সবাইকে চমকে দিয়ে নিজেই ছেড়ে দিয়েছিলেন ক্লার্ক

বিশ্বকাপ ক্রিকেট ২০১৫

উৎপল শুভ্র

২৯ মার্চ ২০২১

সবাইকে চমকে দিয়ে নিজেই ছেড়ে দিয়েছিলেন ক্লার্ক

ফাইনালের আগের দিন নিউজিল্যান্ড অধিনায়ক ব্রেন্ডন ম্যাককালামের সঙ্গে ফটো সেশনে মাইকেল ক্লার্ক। ছবি: আইসিসি

বিশ্বকাপ ফাইনালের আগের দিন প্রেস কনফারেন্সে এসে কোনো অধিনায়ক যদি শুরুতেই ঘোষণা করে দেন, পরদিনের ম্যাচটিই হবে তাঁর জীবনের শেষ ওয়ানডে; সাংবাদিকদের চমকে যাওয়াই স্বাভাবিক। ৪৮ ঘণ্টা আগেও যেখানে এ নিয়ে প্রশ্নের উত্তরে বিন্দুমাত্র আভাস পাওয়া যায়নি এমন কিছুর। তাহলে হঠাৎই কেন এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন মাইকেল ক্লার্ক?

প্রথম প্রকাশ: ২৯ মার্চ ২০১৫। প্রথম আলো।

সংবাদ সম্মেলনে এসে কেউ কোনো প্রশ্ন করার আগেই দেখি কথা বলতে শুরু করেছেন মাইকেল ক্লার্ক! কী ব্যাপার?

ব্যাপার কী, তা প্রথম বাক্যটাতেই বলে দিয়েছেন অস্ট্রেলিয়া অধিনায়ক। পরদিনের বিশ্বকাপ ফাইনালই হবে তাঁর শেষ ওয়ানডে। ঠিক শুনলাম তো! নিজের কানে শুনেও সাংবাদিকদের যেন বিশ্বাস হচ্ছে না। ৪৮ ঘণ্টা আগেও অস্ট্রেলিয়ার ওয়ানডে দলে নিজের জায়গা নিয়ে প্রশ্নের জবাবে সেই পুরোনো উত্তরই দিয়েছেন, ‘আমার রেকর্ড অন্য যে কারও সঙ্গে তুলনা করার মতো। এ নিয়ে আমি একটুও চিন্তিত নই।’ সেই ক্লার্কই কেন হঠাৎ ওয়ানডে ছাড়ার ঘোষণা দিয়ে দিচ্ছেন? সেটিও কিনা বিশ্বকাপ ফাইনালের আগের দিন!

ওয়ানডে ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন, একটু পরই তা জানিয়ে দেবেন সবাইকে। এমসিজিতে স্মৃতিকাতর মাইকেল ক্লার্ক। ছবি: গেটি ইমেজেস

কথাটা মিথ্যা নয় যে, হ্যামস্ট্রিংয়ে চোট আর গত কিছুদিনের ব্যাটিং মিলিয়ে ওয়ানডে দলে তাঁর জায়গা নিয়ে প্রশ্ন উঠে গিয়েছিল। চোটের কারণে ২০১৩ ও ২০১৪ সালে অস্ট্রেলিয়ার খেলা ৪২টি ওয়ানডের মাত্র ১৭টিই খেলতে পেরেছেন। এটাও কারও অজানা নয়, ক্রিকেট-বিশ্বে অস্ট্রেলীয় নির্বাচকদের চেয়ে নিষ্ঠুর আর কিছু নেই। যাঁরা ইয়ান হিলির মতো উইকেটকিপারের নিজের মাঠে শেষ টেস্ট খেলার আকুতিকে অনায়াসে অগ্রাহ্য করতে পারেন। স্টিভ ওয়াহর মতো কালজয়ী অধিনায়ককে বলতে পারেন, এই টেস্টে ভালো না করলে কিন্তু তোমাকে আর আমরা রাখছি না। একটা ত্রিদেশীয় সিরিজে ব্যর্থতার পরই যাঁকে ওয়ানডে দল থেকেই ছেঁটে ফেলে অধিনায়কত্ব দিয়ে দিতে পারেন রিকি পন্টিংকে!

