব ডেসক্রিপশন’ মানে করণীয়ের একটা তালিকা থাকে...তা আপনার কাছে ক্যাপ্টেনসির ‘জব ডেসক্রিপশন’টা কী?

সাকিব আল হাসান: ক্যাপ্টেনসি... ক্যাপ্টেনসি...মাঠে তো একটা ক্যাপ্টেনসি থাকেই। ভূমিকা তো আসলে অনেকগুলো...কত বলব...টিম সিলেকশন থেকে শুরু করে বেস্ট ইলেভেন ঠিক করা, এমনকি টুয়েলভথ ম্যান নির্বাচন করা...মাঠের ভেতরে যদি বলি বোলিং চেঞ্জ, ফিল্ডিং চেঞ্জ, ব্যাটিং অর্ডার ঠিক করা। কোচের সঙ্গে বোঝাপড়ার ব্যাপার আছে। মাঠে কাকে কীভাবে হ্যান্ডল করতে হবে, কাকে কীভাবে হ্যান্ডল করলে সবচেয়ে ভালো ফল পাওয়া যাবে...এটাই মনে হয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

শুভ্র: ক্রিকেট ক্যাপ্টেনকে যা যা করতে হয়, সবই তো বলে ফেললেন। এক কথায় বললে ক্রিকেট ক্যাপ্টেন অধিনায়কের সঙ্গে ম্যানেজারও। যেখানে খেলোয়াড়দের ম্যানেজ করাটা বড় কাজ...  

সাকিব: খেলোয়াড়দের সঙ্গে বোঝাপড়ার ব্যাপারটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমি কী চাচ্ছি ও এটা বুঝতে পারছে কি না বা ও কী চাচ্ছে আমি বুঝতে পারছি কি না...এসব খুব গুরুত্বপূর্ণ। নইলে দেখা যাবে ওর চাওয়া আর আমার চাওয়া মিলছে না। না মিললে আলাপ-আলোচনা করে সেটি ঠিক করা। ও আমার কথা শুনবে কি না, এটাও একটা কথা। অধিনায়ককে ড্রেসিংরুমে চলাফেরা থেকে শুরু করে কথা বলার ধরন, সবকিছুই চিন্তা করতে হয়।  

শুভ্র: রিকি পন্টিং আমাকে খুব ইন্টারেস্টিং একটা কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন, শুধু মাঠে কাউকে দেখে তিনি অধিনায়কত্বের বিচার করতে রাজি নন। কারণ ক্রিকেট-অধিনায়কের বেশির ভাগ কাজই হয় খেলার আগে-পরে। এটা কি মানেন? 

সাকিব: খুব মানি। খেলোয়াড়দের সঙ্গে আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ের ব্যাপারটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর একটা জিনিস আছে যে আপনার জন্য পুরো টিমটা ভালোভাবে খেলতে চাচ্ছে। আবার হয়তো আপনার জন্যই পুরো টিমে একটা ম্যাড়মেড়ে ভাব। সবাই হয়তো শুধু নিজের জন্যই খেলছে। কিন্তু অধিনায়কের জন্য ভালো খেলার চেষ্টা করছে, এটা অন্য রকম একটা ব্যাপার। যেমন আমার মনে হয় যখন বাশার ভাই (হাবিবুল বাশার) ক্যাপ্টেনসি করছে, আর কারোটা জানি না, তবে আমি তখন এ রকম করেছি। মনে হয়েছে উনার জন্য হলেও ভালো কিছু করার চেষ্টা করি। 

শুভ্র: আপনি যে দীর্ঘ মেয়াদে অধিনায়কত্ব চেয়ে এসেছেন, এর কারণ কি এটাই—মাঠের বাইরেও নেতা হয়ে ওঠা? 

