হনুমানের ফেলে দেওয়া টুকরা থেকে যার সৃষ্টি

উৎপল শুভ্র

১৫ এপ্রিল ২০২১

হনুমানের ফেলে দেওয়া টুকরা থেকে যার সৃষ্টি

গলের উনাওয়াটুনা সৈকতের খুব নামডাক। আসার আগে শুধু এই সৈকতের কথাই শুনেছি। এই জায়গাটা নিয়ে যে অনেক কল্পকথা চালু আছে, সেটি জানলাম এখানে আসার পর। সিংহলিজ ভাষায় ‘উনা-ওয়াটুনা’ অর্থ ‘পড়ে যাওয়া’ অথবা ‘যেটি পড়ে গিয়েছিল।’ হনুমানের বয়ে আনা গন্ধমাদন পর্বত থেকে পড়ে যাওয়া একটা টুকরো থেকে নাকি এই উনাওয়াটুনার সৃষ্টি।

প্রথম প্রকাশ: ৮ মার্চ ২০১৩। প্রথম আলো।

টুরিস্ট গাইডে লেখা আছে, ‘ভাগ্য ভালো থাকলে উনাওয়াটুনার সৈকতে কচ্ছপের ডিম পাড়ার দৃশ্য দেখতে পাবেন।’

ভাগ্যটা বেশিই ভালো মনে হচ্ছে। উনাওয়াটুনায় প্রথম রাতেই যে তা দেখে ফেললাম।

পরশু রাতে কাজ-টাজ শেষ করে খেতে গিয়েছি রাস্তার ওপারের সমুদ্র সৈকতে। হ্যাঁ, খাওয়াদাওয়া এখানে সমুদ্র সৈকতেই হচ্ছে। সারি সারি রেস্টুরেন্ট। সৈকতে পেতে দেওয়া চেয়ার-টেবিল। আলোকসজ্জায় রীতিমতো উৎব-উৎসব ভাব। সাগরের ঢেউ আছড়ে পড়ছিল একটু দূরেই। হঠাৎ একটু বেশি চঞ্চল একটা ঢেউ এসে পা-টা ভিজিয়ে স্যান্ডেল ভাসিয়ে নিয়ে গেল।

খাওয়া শেষ করে উঠতে যাচ্ছি, দেখি, একটু দূরে সবাই ভিড় করে দাঁড়িয়ে কী যেন দেখছে। রেস্টুরেস্টের ওয়েটার বলল, তাড়াতাড়ি যান, একটা কচ্ছপ ডিম পাড়তে উঠেছে। এত তাড়াহুড়ার আসলে কিছু ছিল না। ডিম পাড়ার প্রক্রিয়াটা মনে হলো বেশ সময়সাপেক্ষ। যে কারণে পনেরো-বিশ মিনিট দাঁড়িয়ে থেকে বালুতে মুখ গুঁজে থাকা বিশালাকৃতির কচ্ছপটাই শুধু দেখতে পেলাম। কচ্ছপের ডিম দেখার শখ আর মিটল না। তা এমন ভিড়ের মধ্যে কচ্ছপটা ডিম পাড়তে এল কেন? কচ্ছপ মহোদয়া (কচ্ছপের স্ত্রী লিঙ্গটা যেন কী! নাকি তা নেই-ই) যে ‘আলো আমার আলো ওগো’ গাইতে গাইতে ডিম পাড়তে আসেন, এটি আমার জানা ছিল না। পূর্ণিমার রাতে নাকি ডিম পাড়ার ব্যাপারটা সবচেয়ে বেশি ঘটে। অন্য সময় তাদের টেনে আনে রেস্টুরেস্টের আলোকসজ্জা।

উনাওয়াটুনা আসার আগে শুধু এখানকার সৈকতের কথাই শুনেছি। এই জায়গাটা নিয়ে অনেক কল্পকথা চালু আছে, সেটি জানলাম এখানে আসার পর। সিংহলিজ ভাষায় ‘উনা-ওয়াটুনা’ অর্থ ‘পড়ে যাওয়া’ অথবা ‘যেটি পড়ে গিয়েছিল।’

হনুমানের স্মৃতিশক্তি খুব একটা সুবিধার ছিল না। যেতে যেতে গাছের নাম ভুলে যান। তখন তো আর মোবাইল-টোবাইলও নেই যে, ফোন করে আবার জেনে নেবেন। হনুমান তাই উপায়ান্তর না দেখে পুরো গন্ধমাদন পাহাড়টাই মাথায় করে নিয়ে আসেন। 

