হাম্বানটোটায় বৃষ্টি এবং প্রেসবক্সের সেকাল-একাল

শ্রীলঙ্কা ডায়েরি

উৎপল শুভ্র

১৫ এপ্রিল ২০২১

হাম্বানটোটায় বৃষ্টি এবং প্রেসবক্সের সেকাল-একাল

বৃষ্টিতে খেলা বন্ধ আর প্রেসবক্সে বসে খেলা শুরুর অপেক্ষায়— জীবনের অনেকগুলো ঘণ্টা কেটেছে এভাবে। খুব বেশি দিন আগের কথা নয়, যখন এই সময়টাতে প্রেসবক্সে তুমুল আড্ডা হতো। এখন সবাই থাকে যে যার জগতে। সবার সামনে ল্যাপটপ। ইন্টারনেটের কল্যাণে সময় কাটানোর উপকরণেরও অভাব নেই। কেউ সিনেমা দেখছেন, কেউ শুনছেন গান, কেউবা ফেসবুকে ব্যস্ত।

প্রথম প্রকাশ: ২৬ মার্চ ২০১৩। প্রথম আলো।

সাংবাদিকের এই জীবন কত বিচিত্র অভিজ্ঞতাই না উপহার দিল! হাম্বানটোটা যাতে সর্বশেষ সংযোজন।

এই লেখাটা হাম্বানটোটা স্টেডিয়ামে বসেই লিখছি। সামনে ত্রিপলে ঢাকা মাঠ। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়েই চলেছে। দ্বিতীয় ওয়ানডের অপমৃত্যুর আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এখনো আসেনি। তবে বৃষ্টির যে হাবভাব, তাতে সেটির আনুষ্ঠানিকতাটুকুই শুধু বাকি।

বৃষ্টিতে খেলা বন্ধ আর প্রেসবক্সে বসে খেলা শুরুর অপেক্ষায়— জীবনের অনেকগুলো ঘণ্টা কেটেছে এভাবে। খুব বেশি দিন আগের কথা নয়, যখন এই সময়টাতে প্রেসবক্সে তুমুল আড্ডা হতো। এখন সবাই থাকে যে যার জগতে।

সবার সামনে ল্যাপটপ। ইন্টারনেটের কল্যাণে সময় কাটানোর উপকরণেরও অভাব নেই। কেউ সিনেমা দেখছেন, কেউ শুনছেন গান, কেউবা ফেসবুকে ব্যস্ত। আমি এসবের কিছুই না করে ‘দেয়াল’টা শেষ করে ফেললাম। বইটা হাবিবুল বাশারের (মানে বইয়ের মালিক আরকি, বইটা আসলে কার, সেটি বোধ হয় সবারই জানা)। গত পরশু তাঁর রুম থেকে নিয়ে এসেছি। বারবার বলেছেন, ‘মনে করে ফেরত দিয়েন ভাই। আমি এখনো পড়িনি।’

ফেরত তো দিতামই। কিন্তু পরদিন মাঠেই ফেরত দিয়ে দিতে পারব, একদমই ভাবিনি। বৃষ্টি সেই সুযোগ করে দিল। হুমায়ূন আহমেদের বই পড়তে বেশি সময় লাগে না। তা পড়ে কেমন লাগল? আনিসুজ্জামান স্যারের প্রতি শ্রদ্ধাটা আরও বেড়ে গেল। কাহিনির ইঙ্গিত থাকতে পারে ভেবে ভূমিকাটা আগে পড়িনি। বইটা শেষ করার পর পড়লাম। আমার যা মনে হয়েছে, স্যারও দেখি ঠিক তা-ই লিখেছেন! ‘গ্রেট মেন থিংক অ্যালাইক’ কথাটা তাহলে ঠিক নয়! এটা পড়ে আবার ভুলেও ভাববেন না, আনিসুজ্জামান স্যারের গ্রেটনেস নিয়ে সন্দেহ করা হচ্ছে!