সাকিব: সিরিজ বাই সিরিজ ক্যাপ্টেনসি করলে কথার খুব গুরুত্ব থাকে না। যেমন ধরেন, আমি একসময় যেমন কাউকে ভালো কথা বলতে পারি, তেমনি কখনো ঝাড়িও দিতে পারি। ওই ঝাড়িটা আমি দিতে পারব না যখন আমি এক সিরিজের জন্য ক্যাপ্টেনসি করব। কারণ আমি নিজেই জানি না পরের সিরিজে ক্যাপ্টেন থাকব কি না থাকব, আমার ওর সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করার দরকার কী! দীর্ঘ মেয়াদে ক্যাপ্টেনসি পেলে আমি কাউকে ঝাড়ি দিয়ে পরে ভালোভাবে কথা বললে সে হয়তো সেটি ঠিকভাবে নেবে। নইলে তা নেবে না। অপ্রিয় কিছু বলতে গেলে নিজের কাছেও অন্য রকম লাগে। মনে হয় বলব কি বলব না, ও কীভাবে নেবে। এটা আমি ভালোমতোই বুঝেছি, কারণ আমার এমন ছোটখাটো অভিজ্ঞতাও হয়েছে। 

শুভ্র: মাঠে আপনাকে দেখলে খুব নির্ভার মনে হয়। যেন চাপটাপ কিছুই টের পাচ্ছেন না। আসলে ঘটনা নিশ্চয়ই তা নয়। ক্যাপ্টেনসি তো বিষম চাপ, আপনি হয়তো অভিনয়টা ভালো পারেন...

সাকিব:  (হাসি) না, না, ন্যাশনাল টিমে খুব একটা সমস্যা হয় নাই। কোচিং স্টাফ আছে, খেলোয়াড় যারা আছে...সবারই খেলাটা সম্পর্কে ভালোই ধারণা আছে। সবাই সবার কাজটা জানে। বলে বলে কিছু করাতে হয় না। কিন্তু ক্লাব ক্রিকেটে ব্যাপারটা অন্য রকম। ক্লাব অফিসিয়ালরা নানা রকম কথা বলে...ভালো বলুক খারাপ বলুক, সেসব শুনতে হয়। খেলোয়াড়েরাও তো একই ভুল বারবার করে। সব মিলিয়ে আমার কাছে ক্লাব ক্রিকেটে ক্যাপ্টেনসি করাটা বেশি কঠিন বলে মনে হয়েছে।

শুভ্র: এটা তো অবাক করার মতো ব্যাপার। ক্লাব ক্রিকেটে চাপটা, আরও নির্দিষ্ট করে বললে অফিসিয়ালদের গালিগালাজের ব্যাপারটা, হয়তো বেশি প্রত্যক্ষ; কিন্তু জাতীয় দলের দিকে তো পুরো দেশই তাকিয়ে থাকে। অদৃশ্য সেই চাপটা তো সব সময়ই থাকে...

সাকিব: তা থাকে। কিন্তু প্রিমিয়ার লিগে ক্যাপ্টেনসি করতে গেলে যেটা হয়, কথার কথা, আমি একজনকে বোলিং করালাম না এক দিন...টিম একটু খারাপ রেজাল্ট করল, শুরু হয়ে গেল ‘তুই ওকে বল করাসনি কেন?’ এমন যদি কেউ বলে, উত্তর তো কিছু দেওয়ার নাই। আমার ভালো মনে হয় নাই, করাই নাই। তবে এমন বললে পরের ম্যাচে হয়তো দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেলাম...ওকে যদি বোলিং না দিই, ওকে যদি দিই এমন আর কি...কিন্তু ন্যাশনাল টিমে সিদ্ধান্ত যা নেওয়ার আমিই নিচ্ছি। যে সিদ্ধান্তই নিই, সবাই তা সাপোর্ট করে। 

শুভ্র: কিন্তু সারা দেশে তো ঠিকই ঝড় ওঠে। প্রেস কনফারেন্সেও কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়...

