অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলীর একান্ত সাক্ষাৎকার

'ক্যাপ্টেনসিটাকে কখনো জীবন-মরণ ব্যাপার বলে ভাবিনি'

উৎপল শুভ্র

১৪ এপ্রিল ২০২১

'ক্যাপ্টেনসিটাকে কখনো জীবন-মরণ ব্যাপার বলে ভাবিনি'

সৌরভ গাঙ্গুলী

ইন্টারভিউটা নেওয়া ২০০২ সালের সেপ্টেম্বরে। ভারত চ্যাম্পিয়নস ট্রফির ফাইনালে উঠে গেছে। তাতে আরও বেশি করে বলাবলি হচ্ছে, সৌরভ গাঙ্গুলী ভারতের সবর্কালের সেরা অধিনায়ক কি না। ইন্টারভিউটা ছিল তাই মূলত অধিনায়ক সৌরভের। কলম্বাের তাজ সমুদ্র হােটেলে তাঁর রুমে বিছানায় আধশােয়া হয়ে নিজের অধিনায়কত্ব-দর্শনই তাই বেশি ব্যাখ্যা করতে হয়েছিল তাঁকে।

প্রথম প্রকাশ: সেপ্টেম্বর, ২০০২। প্রথম আলো।

উৎপল শুভ্র: অনেকেই বলতে শুরু করেছে যে, আপনি ভারতের সর্বকালের সেরা অধিনায়ক। এ ধরনের কথা শুনতে কেমন লাগে? ভালো না লাগার তো কোনো কারণ নেই, তারপরও আপনার মুখ থেকে শুনতে চাই।

সৌরভ গাঙ্গুলী: শুনতে তে অবশ্যই ভালাে লাগে। তবে আমি ওসব নিয়ে বেশি ভাবি না। টিম ভালাে খেলছে, এটাই সবচেয়ে বড় কথা।

শুভ্র: আপনার অধিনায়কত্বের দর্শনটা কি ব্যাখ্যা করা যায়?

সৌরভ: আমি যখন অধিনায়ক হই, তখনই বলেছি, 'আ ক্যাপ্টেন ইজ অ্যাজ গুড অ্যাজ হিজ টিম'। একজন ভালাে ক্যাপ্টেন হয়তাে ৮০-কে ১০০ করতে পারে, তার বেশি কিছু নয়। এই তাে এখানে নাসের হুসেইন কোয়ার্টার ফাইনালের আগে (২০০২ চ্যাম্পিয়নস ট্রফি) এত থিওরি কপচাল, করতে পারল কিছু? বােলাররা খারাপ করেছে, ওর আর কিছুই করার ছিল না। সে কারণে ইন্ডিয়ার ক্যাপ্টেন হওয়ার পর আমার প্রথম নজর ছিল, টিমটাকে ঠিকমতাে তৈরি করা। ঠিক জায়গায় ঠিক প্লেয়ার রেখে টিমটাকে তৈরি করা। এবার টিমটা আস্তে আস্তে একটু দাঁড়াচ্ছে।

শুভ্র: আপনি যুবরাজ, হরভজন এমন অনেক খেলােয়াড়ের জন্য লড়াই করেছেন, যাঁরা শেষ পর্যন্ত নিজেদের প্রমাণ করেছে। আপনার প্রতিভা চেনার চোখেরও প্রশংসা হচ্ছে। কী দেখে আপনি লড়াইটা করেছিলেন?

সৌরভ: ট্যালেন্ট দেখে, অ্যাবিলিটি দেখে। একটা ছেলের খেলা দেখলেই তাে বােঝা যায় যে, কেমন খেলে। যেমন এই টুর্নামেন্টে তােমাদের নতুন একটা জোরে বােলার দেখলাম, নাম বােধ হয় তালহা (তালহা জুবায়ের), ও অনেক দিন বাংলাদেশকে সার্ভিস দেবে।

শুভ্র: গত বছর (২০০১) অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সেই ঐতিহাসিক সিরিজটাতে ফিরি। আপনি স্টিভ ওয়াহর সঙ্গে যেভাবে কথার লড়াইয়ে নেমেছিলেন, সেটি অস্ট্রেলীয়দের জন্য ছিল বিস্ময়। এটা কি সুচিন্তিত একটা কৌশল ছিল?

সৌরভ: খেলার মাঠে এরকম হয়ই। সবাই ভালাে করার জন্য প্রাণপণ লড়ে। তবে স্টিভ ওয়াহ ভালাে অধিনায়ক। ওদের দলটাও ছিল শক্তিশালী। প্রথম টেস্টে হেরে যাওযার পর সিরিজে ফিরে আসতে আমাদের জন্য সেটাই ছিল একমাত্র পথ। আমরা ভালােমতােই ফিরে এসেছিলাম।

শুভ্র: তা তো এসেছিলেনই। কিন্তু আমার প্রশ্নটা ছিল, মাঠের বাইরে স্টিভ ওয়াহকে যেভাবে আপনি পাল্টা আক্রমণ করছিলেন, সেটি কি ভেবে-চিন্তেই করা?