রামায়ণের ‘ভিলেন’ রাবণের দেশ এই শ্রীলঙ্কা। রামায়ণে বাল্মীকির দেওয়া সমুদ্র সৈকতের বর্ণনার সঙ্গে নাকি উনাওয়াটুনার সৈকত খুব মিলে যায়। জায়গাটার নামকরণের উৎসও রামায়ণ। সীতাকে উদ্ধারের জন্য রাম-রাবণের সেই মহাযুদ্ধে লক্ষ্মণের বুকে শক্তিশেল বিঁধেছিল। মুমূর্ষু লক্ষ্মণকে বাঁচাতে জাম্বুবানের দেওয়া ‘প্রেসক্রিপশন’ মতো রামভক্ত হনুমান হিমালয় থেকে মৃতসঞ্জীবনী, বিশল্যকরণী, সুভামাকরণী ও সন্ধানী নামে চারটি ঔষধি গাছ নিয়ে আসতে ভারতে উড়ে যান। হনুমানের স্মৃতিশক্তি খুব একটা সুবিধার ছিল না। যেতে যেতে গাছের নাম ভুলে যান। তখন তো আর মোবাইল-টোবাইলও নেই যে, ফোন করে আবার জেনে নেবেন। হনুমান তাই উপায়ান্তর না দেখে পুরো গন্ধমাদন পাহাড়টাই মাথায় করে নিয়ে আসেন। আসার পথে তারই একটা টুকরো পড়ে গিয়ে এই ‘যেটি পড়ে গিয়েছিল’ মানে উনাওয়াটুনার সৃষ্টি।

পর্বতের টুকরো পড়লে পুরোটা সমতল হওয়ার কথা নয়। পাহাড়মতো একটা জায়গাও সৃষ্টি হলো তাতে। যেটির নাম রুমাসালা পাহাড়। কাল সকালে মাঠে যাওয়ার আগে সেই রুমাসালা পাহাড় ঘুরে এলাম। এই ভূখণ্ড সৃষ্টির স্বীকৃতি হিসেবে হনুমানজির বিশাল একটা মূর্তি আছে সেখানে। পাশে জাপানিদের অর্থানুকূল্যে বানানো একটা প্যাগোডা। নাম ‘পিস প্যাগোডা’। বৃত্তাকার সেই প্যাগোডায় বুদ্ধের জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ের চারটি মূর্তি। জঙ্গলের পাশে বলে নিচে সৈকতটার নাম ‘জাঙ্গল বিচ।’

রুমাসালা পাহাড়ের মাথায় পিস প্যাগোডা ও জাঙ্গল বিচ। চারপাশে জঙ্গল বলেই এই সৈকতের অমন নাম

রামায়ণের ওই গল্পের পক্ষে সমর্থন হিসেবে অনেক ‘প্রমাণ’ আছে। রুমাসালা পাহাড়ের গাছপালার সঙ্গে হিমালয়ের গাছপালার নাকি অনেক মিল। ঔষধি গাছেও নাকি জঙ্গলটা ভরা। রুমাসালা পাহাড়ে উঠে হনুমানের মূর্তি আর পিস প্যাগোডার চেয়ে আমার অবশ্য বেশি ভালো লাগল সেখান থেকে দেখা দৃশ্যটা। নিচে নীল জলের গল হারবার, গলের বিখ্যাত দুর্গটাও দৃশ্যমান। অপূর্ব এক ছবি!

ভালো কোনো গল্পকে তথ্য দিয়ে নষ্ট করার কোনো মানে হয় না। আর্থার সি ক্লার্ক অবশ্য তা-ই করেছেন। মহাকাশ কল্পকাহিনির কিংবদন্তি এই লেখক শ্রীলঙ্কায় এসে উনাওয়াটুনাতেই আবাস গেড়েছিলেন। তাঁর দাবি, অনেক বছর আগে এখানে একটা কিছু পড়েছিল ঠিকই, তবে সেটি উল্কা।

উনাওয়াটুনায় কিছু একটা কি আসলেই আছে? পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র নাকি এখানে অন্য রকম আচরণ করে। কৃত্রিম উপগ্রহ এটির ওপরে এলে আর ‘ফ্রিকোয়েন্সি’ পায় না। ক্লার্ক তো আরও অদ্ভুত সব দাবি করে গেছেন। এই উনাওয়াটুনার ওপরে নাকি সব বাতিল কৃত্রিম উপগ্রহ, মহাকাশযান, মহাকাশ-বর্জ্য চক্রাকারে ঘুরছে। সঙ্গে অবশ্য আশ্বস্তও করেছিলেন, ওসব ২৬ হাজার মাইল ওপরে বলে আছড়ে পড়ার ভয় নেই।

কিন্তু যদি পড়ে! আর্থার সি ক্লার্ক যে সবজান্তা ছিলেন, এমন তো নয়। এমনিতেই সাগরপাড়ে আছি বলে মাঝেমধ্যেই সুনামির ভয় হয়। এর সঙ্গে যদি মহাকাশ থেকে ওসব পড়তে শুরু করে, তাহলে তো সর্বনাশ!

৭ মার্চ ২০১৩। গল।

আরও পড়ুন:

হাম্বানটোটার প্রেসবক্সে বৃষ্টির অবসরে

হাতির রাজ্যে উড়ন্ত ময়ূর

হাম্বানটোটায় কালুভিতারানার অতিথি

প্রেমাদাসায় বসে শেয়ালের ডাক শোনা

প্রেমাদাসায় গেলে শচীনকেই কেন আগে মনে পড়ে

সুনামি ও গল স্টেডিয়ামের পুনর্জন্ম

তুমি সাগর অনন্ত মুগ্ধতার

বিশ্বের প্রথম সুড়ঙ্গ মন্দিরে বুদ্ধ শরণে

মাতারা হারিকেনের সঙ্গে মাতারায়

যত কাণ্ড মাতারায়

​​​

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×