সেই ইডেন, এই ইডেন

উৎপল শুভ্র

৩ এপ্রিল ২০২১

সেই ইডেন, এই ইডেন

কলকাতার ইডেন গার্ডেন। ছবি: গেটি ইমেজেস

ভারতের বিনোদ কাম্বলি আর ইংল্যান্ডের পল টেলরের সঙ্গে আমার মিল কোথায়, জানেন? ওই দুজনের মতো আমারও ইডেন গার্ডেনে টেস্ট অভিষেক। ক্রিকেটারদের অভিষেক হতে পারলে সাংবাদিকের কেন নয়? ১৯৯৩ সালের জানুয়ারিতে প্রথম ইডেন দর্শনের পর আরও অনেক ম্যাচ কাভার করেছি এই মাঠে। সর্বশেষ ২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে। ইডেন গার্ডেন নিয়ে তখনই স্মৃতির সঙ্গে এই আড্ডা।

প্রথম প্রকাশ: ১৭ মার্চ ২০১৬। প্রথম আলো।

বাইরে অশ্বারোহী সাদা পুলিশ। মাঠে ঢোকার জন্য প্রায় আধা কিলোমিটার দূরের রাস্তা থেকে দুই পাশে বাঁশ দিয়ে পথ করে দেওয়া। পাশাপাশি অনেকগুলো তোরণ। যাতে গেট নম্বর লেখা। ওই পথই নিয়ে যাবে নির্দিষ্ট গেটে। না, ইডেন গার্ডেনের কিছুই বদলায়নি। ২৩ বছর আগে প্রথম যা দেখেছিলাম, এখনো সে রকমই আছে।

ভেতরটা অবশ্যই বদলেছে। তখন ছিল কংক্রিটের বেঞ্চ। এখন গ্যালারিতে চেয়ারের সারি। তাতে দর্শকদের আরাম হয়েছে ঠিকই, তবে একটা জায়গায় এমসিজিকে ওয়াকওভার দিতে হয়েছে। একটা সময় বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ধারণক্ষমতার মাঠ হিসেবে ইডেন আর এমসিজির একটা লড়াই ছিল। সেটি আর নেই।

বর্ণবাদের কারণে নিষিদ্ধ দক্ষিণ আফ্রিকার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রত্যাবর্তন এই ইডেনেই। সে ম্যাচে উপচে পড়েছিল গ্যালারি। সংখ্যাটা এক লাখ ছুঁয়েছিল বলেই দাবি। তা-ই যদি হয়ে থাকে, কোনো ক্রিকেট ম্যাচে সবচেয়ে বেশি দর্শকের রেকর্ড এটিই। ফুটবলে যেমন ১৯৫০ বিশ্বকাপের শেষ ম্যাচে মারাকানায় প্রায় দুই লাখ দর্শকের রেকর্ড কোনো দিন ভাঙবে না, ইডেনের ওই রেকর্ডও একই রকম অমরত্ব পেয়ে গেছে।

চেয়ার বসানোর পর ইডেনে এখন ৬৭ হাজারের মতো দর্শকের ঠাঁই হয়। দর্শকদের আওয়াজের কথা বললে অবশ্য এমসিজির চেয়ে ধারণক্ষমতার দিক থেকে প্রায় ২৫ হাজার পিছিয়ে থাকা ইডেনই হয়তো এগিয়ে। এটা অবশ্য অবাক করার মতো কিছু নয়। চিৎকার-চেঁচামেচি করার দিক থেকে উপমহাদেশের দর্শকদের সঙ্গে একমাত্র ওয়েস্ট ইন্ডিজেরই একটু তুলনা চলে। ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের দর্শকেরা আনন্দ প্রকাশে অনেক পরিমিত।

কাল বাংলাদেশ-পাকিস্তান ম্যাচের সময় প্রেসবক্সের কাচঘেরা ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের এক সাংবাদিক বলছিলেন, গ্যালারির চার  ভাগের এক ভাগও ভরেনি, তাতেই এমন আওয়াজ। পুরো গ্যালারি ভরলে না জানি কী হবে!

সেই অভিজ্ঞতা আমার আছে। নব্বইয়ের দশকে এখানে নিয়মিত ম্যাচ কাভার করেছি। ৯০ হাজার দর্শকে ঠাসা ইডেন গার্ডেনের গগনবিদারী গর্জন শুনতে প্রায়ই গিয়ে দাঁড়িয়েছি প্রেসবক্সের বাইরে। সে এক অভিজ্ঞতা বটে!

