২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজ জয়ের পর মোহাম্মদ আশরাফুল ও সাকিব আল হাসানকে একসঙ্গে বসিয়ে যৌথ সাক্ষাৎকার

‘প্রমাণ হলো, আমরা ঠিক রাস্তাতেই ছিলাম’

উৎপল শুভ্র

৩১ মার্চ ২০২১

‘প্রমাণ হলো, আমরা ঠিক রাস্তাতেই ছিলাম’

সাকিব আল হাসান ও মোহাম্মদ আশরাফুল। ছবি: মোহাম্মদ মানিক

সময়টা মনে রাখুন। ২০০৯ সালের জুলাই। মোহাম্মদ আশরাফুল বাংলাদেশ দলের প্রতীক হয়ে আছেন অনেক দিন ধরেই। সাকিব আল হাসান হয়ে উঠছেন নতুন বাংলাদেশের প্রতীক। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ জিতেছে বাংলাদেশ। আশরাফুল রান না পেলেও সাকিবের তাতে বড় ভূমিকা। ওয়ানডে সিরিজ জয়ে ভূমিকা ছিল দুজনেরই। ডমিনিকায় ওয়ানডে সিরিজ জয়ের রাতে টিম হোটেলে আশরাফুল ও সাকিবকে একসঙ্গে বসিয়ে করা এই ইন্টারভিউয়ের কথাবার্তা শুধু ওই সিরিজেই সীমাবদ্ধ থাকেনি।

প্রথম প্রকাশ: ৩০ জুলাই ২০০৯। প্রথম আলো।

উৎপল শুভ্র: ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ জয়—আপনাদের কাছে এর অর্থ কী?

মোহাম্মদ আশরাফুল: আমি বলব, আমাদের ক্রিকেটের জন্য বড় একটা পাওয়া। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে (২০০৯) আয়ারল্যান্ডের কাছে হারার পর যে প্রতিক্রিয়াটা হয়েছিল...সবাই ভেবেছিল আমাদের ক্রিকেট এগোচ্ছে না। তবে আমরা যাঁরা খেলছিলাম, সবার ধারণা ছিল আমাদের টিমটা ঠিক রাস্তাতেই আছে। আমি মনে করি, এই রেজাল্টে সেটাই প্রমাণিত হলো।

সাকিব আল হাসান: আমরা জানতাম, আমরা উন্নতি করছি। কিন্তু সেটির একটা প্রমাণ তো লাগবে। এই সিরিজটাকে আমি মনে করি, সেই প্রমাণ। আমরা আগেও ভালো ক্রিকেট খেলছিলাম, শুধু রেজাল্টটা আসছিল না। এটা যে এসেছে, এটা খুবই বড় ব্যাপার।

শুভ্র: তবে সেই রেজাল্টটা যে দলের বিপক্ষে এসেছে, এটা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতেই পারে। এটা তো আসল ওয়েস্ট ইন্ডিজ নয়!

সাকিব: এমন বললে তো বাংলাদেশের বিপক্ষে অস্ট্রেলিয়া-দক্ষিণ আফ্রিকার রেকর্ডও গোনায় ধরা উচিত নয়। আমরা ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে খেলেছি, কারা খেলেছে, এটা আমাদের দেখার বিষয় না। ওরাও ভালো প্লেয়ার। ৫ উইকেট নিলে ওরাও বল উঁচু করে দেখায়, সেঞ্চুরি করলে ব্যাট উঁচু করে।

আশরাফুল: এটা ঠিক, এখানে আসার আগে এমন একটা অবস্থা হবে আমরা কল্পনাও করিনি। তবে আমাদের মধ্যে একটা জেদ ছিল। কে জানে, ক্রিস গেইলরা খেললেও আমরা হয়তো ভালো কিছু করতে পারতাম। আরেকটা ব্যাপার, এ ঘটনার কারণে পুরো চাপটাই কিন্তু আমাদের ওপর চলে এসেছিল। আমরা ভালো কিছু করতে না পারলে অনেক কথা হতো।

২০১১ বিশ্বকাপের সময় আশরাফুল ও সাকিব। ছবি: গেটি ইমেজেস

শুভ্র: শততম ওয়ানডেতে বাংলাদেশ ভারতকে হারিয়েছিল, ২০০ নম্বর ওয়ানডেতে হারাল ওয়েস্ট ইন্ডিজকে। আশরাফুলের ওই শততম ম্যাচের কথা কী মনে পড়ে? আর সাকিব, আপনি তখন কোথায় ছিলেন?

আশরাফুল: আফতাব খুব ভালো ব্যাটিং করেছিল, মনে আছে। আর মাশরাফি তো ব্যাটিং-বোলিং-ফিল্ডিংয়ে ছিল দুর্দান্ত। ওই ম্যাচের আরেকটা জিনিস মনে পড়ে। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে একটুও জায়গা খালি ছিল না। বাইরেও বোধহয় পাঁচ হাজার দর্শক ছিল।

সাকিব: আমি ওই ম্যাচটা দেখেছি কি না, মনে পড়ছে না। কোথায় ছিলাম, তা-ও মনে পড়ছে না। তবে রানা ভাইয়ের (প্রয়াত মানজারুল ইসলাম রানা) কাছে গল্প শুনেছি, স্টেডিয়ামে নাকি অনেক লোক ছিল। অত দর্শক নাকি বাংলাদেশ দেখেনি।

শুভ্র: অমন একটা ম্যাচ! অথচ সাকিব, আপনার তা মনে নেই! কী আশ্চর্য!

