‘ক্যান্ট ব্যাট, ক্যান্ট বোওল, ক্যান্ট ফিল্ড’

উৎপল শুভ্র

২৬ মার্চ ২০২১

‘ক্যান্ট ব্যাট, ক্যান্ট বোওল, ক্যান্ট ফিল্ড’

বাংলাদেশের এই দলের তিনটিই সমস্যা–ওরা ব্যাটিং করতে পারে না, ওরা বোলিং করতে পারে না, ওরা ফিল্ডিং করতে পারে না। কথাটা আপনার খুব পছন্দ হয়েছে বলে অনুমান করছি।

বিশেষ করে তাঁদের, যাঁরা শুরু থেকে ম্যাচ দেখবেন বলে ভোররাতে ঘুম থেকে উঠেছেন। দেরিতে ঘুমানোর অভ্যাসের কারণে আমার মতো যারা ঘুমাতেই পারেননি, তাদের তো আরও বেশি।

কিন্তু আপনাদের পছন্দ হবে অনুমান করে কথাটা নিজের নামের নামে চালিয়ে দেওয়াটা অসততা হবে। কথাটা আসলে আমার নয়। মার্টিন জনসন নামে ইংলিশ ক্রীড়া সাংবাদিকের। তা মার্টিন জনসন কেন বাংলাদেশ দল নিয়ে পড়লেন? তুই ব্যাটা ইংলিশ সাংবাদিক, তুই ইংল্যান্ড নিয়েই থাক্। 

না, তুই-তোকারি করাটা একদমই ঠিক হচ্ছে না। মার্টিন জনসনের লেখা আমার খুব ভালো লাগে। লেখায় এমন হিউমার থাকে যে, অনেকবারই এমন হয়েছে, পড়তে পড়তে আমি সশব্দে হাসতে শুরু করেছি।

আশেপাশের লোকজনের মধ্যে যে আমার মানসিক সুস্থতা সম্পর্কে সন্দেহ দেখা দিয়েছে, সে জন্য আমি তাদের দোষ দিই না। 

মার্টিন জনসনের লেখা খুব ভালো লাগে–এই কথাটায় কালের কোনো ঝামেলা নেই। আগেও ভালো লাগত, এখনো লাগে, ভবিষ্যতেও লাগবে। তবে লেখায় 'হিউমার থাকে' কথাটাকে 'হিউমার থাকত'-তে বদলে দিতে হয়। কারণ মার্টিন জনসন অনেক দিনই লেখেন না। আর কোনোদিন লিখবেনও না। কারণ আপনি যত প্রতিভাবান লেখকই হোন না কেন, মৃত্যুর পর আর লেখালেখি করা যায় না। রবীন্দ্রনাথও পারেননি। গত ১৩ মার্চ মার্টিন জনসন ব্যাটিং-বোলিং-ফিল্ডিং সব কিছুর উর্ধ্বে চলে গেছেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭১।

তাছাড়া মার্টিন জনসন তো পরচর্চাও করেননি। 'ক্যান্ট ব্যাট, ক্যান্ট বোওল, ক্যান্ট ফিল্ড' কথাটা বলেছিলেন ইংল্যান্ড দল সম্পর্কেই। ১৯৮৬-৮৭ অ্যাশেজ সিরিজ খেলতে অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার পর প্রস্তুতি ম্যাচগুলোতে মাইক গ্যাটিংয়ের দলের এমনই বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা যে, মার্টিন জনসন 'দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট' পত্রিকায় লেখা কলামে তাঁর নিঃসংশয় সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেন। গ্যাটিংয়ের সেই দলই অ্যাশেজ জিতে ফেলার পরও তিনি মোটেই বিব্রত হননি। বরং স্বভাবজাত রসিকতার সুরে বলেন, কথাটা ঠিকই ছিল, দলটা বুঝতে তাঁর ভুল হয়েছে। 'রাইট কোট, রং টিম'। কিছুদিন পর মার্টিন জনসন 'ক্যান্ট ব্যাট, ক্যান্ট বোওল, ক্যান্ট ফিল্ড' নামে একটা বইও লিখে ফেলেন।

