`পারফেক্ট টেন` নাদিয়া কোমানেচকে কিনা চিনতেই পারিনি!

এথেন্স অলিম্পিক ২০০৪

উৎপল শুভ্র

৬ এপ্রিল ২০২১

`পারফেক্ট টেন` নাদিয়া কোমানেচকে কিনা চিনতেই পারিনি!

বিশ্বের সব মানুষের হৃদয়ে ঢুকে যাওয়া ১৯৭৬ মন্ট্রিয়ল অলিম্পিকের সেই কিশোারী। নাদিয়া কোমানেচ। ছবি: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস

রোমানিয়ান দলের সঙ্গে এমনভাবে মিশে ছিলেন যে, তাঁকে মনে হচ্ছিল এই দলেরই কেউ। ১৯৭৬ সালের মন্ট্রিয়ল অলিম্পিকে প্রথম জিমন্যাস্ট হিসেবে ‘পারফেক্ট টেন’ পেয়ে সবার হৃদয়ে ঢুকে গিয়েছিল ১৪ বছরের যে কিশোরী, ৪২ বছরের নাদিয়া কোমানেচের মধ্যেও কি তাঁকেই খুঁজলাম! এ কারণেই কি চিনতেই পারিনি তাঁকে?

প্রথম প্রকাশ: ২৫ আগস্ট ২০০৪। প্রথম আলো।

ক্যাটালিনা পোনর আর ড্যানিয়েলা সফরোনিকে অমন হাসতে দেখেও অন্য কিছু মনে হয়নি। একটু আগে ফ্লোর এক্সারসাইজে সোনা আর রুপা জিতেছেন রোমানিয়ার এই দুই জিমন্যাস্ট। তাদের হাসিতে ওই সোনা আর রুপাই দেখছিলাম। কিন্তু পাশেই ভিড় করে থাকা রোমানিয়ার বাকি জিমন্যাস্টরাও প্রতিটি প্রশ্নেই এমন হাসছেন কেন?

রহস্যটা ঘোচালেন ১৩ বছর ধরে রোমানিয়ান জিমন্যাস্ট দলের কোরিওগ্রাফার মারিয়া বিটাং। এতক্ষণ তিনিও হাসছিলেন, হাসতে হাসতেই বললেন, ‘যাঁকে নিয়ে এত প্রশ্ন করছেন, সে তো এখানেই আছে।’ এ এক বিষম চমক! ‘নাদিয়া কোমানেচি এখানেই আছেন!’ বিটাং সংশোধন করে দিয়ে বললেন, “কোমানেচি নয়, কোমানেচ, ‘আই’টার কোনো উচ্চারণ নেই।”

এবার দেখলাম, সত্যিই একটু দূরে দাঁড়িয়ে নাদিয়া কোমানেচি, স্যরি কোমানেচ। রোমানিয়ান দলের সঙ্গে এমনভাবে মিশে ছিলেন যে, তাঁকে মনে হচ্ছিল এই দলেরই কেউ। ১৯৭৬ সালের মন্ট্রিয়ল অলিম্পিকে প্রথম জিমন্যাস্ট হিসেবে ‘পারফেক্ট টেন’ পেয়ে সবার হৃদয়ে ঢুকে গিয়েছিল ১৪ বছরের যে কিশোরী, ৪২ বছরের নাদিয়া কোমানেচের মধ্যেও কি তাঁকেই খুঁজলাম? কারও কারও জীবন একটা দৃশ্যে আটকে যায়। নাদিয়া কোমানেচ মানেই তো সাদা ফুল স্লিভ গায়ে ১৪ বছরের ওই কিশোরী! ব্যালান্স বিম আর আনইভেন বারে সাত-সাতবার ‘পারফেক্ট টেন’ স্কোর করার বিস্ময়!

স্কোর ভেসে উঠেছে ১.০০, অথচ তাঁর স্কোর ১০! কেউ যে `পারফেক্ট টেন`ও করতে পারেন, সেদিনের আগ পর্যন্ত তো তা-ই ছিল অজানা। ছবি: আইওসিল

তিনি এথেন্সে, জানা ছিল না। তারপরও গত পরশু আর্টিস্টিক জিমন্যাস্টিকসের সমাপনী রাতে নাদিয়া কোমানেচই টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন অলিম্পিঙ্ক ইনডোর হলে। এই প্রজন্মের রোমানিয়ান জিমন্যাস্টদের কাছেও কি নাদিয়া কোমানেচ একই রকম প্রেরণা— এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই সেখানে যাওয়া।

নাদিয়ার দেখানো পথ দিয়ে এখনো হাঁটছে রোমানিয়ান মেয়েরা। এথেন্সেও মেয়েদের দলগত শিরোপা রোমানিয়ার। সেই দলের সবচেয়ে বড় তারকা ক্যাটালিনা পোনর গত পরশু ব্যালান্স বিম আর ফ্লোর এক্সারসাইজেও সোনা জিতে এখন জিমন্যাস্টিকসের নতুন রানী। ২৮ বছর আগের মন্ট্রিয়ল অলিম্পিকের কথা জানেন তিনি? জানেন নাদিয়া কোমানেচের ‘পারফেক্ট টেন’-এর কথা? প্রশ্নটা শুনে পোনর অবাক, ‘নাদিয়ার কথা জানব না কেন? আমরা সবাই জানি।’