সাকিব: আমি আসলে তখন সেভাবে খেলা দেখতাম না। বাংলাদেশের খেলা তো আরও না। দেখলে দেখতাম পাকিস্তানের খেলা। সত্যি কথা বলতে বলেছেন সত্যিই বলছি (হাসি)।

শুভ্র: এখানে দুটি ওয়ানডেতেই বাংলাদেশের জয়ে আপনাদের বড় অবদান (দুজনেরই দুটি করে ফিফটি ছিল, সঙ্গে সাকিবের উইকেটও ছিল ২টি)। এই দুটি ম্যাচে নিজেদের পারফরম্যান্স সম্পর্কে কী বলেন?

আশরাফুল: টেস্ট সিরিজে তো একদমই বাজে খেলেছি (চার ইনিংসে ২৪ রান)। ওয়ানডে সিরিজের আগে প্র্যাকটিস ম্যাচটাও ভালো খেলিনি। আমি তাই একটু ডাউনই ছিলাম। তবে টিমমেট, কোচিং স্টাফ—সবাই আমাকে খুব সাপোর্ট দিয়েছে। বিশেষ করে ম্যাচের আগের দিন কোচ জেমি সিডন্সের কথাগুলো আমাকে খুব সাহায্য করেছে। ও বলেছে, ও বিশ্বাস করে আমি বাংলাদেশকে অনেক কিছু দিতে পারব। এই পারফরম্যান্সটা আমার নিজের জন্যই খুবই দরকার ছিল। কারণ আমি টিমকে কিছু দিতে পারছিলাম না। টেস্ট সিরিজে আমরা জিতলাম—সাকিব ভালো খেলল, মুশফিক ভালো খেলেছে, তামিম ভালো খেলেছে, বোলাররাও ভালো করেছে। অথচ এতগুলো ম্যাচ খেলার পরও আমি কিছু করতে পারিনি বলে আমার খুব খারাপ লেগেছে।

সাকিব: দুটি ইনিংসই অনেক হিসাব করে খেলতে হয়েছে। এত হিসাব করে কখনো খেলিনি। তবে যখন যেটা প্রয়োজন ছিল, সেটা করতে পেরেছি। টেস্টে শেষ ইনিংসটায় ৯৬ করলাম, বাংলাদেশ ম্যাচ জিতল। আত্মবিশ্বাসটা ছিল। টেস্টের তুলনায় ওয়ানডের উইকেট ছিল অনেক ভালো। খারাপ উইকেটে রান করে এলে ভালো উইকেটে ভালো করার আত্মবিশ্বাসটা বেড়ে যায়। ওটাই কাজ করেছে।

"সাকিবকে প্রথম দেখেছি ২০০৬ সালে সোনারগাঁও-ভিক্টোরিয়া ম্যাচে। ও প্রথম চার বলে তিনটা লাইফ পেয়েছে... "

শুভ্র: আশরাফুল, সাকিব তো আপনার অনেক জুনিয়র। ওকে আপনি প্রথম কবে দেখেছিলেন?

আশরাফুল: সাকিবকে প্রথম দেখেছি ২০০৬ সালে সোনারগাঁও-ভিক্টোরিয়া ম্যাচে। ও প্রথম চার বলে তিনটা লাইফ পেয়েছে... (হাসি)।

সাকিব: (হাসি) তাপস ভাই বল করছিলেন। প্রথম বলটা মেরেছি, ফার্স্ট স্লিপে রোকন ভাই (আল-শাহরিয়ার) ক্যাচ ফেলে দিয়েছেন। পরের বলটায় দ্বিতীয় স্লিপে কে যেন ক্যাচ ফেললেন। পরের বলে উইকেটকিপারকে সহজ ক্যাচ, সেলিম ভাই ফেলে দিলেন। পরের বলে বোল্ড!

আশরাফুল: আমি ওই ম্যাচে সোনারগাঁওয়ের ক্যাপ্টেন ছিলাম। ওর নাম অনেক শুনেছি...সাকিব-সাকিব...আমি ওর ব্যাটিং দেখে বললাম, এটা কী ধরনের ব্যাটিং। পরে ওই ম্যাচেই অবশ্য ও ভালো বোলিং করেছিল।

শুভ্র: সাকিব, আশরাফুলের সঙ্গে আপনার প্রথম পরিচয় কবে?

সাকিব: টিভিতেই দেখেছি প্রথম, পরে সামনাসামনি। সোনারগাঁওয়ের সঙ্গে ওই ম্যাচেই প্রথম দেখা হয়েছে। সেভাবে পরিচয় হয়নি।

শুভ্র: এই প্রশ্নটা সাকিবকে। আশরাফুল ক্যাপ্টেনসি হারালেন আর আপনি হঠাৎ ক্যাপ্টেন হয়ে গেলেন। আপনি যখন খেলা শুরু করেন, আশরাফুল তখনই বড় তারকা। এটা নিয়ে কোনো অস্বস্তি হয়নি?