মার্টিন জনসনের এই অমর উক্তিটা যথাযথ ঋণ স্বীকার করে  অনেকবারই আমি আমার লেখায় ব্যবহার করেছি। অবশ্যই বাংলাদেশ দল প্রসঙ্গে। আমারও পরচর্চার করার অভ্যাস নেই। যতবারই লিখেছি, ততবারই মনে হয়েছে, এই ম্যাচে বাংলাদেশ দলের পারফরম্যান্স বোঝাতে এর চেয়ে ভালো কথা আর হয় না। আজও যেমন মনে হচ্ছে। 

বাংলাদেশের এমন ম্যাচ আমি অসংখ্য কাভার করেছি। লাঞ্চের সময়ই ম্যাচ রিপোর্ট লিখে ফেলা যায়, এমন ম্যাচ আর কি! পরে দু'একটা স্কোর-টাের বসানোর জন্য শূন্য স্থান রাখা ছাড়া তা সম্পূর্ণ ম্যাচ রিপোর্টই হতো।

একটু বেশিই মনে হচ্ছে। মানে আগে যতবার তা লিখেছি, দু'একবার হয়তো না লিখলেও পারতাম বলে মনে হচ্ছে আর কি! মনে হচ্ছে, কথাটা ওয়েলিংটনের বেসিন রিজার্ভে সিরিজের এই তৃতীয় ওয়ানডের জন্যই তুলে রাখা উচিত ছিল।

বাংলাদেশের এমন ম্যাচ আমি অসংখ্য কাভার করেছি। লাঞ্চের সময়ই ম্যাচ রিপোর্ট লিখে ফেলা যায়, এমন ম্যাচ আর কি! পরে দু'একটা স্কোর-টাের বসানোর জন্য শূন্য স্থান রাখা ছাড়া তা সম্পূর্ণ ম্যাচ রিপোর্টই হতো। কিন্তু সে সব লেখার সময় এতটা অসহ্য লাগেনি। ১৯৯৯ বিশ্বকাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে জয়ের পর জয়হীন টানা ৪৭ ম্যাচের সময়টাতে তো এমন ম্যাচ রিপোর্ট লেখা অভ্যাসই হয়ে গিয়েছিল। তাহলে আজ এত রেগে গেলাম কেন?

নির্ঘুম রাত মনে হয় না একমাত্র কারণ। আরও কারণ অবশ্যই আছে। মাঝের সময়টায় বুড়িগঙ্গায় দূষিত থেকে দূষিততর অনেক জল গড়িয়েছে, অন্তত ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশ একটু হলেও সমীহ জাগানো দল হয়ে উঠেছে। সেই দল আগের ম্যাচে একটু ভালো খেলায় কোথায় একটু উজ্জীবিত রূপে দেখা দেবে, উল্টো মেলে ধরল বোলিং-ব্যাটিং-ফিল্ডিংয়ের জঘন্য এক প্রদর্শনী। তা এমনই যে, সদ্য প্রয়াত মার্টিন জনসনকে টেনে না এনে কোনো উপায় থাকল না।

এই লেখা যখন শেষ করে আনছি, প্রিয় প্রতিপক্ষের বিপক্ষে নিঃসঙ্গ লড়াই তখনো চালিয়ে যাচ্ছেন মাহমুদউল্লাহ । লেখাটা পড়লে তিনি একটু রাগ করতেই পারেন। করলে করবেন। আমারও জবাব আছে। 
আমি বলব, 'ঠিক আছে, আপনার ক্ষেত্রে না হয় 'ক্যান্ট ব্যাট' বলাটা অন্যায়। কিন্তু বাকি দুটি? বোলিং করেনইনি বলে 'ক্যান্ট বোওল'-এর মীমাংসা হয়নি। আর 'ক্যান্ট ফিল্ড'-এর উজ্জ্বল (আসলে উল্টো) উদাহরণ তো আপনিও। ড্যারিল মিচেলের অমন সহজ ক্যাচটা ফেলে না দিলে তো নিউজিল্য্যান্ড ওই ব্যাটিং-তাণ্ডব চালাতে পারে না।'

আর চূড়ান্ত আশ্রয় হিসাবে সেই আপ্তবাক্যটা তো আছেই, ব্যতিক্রম নিয়মকেই প্রমাণ করে! মাহমুদউল্লাহর ব্যাটিং আর তাসকিনের বোলিংও এমন ব্যতিক্রম হয়েই থাকছে। এই ম্যাচের বাংলাদেশ দল সম্পর্কে ওই কথাটা একটুও বদলাচ্ছে না।

ক্যান্ট ব্যাট, ক্যান্ট বোওল, ক্যান্ট ফিল্ড!

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×