সাকিব: তা ঠিক। তবে আমার কাছে এটাই ডোমেস্টিক ক্রিকেট আর ন্যাশনাল টিমে ক্যাপ্টেনসির পার্থক্য। ডোমেস্টিকে আমার মন যা চায় তা করতে দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাজ করে...এটা করছি, কী-না কী হবে। ন্যাশনাল টিমে আমার মন যা বলে, আমি সোজা তা করে ফেলি।

শুভ্র: এবার কোচ নিয়ে একটু কথা বলি। ক্রিকেটে কোচের একটু আড়ালে থাকাই নিয়ম। কিন্তু বাংলাদেশ দলে দেখা যায়, অধিনায়কের চেয়ে বেশি ক্ষমতাবান হয়ে যান কোচ। আপনার আর জেমি সিডন্সের ঘটনাও কি তাই?

সাকিব: অন্য টিমের কথা তো আমি বলতে পারব না। তবে আমাদের টিমে যেটা হয়, আমরা সবকিছু নিয়েই আলোচনা করি। মাঠের ভেতরে যা হয়, বোলিং চেঞ্জ থেকে শুরু করে ফিল্ডিং সাজানো—এসব সম্পূর্ণই আমি করি। তবে টিম নিয়ে যখন আলাপ হয়, তখন আমরা দুজনই নিজেদের মতামত দিই। তারপর যেটি ভালো মনে হয়, সেটিই করি। তবে একবার বেস্ট ইলেভেন ঠিক করে ফেলার পর তাতে আমাদের কারও মনমতো না হলেও আমরা দুজনই সেটিকে সাপোর্ট করি।

শুভ্র: ক্রিকেট তো সবকিছুর পর ‘ক্যাপ্টেনস্ গেম’। শেষ কথাটা হওয়া উচিত অধিনায়কেরই। তা কি হয়?

সাকিব: হ্যাঁ, সেটাই হয়। ব্যাটিং অর্ডার যদি চেঞ্জ করি, বেশির ভাগ সময় আমিই তা করি। কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকলে আমি হয়তো ওকে জিজ্ঞেস করি। ওর কখনো কিছু মনে হলে হয়তো আমাকে এসে বলে, তুমি কী মনে করো...তবে মাঠের যেকোনো ব্যাপারে শেষ সিদ্ধান্ত আমিই নিই। মাঠের বাইরে টিম সিলেকশনে ঝামেলায় পড়লে হয়তো আমিই বলি, ‘আমি ঠিক বুঝতে পারছি না, তুমি যা ভালো বোঝ করো।’ কোনো ব্যাপারে দুজনের দুই মত হলে আমি আমার সিদ্ধান্তমতোই কাজ করি।

শুভ্র: দীর্ঘ মেয়াদে অধিনায়কত্ব পাওয়ার পর দল নির্বাচনে ভূমিকা রাখতে চান বলে জানিয়েছেন। সেটা কী রকম? ড্যানিয়েল ভেট্টোরির মতো অফিসিয়ালি নির্বাচক হয়ে? 

সাকিব: আমার মনে হয়, আমাদের যে পলিসিটা এখন আছে, সেটি ঠিকই আছে। টিম সিলেকশনের ব্যাপারে আমার মতামত চাওয়া হয়। এমন কোনো বারই হয়নি যে আমার সঙ্গে কোনো আলাপ ছাড়াই টিম করে ফেলা হয়েছে।

শুভ্র: আপনার সঙ্গে আলাপ হয় বুঝলাম, কিন্তু আপনার মতামত কি মূল্য পায়?

সাকিব: এখন পর্যন্ত যা হয়ে আসছে, তাতে তো পায়ই বলতে হবে। হান্ড্রেড পার্সেন্ট হয়তো হয় না, তবে বেশির ভাগই হয়। আর আমাদের এখানে ১৫ জনের একটা দল করতে গেলে একজন, বড়জোর দুজনকে নিয়েই একটু দ্বিধাদ্বন্দ্ব হয়। এটা নিয়ে তখন নির্বাচকেরা আমার সঙ্গে আলাপ করেন, কোচের সঙ্গে আলাপ করেন...তার পরই সিদ্ধান্ত নেন।

শুভ্র: অধিনায়ক হিসেবে কোনো আদর্শ কি ছিল বা আছে? এমন কেউ যাকে দেখে মনে হয়েছে, আমি অধিনায়ক হিসেবে এ রকমই হতে চাই...

