বৃষ্টিভেজা মধুর জয়

পাঁচ বছর আগে এই দিনে

উৎপল শুভ্র

২৮ মার্চ ২০২১

বৃষ্টিভেজা মধুর জয়

শ্রীলঙ্কার মাটিতে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের ওয়ানডে সিরিজ ড্র করার স্মারক এই ছবি। ট্রফিতে মুশফিকুর রহিম ও অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুসের সমান অধিকার। ছবি: এএফপি

এর আগে শ্রীলঙ্কার মাটিতে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ১৫টি ওয়ানডের যে একটিতেই পরাজয় এড়ানো গেছে, তা বৃষ্টির কল্যাণে। ঠিক আগের ম্যাচেই। পাল্লেকেল্লেতে এই ম্যাচের আগেও বাংলাদেশ দল ঢাকা নৈরাশ্যের মেঘে। শ্রীলঙ্কার চেয়েও বড় প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে ইনজুরি। সেই ম্যাচেই জয় পেয়ে সিরিজ ড্র করে ফেলেছিল বাংলাদেশ। বৃষ্টিভেজা মধুর সেই জয়ের গল্প।

প্রথম প্রকাশ: ২৯ মার্চ ২০১৩। প্রথম আলো।

শ্রীলঙ্কা: ৫০ ওভারে ৩০২/৯, বাংলাদেশ: ২৬ ওভারে ১৮৪/৭

ফল: বাংলাদেশ ৩ উইকেটে জয়ী (ডি/এল)

বাংলাদেশ ইনিংসের ১৩.৪ ওভার পর যখন বৃষ্টি নামল, ভাবাই যায়নি বাংলাদেশের জন্য তা কত বড় উপহার নিয়ে এসেছে! রানরেট তখন প্রায় ৬। তার পরও বৃষ্টিকে যত না উপদ্রব মনে হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি ‘ত্রাতা’!

‘ত্রাতা’-ই তো! এই মাঠে পরে ব্যাটিং করে কোনো দল ২৭৪ রানের বেশি করেনি। ১৯৭ রানের বেশি তাড়া করে জেতার রেকর্ড নেই। সেখানে বাংলাদেশের সামনে ৩০২ রানের পাহাড়!

বৃষ্টি সেই পাহাড়কে বানিয়ে দিল ‘টিলা’। প্রায় আড়াই ঘণ্টা পর আবার যখন খেলা শুরু হলো, নতুন লক্ষ্য ২৭ ওভারে ১৮৩। অর্থাৎ বাকি ১৩.২ ওভারে করতে হবে ১০৫ রান। আস্কিং রেট আটের মতো। কিন্তু এই টি-টোয়েন্টির যুগে এটি কোনো ব্যাপার নাকি! অন্তত ২১৮ বলে ২২৫ রানের (বৃষ্টি না নামলে যা করতে হতো) তুলনায় এই ৮০ বলে ১০৫ অনেক সহজ।

‘অনেক সহজ’ না বলে বোধ হয় ‘কম কঠিন’ বলাই ভালো। শেষ পর্যন্ত অবশ্য শ্রীলঙ্কার মাটিতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে প্রথম জয়টা সহজই হলো। এক ওভার বাকি থাকতেই মাঠে বিজয়োল্লাসে মেতে উঠলেন নাসির হোসেন ও সোহাগ গাজী। ড্রেসিংরুমের ব্যালকনিতে বাংলাদেশ দলের বাকি সবাই তখন একে অন্যকে আলিঙ্গনে বাঁধতে ব্যস্ত। ম্যাচ জয়ের সঙ্গে ড্র করা হলো সিরিজও (১-১)। এই প্রথম শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিরিজ হারল না বাংলাদেশ।

আবদুর রাজ্জাককে এনামুলের অভিনন্দন। ক্যারিয়ারে চতুর্থবারের মতো ৫ উইকেট নিয়েছেন, ছুঁয়েছেন ২০০ উইকেটের মাইলফলক, পরে এর সঙ্গে যোগ হয়েছে বাংলাদেশের জয়। সব মিলিয়ে আবদুর রাজ্জাকের স্মরণীয়তম ম্যাচগুলোর একটি। ছবি: এএফপি

বৃষ্টি শুধু বাংলাদেশের সমীকরণটাই সহজ করে দেয়নি, শ্রীলঙ্কাকে বড় একটা সমস্যাতেও ফেলল। বোলারদের ওভার বিলিবণ্টন নিয়ে অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুসের সব চিন্তাভাবনা তখন ওলটপালট। সংক্ষিপ্ত হয়ে যাওয়া ম্যাচে মাত্র দুজন বোলার ৬ ওভার করে করতে পারবেন, তিনজন ৫ ওভার করে। লাসিথ মালিঙ্গার ৫ ওভার বৃষ্টির আগেই শেষ। যে একটি মাত্র ওভার বাকি ছিল, সেটিই প্রায় ভাগ্য নির্ধারণ করে দিচ্ছিল ম্যাচের। শেষ ৩ ওভারে প্রয়োজন তখন ২৩ রান। মালিঙ্গা এসে প্রথম বলে চার খেলেন। কিন্তু পরের পাঁচ বলে একটি ওয়াইড করেও ২ রান দিয়ে তুলে নিলেন দুটি উইকেট।

