প্রেমাদাসায় গেলে শচীনকেই কেন আগে মনে পড়ে!

শ্রীলঙ্কা ডায়েরি

উৎপল শুভ্র

১৫ এপ্রিল ২০২১

প্রেমাদাসায় গেলে শচীনকেই কেন আগে মনে পড়ে!

কলম্বোর প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামে টেস্ট কাভার করছি এই প্রথম। তবে ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টি তো খুব কম করিনি। বিচিত্রই বলতে হবে, আর কোনো ম্যাচের কোনোকিছুই সেভাবে মনে পড়ে না। যতবারই এই মাঠে আসি, অবধারিতভাবেই মন চলে যায় ১৯৯৪ সালের ৯ সেপ্টেম্বরে। চোখে ভেসে ওঠে শচীন টেন্ডুলকারের মুখ।

প্রথম প্রকাশ: ১৭ মার্চ ২০১৩। প্রথম আলো।

প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামে এলেই শচীন টেন্ডুলকারকে মনে পড়ে। চোখ চলে যায় ড্রেসিংরুমের ওই সিঁড়িতে, যেখানে টেন্ডুলকারকে দাঁড় করিয়ে কথা বলেছিলাম।

এই মাঠে টেস্ট কাভার করছি এই প্রথম। তবে ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টি তো খুব কম করিনি। বিচিত্রই বলতে হবে, আর কোনো ম্যাচের কোনোকিছুই সেভাবে মনে পড়ে না। যতবারই এই মাঠে আসি, অবধারিতভাবেই মন চলে যায় ১৯৯৪ সালের ৯ সেপ্টেম্বরে।

শচীন টেন্ডুলকার সেদিন পরম আরাধ্য প্রথম ওয়ানডে সেঞ্চুরি পেয়েছেন, যে সেঞ্চুরি না পাওয়ার রহস্য নিয়ে দিস্তা দিস্তা কাগজ খরচ করেছেন সাংবাদিকেরা। কথাটা আক্ষরিক অর্থেই নিন। এখন যেমন সাংবাদিকদের হাতে হাতে ল্যাপটপ, তখন সেটি কারও কল্পনাতেও ছিল না। লেখাটা তখন কাগজে-কলমেই হতো। লেখার পর সেটি অফিসে পাঠানোর মাধ্যম ছিল ফ্যাক্স। সেই ফ্যাক্স-যুগ হয়ে আছে দুঃসহ এক স্মৃতি। ফ্যাক্স মেশিনে বাংলাদেশের লাইন পাওয়া যে ছিল রীতিমতো আরাধনার ব্যাপার! এমন কত হয়েছে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা চেষ্টা করেও লাইন পাওয়া যাচ্ছে না। ফ্যাক্সের লাইন পেলে ক্যারকেরে কর্কশ যে শব্দটা হতো, সেটিকে মনে হতো বিশ্বের মধুরতম সংগীত!

১৯৯৪ সালে ওই শ্রীলঙ্কা সফরের আগে বিদেশ বলতে শুধু কলকাতা। ভারত-ইংল্যান্ড টেস্ট কাভার করতে গিয়ে থেকেছি আত্মীয়ের বাসায়, একটু ভিন্ন উচ্চারণ হলেও সবার মুখে শুনেছি বাংলা—বিদেশ-বিদেশ অনুভূতিটা তাই সেভাবে হয়নি। প্রথম সত্যিকার বিদেশ বলতে এই শ্রীলঙ্কা।

সিঙ্গার ওয়ার্ল্ড সিরিজ কাভার করতে সেই সফরের স্মৃতির বড় একটা অংশ জুড়ে আছে ফ্যাক্সের লাইন পাওয়ার ওই যুদ্ধ। পচা একটা হোটেলে থাকি, ফ্যাক্স-ট্যাক্স থাকার প্রশ্নই ওঠে না। মাঠে ব্যবস্থা ছিল। তবে সেটি শুধু খেলার দিন। সেই টুর্নামেন্টে অনেক বিরতি ছিল আর ছিল বৃষ্টির উৎপাত। বেশির ভাগ দিনই লেখা পাঠাতে যেতে হতো সিটিও, অর্থাৎ সেন্ট্রাল টেলিগ্রাফ অফিসে। এমনও হয়েছে, সারা রাত লিখে সকালে সিটিওতে লেখাটা ফ্যাক্স করতে দিয়ে মাঠে চলে এসেছি। সেটি ঢাকায় পৌঁছেছে বিকেলবেলায়! রাতে হোটেলে ফেরার সময় লেখাটা ফেরত নিয়ে যেতাম, যেটিতে স্ট্যাপল করা থাকত একগাদা ‘এরর রিপোর্ট’। এটাও বোধ হয় এখন ব্যাখ্যার দাবি রাখে। 'এরর রিপোর্ট' মানে ফ্যাক্স পাঠাতে চেয়ে ব্যর্থ হওয়ার দালিলিক প্রমাণ।

ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফ্যাক্স মেশিনে গুঁতোগুঁতি করতে কার ঠেকা পড়েছে! সিটিওর কর্মচারীদের সঙ্গে তাই খাতির জমাতে কত কিছুই না করতে হয়েছে! গল্পগুজব তো বটেই, টুকটাক গিফটও দিয়েছি। তখন টাকাপয়সারও টানাটানি। যত কম দামিই হোক, ‘মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা’য় এটা-ওটা কিনতে বড় বুকে লাগত। তবে কাজ হয়েছিল তাতে। কদিন পর থেকে তো সিটিওর লোকজন এমন অভ্যর্থনায় স্বাগত জানাত যে, মনে হতো আমি তাঁদেরই একজন!