সাকিব: না, ও রকম কাউকে পাই না।

শুভ্র: আদর্শ না হোক, প্রিয় ক্যাপ্টেন?

সাকিব: স্মিথ, গ্রায়েম স্মিথ।

শুভ্র: ট্যাকটিক্যাল কোনো কারণে, নাকি স্মিথের মধ্যে একটা ডাকাবুকো ভাব আছে বলে? 

সাকিব: ট্যাকটিকাল দিক আছে, আক্রমণাত্মক মেজাজ আছে। এর বাইরে ও যেভাবে টিমটাকে হ্যান্ডল করেছে...দক্ষিণ আফ্রিকায় ঝামেলা অনেক বেশি। এটা সামলে ও যেভাবে নেতৃত্ব দিয়েছে, এর সঙ্গে পারফর্ম করে এসেছে, এ কারণেই ও একটু প্রিয়। তবে খুব যে প্রিয় এমন না।

অধিনায়ক হিসাবে সাকিবের বেশ পছন্দ ছিলেন গ্রায়েম স্মিথ। ছবি: বিসিসিআই

শুভ্র: দীর্ঘ মেয়াদে অধিনায়কত্ব চেয়েছিলেন, পেয়েছেন। সবকিছু ঠিক থাকলে হয়তো আরও অনেক বছর অধিনায়কত্ব করবেন। দীর্ঘ মেয়াদে চিন্তাভাবনা করারও সুযোগ হয়েছে এখন। তা অধিনায়ক হিসেবে কোথায় পরিবর্তন আনতে চান?

সাকিব: মাঠের বাইরেটাই আমার কাছে বেশি ইম্পর্ট্যান্ট মনে হচ্ছে। মাঠের ভেতরে আমার মনে হয় ঠিকই আছে...নিজের পারফরম্যান্স প্লাস দলের পারফরম্যান্স, ক্যাপ্টেনসির ব্যাপারেও মনে হয় না খুব বেশি ভুল করেছি। ছোটখাটো ভুল তো নিশ্চয়ই আছে। তবে মাঠের বাইরে আমার মনে হয় আমি আরও বেশি ইনভলভ হতে পারি। অনেক কাজ আছে, যেগুলো আরও ভালোভাবে করার সুযোগ আছে।

শুভ্র: সেসব কী?

সাকিব: সিস্টেম। সিস্টেম বলতে সবকিছু...যেমন ডিসিপ্লিন...সেটা ড্রেসিংরুমে ঢোকার ডিসিপ্লিন থেকে ব্যাগ রাখার ডিসিপ্লিন, মাঠে ওয়ার্মআপ করতে একসঙ্গে নামার ডিসিপ্লিন...সবকিছু। প্লেয়ারদের সঙ্গে আন্ডারস্ট্যান্ডিংটা আরও ভালো হতে পারে। দেখা যাচ্ছে, আমি হয়তো কিছু প্লেয়ারের সঙ্গে বেশি মিশি, কিছু প্লেয়ারের সঙ্গে কম। তবে কেউ যেন এটা না বোঝে যে ক্যাপ্টেন আমার চেয়ে ওকে বেশি পছন্দ করে। নিজের আচার-আচরণ, চলাফেরা এসবেও হয়তো উন্নতির সুযোগ আছে। পারফর্ম করলে এসব নিয়ে কোনো সমস্যা হয় না, তবে পারফর্ম না করলে এসব বড় হয়ে দাঁড়ায়।

শুভ্র: এই ছাড়া-ছাড়া অধিনায়কত্ব করার সময়টাতেই আপনি এমন অনেক অপ্রিয় সত্যি কথা বলে দিয়েছেন, যেটি অন্য কেউ হলে এড়িয়ে যেত। আপনি কি সব ক্ষেত্রেই এমন—যা মনে হয়, তা-ই বলে দেন?