সাকিব: আমি ওনার সঙ্গে খেলা-টেলা নিয়ে খুব কম কথা বলি। আমিও চাই না ওনাকে কিছু বলতে, উনিও আমাকে কিছু বলেন না। আমি ওনার সঙ্গে মজাই করি, খেলা বিষয়ে খুব একটা আলাপ হয় না।

শুভ্র: কিন্তু ক্যাপ্টেনসি করার সময় প্রথম প্রথম একটু অস্বস্তি হয়নি?

আশরাফুল: এটা আমি বলি। আমি যখন ক্যাপ্টেন ছিলাম, তখন ওর সঙ্গেও আলাপ করতাম। আমাদের টিমে এটা সব সময় ছিল। এখন রুবেলও যদি ক্যাপ্টেন হয়, আমাদের সম্পর্কে কোনো পরিবর্তন হবে না। আমাদের টিমের সবার মধ্যে খুব মিল আছে।

সাকিব: এখনো যা হয়, মুশফিক ভাই হয়তো এসে একটা কথা বলে। একসময় রকিবুল এসে বলে, রিয়াদ ভাই (মাহমুদউল্লাহ) বলে...সবার কথাই কিন্তু নেওয়া হয়। আমাদের দলে এটা খুব ভালো। সমস্যা কখন হয়—কেউ যদি অন্য রকম আচরণ করে। আমাদের টিমে ওরকম কেউ নেই।

"এখনো যেখানেই যাই, প্রথমে সবাই আশরাফুল-মাশরাফিকে খোঁজে। যেদিন উনি ব্যাটিং করেন, বিশ্বের কোনো বোলারকেই বোলার মনে হয় না।"

শুভ্র: ক্রিকেটার হিসেবে যদি একজনকে আরেকজন সম্পর্কে বলতে বলি। রাখঢাক করে বলা যাবে না কিন্তু, মনের কথাটাই বলতে হবে।

আশরাফুল: মনের কথাই বলছি, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ঢোকার পর থেকেই সাকিব সাকসেসফুল। ও যা করতে চায়, তা করতে পারে। ওর গেমপ্ল্যানটা বরাবরই একই রকম। আমার যেমন এখনো প্রবলেম, একেক দিন একেক রকম খেলি। আর ক্রিকেটার হিসেবে আমি বলব, একজন ক্রিকেটার হয়তো ভালো ব্যাটিং করে, কেউ ভালো বোলিং, কেউ বা ভালো ফিল্ডিং। ওর আল্লাহর রহমতে তিনটাই ভালো।

সাকিব: ক্রিকেটার হিসেবে ওনার সম্পর্কে কী বলব? বাংলাদেশের সব বড় বড় জয়েই ওনার অবদান ছিল। বাংলাদেশের ক্রিকেটকে মানুষ ওনার মাধ্যমেই চিনেছে। এখনো যেখানেই যাই, প্রথমে সবাই আশরাফুল-মাশরাফিকে খোঁজে। যেদিন উনি ব্যাটিং করেন, বিশ্বের কোনো বোলারকেই বোলার মনে হয় না।

শুভ্র: বাংলাদেশের ক্রিকেটে ওয়েস্ট ইন্ডিজে এই সাফল্যের প্রভাব কী হবে বলে মনে করেন?

সাকিব: এই সাফল্য আমাদের পরের একটা পর্যায়ে নিয়ে যাবে। দলে এখন দারুণ আত্মবিশ্বাস। আগে একটা উইকেট পড়লে সবাই মুখ কালো করে বসে থাকত। এখন গল্প করছে, হাসছে। ক্রিকেটে এই আত্মবিশ্বাসটা খুবই বড় ব্যাপার। ভবিষ্যতে এটা অনেক কাজে আসবে। আমরা যখন পেছনে ফিরে তাকাব, দেখব আমাদের এতগুলো জয় আছে, এমন ভালো ক্রিকেট খেলেছি—নিজেদের তখন বড়-বড় মনে হবে।

আশরাফুল: জয়টা একটা অভ্যাস। ২০০৭ বিশ্বকাপে আমাদের ভালো করার পেছনে বড় কারণ ছিল জিম্বাবুয়ে-কেনিয়ার সঙ্গে অনেক ম্যাচ আমরা জিতেছিলাম। ম্যাচ জেতাটা আমাদের অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। এই জয়গুলোও এমন কাজে লাগবে। এখন আমরা র‍্যাঙ্কিংয়ের নয় নম্বরে, ওয়েস্ট ইন্ডিজের পেছনে। সেরা আট দল খেলছে বলে এবার চ্যাম্পিয়নস ট্রফি খেলতে পারছি না। এই জয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে আমাদের ব্যবধান কমবে। আশা করব, আগামী বছর আমরা আট নম্বর হয়ে চ্যাম্পিয়নস ট্রফি খেলব।

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×