গ্যালারি আধুনিক হয়েছে, তবে তাতে আমাদের কী! ইডেনের প্রেসবক্স যে সেই মান্ধাতা আমলেই পড়ে আছে। ক্লাব হাউসের দর্শকদের মাঝখান দিয়ে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে ওঠো, তার পর আবার লোহার সিঁড়ি। সেই প্রেসবক্সও মহাশূন্যের প্রায় কাছাকাছি। বিশ্বের বিখ্যাত সব স্টেডিয়ামের মধ্যে ইডেনই একমাত্র ব্যতিক্রম, যেখানে এতটা ওপরে ওঠার জন্য এখনো কোনো লিফট নেই। পদযুগলই ভরসা। লেখার এই অংশটা দেখে কলকাতার এক সাংবাদিক একটু সংশোধনী দিলেন। ইডেনের স্বত্বাধিকারী ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অব বেঙ্গলের মূল ভবনে তিনতলায় ওঠার জন্য একটা লিফট নাকি আছে।

এটা ইডেন গার্ডেনের প্রেস কনফারেন্স রুম। অধিনায়কেরা আসতে দেরি করছিলেন বলে লেখাটা একটু এগিয়ে রাখছিলাম

ওয়াশরুমে যাওয়াও এক যন্ত্রণা। সিঁড়ি বেয়ে নেমে আবারও ক্লাব হাউসের দর্শক ডিঙিয়ে নিচে নামতে হয়। সেই ওয়াশরুমও অন্য সব স্টেডিয়ামের প্রেসবক্সের মতো সাংবাদিকদের জন্য সংরক্ষিত নয়। সবার জন্য অবারিত দ্বার। এমনই ভিড় যে, যতবার যাই, ততবারই প্রকৃতির কাছে প্রার্থনা করি। 'তিনি' যত কম ডাকেন, ততই ভালো। খাওয়ার জায়গায়ও ঠাসাঠাসি ভিড়। চেয়ার-টেবিলে বসে খাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। প্রেসবক্সে বসাও গাদাগাদি করে। দুই টেবিলের মাঝখানের জায়গাটা এমনই সংকীর্ণ যে, মেদভুঁড়িসম্পন্ন সাংবাদিকের এখানে না আসাই ভালো! 

১৯৯৩ সালে প্রথম যখন এখানে এসেছিলাম, এর কোনো কিছুই সমস্যা বলে মনে হয়নি। তখন ইডেনের প্রেসবক্সে বসতে পেরেছি, এই আনন্দেই বিভোর ছিলাম। কিন্তু ক্রিকেট-বিশ্ব ঘুরে ফেলার পর এখন এসব শুধু চোখেই লাগে না, কাজ করতেও বড় যন্ত্রণা হয়। মিরপুরকে মনে হয় স্বর্গ। বাংলাদেশ ঘুরে আসা ভারতীয় সাংবাদিকেরাও যাতে একমত। মিরপুর স্টেডিয়ামের প্রেসবক্স অবশ্য আরেকটা জায়গাতেও এগিয়ে, যেখানে এগিয়ে না থাকলেই ভালো হতো। বিশ্বের আর কোনো প্রেসবক্সে সাংবাদিকেরা এমন সাধারণ দর্শকদের মতো হাততালি দেন না, প্রায় সারাক্ষণই কিচিরমিচির তো আছেই। তাতে অবশ্য একটা সুবিধা হয়। সহ্যক্ষমতা বাড়ে। মিরপুর প্রেসবক্সে বসে কেউ লিখতে পারলে তাঁর আর কোনো সমস্যা নেই। সে বাজারে বসেও লিখতে পারবে।

ইডেনের অনেক কিছুই বদলায়নি বলছিলাম। এরই একটি ম্যাচ শুরুর আগে ইডেনের পাশের ময়দানে কলকাতা স্পোর্টস জার্নালিস্টস ক্লাবে যাওয়া। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ম্যাচ টিকিট নিতে হচ্ছে ওখানে। অ্যাক্রিডিটেশন কার্ডের চল হওয়ার আগে সাংবাদিকদেরও প্রেসবক্সে ঢোকার জন্য টিকিট দেওয়া হতো। ইডেনের যেকোনো আন্তর্জাতিক ম্যাচের টিকিট নিতে হতো ওখান থেকেই। সেই টিকিট দেওয়া না-দেওয়ার ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তও ছিল ওই স্পোর্টস জার্নালিস্টস ক্লাবের। বাংলাদেশে সবকিছুর মতো ক্রীড়া সাংবাদিকদের মধ্যেও বিভক্তি। ক্রীড়া সাংবাদিকদের তিন-তিনটি সংগঠন। যা শুনে কলকাতার ক্রীড়া সাংবাদিকেরা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকেন। যে চাউনির সামনে বড় বিব্রত লাগে।

অনেক আশা নিয়ে বাংলাদেশ থেকে উড়ে আসা সমর্থকদেরও কাল পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচশেষে অমন একটু কাঁচুমাচু ভাব করেই গ্যালারি ছাড়তে হলো। গত পরশু থেকেই কলকাতার রাস্তাঘাটে বাংলাদেশের জার্সি পরা মানুষ হঠাৎই অনেক বেড়ে গেছে। স্টেডিয়ামের আশপাশের হোটেল সুযোগ বুঝে দাম চড়িয়ে দিয়েছে। আগে থেকে বুক করে রেখেছিলাম বলে রক্ষা। নইলে ইডেন থেকে হাঁটা দূরত্বের যে হোটেলে প্রতি রাত সাত হাজার রুপিতে আছি, গতকাল সকালে সেটিরই ভাড়া পোলভল্টে লাফিয়ে ২০ হাজার রুপি হয়ে যেতে দেখলাম!

আগামীকাল ও পরশু অঙ্কটা নাকি আরও বাড়বে। পরশুই যে ইডেনে মহারণ। ভারত-পাকিস্তান!

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×