সাকিব: বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই। সব ক্ষেত্রে হয়তো পারি না, তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই...

শুভ্র: কিছুদিন আগে মাইকেল ভন বলেছেন, ইংল্যান্ড-অধিনায়ক হিসেবে তাঁর বেশির ভাগ সংবাদ সম্মেলনই ছিল মিথ্যায় ভরা। প্রায় সব ক্রিকেটারই যেখানে বিতর্ক হতে পারে এমন কিছু ছোঁয়াচে রোগের মতো এড়িয়ে চলে, আপনি সেখানে আশ্চর্য ব্যতিক্রম। চিরদিন এমনই থাকুন, এটাই চাই। তবে তার পরও প্রশ্ন—কেউ ক্ষুব্ধ হতে পারে, বোর্ডে জবাবদিহি করতে হতে পারে—এসব ভেবে ভয় পান না? 

সাকিব: অনেক সময় কিন্তু সত্যি কথা বলে দেওয়া ভালো। তাতে হয়তো সাময়িকভাবে সমস্যা হবে, বিতর্ক হবে তবে শেষপর্যন্ত তাতে রেজাল্টটা ভালো হবে। আবার কখনো মিথ্যা বলারও প্রয়োজন পড়ে। তাতে প্রাথমিকভাবে হয়তো একটা নেতিবাচক ধারণা তৈরি হবে, কিন্তু পরে সেটির ফল ভালোও হতে পারে। যেমন জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচের পর আমি যা বলেছি, যে যতই বলুক আমার মাথাটাথা ঠিক ছিল না, কথাটা ঠিক না, আমার মাথা একদম পারফেক্টই ছিল। আমি জানতাম যে আমি আজ এটাই বলব।

শুভ্র: তার মানে ব্যাপারটা এমন নয় যে যখন যা মনে হচ্ছে সব সময় তা-ই বলে দিচ্ছেন। এর পেছনে চিন্তাভাবনাও আছে...

সাকিব: বলতে পারেন। আমার এক টিচার আমাকে বলেছিল তোমার স্টুডেন্ট যদি তোমাকে খুব পছন্দ করে, তার ভালো রেজাল্ট করার চান্স আছে। আবার তোমাকে যদি ঘৃণা করে, তাও ভালো রেজাল্ট করার চান্স আছে। কিন্তু তোমাকে যদি মাঝামাঝি ভাবে, তা হলে কিন্তু ভালো রেজাল্ট করার চান্স কম। ঘৃণা করলে রাগ করে ভালো রেজাল্ট করতে চাইবে আর পছন্দ করলে তো খুশি করার জন্যই তা করতে চাইবে। ওই ম্যাচের পর আমারও চিন্তা ছিল, প্লেয়াররা আমার ওপর রাগ করুক যাই করুক, টিমের রেজাল্ট ভালো হলেই হলো। সেটি হয়েছেও (হাসি)।

শুভ্র: মিডিয়ায় আলোচনা-সমালোচনা আপনাকে কতটা প্রভাবিত করে?

সাকিব: একটুও না।

শুভ্র: একটুও না! এটা কি বিশ্বাসযোগ্য?

সাকিব: সত্যি বলছি, মিডিয়া কী লিখল এটা নিয়ে মাথা ঘামাই না। ভালো লিখলে ভালো, খারাপ লিখলে ভাবি দুদিন পর ঠিক হয়ে যাবে। 

সৌরভ আসার পর ভারত বদলে গেছে, টিম হিসেবে খেলতে শুরু করেছে, পারফর্ম করতে শুরু করেছে। ‘নো ফিয়ার’ একটা মনোভাব পুরো দলে ছড়িয়ে পড়েছে। আমিও এমন একটা চেঞ্জ আনতে চাই।

শুভ্র: অধিনায়কত্বের মেয়াদ শেষে, সেটি যত দিনই হোক, বাংলাদেশের ক্রিকেটে কী ছাপ রেখে যেতে চান?