নাদিয়ার ওই কীর্তির সময় তো তাদের কারো জন্মই হয়নি! ‘তাতে কী, আমাকে আমার বাবা-মা নাদিয়ার কথা বলেছেন। আমি মন্ট্রিয়ল অলিম্পিকের ভিডিও-ও দেখেছি’— এবার উত্তর দিলেন ফ্লোর এক্সারসাইজে রুপাজয়ী ড্যানিয়েলা সফরোনি। পোনর-সফরোনির মতো রোমানিয়ার বাকি জিমন্যাস্টদের কাছে নাদিয়া কোমানেচ এক অনুপ্রেরণার নাম। মারিয়া বিটাংয়ের কাছেই জানা গেল, রোমানিয়ার জিমন্যাস্টিকস স্কুলগুলোতে এখনো নাদিয়ার মন্ট্রিয়ল অলিম্পিকের ভিডিও দেখানো হয়। কোচিংয়ের অংশ হিসেবে নয়, কারণ জিমন্যাস্টিকস এখন আর আগের মতো নেই। নাদিয়ার ভিডিও দেখানো হয় ‘পারফেক্ট টেন’ও যে সম্ভব, তা বোঝাতে। রোমানিয়া দলের সহকারী কোচ লুসিয়ান সান্ডুই বললেন আসল কথাটা, ‘নাদিয়ার আগে-পরে রোমানিয়ায় অনেক ভালো জিমন্যাস্ট এসেছে। কিন্তু নাদিয়া হলো আইকন।’

সেই ‘আইকন’ অলিম্পিক এলেই যেন রক্তে একটা নাচন টের পান। এ কারণেই বার্সেলোনা, আটলান্টা, সিডনির মতো এথেন্সের জিমন্যাস্টিক হলেও হাজির নাদিয়া কোমানেচ। ‘রোমানিয়া দলকে উৎসাহ দিতেই আসি। আমার ভালো লাগে।’ এই যে এত বছর পরও রোমানিয়ান জিমন্যাস্টদের মুখে মুখে তাঁর কথা, কেমন লাগে এতে? নাদিয়ার উত্তর, ‘আমার ভালো লাগে না বললে মিথ্যে বলা হবে।’ এ নিয়ে অনেক কথা বলেছেন বলেই কি না, মন্ট্রিয়ল অলিম্পিকের ‘পারফেক্ট টেন’ নিয়ে আলোচনা করতে স্পষ্টতই অনীহা, ‘এটা অনেক আগের কথা। এখন ওদের নিয়ে কথা বলুন।’ ‘ওদের’ মানে কাদের, পোনর-সফরোনিদের দিকে আঙুল তুলে বুঝিয়ে দিলেন তা-ও।

নাদিয়া কোমানেচ থেকে ক্যাটালিনা পোনর...মাঝখানে জিমন্যাস্টিকসের আরও কত তারকা বেরিয়ে এসেছে রোমানিয়া থেকে, রহস্যটা কী? রোমানিয়া দলের হেড কোচ অক্টাভিয়ান বেলু পুরো কৃতিত্বই দিতে চান সিস্টেমের ধারাবাহিকতাকে, ‘রোমানিয়ায় আগের মতোই সরকার জিমন্যাস্টিকসকে পৃষ্ঠপোষকতা করে। ৯-১০টি জিমন্যাস্টিকস স্কুল আছে আমাদের, প্রতিটিতে ১৪-১৫ জন করে ছাত্র। ছোটবেলা থেকেই ওরা সেখানে থাকে।’

২০০৪ এথেন্স অলিম্পিকে নাদিয়া কোমানেচ। রোমানিয়ার জিমন্যাস্টিকস কোচ অক্টাভিয়ান বেলুর সঙ্গে। ছবি: গেটি ইমেজেস

ছোটবেলা মানে খুবই ছোটবেলা। ৪ ফুট ৯ ইঞ্চি উচ্চতার দারুণ মিষ্টি মেয়ে ড্যানিয়েল সফরোনির জিমন্যাস্টিকস স্কুলে যাওয়া শুরু চার বছর বয়সে। ক্যারোলিনা পোনরের এর চেয়েও দু মাস ছোট থাকতেই। এই যে বিমে-বারে-ফ্লোরে গিয়ে যা বলছেন, তা-ই শুনছে শরীর, এর পেছনে অনেক সাধনা। পোনর-সফরোনি দুজনই প্রতিদিন ৫-৬ ঘণ্টা প্র্যাকটিস করেন, বাকি মেয়েরাও তা-ই। বাইরে ছড়িয়ে থাকা এত সব আকর্ষণ তাদের টানে না? পোনরের উত্তর, ‘বাকি যেকোনো কিছুর চেয়ে আমার জিমন্যাস্টিকসই ভালো লাগে।’

একসময় বরিস বেকারের কোচ হিসেবে সবাই চিনত তাঁকে, মোটা গোঁফের সেই ইয়ন টিরিয়াক এখন রোমানিয়ান অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি। টিরিয়াক জানাচ্ছেন, অলিম্পিকের খেলাগুলোর মধ্যে এই জিমন্যাস্টিকস ছাড়া রোয়িংয়েই শুধু ভালো রোমানিয়া। সমাজতন্ত্রের পতনের পরও রোমানিয়ার ক্রীড়াঙ্গন আগের মতোই সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় চলছে, শুধু ফুটবলটাকেই তুলে দেওয়া হয়েছে মুক্তবাজার অর্থনীতির হাতে। জিমন্যাস্টিকস চালায় জিমন্যাস্টিকসের লোকেরাই, এত বছর ধরে চলে আসা ধারাবাহিকতাই জন্ম দিয়ে যাচ্ছে ক্যাটালিনা পোনরদের।

পদ্ধতির ধারাবাহিকতারই ফসল। তবে নাদিয়া কোমানেচও আছেন। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে রোমানিয়ান মেয়েদের প্রেরণা হয়ে।

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×