এ বিষের কি নেইকো কোনো শেষ?

এ বিষের কি নেইকো কোনো শেষ?

ফিল্ডার ক্যাচ মিস করা সত্ত্বেও বোলার হাসছেন দেখে দর্শকের মন বলছে, `নিশ্চিত ফিক্সিং হয়েছে।` আম্পায়ার ওয়াইড ডাকছেন না, দর্শক ভেবে ফেলছেন, এ-ও নিশ্চয়ই ফিক্সিংয়েরই খেলা। তারই বা দোষ কোথায়, ক্রিকেটের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ফিক্সিংয়ের বিষবাষ্প এমন করেই ঢুকে পড়েছে, একটু অস্বাভাবিক কিছু দেখলেই সন্দেহ জাগে তার। এই অভিজ্ঞতার কথাই লিখেছেন এক দর্শক।

সাবধান! ক্রিকেটে সাপের আগমন, ছোবল খাবার শঙ্কা!

অপ্রয়োজনে সাবধান করার কোনো প্রয়োজনীয়তা এখন আর দেখছি না। বাগানে কালনাগিনী ঢুকেছে বহু আগেই। ইদানীং মাঝেমধ্যে কামড়ে দিচ্ছে, এই আরকি!

কেউ পাগল হয় প্রেমিকার কিংবা প্রেমিকের, কেউ খেলাধুলার। ক্রিকেটে নাকি ফুটে ওঠে জীবনের প্রতিচ্ছবি। আচ্ছা যে খেলা জীবন বোঝায়, সে খেলা অনেকের জীবন তো নষ্টও করে দেয়! তার পরও যে মানুষ এই খেলার প্রেমে মশগুল থাকে, এর কারণটা কী? বহু কারণ হাজির করতে পারেন আপনি, কিন্ত এ ভালো লাগার মূলে 'অনিশ্চয়তার' কারণটা দেখালে আপনি নিশ্চয়ই দ্বিমত পোষণ করবেন না। আমরা খেলা দেখে যে মজা পাই, অনিশ্চয়তা না থাকলে সে মজাটা কি পেতাম?

ম্যাচের আগে পিচ, প্রতিপক্ষ, নিজের শক্তিমত্তা, আরও কত কী বিবেচনায় নিয়ে সম্ভাবনার কত আলোচনা! অথচ ম্যাচ গড়াতেই দেখা গেল, আপনি যা ভেবেছিলেন, হলো তার উল্টোটা৷ যে ব্যাটসম্যান ফিফটি হাঁকাবেন বলে আপনার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, সে প্রথম বলেই আউট! আপনি যা ভাবতেও পারেননি, চোখের সামনে মঞ্চায়ন হলো তা-ই। আপনি তাই সেসব মুহূর্ত দেখে আনন্দে উল্লসিত হন কিংবা বেদনায় অশ্রুসিক্ত হন। কী হতে চলেছে, তা আগে থেকে জানেন না বলেই তো খেলা দেখতে বসেন আপনি।

কিন্ত হায়! সেই অনিশ্চয়তার খেলায় তো মাঝেমধ্যেই সামান্যতম নিশ্চয়তা ঢুকে যায়। টাকার কাছে বিক্রি হয়ে যায় আপনার বন্ধক রাখা বিশ্বাস।

এই টাকা এক অদ্ভুত জিনিস রে ভাই! যার নেই, তার তো না চেয়ে উপায়ই নেই; এমনকি যার আছে, সে-ও চায়। যার যত আছে, সে চায় আরও। টাকার লোভে পড়েই ভক্ত-অনুরাগীদের বিশ্বাসের সাথে খেলা করেন নায়কেরাও! টাকার কাছে নিজেদের বিকিয়ে দিয়ে ক্রনিয়ে, আজহাররাও ক্ষণিকেই রূপান্তরিত হন খলনায়কে। তাঁদের কল্যাণেই ক্রিকেট অভিধানে যুক্ত হয় নতুন এক শব্দ, 'ফিক্সিং!'

ক্রিকেটের রক্তে 'ফিক্সিং' নামের এ বিষের সঞ্চালনা চলছে বহু কাল ধরেই। নামকরা তারকামহলের তুলনায় ফিক্সিংয়ের বিচরণ ছোট আঙিনাতেই বেশি। বাজিকরদের ঝোঁক অখ্যাত লিগ, অখ্যাত ক্রিকেটারদের দিকে। যার বিষক্রিয়ায় নীল হয়েছেন হিথ স্ট্রিকও। না, খেলোয়াড় হিসেবে নন, কোচ হিসেবে ফিক্সিংয়ে জড়িয়ে তিনি পেয়েছেন আট বছরের নিষেধাজ্ঞা। অথচ এ পাপ থেকে শিষ্যদের দূরে থাকার বাণী শোনানোর কথা ছিল তাঁরই। কিন্ত সেই তিনিই যখন পাপী, তখন হতভম্ব হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না!