শেষ ২ ওভারে ১৭ রান চাই। বাংলাদেশের মতো শ্রীলঙ্কাও তখন ভালোমতোই ম্যাচে। কিন্তু নাসিরের বীরত্বে শেষ ওভারের স্নায়ুক্ষয়ী উত্তেজনায় আর যেতেই হলো না। থিসারা পেরেরার ওভার থেকেই এসে গেল ১৮ রান। ৩টি চার মেরে দলকে জয়ের চৌকাঠে নিয়ে রেখেছিলেন নাসির। শেষ বলে চার মেরে সেটি পার করিয়ে দিলেন সোহাগ গাজী। জয়ের হাত ধরে এল বড় একটা পুরস্কারও। নিউজিল্যান্ডকে টপকে ওয়ানডে র‍্যাঙ্কিংয়ের ৮ নম্বরে উঠে গেল বাংলাদেশ।

ম্যাচের ফল নির্ধারক ইনিংসটা খেলেছেন নাসির হোসেন। কিন্তু ২৭ বলে অপরাজিত ৩৩ রানের ইনিংসটি তো দিলশানের সেঞ্চুরিকে মিথ্যা করে দিতে পারে না। যে কারণে ম্যান অব দ্য ম্যাচ তিলকরত্নে দিলশানই। এই মাঠটা এমনিতেও তাঁর বড় পছন্দের। এখানে খেলা অষ্টম ওয়ানডেতে চতুর্থ সেঞ্চুরি তুলে নিলেন কাল। সেঞ্চুরি ছিল গত নভেম্বরে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ঠিক আগের ম্যাচটাতেও। এই মাঠে ব্যাটিং গড় ৯৩.৫০। বাংলাদেশের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজে কালই প্রথম আউট হলেন বলে যেটি পর্বতপ্রমাণ ২৪৮! ম্যান অব দ্য সিরিজও তাই তিনিই।

শ্রীলঙ্কার মাটিতে শ্রীলঙ্কাকে প্রথম হারানোর আনন্দে আলিঙ্গনাবদ্ধ নাসির হোসেন ও সোহাগ গাজী। ছবি: এএফপি

দিলশানকে ফিরিয়েছেন শাহাদাত। তবে একমাত্র এই সাফল্য অনেক বড় মূল্য দিয়ে। খরুচে বোলিংয়ের পুরোনো ‘সুনাম’ ধরে রেখে ১০ ওভারে দিলেন ৭১ রান। আরেক পেসার জিয়াউর রহমান ১০ ওভারে ৬৫। উইকেটে ঘাস ছিল, ছিল গতি আর বাউন্সও। কিন্তু থাকলেই তো হবে না, সেটি কাজে লাগানোর মতো পেসার তো চাই। যা করার করতে হলো তাই তিন স্পিনারকেই।

ক্যারিয়ারে চতুর্থবারের মতো ৫ উইকেট নিয়ে নায়ক আবদুর রাজ্জাক। তবে দুই পার্শ্বনায়কও কম উজ্জ্বল নয়। সোহাগ গাজী প্রথম ২ ওভারে মাত্র ৪ রান দেওয়ার পরও মুশফিকুর রহিম কী ভেবে তাঁকে সরিয়ে বল তুলে দিলেন মাহমুদউল্লাহর হাতে। স্লগ ওভারে শাহাদাতকে ফিরিয়ে আনার জন্য যদি মুশফিকুরের অধিনায়কত্বে কোনো নম্বর কাটা যায়, এর চেয়ে বেশি যোগ হওয়া উচিত এই সিদ্ধান্তের কারণে। টানা ১০ ওভার বোলিং করে সবচেয়ে কম রান দিলেন মাহমুদউল্লাহই। শেষ ওভারে ১৪ রান দিয়ে না ফেললে অবশ্য কৃতিত্বটা সোহাগ গাজীর নামের পাশে থাকে।

রাজ্জাক বাংলাদেশের প্রথম বোলার হিসেবে ওয়ানডেতে ২০০ উইকেট নিলেন। ম্যাচে ৫ উইকেট চতুর্থবারের মতো। পর পর দুই বলে শেষ দুটি উইকেট নিয়ে ‘২০০’ করেছেন বলেই নয়, এর বাইরেও এটির একটু আলাদা মহিমা আছে। এই প্রথম কোনো বড় দলের বিপক্ষে ৫ উইকেট। আগের তিনটিতেই প্রতিপক্ষ ছিল জিম্বাবুয়ে।

মূলত তিন স্পিনারের কল্যাণেই ইনিংসের মাঝখানে শ্রীলঙ্কার ইনিংসকে একটু এলোমেলো করে দেওয়া গিয়েছিল। কিন্তু শেষ তিন ওভারে ৩৯ রানের ঝড় তুলে শ্রীলঙ্কা ঠিকই গুছিয়ে নেয়। শেষ বলে ছক্কা মেরে তিন শ পার করে দেন লাহিরু থিরিমান্নে। তখন মনে হচ্ছিল, বাংলাদেশকে ম্যাচ থেকে ছিটকেও দিলেন।

বৃষ্টিদেবতা তখন মুচকি হাসছেন। সবকিছু ওলটপালট করে দিয়ে বাংলাদেশের জন্য উপহার পাঠাবেন বলে যে ততক্ষণে ঠিক করে ফেলেছেন তিনি!

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×