চেতন চৌহানকে ছাড়িয়ে ওয়ার্নকে ধাওয়া ডিকভেলার

উৎপল শুভ্র

১ মে ২০২১

চেতন চৌহানকে ছাড়িয়ে ওয়ার্নকে ধাওয়া ডিকভেলার

নিরোশান ডিকভেলা: একটা রেকর্ড থেকে মুক্তি পেলেই আরেকটা রেকর্ডের ভয় থেকে বাঁচেন!

একটা ভয়ও হয়তো কাজ করে নিরোশান ডিকভেলার মনে। একটাও সেঞ্চুরি না করে টেস্টে সবচেয়ে বেশি ফিফটির যে রেকর্ডটা চেতন চৌহানের ছিল, সেটি তাঁর হয়ে গেছে। এই রেকর্ডের নাগপাশ থেকে মুক্তি না পেলে শেন ওয়ার্নের রেকর্ডটাও না একদিন তাঁর হয়ে যায়! টেস্ট ক্রিকেটে সেঞ্চুরি না করে সবচেয়ে বেশি রান করার রেকর্ডে ডিকভেলার সামনে যে এখন শুধুই শেন ওয়ার্ন।

রেকর্ডটা আগে থেকেই তাঁর ছিল। সেটিকে আরেকটু উঁচুতে তুলে নিলেন নিরোশান ডিকভেলা। তবে মনে হয় না, তাতে তিনি খুশি হয়েছেন! টেস্টে সেঞ্চুরিহীন সবচেয়ে বেশি ফিফটি করার রেকর্ড কি আর খুশি হওয়ার মতো! 

পাল্লেকেলেতে বাংলাদেশের বিপক্ষে দ্বিতীয় টেস্টের প্রথম ইনিংসে অপরাজিত ৭৭ ডিকেওয়ালার ১৮ নম্বর ফিফটি। শ্রীলঙ্কান অধিনায়ক দিমুথ করুনারত্নে ইনিংস ঘোষণা না দিলে কে জানে, হয়তো এই অস্বস্তির রেকর্ড থেকে মুক্তি পেলেও পেতে পারতেন। 'হয়তো' কথাটা লিখেছি, সেঞ্চুরি আরও ২৩ রান দূরে ছিল বলেই শুধু নয়, এর আগে দুবার যে নব্বইয়ের ঘরে গিয়েও সেঞ্চুরি পাননি। 

ডিকভেলার মনে সেই ক্ষত এখনো দগদগে। ওই দুটি নব্বই যে এই বছরেই। জানুয়ারিতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে গল টেস্টে ৯২ রানে আউট হয়েছেন, মাসখানেক পরই আবারও পুড়েছেন এই দুঃখের আগুনে। এবার ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে অ্যান্টিগায় ৯৬ রানে আউট! প্রথম ৯০-টাতে চেতন চৌহানকে ছুঁয়েছেন, দ্বিতীয়টাতে ছাড়িয়ে গেছেন তাঁকে।

কী ছুঁয়েছেন, আর কী ছাড়িয়ে গেছেন, তা তো বুঝতেই পারছেন। সেঞ্চুরি ছাড়া টেস্টে সবচেয়ে বেশি ফিফটি করার রেকর্ড আর কি! সুনীল গাভাস্কারের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী ওপেনিং পার্টনার হিসেবে বেশি বিখ্যাত চেতন চৌহান অনেক বছর যে রেকর্ডটির মালিক ছিলেন।   

ডিকভেলার মতো চৌহানও দুবার নব্বইয়ের ঘরে আউট হয়েছেন। একবার ৯৩ রানে, একবার ৯৭-এ। মজার ব্যাপার হলো (ভু্ক্তভোগীদের জন্য অবশ্যই নয়), ১৯৭৮ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে যে লাহোর টেস্টে চেতন চৌহান ৯৩ রানে আউট হয়েছিলেন, তাঁর বিখ্যাত ওপেনিং পার্টনারও একটু পরই অনুসরণ করেছিলেন তাঁকে। সুনীল গাভাস্কারের স্কোরটা ছিল নব্বইয়ের ঘরে চেতন চৌহানের আরেকটি স্কোরের সমান, মানে ৯৭। আপনার কাছে এর চেয়েও কৌতূহলোদ্দীপক বলে মনে হতে পারে চৌহানকে আউট করা বোলারের নামটা। পাকিস্তান ক্রিকেটের বড়ে মিয়াঁ যে ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে লেগ ব্রেক বোলিং করতেন, তা জানা থাকলে অবশ্য খুব বেশি অবাক হবেন না। জাভেদ মিয়াঁদাদ! টেস্ট ক্রিকেটে মিয়াঁদাদের ১৭টি উইকেট আছে। শিকারের মধ্যে আছেন গ্রেগ চ্যাপেলের মতো ব্যাটিং গ্রেটও।  