সেই বহু আরাধ্য সেঞ্চুরির পরমুহূর্তে। কলম্বোর প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামে গেলেই আমার মনে পড়ে যায় যে স্মৃতি। ছবি: ফেসবুক

এমনিতেও আমাকে দেখে এই ভুলটা অনেক শ্রীলঙ্কানই করে। চেহারাছবি-গাত্রবর্ণ সব মিলিয়ে তাদেরই একজন মনে করে আর কি! হোটেলে-রাস্তায় বা কোনো বিপণিবিতানে স্থানীয় কেউ এসে অবলীলায় সিংহলিজ ভাষায় কথা বলতে শুরু করেছে, এই অভিজ্ঞতা আমার অনেকবারই হয়েছে। হয়তো প্রেসবক্সের সিঁড়ি দিয়ে উঠছি, শ্রীলঙ্কান কোনো সাংবাদিক ‘ইয়ালা আলা’ জাতীয় কিছু শব্দ উচ্চারণ করে কী একটা বলতে বলতে পাশ দিয়ে নেমে গেল।

শ্রীলঙ্কায় বেবিট্যাক্সিকে বলে টুকটুক। বাংলাদেশে তো বেবিট্যাক্সি কথাটাই উঠে গেছে, জ্বালানির নামে সেটির নাম এখন সিএনজি। শ্রীলঙ্কায় অবশ্য এটি অনুসরণ করা কঠিন। এখানে টুকটুক চলে পেট্রলে। সিএনজিটা গা সয়ে গেছে, কিন্তু বেবিট্যাক্সিকে ‘পেট্রল’ ডাকাটা বোধ হয় একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যায়! তো এখানে টুকটুক ড্রাইভাররা আমাকে স্বজাতি ভেবে সব সময়ই দেখি সিংহলিজ ভাষায় ভাড়ার কথা বলে।

১৯৯৬ বিশ্বকাপ ফাইনালের আগের দিন ওয়ার্নের ছবিসংবলিত পাতাটা বের করে আমার 'ষোল তারকার মুখোমুখি' বইটা তাঁকে দিয়ে বললাম, ‘মনে আছে, শ্রীলঙ্কায় তোমার সঙ্গে অনেকবার কথা হয়েছিল?'ওয়ার্ন হাসি দিয়ে বললেন, ‘বলতে হবে না, তোমাকে দেখেই বুঝেছি, তুমি শ্রীলঙ্কান।’

আমাকে শ্রীলঙ্কান বলে ভুল করেছেন, এমন লোকজনের মধ্যে শেন ওয়ার্ন নামের একজন লেগ স্পিনারও আছেন। সেই সিঙ্গার ওয়ার্ল্ড সিরিজের সময় এই শ্রীলঙ্কাতেই প্রথম ওয়ার্নের ইন্টারভিউ করেছিলাম। সেবার ইন্টারভিউও করেছিলাম বিস্তর। পরে সেগুলো একখানে করেই আমার প্রথম বই 'ষোল তারকার মুখোমুখি' বের হলো। বাংলায় লেখা বই, যাঁদের নিয়ে লেখা, তাঁরা কে কী বুঝবে! অথচ কী এক খেয়ালে ওই বইয়ের উপজীব্য ‘ষোল তারকা’কেই একটা করে বই উপহার দিয়েছিলাম। ১৯৯৬ বিশ্বকাপ ফাইনালের আগের দিন লাহোরের গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে ওয়ার্নের ছবিসংবলিত পাতাটা বের করে বইটা তাঁকে দিয়ে বললাম, ‘মনে আছে, শ্রীলঙ্কায় তোমার সঙ্গে অনেকবার কথা হয়েছিল?’ ওয়ার্ন হাসি দিয়ে বললেন, ‘বলতে হবে না, তোমাকে দেখেই বুঝেছি, তুমি শ্রীলঙ্কান।’

পুনশ্চ: লেখাটা প্রেমাদাসা স্টেডিয়াম নিয়ে হওয়ার কথা ছিল। কথায় কথায় কোথায় যে চলে গেলাম! এখন দেখছি, পত্রিকায় এই কলামের জন্য বরাদ্দ জায়গা শেষ। প্রেমাদাসার গল্প তাহলে না হয় আগামীকালই বলি।

১৬ মার্চ ২০১৩। কলম্বো।

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×