সৌরভ: কিছুটা তা-ই। তা ছাড়া আমি জানতাম যে, আমরা ভালাে দল। ওই সিরিজের প্রথম টেস্টে আমরা হেরেছিলাম অ্যাডাম গিলক্রিস্টের অসাধারণ একটি ইনিংসের কারণে। তবে তখনই লক্ষ করেছিলাম, বল স্পিন করতে শুরু করলেই অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটসম্যানদের একটু নড়বড়ে দেখায়।

২০০১ সালের সেই ঐতিহাসিক সিরিজে দুই অধিনায়ক স্টিভ ওয়াহ ও সৌরভ গাঙ্গুলী। ছবি: গেটি ইমেজেস

শুভ্র: ইডেনে ফলো অন করার পরও অবিশ্বাস্য ওই জয়ই কি আপনার ক্যাপ্টেনসি ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট?

সৌরভ: আমি কখনােই ক্যাপ্টেনসিটাকে আমার জীবন-মরণ ব্যাপার বলে ভাবিনি। হলে হলাে, না হলে আমি খেলােয়াড় হিসেবে খেলব। ইন্ডিয়ার পক্ষে খেলাটাই তাে আসল। আমি আজ ক্যাপ্টেন, কাল অন্য কেউ হবে। এজন্যই আমি কখনাে বাড়তি চাপ নিই না। এই ম্যাচ হেরে গেলে আমার ক্যাপ্টেনসি চলে যাবে, ওই ম্যাচ হারলে ক্যাপ্টেনসি চলে যাবে—এ রকম কিছু কখনোই ভাবি না আমি। এভাবে ভাবার কোনো মানেও হয় না।

শুভ্র: ক্যাপ্টেনসি চলে যাওয়ার ব্যাপার নয়, কলকাতা টেস্টে অমন জয়, তা-ও আবার অস্ট্রেলিয়ার মতো দলের বিপক্ষে....এটা  নিশ্চয়ই ক্যাপ্টেন হিসেবে আপনার আত্মবিশ্বাসটা অনেক বাড়িয়ে দিয়েছিল?

সৌরভ: তা তাে অবশ্যই। অনেক সময় এমন তো হয়ই, টিম হেরে গেলেই নতুন ক্যাপ্টেন। তার ওপর সেটা ছিল হােম সিরিজ।

শুভ্র: শুরু করার সময় আপনার প্রিয় ক্যাপ্টেন কে ছিলেন?

সৌরভ: সে রকম কোনাে প্রিয় ক্যাপ্টেন ছিল না গো। তবে ক্যাপ্টেন হিসেবে স্টিভ ওয়াহকে ভালাে লাগে। 

শুভ্র: স্টিভ ওয়াহর ক্যাপ্টেনসির কোন দিকটি সবচেয়ে ভালাে লাগে?

সৌরভ: সবকিছু মিলিয়েই। যেভাবে ও দলটাকে চালায়, ওর পেশাদার মানসিকতা।

শুভ্র: আপনি অধিনায়ক হওয়ার পর ভারতীয় দলে বড় কোনাে পরিবর্তনের কথা বলতে পারেন?

সৌরভ: ক্রিকেট নিয়ে আমার চিন্তা-ভাবনার ছাপ দলের মধ্যে এসেছে। যেমন রাহুল দ্রাবিড়কে দিয়ে কিপিং করানাে, টেন্ডুলকারের ব্যাটিং লাইনআপ পরিবর্তন। আমি তাে আর ওদের খেলা শেখাতে পারি না। খেলা শেখানাের দরকারও পড়ে না। এই লেভেলে এসে সবাই জানে কী করতে হয়।

শচীন টেন্ডুলকার ও রাহুল দ্রাবিড়ের সঙ্গে। টেন্ডুলকারকে ওপেনিং থেকে সরিয়ে চারে খেলিয়েছিলেন সৌরভ, দ্রাবিড়কে দিয়ে করিয়ে ছিলেন উইকেটকিপিং। ছবি: গেটি ইমেজেস

শুভ্র: টেন্ডুলকারকে চার নম্বরে নামিয়ে দেওয়া নিয়ে ভারতে অনেক কথাবার্তা হচ্ছে।

সৌরভ: ভারতবর্ষে ক্রিকেট এত বড় খেলা যে, সব মুভ নিয়েই কথাবার্তা হবে। দ্রাবিড়ের কিপিং নিয়ে হয়েছে, টেন্ডুলকারের ব্যাটিং নিয়ে হবে, কদিন বাদে শেবাগ রান না পেলে তা নিয়েও হবে। ভারতবর্ষে এই জিনিস চলতেই থাকবে।

শুভ্র : এসব কথাবার্তা বা সাংবাদিকদের লেখা আপনাকে কতটা প্রভাবিত করে?