সাকিব: রেজাল্ট দিয়ে ছাপ রাখতে পারলে খুবই ভালো। তা হলে প্রমাণ থাকবে কী করেছি। তা না হলেও চাই, বাংলাদেশ একটা অন্য রকম টিম হিসেবে তৈরি হবে। এখানে সৌরভ গাঙ্গুলীর কথা বলতে পারি। ও আসার পর থেকে যেমন ‘টিম ইন্ডিয়া’ কথাটা এসেছে। গাঙ্গুলীর উদাহরণটা দিলাম এ কারণে যে সবাই যেমন বলে, সৌরভ আসার পর ভারত বদলে গেছে, টিম হিসেবে খেলতে শুরু করেছে, পারফর্ম করতে শুরু করেছে। ‘নো ফিয়ার’ একটা মনোভাব পুরো দলে ছড়িয়ে পড়েছে। আমিও এমন একটা চেঞ্জ আনতে চাই।

শুভ্র: ২০০৯-এর শুরুতে আপনি ওয়ানডে অলরাউন্ডারদের র‍্যাঙ্কিংয়ে এক নম্বর হওয়ার পর খুশি তো হয়েছিলামই, তবে সত্যিটাই বলি, মনে হয়েছিল কদিন আর সাকিব ওখানে থাকবে! এই যে দুই বছর ধরে আপনি নাম্বার ওয়ানের মতোই খেলে যাচ্ছেন, এই স্বপ্নযাত্রা থেমে যেতে পারে বলে ভয় হয় না কখনো?

সাকিব: না, এ রকম চিন্তা কখনো আসে না। আমার সব সময় মনে হয়, মাঠে আমার অনেক কিছু করার সুযোগ আছে। ব্যাটিং-বোলিং-ফিল্ডিং, সঙ্গে ক্যাপ্টেনসি। এ কারণে ‘যদি খারাপ খেলি’ ধরনের টেনশন হয়ই না। জানি, কিছু না কিছু হবেই। আজ বোলিং ভালো না হলে ব্যাটিংয়ে ভালো করব, কাল ব্যাটিং খারাপ হলো তো বোলিং ভালো করব। তবে আমার কাছে দলে অবদান রাখাটাই সবচেয়ে জরুরি। ৩০ রান করলাম বা ১০ ওভারে ৩৫ রান দিলাম...দলে অবদান রাখতে পারলেই হলো। আর ওসব র‍্যাঙ্কিং-ফ্যাঙ্কিং নিয়ে সত্যি তেমন চিন্তা করি না। 

শুভ্র: এর আগে টুকটাক যা-ই ক্যাপ্টেনসি করেছেন, সেটি ঠেকা কাজ চালানো। এবারই বাংলাদেশ-অধিনায়ক হিসেবে আসল অভিষেক হচ্ছে আপনার এবং সেটি বিশ্বকাপে। বিশ্বকাপের টিকিট নিয়ে যা হচ্ছে, সেটি দেখেই তো প্রত্যাশার চাপটা অনুভব করার কথা... 