ডিন জোন্স, ডেভিড বুন, মার্ক টেলর, মার্ক ওয়াহ...অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটে সারি সারি উজ্জ্বল সব নাম নির্বাচকদের এই নিষ্ঠুরতার পরিচয় পেয়েছেন। অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটে কথাটা খুব চালু, ‘ট্যাপ অন দ্য শোল্ডার’। আক্ষরিক অর্থ, কাঁধে টোকা দেওয়া আর অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট অভিধানে, ‘ধন্যবাদ, তুমি অনেক দিয়েছ। তবে এখন তোমার যাওয়ার সময়। আমরা ভবিষ্যতের কথা ভাবছি।’ যুগে যুগে নির্বাচকদের নাম বদলেছে, কিন্তু তাঁদের নীতির কোনো পরিবর্তন হয়নি।

মাইকেল ক্লার্ককেও এমন একটা বার্তা নির্বাচকেরা দিতে যাচ্ছেন বলে কথা উড়ছিল বাতাসে। কিন্তু এমসিজির ভরা মজলিসে বিশ্বকাপ হাতে নিয়ে ফেললে সেটি কি খুব সহজ হতো তাঁদের জন্য? নির্বাচকেরা যতই ভবিষ্যতের কথা ভাবুন, যতই বাস্তববাদী হোন, গণমানুষের অনুভূতি তো কিছুটা হলেও তাঁদের প্রভাবিত করতে বাধ্য। মাইকেল ক্লার্ক বিশ্বকাপ জিতে গেলে সেটিতে ভর করেই হয়তো আরও বেশ কিছুদিন নিশ্চিন্তে কাটিয়ে দিতে পারতেন। নিজেও বলছেন, ‘আরও বছর দুয়েক আমি ওয়ানডে খেলে যেতেই পারতাম।’ তাহলে কেন ছেড়ে দিচ্ছেন?

ক্যারিয়ারজুড়েই ব্যক্তিগত স্বার্থের আগে দলের কথা ভেবেছেন। এখানেও কাজ করেছে সেই দর্শনই, ‘কিছুদিন ধরে অনেক ভেবে দেখলাম, আমার শরীরের যে অবস্থা, তাতে আগামী বিশ্বকাপ পর্যন্ত থাকার কোনো সম্ভাবনাই নেই। আমি যেমন গত বিশ্বকাপের পর অধিনায়কত্ব পেয়ে এই বিশ্বকাপের জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগ পেয়েছি, পরের অধিনায়কেরও সেই সুযোগটা প্রাপ্য। এ কারণেই ছেড়ে দিচ্ছি।’

এই ছবিটা বিশ্বকাপ জয়ের পরে। স্ত্রী কাইলির সঙ্গে কথা বলেই নিয়েছিলেন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। ছবি: গেটি ইমেজেস

সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেওয়ার ঘণ্টা খানেক আগে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার প্রধান নির্বাহী জেমস সাদারল্যান্ডকে সিদ্ধান্তটার কথা জানিয়েছেন। দলকে মাত্র মিনিট দশেক আগে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়টাও সুনির্দিষ্টভাবে জানিয়ে দিলেন। সিডনির সেমিফাইনালে ভারতকে হারিয়ে বাড়ি পৌঁছেছেন রাত সাড়ে ১২টার দিকে। স্ত্রী কাইলি তখন বিছানায়। তাঁর সঙ্গে আলোচনা করেই সিদ্ধান্তটা চূড়ান্ত করে ফেলেন ক্লার্ক। টেস্ট ক্যারিয়ারকে আরও দীর্ঘায়ু করাও যে সিদ্ধান্তের আরেকটি কারণ।

এখানেও ক্লার্ক ব্যতিক্রম। আধুনিক ক্রিকেটে অর্থের হাতছানিকে বড় মেনে যেখানে টেস্ট ক্রিকেট ছেড়ে দিয়ে সীমিত ওভারের খেলা চালিয়ে যাওয়াই ‘নিয়মে’ পরিণত, তিনি কিনা টেস্ট ক্রিকেটকেই বড় বলে মানলেন। ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টিও তাঁর অনেক পছন্দ, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁর কাছে টেস্ট ক্রিকেটটাই যে সবচেয়ে বড় আনন্দের আধার, সেটিও বিস্তারিত ব্যাখ্যা করলেন বিদায়বেলায়। গণমানুষ টেস্ট ক্রিকেটের চেয়ে ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টিই বেশি পছন্দ করে, তাহলে কেন টেস্ট ছেড়ে ওয়ানডে ক্যারিয়ার লম্বা করার কথা ভাবলেন না?