ডিকভেলা ও চেতন চৌহান দুবার নব্বইয়ের ঘরে আউট হয়েছেন। শেন ওয়ার্নও তা-ই। ওয়ার্ন আসছেন কেন? আসছেন, কারণ টেস্টে একটাও সেঞ্চুরি না পেয়ে সবচেয়ে বেশি ফিফটি করার রেকর্ডে চার নম্বরেই আছে ওয়ার্নের নাম।দুঃখটাও মনে হয় তাঁরই সবচেয়ে বেশি। এই দুর্ভাগাদের দলে সেঞ্চুরির সবচেয়ে কাছাকাছি যে তিনিই গিয়েছিলেন। ৯৯ রান থেকে বিফল মনোরথে ফিরে আসাও নিজেরই দোষ। প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরিটা একটু স্টাইলেই করা উচিত। হয়তো সেই চিন্তা থেকেই ড্যানিয়েল ভেট্টোরিকে ছক্কা মারতে গিয়েছিলেন। উল্টো ক্যাচ হয়ে যান ডিপ মিড উইকেটে। এই ঘটনা ২০০১ সালের ডিসেম্বরে পার্থ টেস্টের ঘটনা।

সেঞ্চুরিহীন টেস্ট ক্যারিয়ারে সবচেয়ে বেশি রান করার রেকর্ড শেন ওয়ার্নের। ছবি: গেটি ইমেজেসএর সাড়ে তিন বছর পর, ২০০৫ সালের অ্যাশেজ সিরিজে ৯০ রানে আউট হয়েছেন। এর আগে ৮৬ রানে দুবার। শেষ পর্যন্ত টেস্ট সেঞ্চুরি ছাড়াই শেষ করতে হয়েছে ক্যারিয়ার। তবে একটা রেকর্ড তিনি ঠিকই সঙ্গে নিয়ে গেছেন। সেঞ্চুরি না করেই টেস্টে সবচেয়ে বেশি রান (৩১৫৪) করার রেকর্ড। এখনো যা ওয়ার্নেরই আছে।

সেঞ্চুরিহীন টেস্ট ক্যারিয়ারে সবচেয়ে বেশি ফিফটি ও সবচেয়ে বেশি রান দুটি রেকর্ডই এক সময় চেতন চৌহানের ছিল। প্রথমটি থেকে তাঁকে মুক্তি দিয়েছেন ডিকভেলা আর দ্বিতীয়টি থেকে ওয়ার্ন। ২০২০ সালের আগস্টে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ায় এর প্রথমটির আনন্দ অবশ্য পাওয়া হয়নি চেতন চৌহানের। 

সেঞ্চুরি না করে টেস্টে সবচেয়ে বেশি ফিফটি করায় ডিকভেলা-চৌহান এক আর দুই নম্বরে, তা ওয়ার্ন যদি চার হন, তাহলে তিন নম্বরে কে? তিন নম্বরে অস্ট্রেলিয়ান অলরাউন্ডার কেন ম্যাকে। ১৯৫৬ থেকে ১৯৬৩ সালের মধ্যে ৩৭ টেস্ট খেলে ১৩টি ফিফটি করেছেন ম্যাকে, যার একটিকেও সেঞ্চুরিতে রূপ দিতে পারেননি। নব্বইয়ের ঘরেই তো যাওয়া হয়নি। সব সময় যে নিজের দোষে, তা নয়। মূলত আট নম্বরেই ব্যাটিং করতেন। দল অলআউট হয়ে যাওয়ায় দুবার আশির ঘরে নট আউট থাকতে হয়েছে (৮৩ ও ৮৬)। ৮৯ রানের সর্বোচ্চ ইনিংসটার সমাপ্তিতেও ভূমিকা আছে এত পরে ব্যাটিং করার। উইকেটে এসে গেছেন শেষ ব্যাটসম্যান, ম্যাকে তাই ভারতীয় অফ স্পিনার জেসুভাই প্যাটেলকে বাইরে বেরিয়ে মারতে গিয়ে স্টাম্পড হয়ে যান (১৯৬০ সালে চেন্নাই টেস্টে)। 

একটা কথা ভেবে অবশ্য সান্ত্বনা পেতে পারেন কেন ম্যাকে। এই তিনটা ইনিংসের একটা সেঞ্চুরি হয়ে গেলে কেই-বা তাঁকে মনে রাখত! ১৫০৭ রান আর ৫০ উইকেটের ক্যারিয়ার মনে রাখার মতো এমন কিছু তো নয়। তবে নিরোশান ডিকভেলা মনে হয় না, এমন সান্ত্বনায় খুশি থাকবেন। শয়নে-স্বপনে একটা টেস্ট সেঞ্চুরির স্বপ্নই নিশ্চয়ই দেখে যাচ্ছেন শ্রীলঙ্কান উইকেটকিপার। একটা ভয়ও হয়তো কাজ করে মনে। চেতন চৌহানের রেকর্ডটা তাঁর হয়ে গেছে। এই রেকর্ডের নাগপাশ থেকে মুক্তি না পেলে শেন ওয়ার্নের রেকর্ডটাও না একদিন তাঁর হয়ে যায়! টেস্ট ক্রিকেটে সেঞ্চুরি না করে সবচেয়ে বেশি রান করার রেকর্ডে ডিকভেলার সামনে যে এখন শুধুই শেন ওয়ার্ন।

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×