টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম জয়-৮

টেস্ট জয়ের স্বপ্নপূরণ

উৎপল শুভ্র

২৭ মার্চ ২০২১

টেস্ট জয়ের স্বপ্নপূরণ

টেস্ট অভিষেকের চার বছর দুই মাস পর ধরা দিয়েছিল সেই আরাধ্য স্বপ্ন। টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম জয়! ২০০৫ সালের জানুয়ারিতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে চট্টগ্রামের এম এ আজিজ স্টেডিয়ামে সেই জয় চিরদিনই অন্যরকম একটা জায়গা নিয়ে থাকবে বাংলাদেশের ক্রিকেটে। সেই টেস্টের প্রতিটি দিনই তাই আবার ফিরে দেখার মতো।

প্রথম প্রকাশ: ১১ জানুয়ারি ২০০৫। প্রথম আলো।

কাল সকালে পুব আকাশে যে সূর্যটা উঠেছিল, সেটি কি একটু অন্য রকম ছিল? একটু বেশি লাল? বাংলাদেশের জন্য লাল অক্ষরে লিখে রাখার দিনটিতে সূর্যের রঙটাও তো একটু অন্য রকমই হওয়ার কথা! কাল দুপুরে সবকিছুই যে কেমন রঙ বদলে ফেলল!  

এনামুলের বল ক্রিস্টোফার পোফুর ব্যাট হয়ে সিলি মিড অফে দাঁড়ানো আশরাফুলের হাতে জমা পড়তেই ফেটে পড়ল এম এ আজিজ স্টেডিয়াম। ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকার আনন্দে দর্শকরা তারস্বরে চেঁচাচ্ছেন, মাঠে খেলোয়াড়রা আনন্দে আত্মহারা হয়ে কে কী করছেন তার ঠিক নেই, বিশাল একটা জনস্রোত ছুটে আসছে স্টেডিয়ামের দিকে। ৪ বছর ২ মাস ধরে যে স্বপ্ন দেখে আসছে বাংলাদেশ, সেই স্বপ্নপূরণের দিনে তো এমনই হওয়ার কথা। আহ! টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম জয়! ঘড়িতে তখন ১২টা ৫৩।

ল্যাপ অব অনার আর নিছক ল্যাপ অব অনার থাকল না। আনন্দে মাতোয়ারা বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের অনেকে জিমন্যাস্টও হয়ে গেলেন। ছবি: শামসুল হক টেংকু

গত বছর সেপ্টেম্বরে মুলতানে ধরা দিতে দিতে হারিয়ে গেছে এই জয়, যেন দেশের মাটিতে ধরা দিয়ে উত্সবটাকে আরো রঙিন করে তোলার জন্যই! জাতীয় পতাকা নিয়ে বাংলাদেশের খেলোয়াড়রা যখন ল্যাপ অব অনার দিচ্ছেন, সেই দৃশ্য দেখে অনেকের চোখেই জল। আইসিসি ট্রফি ও ’৯৯ বিশ্বকাপের পর প্রথম টেস্ট জয়...বাংলাদেশের চোখে আবারও আনন্দাশ্রু এল সেই ক্রিকেটারদের সৌজন্যেই। 

আর কোনো সিরিজের জন্য বাংলাদেশ এমন ব্যগ্র প্রতীক্ষায় ছিল না। জিম্বাবুয়ে আসার আগেই যেন এই জয়ের সুবাস পেতে শুরু করেছিল বাংলাদেশ। বড় ভয়টাও ছিল সেখানেই। জয়ের জন্য মাঠে নামা—এই অভিজ্ঞতার সঙ্গে বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের যে এটাই প্রথম পরিচয়। জিম্বাবুয়ের চেয়েও বড় প্রতিপক্ষ হয়ে ছিল সেই চাপ। সেটি জয় করে বাংলাদেশ দল এমন ঝলমলে বিজয়ীর বেশে বেরিয়ে এল যে, ২২৬ রানের জয়টাও যেন তা ঠিকমতো বোঝাতে পারছে না। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে বাংলাদেশ যদি ২২৬ রানে জিতে থাকে, ওই চাপের বিপক্ষে জয়ের ব্যবধানটা আরো বড়। আসল জয়টাও সেখানেই।