হাম্বানটোটা-পর্ব দেখতে দেখতে শেষ হয়ে গেল। কাল সকালে আবার ছুটতে হবে ক্যান্ডিতে। এখানে আসার পর প্রতিদিনের লেখার শুরুতেই ‘হাম্বানটোটা থেকে’ পড়েছেন। সব লেখা কিন্তু হাম্বানটোটায় বসে লিখিনি। এখানে আমার ঠিকানা ছিল উদাওলাওয়ে, যেটি আসলে হাম্বানটোটা জেলারও অংশ নয়। এটি পড়েছে রত্নাপুরা জেলায়। রত্নাপুরা মানে রত্নপুর। নাম থেকেই যেটির বিশেষত্ব বুঝে ফেলা সম্ভব।

শ্রীলঙ্কার মাটির নিচে থরে থরে সাজানো নানা রত্নের সমাহার। স্যাফায়ার, টোপাজ, ক্যাটস আই, রুবি, প্রবাল—এমন আরও সব ‘রত্নের’ মূল ঠিকানা রত্নাপুরা। সেখানে ‘রত্নের জাদুঘর’-ও আছে একটা। কলম্বো থেকে এখানে আসার পথে রত্নাপুরার সেই জেম মিউজিয়াম দেখে এসেছি। নীল স্যাফায়ারে ঝলমলে বিশাল পাথরখণ্ডের ছবি তুলতে না পারায় আফসোসও হয়েছে। অনেক অনুরোধেও কাজ হয়নি। ছবি বা ভিডিও করা নিষিদ্ধ তো নিষিদ্ধই।

হাম্বানটোটা স্টেডিয়ামের আশপাশে কোনো ভালো হোটেল-টোটেল নেই, এ কথা তো আপনাদের আগেই জানিয়েছি। বাংলাদেশের সাংবাদিকেরা কেউ থাকছি উদাওলাওয়েতে, কেউ আম্পলিপিটিয়ায়, কেউবা অন্য কোথাও। ম্যাচের দিন তো হাম্বানটোটা স্টেডিয়াম থেকেই সবাই কাজ করেছি, কিন্তু অন্য দিন যার যার ঠিকানা থেকে। পাঠক বিভ্রান্ত হতে পারেন ভেবে সেদিনও অবশ্য সবাই ‘হাম্বানটোটা থেকে’ই লিখেছি।

রত্নাপুরার জেম মিউজিয়াম। ছবি: অ্যাট্রাকশন্স ইন শ্রীলঙ্কা।

বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা বলছিলাম। ম্যাচ শেষ করে হোটেলে ফিরতে ফিরতে মাঝরাত পেরিয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা এর আগেও অনেকবারই হয়েছে। তবে রাত সোয়া ১২টায় মাঠ থেকে বেরিয়ে ৩৫-৪০ কিলোমিটার দূরের হোটেলে ফেরার অভিজ্ঞতা হলো এখানেই প্রথম। বিরানভূমিতে দাঁড়িয়ে থাকা এই স্টেডিয়াম থেকে বেরিয়ে দিনদুপুরেই কোনো যানবাহন মেলে না। মাঝরাতে তো প্রশ্নই ওঠে না। যাওয়া-আসা আর মাঝখানে আট-নয় ঘণ্টা বসে থাকার চুক্তিতে তাই একটা টুকটুক ভাড়া করেছি। ফ্লাডলাইট বিপত্তির কারণে সেই আট-নয় ঘণ্টা প্রায় সাড়ে এগারো ঘণ্টায় রূপ নিল প্রথম ওয়ানডের রাতে। ওই নিশুতি রাতে টুকটুক করে যখন ফিরছি, অশরীরী একটা অনুভূতি হচ্ছিল। দুই পাশে হয় জলাভূমি, নয়তো ঘন জঙ্গল। মনে মনে এটাও ভাবছিলাম, বাংলাদেশে এত রাতে এত দূরের পথ সিএনজিতে পাড়ি দিতে হলে ‘অশরীরী’ কিছু নয়, ‘শরীরী’ ভয়টাই মনে বেশি কাজ করত। এখানে অন্তত ছিনতাই-টিনতাইয়ের কবলে পড়ার কোনো আশঙ্কা তো নেই।