প্রশ্নটা হলো। চেহারাছবি আর ভাবভঙ্গিতে বালকসুলভ একটা নিষ্পাপ ব্যাপার থাকলেও ভেতরে যে কাঠিন্য লুকিয়ে, সেটিই বেরিয়ে এল উত্তরে, ‘গণমানুষ কী চায়, তা ভেবে আমি কখনো কোনো সিদ্ধান্ত নিইনি।’ জেমস সাদারল্যান্ড ক্লার্কের সিদ্ধান্তে বিস্ময়ের কথা জানিয়ে তাঁকে স্বীকৃতি দিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার ওয়ানডে ইতিহাসের অন্যতম ‘গ্রেট’ বলে। গ্রেট? হঠাৎ শুনলে একটু বিস্ময় জাগতে পারে। কিন্তু এই বিশ্বকাপে বাধ্য হয়ে নিজের যে রেকর্ডের কথা বারবার মনে করিয়ে দিয়েছেন, সেটি তো আসলে তা-ই বলে! ৪৪.৪২ গড়ে ৭৯০৭ রান, ওয়ানডেতে অস্ট্রেলিয়ার পক্ষে এর চেয়ে বেশি রান করেছেন মাত্র তিনজন—রিকি পন্টিং, অ্যাডাম গিলক্রিস্ট ও মার্ক ওয়াহ। ২০০৭ বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার হ্যাটট্রিক শিরোপা জয়ে তাঁর অবদানের কথাও কেন যেন ঝাপসা স্মৃতি হয়ে থাকে! ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিশ্বকাপে ৮৭.২ গড়ে ৪৩৬ রান এসেছিল ক্লার্কের ব্যাট থেকে। বিশ্বকাপ নিয়ে তাই গর্বভরে বলতে পারেন, ‘আমার তিনটি বিশ্বকাপের দুটিতে ফাইনাল আর একটি কোয়ার্টার ফাইনাল খেলেছি। কম তো পাইনি।’

এই ছবি ২০০৭ বিশ্বকাপের। অস্ট্রেলিয়ার হ্যাটট্রিক শিরোপা জয়ে বড় অবদান ছিল মাইকেল ক্লার্কের। ছবি: গেটি ইমেজেস

২০০৭ বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার হ্যাটট্রিক শিরোপা জয়ে  ক্লার্কের অবদানের কথাও কেন যেন ঝাপসা স্মৃতি হয়ে থাকে! ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিশ্বকাপে ৮৭.২ গড়ে ৪৩৬ রান এসেছিল ক্লার্কের ব্যাট থেকে।

২০১১ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বিদায় নেওয়া অস্ট্রেলিয়াকে আবার ওয়ানডে র‌্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে তুলে আনাও তো ক্লার্কের অধিনায়কত্বেরই জয়গান গাইছে। বিদায়বেলাটাও বেছে নিয়েছেন কী সুন্দর! আজ ফাইনালে এমসিজির দর্শকসংখ্যা আগের সব রেকর্ড ভেঙে দিতে পারে বলে প্রবল জল্পনা। শেষ পর্যন্ত সংখ্যাটা কত হবে, তা এখনো অজানা। তবে ৯০ হাজারের আশপাশে তো বটেই। প্রায় লাখো দর্শকের সামনে বিশ্বকাপ হাতে নিয়ে যদি বিদায় বলতে পারেন, ক্রিকেট ইতিহাসে তা রূপকথাসম হয়েই রইবে।

যদি বিশ্বকাপ হাতে না-ও ওঠে, তাতেই-বা কী! নিজের ওয়ানডে ক্যারিয়ার কখন শেষ হবে, সেই সিদ্ধান্ত নিজেই নিয়েছেন, এই তৃপ্তি তো আর ক্লার্কের কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারবে না কেউ!

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×