চট্টগ্রাম টেস্টের প্রতিটি দিনই তো বাংলাদেশ দল নতুন করে চেনাল নিজেদের। ব্যাটিং-বোলিং-ফিল্ডিং সব কিছুতেই এমন অভূতপূর্ব পেশাদারিত্বের ছাপ যে, বারবার অবাক হয়ে নিজেকেই প্রশ্ন করতে হয়েছে, ‘এটা বাংলাদেশ দলই তো!’ বাংলাদেশ দলই, তবে একটু বদলে যাওয়া বাংলাদেশ।

চট্টগ্রাম এম এ আজিজ স্টেডিয়ামের স্কোরবোর্ড বলছে বিজয়ের গল্প। ছবি: শামসুল হক টেংকু

কালকের দিনটির কথাই ধরুন না! শেষ দিনে স্বপ্নপূরণের সঙ্গে ব্যবধান ছিল ৭ উইকেটের। প্রথম ঘণ্টায় সেটি তো কমলই না, উল্টো ১৫ ওভারে ৬৬ রান তুলে জিম্বাবুয়ে যেন একটা চ্যালেঞ্জই ছুড়ে দিল। তারপরও বাংলাদেশের কোনো খেলোয়াড়কে এতটুকু হতোদ্যম মনে হলো না, কারো শরীরী ভাষাই হতাশার কথা বলল না, বরং তা থেকে ফুটে বেরোল ‘আমরা ওদের চেয়ে ভালো দল। আমরাই জিতব’—এই বিশ্বাস। আর এনামুল হক হয়ে উঠলেন সেই বিশ্বাসটার মূর্ত প্রতীক। 

বয়স মাত্র ১৮, এটি তার মাত্র চতুর্থ টেস্ট—কালকের এনামুলকে দেখে তা বোঝার সাধ্য কার! প্রথম ইনিংসে ভালো বোলিং করেও শুধুই দুর্ভাগ্যের কারণে কোনো উইকেট পাননি। সেই হতাশাকে কবর দিয়ে কাল ১৬.২ ওভারে ৩৭ রান দিয়ে তার ৫ উইকেট। গত পরশু বিকেলে নিয়েছিলেন আরেকটি। সব মিলিয়ে ৪৫ রানে ৬ উইকেট। টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের পক্ষে সেরা বোলিংয়ের রেকর্ড তো হলোই, ‘ম্যান অব দ্য ম্যাচ’ পুরস্কার পাওয়ার মাধ্যমে পেলেন এই ম্যাচের নায়কের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতিও। প্রথম ড্রিংকস ব্রেকের পর প্রথম ওভারে এনামুলই ভেঙেছেন বাংলাদেশের গলার কাঁটা হয়ে ওঠা হ্যামিল্টন মাসাকাদজা আর ব্রেন্ডন টেলরের ৭০ রানের জুটিটি। এরপর দুটি উইকেট নিয়ে মাশরাফিই যা একটু সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন, বাকিটুকু শুধুই এনামুলময়।

কাল প্রথম ঘণ্টায় মাসাকাদজা আর টেলর যখন দারুণ সব স্ট্রোক খেলছেন, ‘একটা উইকেট পেলেই ম্যাচের চেহারা অন্যরকম হয়ে যাবে’—এ কথা বলে সতীর্থদের উদ্দীপ্ত করে এসেছেন হাবিবুল। সত্যিই অন্য রকম হয়ে গেল। এনামুল টেলরকে ফিরিয়ে দিতেই একের পর এক উইকেট পড়তে থাকল, এতদিন তা বাংলাদেশের ইনিংসেরই বিশেষত্ব হয়ে ছিল। প্রতিপক্ষেরও যে এমন কিছু হতে পারে, বাংলাদেশের জন্য সেই অভিজ্ঞতা কালই প্রথম। মাত্র ৪২ রানে পড়েছে জিম্বাবুয়ের শেষ ৭ উইকেট। লাঞ্চের পর পৌনে এক ঘণ্টা খেলা হতে না হতেই খেলা শেষ। 

অনিশ্চয়তার কোনো দোলাচল ছিল না। ১২৬ রানের মধ্যে টাইবু আর মাসাকাদজা আউট হওয়ার পরই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশের জয়। ছিল শুধু ব্যগ্র প্রতীক্ষা, কখন আসবে সেই জয়! সেই প্রতীক্ষাও শেষ হলো এক সময়; পুরো বাংলাদেশই হয়ে গেল উৎসবের দেশ।

আরও পড়ুন...
টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম জয়-১
টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম জয়-২
টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম জয়-৩
টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম জয়-৪
টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম জয়-৫
টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম জয়-৬
টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম জয়-৭

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×