জিম্বাবুয়ের পক্ষে খেলেই খুশি অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার

'ক্রিকেট খেলায় চাপ নিয়ে একটু বেশিই কথা হয়'

উৎপল শুভ্র

২৮ এপ্রিল ২০২১

'ক্রিকেট খেলায় চাপ নিয়ে একটু বেশিই কথা হয়'

অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার। ছবি: দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট

সাধারণ এক দলের অসাধারণ এক ব্যাটসম্যান তিনি। শচীন টেন্ডুলকার, স্টিভ ওয়াহদের ছাপিয়ে তাঁর নাম কখনও কখনও চলে আসে র‍্যাঙ্কিংয়ের এক নম্বরে--এমন বিস্ময়কর ধারাবাহিকতা অ্যান্ডি ফ্লাওয়ারের ব্যাটিংয়ে। সেই বিস্ময়ের ধাক্কায় অনেক সময় মনেই থাকে না যে, এই লোকটি জিম্বাবুয়ের উইকেটকিপারও। কথাবার্তায় বরাবরই বিনয়ী, তবে তাই বলে অপ্রিয় সত্য কথা বলতে ভয় পান না। এই একান্ত সাক্ষাৎকারেও পাওয়া যাবে এর প্রমাণ।

প্রথম প্রকাশ: ৭ নভেম্বর ২০০১। প্রথম আলো।

উৎপল শুভ্র: আপনি সব সময় যা বলেন, গতকাল ঢাকা পৌঁছেও বলেছেন তা-ই। আপনি র‍্যাঙ্কিংয়ে বিশ্বাস করেন না। কিন্তু আপনি কি অন্য ‘গ্রেট’ প্লেয়ারদের পারফরম্যান্স অনুসরণ করে নিজের পারফরম্যান্সটা সেগুলোর সঙ্গে তুলনা করেন না?

অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার: না, না, আমি বলিনি যে, আমি র‍্যাঙ্কিংয়ে বিশ্বাস করি না। বরং আমি মনে করি, খেলোয়াড়দের ফর্ম বোঝার জন্য পরিসংখ্যানগতভাবে এটি একটি ভালো পদ্ধতি। আমি যেটা বলতে চেয়েছি তা হলো, ক্রিকেট মাঠে নামার পর র‍্যাঙ্কিংয়ের আসলে কোনো মূল্য নেই। তখন এটি প্রতিপক্ষ দল ও প্রতিপক্ষের বোলারদের সঙ্গে লড়াই, পরিসংখ্যানে তখন কিছুই এসে-যায় না। যতবার আপনি মাঠে নামবেন, আপনার অতীত পারফরম্যান্সের কোনো মূল্যই থাকবে না। আপনাকে আবার শূন্য থেকেই শুরু করতে হবে।

শুভ্র: আপনার চোখে বর্তমান বিশ্বের সেরা পাঁচজন ব্যাটসম্যান কে কে?

অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার: পাঁচজনের কথা বলতে পারব কি না, জানি না। তবে কয়েকজনের কথা বলি। প্রথমে অবশ্যই শচীন। ওর ব্যাটিং দেখতে সব সময়ই আমার খুব ভালো লাগে। হি ইজ ফুল অব ক্লাস। স্টিভ ওয়াহকে পছন্দ তাঁর দৃঢ়প্রতিজ্ঞা আর সাফল্যের জন্য একাগ্র মানসিকতার কারণে। এর সঙ্গে সে তার দলকে যেভাবে একটা উইনিং ইউনিটে পরিণত করেছে, সেজন্যও শ্রদ্ধা করি ওকে। ব্রায়ান লারাও অসাধারণ। স্টাইল, ক্লাস, হাতে প্রচুর শট। আমি এদের সবার খেলা দেখতেই পছন্দ করি।

শুভ্র: আপনার কি কখনও মনে হয়, জিম্বাবুয়ের মতো দুর্বল কোনো দলের পরিবর্তে শক্তিশালী কোনো দলে খেললে আপনার পারফরম্যান্স আরও ভালো হতো। কারণ তাহলে চাপটা আরও কম থাকত আপনার ওপর?

অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার: আমি কখনোই তা বলব না। কী হলে কী হতে পারে--এটা বলা কঠিন। কে জানে, আমি যদি শক্তিশালী কোনো দেশে জন্মাতাম, হয়তো ১৯৯২ সালেই টেস্ট খেলার সুযোগ পেতাম না। অন্য কিছু হলে কী হতো, এ নিয়ে ভাবাটা আমি মনে করি অর্থহীন। বরং আমার মনে হয়, বাস্তব অবস্থা যা, সে অবস্থাতেই নিজের কাজটা ঠিকভাবে করার চিন্তা করাই উচিত।

শুভ্র: কিন্তু সবাই জানে, আপনাকে আউট করলেই জিম্বাবুয়ের ব্যাটিং অর্ধেক শেষ। যতবার আপনি ব্যাট করতে নামেন, দল বড় কিছু প্রত্যশা করে আপনার কাছ থেকে। এই চাপটাকে কখনও কখনও অসহনীয় বলে মনে হয় না?

অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার: না, মোটেও তা নয়। আমি মনে করি ‘অসহনীয়’ কথাটা শুধু এক ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হতে পারে, পরিবারিক সমস্যার ক্ষেত্রে। আপনি আপনার ফ্যামিলির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারছেন না, সেক্ষেত্রেই। ক্রিকেট খেলা তা হতে যাবে কেন? এখানে কখনও কখনও চাপ অনুভব করতে হয়। তবে তা জীবন-মরণ কোনো ব্যাপার নয়। আমার মনে হয়, ক্রিকেট খেলায় এই চাপের ব্যাপারটি নিয়ে একটু বেশিই কথা হয়। এত কথাবার্তা হওয়ার কোনো যুক্তি নেই।

অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার: সাধারণ এক দলের অসাধারণ এক ব্যাটসম্যান

শুভ্র: গত কিছুদিন জিম্বাবুইয়ান ক্রিকেটে মাঠের চেয়ে মাঠের বাইরেই বেশি ঘটনা ঘটেছে। এটি কি আপনার পারফরম্যান্সে প্রভাব ফেলে না? এত কিছুর পরও আপনি কীভাবে নিজের কাজটা এমন সাফল্যের সঙ্গে করে যান?

অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার: অবশ্যই তা পারফরম্যান্সে প্রভাব ফেলে। মাঠের বাইরে অনেক সমস্যার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে আমাদের এবং আমার মনে হয়, তা সবার পারফরম্যান্সেই প্রভাব ফেলছে। সব দিক দিয়ে সন্তুষ্ট-পরিতৃপ্ত একটা দলের পারফরম্যান্সে উন্নতি হতে বাধ্য, আমাদের ক্ষেত্রে তা বলা যাচ্ছে না। তবে হোপফুলি আগামী দিনগুলোতে হয়তো আমরা সামনের দিকে তাকিয়ে একটা হ্যাপি ইউনিট গড়ে তুলতে পারব।

শুভ্র: বাংলাদেশে এটি আপনার চতুর্থ সফর। ক্রিকেট নিয়ে এখানকার মানুষের উন্মাদনার কথা অনেকবারই প্রশংসাভরে উচ্চারিত হতে শুনেছি আপনার মুখে। জিম্বাবুয়েতে এটি কি আপনি মিস করেন, কারণ ক্রিকেট সেখানে আর যা-ই হোক, উন্মাদনার প্রতিশব্দ নয়।

অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার: হ্যাঁ, কথাটা সত্যি। সংখ্যার বিচারে বাংলাদেশ, ভারত বা শ্রীলঙ্কার মতো এত লোক জিম্বাবুয়েতে ক্রিকেট নিয়ে আগ্রহী নয়। তাই এই অঞ্চলে এসে মানুষের মধ্যে ক্রিকেট নিয়ে এমন আগ্রহ দেখে প্রতিবারই চমৎকৃত হই আমরা।

শুভ্র: বাংলাদেশকে বাদ দিলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে জিম্বাবুয়ের বোলিং অ্যাটাকই সবচেয়ে দুর্বল। ব্যাটসম্যান হিসেবে আপনাকে সব সময়ই তুলনামুলক ভালো বোলিং খেলতে হয়। টেকনিক্যাল স্কিল ছাড়াও এজন্য যে মানসিক দৃঢ়তা প্রয়োজন, সেটি আপনি কীভাবে অর্জন করেছেন?

অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার: বোলিংয়ের ব্যাপারটা যা বললেন, আমার মনে হয়, এটি মাথাতেই আনা উচিত নয়। কারণ আপনার নিজের দলের বোলিং যা-ই হোক না কেন, আপনাকে সব সময় প্রতিপক্ষের বোলিংই খেলতে হবে। তাই নিজের দলের বোলিং নিয়ে আমাদের ব্যাটিং সাইডের ভাবার কিছু নেই। ভাবতে হবে নিজের খেলা নিয়ে, কিছুটা প্রতিপক্ষের বোলিং নিয়ে।

শুভ্র: গত এপ্রিলে বাংলাদেশের জিম্বাবুয়ে ট্যুরের সময় আপনার বাবা-মার সঙ্গে কথা বলেছিলাম। আপনার বাবা আমাকে বলেছিলেন, মানসিক দিকটার উন্নতি করার জন্য আপনি প্রচুর মনোবিজ্ঞান পড়েছেন।

অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার: হয়তো আমি আমার ক্যারিয়ারে ক্রমশই আরও ভালো করেছি। তবে সেটিকে বিশেষ কোনো কিছুর অবদান না বলে আমি বলব, এর মূলে আছে কঠোর পরিশ্রম। আমি বিশ্বাস করি, যদি আপনি কঠোর পরিশ্রম করেন, তাহলে আপনি সাফল্য পাবেনই, তা সে সাফল্যের মাত্রা যা-ই হোক না কেন!

স্পিন খুব ভালো খেলতেন। যার সবচেয়ে বড় প্রমাণ ২০০০-০১ ভারত ট্যুর। মাত্র চার ইনিংস খেলে করেছিলেন ৫৫০ রান, দুবার আউট হওয়ায় অ্যাভারেজ ছিল ২২৫!

শুভ্র: গত কিছুদিন আপনার বিস্ময়কর ধারাবাহিকতার রহস্য হিসেবে আপনার বাবাই বলেছিলেন, অধিনায়কত্ব হারানোটাই বাড়তি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ করে তুলেছে আপনাকে। কথাটা কি ঠিক?

অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার: আমি তা মনে করি না। হতে পারে, অধিনায়কত্বের বাড়তি দায়িত্ব না থাকায় নিজের খেলা নিয়ে বেশি ভাবার, বেশি কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। তবে আমার মনে হয় না, বাড়তি দৃঢ়প্রতিজ্ঞার কোনো ব্যাপার এখানে ছিল। আমি যখন অধিনায়ক ছিলাম, তখনও রান করেছি। হয়তো এত নয়, তবে অধিনায়ক হিসেবেও রান খুব কম করিনি। অধিনায়কত্ব হারানোর পর বাড়তি কোনো চেষ্টা করিনি, এর মধ্যে অন্য কিছু খোঁজা ঠিক হবে না।

শুভ্র: এখন তো প্রায় প্রতিদিনই জিম্বাবুয়ে দলের অধিনায়ক হিসেবে দেখা যাচ্ছে নতুন কাউকে। দলের সবচেয়ে সিনিয়র সদস্য হিসেবে ব্যাপারটা নিশ্চয়ই বিরক্তিকর আপনার জন্য?

অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার: অবশ্যই। এটাই প্রমাণ করে যে, আমাদের কিছু সমস্যা আছে। মাঠের বাইরে সবকিছু ঠিকভাবে হচ্ছে না। এই মুহূর্তে শুধু আশাই করতে পারি যে, এই সমস্যাগুলো দূর হবে। একটা সেটলড দল, সেটলড লিডারশিপ পাব আমরা।

শুভ্র: বাংলাদেশের বিপক্ষে এই সিরিজে আপনার টার্গেট কী?

অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার: আমরা আমাদের সবগুলো ম্যাচই জিততে চাই। এটাই টার্গেট। ব্যক্তিগত কোনো টার্গেটের কথা যদি বলেন...না, ব্যক্তিগত কোনো টার্গেট নেই আমার।

আরও পড়ুন: 'অ্যান্ডির সঙ্গে আমিও যোগ দিতে চেয়েছিলাম'

আরও পড়ুন: জিম্বাবুয়ে দলকে নিজের সম্পত্তি বানিয়ে ফেলেছিলেন অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার!

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×