সৌরভ: খুব একটা না। কোনাে লেখা পড়লেই বােঝা যায় তা সৎভাবে লেখা হয়েছে, নাকি কেউ প্রতিশােধপরায়ণ হয়ে লিখেছে। এত দিন খেলে এটা তাে বুঝতেই পারি।

শুভ্র: '৯২ সালে অস্ট্রেলিয়া সফর শেষে বাদ পড়ার পর '৯৬-এ আবার ভারতীয় দলে  ফিরলেন। সে সময় কখনাে কি দূরতম কল্পনাতেও ভেবেছিলেন, একদিন ভারতের অধিনায়ক হবেন?

সৌরভ: '৯২-য়ের পর ভেবেছিলাম আর কোনোদিন ভারতের হয়েই খেলা হবে না, ক্যাপ্টেন দূরের কথা। খেলি, তারপর তাে ক্যাপ্টেন।

শুভ্র: আপনি ভারতের দলে খেলতে শুরু করার সময়ই টেন্ডুলকার ভারতে বিরাট ব্যাপার। দুবার অধিনায়ক হলাে, এখন আপনার অধিনায়কত্বে খেলছে। ওর দিকে কি আলাদা একটু নজর দিতে হয়? এত বড় ব্যাটসম্যান, একটা 'ইগাে' তাে থাকতেই পারে।

সৌরভ: একদমই ইগাে নেই। হি হ্যাজ নাে ইগাে । আমরা যথেষ্ট পরিণত, একজন আরেকজনকে বিশ্বাস করি। তাই অনেক রকম কথাবার্তা হলেও তা আমাদের সম্পর্কে প্রভাব ফেলে না।

শুভ্র: আপনার ব্যাটিংয়ে আসি। নিশ্চয়ই খেলতে খেলতে অনেক পরিবর্তন হয়েছে তাতে?

সৌরভ : তা তাে হয়েছেই। খেলতে খেলতে তা হয়ই। তবে মেন্টাল চেঞ্জটাই আসল, ব্যাটিংয়ের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। খেলা হয়তাে উনিশ-বিশ, এই লেভেলে টেকনিক সবারই আছে। মনটাকে ঠিক করে কীভাবে আপনি পরিস্থিতি অনুযায়ী খেলবেন, সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

শর্ট বলে তাঁর দুর্বলতা নিয়ে এত কথার জবাব দিয়েছিলেন ২০০৩-০৪ অস্ট্রেলিয়া সফরে। এই ইন্টারভিউ অবশ্য এর আগে। ছবি: গেটি ইমেজেস

শুভ্র: শর্ট বলে আপনার দুর্বলতা নিয়ে অনেক কথা হয়। দু-একটি ইনিংস খারাপ খেললেই ফর্মে নেই চিৎকার শুরু হয়। আপনি কি এসবকে যৌক্তিক মনে করেন?

সৌরভ: দেখুন, আমার টেস্ট অ্যাভারেজ এখন ৪৪। আউট অব ফর্মে থাকা একজন ব্যাটসম্যানের জন্য অ্যাভারেজটা তাে ভালােই, তা-ই না? এখন যেমন বলা হচ্ছে শচীন আউট অব ফর্ম। ভারতবর্ষে আউট অব ফর্ম, ইন ফর্ম এগুলাে নিয়ে কথা চলতেই থাকবে। ক্রিকেট নিয়ে ভারতে এত কথা হয়, এত মানুষ কথা বলে যে, এসব হবেই। তা নিয়ে ভাবি না।

শুভ্র: অনেকে বলে, আপনি ওয়ানডে ব্যাটসম্যান হিসেবে যতটা বড়, টেস্ট ব্যাটসম্যান হিসেবে ততটা নন।

সৌরভ: আমি মনে করি, আমার ক্যারিয়ার বিচার করার জন্য এটা বেশি তাড়াতাড়ি হয়ে যাচ্ছে। এই গত বছরের আগেও টেস্টে আমার অ্যাভারেজ ছিল ৫০, যা একজন গ্রেট ব্যাটসম্যানের ইঙ্গিত দেয়। এখন তা ৪৪-এ নেমে এসেছে। তবে এখনাে আমার অনেক ক্রিকেট খেলতে বাকি। আমি এরই মধ্যে ৪ হাজার রান করেছি, সংখ্যাটা খুব কম নয়। আমি আরও খেলতে চাই, আরও রান করতে চাই। ৬০ টেস্টে চার হাজার রান করেছি, মনে করি, আমার ক্যারিয়ার বিচার করার সময় এখনাে হয়নি।

শুভ্র: অধিনায়ক হিসেবে কোনাে টার্গেট আছে?

সৌরভ : বিশ্বকাপ। দেখা যাক, কদ্দুর যাওয়া যায়!

(শেষ প্রশ্নটার উত্তরে সৌরভ যে বিশ্বকাপের কথা বলেছিলেন, তা ছিল ২০০৩ দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপ। কদ্দুর যাওয়া যায় দেখতে চেয়েছিলেন, গিয়েছিলেন ফাইনাল পর্যন্ত)।

আরও পড়ুন...
সাতানব্বই সালের সেই সৌরভের সঙ্গে মিলিয়ে নিন পরের সৌরভকে

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×