স্টেডিয়াম থেকে এত দূরে থাকতে হবে জেনে প্রথমে যে ভয়টা পেয়ে ছিলাম, সেটি অবশ্য প্রথম দিনেই কেটে গেছে। রাস্তার সামান্য একটু অংশে নির্মাণকাজ চলছে, বাকিটুকু মসৃণ পিচঢালা পথ। বাংলাদেশের সঙ্গে সবচেয়ে বড় পার্থক্য, ট্রাফিক জ্যামের কোনো ভয় নেই। আমার হোটেল থেকে হাম্বানটোটা স্টেডিয়াম যতটা দূরত্বে, ঢাকা থেকে ফতুল্লা স্টেডিয়ামও তো সে রকমই। অথচ ঢাকা থেকে রওনা হওয়ার সময় যেমন আপনি জানেন না কখন গিয়ে পৌঁছাবেন, এখানে ঘটনা তা নয়। ৪৫ মিনিট মানে ৪৫ মিনিটই।

হাম্বানটোটায় এই দৃশ্য নিয়মিতই। ছবি: ডেইলি নিউজ লঙ্কা

প্রথম ওয়ানডের রাতে ফেরার সময় টুকটুক ড্রাইভারের হঠাৎ চিৎকারে সামনে তাকিয়ে দেখি, একটা খরগোশ! আঁকাবাঁকা দৌড়ে অনেকক্ষণ সেটি সামনে সামনে থাকল। রাস্তায় গুইসাপ, খরগোশ, সাপ এসব এখানে খুব চোখ-সওয়া ব্যাপার। প্রথম ওয়ানডেতে হাতে চোট পেয়ে হাসপাতালে এক্স-রে করাতে গিয়ে তামিম ইকবালের অবশ্য এসবের চেয়ে ‘সামান্য’ একটু বড় এক প্রাণীর সঙ্গে দেখা হয়ে গিয়েছিল। এক্স-রে করে ফিরছেন, হঠাৎই গাড়ির সামনে জলজ্যান্ত এক হাতি। এই অঞ্চলে এমন ঘটনা নাকি প্রায়ই হয়। তামিমের কপাল ভালো, হাতি মহোদয় রাস্তা পার হয়ে চলে গেছেন। মাঝেমধ্যে তিনি রাস্তায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন। হুস-হাস করলে গাড়িতে আক্রমণ করে বসতে পারে। নট নড়ন-চড়ন করে তখন তাই চুপ করে অপেক্ষা করতে হয়। সেই অপেক্ষা কখনো কখনো এক-দুই ঘণ্টাও স্থায়ী হয়!

উদাওলাওয়ে ন্যাশনাল পার্কে এত হাতি দেখেছি যে হাতি দেখার শখ মোটামুটি মিটে গেছে। তারপরও রাস্তায় হঠাৎ গাড়ির সামনে হাতি অন্য রকম একটা অভিজ্ঞতাই হতো। আজ তো মাঠ থেকে ফিরতে অত রাত হবে না। একটু পরই বেরিয়ে যাব প্রেসবক্স থেকে। তবে হাতির সঙ্গে দেখা বোধ হয় হবে না। হাতি বৃষ্টিতে ভিজতে পছন্দ করে বলে তো কখনো শুনিনি।

২৫ মার্চ ২০১৩। হাম্বানটোটা।

আরও পড়ুন:

হাতির রাজ্যে উড়ন্ত ময়ূর

হাম্বানটোটায় কালুভিতারানার অতিথি

প্রেমাদাসায় বসে শেয়ালের ডাক শোনা

প্রেমাদাসায় গেলে শচীনকেই কেন আগে মনে পড়ে

সুনামি ও গল স্টেডিয়ামের পুনর্জন্ম

হনুমানের ফেলে দেওয়া টুকরো থেকে যেটির সৃষ্টি

তুমি সাগর অনন্ত মুগ্ধতার

বিশ্বের প্রথম সুড়ঙ্গ মন্দিরে বুদ্ধ শরণে

মাতারা হারিকেনের সঙ্গে মাতারায়

যত কাণ্ড মাতারায়

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×