সাকিব: যেদিন টিকিট ছাড়া হলো, সেদিন সকালে ধানমন্ডি ৪ নম্বরে ক্লাবের প্র্যাকটিসে যাওয়ার সময় সিটি কলেজের সামনে দিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। আমি ওদের বললাম, চল্ ২৭ নম্বর দিয়ে যাই, ওখানে সিটি ব্যাংক আছে, অবস্থাটা দেখি। ওখানে লম্বা লাইন দেখে বললাম, ম্যাচের পর ম্যাচ যখন হারব, তখন এই কষ্ট সবার মনে পড়বে আর গালাগালি তো চলবেই (হাসি)। সারা দেশে এমন উন্মাদনা, মাঠে এত দর্শক, এটাকে কারও কাছে চাপ মনে হতেই পারে। তবে চাপ...চাপের কী আছে...আমরা ভালো ক্রিকেট খেললে যে কাউকে হারিয়ে দিতে পারি। শুধু ইন্ডিয়ার সঙ্গে ম্যাচটাতে ইন্ডিয়া যদি সেভেন্টি-এইট্টি পার্সেন্ট খেলে আর আমরা হান্ড্রেড পার্সেন্ট খেলি, তা হলে হয়তো জেতা সম্ভব। তবে এর বাইরে আমাদের গ্রুপে যেসব টিম আছে, আমাদের হান্ড্রেড পার্সেন্ট খেলতে পারলে ভালোভাবে ম্যাচ জেতা সম্ভব। গত কিছুদিন যেমন খেলেছি, তাতে একটা আত্মবিশ্বাস তো আমাদের আছেই। আসলে ক্যাম্প শুরু হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই টের পেয়ে যাব, বিশ্বকাপে আমাদের রেজাল্ট কেমন হতে পারে। ক্যাম্পের প্রথম দিন থেকেই একটা ইতিবাচক আবহাওয়া তৈরি হওয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ। গত বিশ্বকাপ শুরুর আগেই যেমন আমাদের মনে হচ্ছিল, আমরা ভালো কিছু করতে পারি। আমাদের গ্রুপে দুটি ভালো টিম ছিল, তার পরও সবার মনে হয়েছে, আমরা কিছু করতে পারি। এই বিশ্বাসটা খুব জরুরি। নয়জন প্লেয়ার বিশ্বাস করলেও হবে না। ১১ জনই যদি বিশ্বাস করে, শুধু তা হলেই এই বিশ্বকাপে আমাদের ভালো রেজাল্ট করা সম্ভব। 

শুভ্র: সেই ভালো রেজাল্টটা কী? কী হলে বলবেন, ভালো রেজাল্ট হয়েছে?

সাকিব: সেকেন্ড রাউন্ডে কোয়ালিফাই করা। বড় দুইটা দলকে হারালে সেকেন্ড রাউন্ড কনফার্ম। একটাকে হারালে হয়তো ফিফটি-ফিফটি চান্স, তখন রানরেট-টেটের ব্যাপার আসবে। তবে আমার মনে হয় সম্ভব, এটা অসম্ভব কিছুই না। দেশের মাটিতে খেলা, অবশ্যই সেকেন্ড রাউন্ডে যাওয়া সম্ভব। আর সেকেন্ড রাউন্ডে গেলে সেমিফাইনালে যাওয়ার চান্সও খুব বেশি। তখন এক ম্যাচের খেলা...সবারই মনে হবে, ‘একটাই তো ম্যাচ, দেখি না সবাই চেষ্টা করে’। তা ছাড়া সেকেন্ড রাউন্ডে উঠে গেলে দলের আত্মবিশ্বাসটাই হবে অন্য রকম। 

শুভ্র: নিউজিল্যান্ডকে হোয়াইটওয়াশ করার পর তো অতি আশাবাদী অনেকে এমনও বলছেন, বাংলাদেশ বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়নও হয়ে যেতে পারে...

সাকিব:  (হাসি) আমার কী মনে হচ্ছে জানেন, আমাদের সেকেন্ড রাউন্ডে কোয়ালিফাই করাটাই কঠিন। এটি করতে পারলে খুব ইজি হয়ে যাবে। সেকেন্ড রাউন্ডে কোয়ালিফাই করলে আমরা ফাইনালও খেলে ফেলতে পারি। আর ফাইনাল পর্যন্ত গেলে কী হবে কে বলতে পারে...

শুভ্র: ফাইনালে উঠে গেলে আর চ্যাম্পিয়ন হওয়াটা বাদ থাকে কেন?

সাকিব: (হাসি) হ্যাঁ, হ্যাঁ চ্যাম্পিয়নও হয়ে যেতে পারি। তবে আগে সেকেন্ড রাউন্ডে তো উঠি।

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×