ফিক্সিংয়ের বিস্তার চলছেই, এদিকে ওই প্রেমিকদের ক্রিকেট বিশ্বাসের উপরও পড়ছে প্রভাব। নিজের ক্রিকেট বিশ্বাসের উপর এমন ভয়াবহ প্রভাবেরই একটা গল্প বলি। ২০১৯ আইপিএলের ফাইনালে মুখোমুখি মুম্বাই ও চেন্নাই। স্ট্রাইক প্রান্তে তখন পোলার্ড। বল ওয়াইড লাইনের বাইরে দিয়ে গেল, কিন্তু আম্পায়ার ওয়াইড দিলেন না। ব্যাট আকাশের পানে ছুড়ে পোলার্ড ভিন্নধর্মী এক নীরব প্রতিবাদ দেখালেন।

বুমরাহর মুখে কঠিন পরিস্থিতিতেও স্বভাবতই এমন হাসি দেখা যায়; আর আমি কিনা এই হাসির জন্য সন্দেহ করছি যে, তিনি আগে থেকেই জানেন, ম্যাচ জিতবেন। তাই খারাপ সময়েও হাসছেন!

এবার ফিরি মুম্বাইয়ের বোলিংয়ে। তখন মুম্বাইয়ের জন্য পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছেন শেন ওয়াটসন। অথচ সেই ওয়াটসনেরই ক্যাচ ড্রপ হবার পরে হাসতে দেখা যায় বোলার জসপ্রীত বুমরাহকে। ভাবা যায়, তাঁর বোলিংয়ে ক্যাচ ড্রপ, অথচ বুমরাহ হাসছেন!

দেখুন, এই ফিক্সিং কী জঘন্য পরিস্থিতিতেই না আমায় সে সময় ফেলে দিয়েছিল! বুমরাহর মুখে কঠিন পরিস্থিতিতেও স্বভাবতই এমন হাসি দেখা যায়; আর আমি কিনা এই হাসির জন্য সন্দেহ করছি যে, তিনি আগে থেকেই জানেন, ম্যাচ জিতবেন। তাই খারাপ সময়েও হাসছেন। খারাপ অবস্থাতেও বিচলিত না হয়ে বুমরাহর মুখে হাসি ধরে রাখতে পারার এই দারুণ স্বভাবের কথা আমি তো তখন জানতাম না; পরে তাঁকে যত দেখেছি, তত আমার ভুল ধারণা সম্পর্কে পরিষ্কার হয়েছি।

আর কী কান্ড দেখুন! যখন ওয়াইড মুম্বাইয়ের বিরুদ্ধে (তখন ভেবেছি বিরুদ্ধে) দেয়া হলো, তখন ভেবেছিলাম ফিক্সিংয়ে লাভবান হলো এক পক্ষ। ম্যাচ শেষে ভাবলাম অন্য পক্ষ। আরও কী ভেবেছিলাম, জানেন? ওয়াইডটা না দিয়ে আম্পায়ার একটু নিরপেক্ষতা জাহির করলেন আরকি! জিতবে তো মুম্বাই-ই, এখন একটা সিদ্ধান্ত মুম্বাইয়ের বিপক্ষে দেয়াটা নিরপেক্ষতা প্রমাণের খাতিরে মন্দ হবে না! কিন্ত যখন ওয়াইডের নিয়ম জেনে ওই বলটা যে ওয়াইড ছিল না বুঝতে পেরেছি, তখন নিজের নির্বুদ্ধিতার কথা ভেবে নিজেই হেসেছি! পোলার্ড ওই বলটাতে স্টাম্প ছেড়ে অফ সাইডের দিকে অনেকখানিই সরে এসেছিলেন, তাই বল দাগের বাইরে দিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও ওয়াইড ডাকেননি আম্পায়ার। কিন্ত এ ঘটনায় নিজের নির্বুদ্ধিতায় আমার কোন দুঃখবোধ নেই। বিশ্বাসে যদি অবিশ্বাসের ছিটেফোঁটাও না পড়ত, তাহলে তো এমন ভাবনাই জন্মানোর কথা না!

দর্শক যেকোনো খেলারই প্রাণ। প্রাণহীন সে খেলার রূপ কেমন হবে, চোখের সামনেই এরকম উদাহরণে ভরা বলে তা অনুমান করার কষ্টও করতে হবে না। তবে এই ফিক্সিং কিন্তু খেলার প্রাণনাশেই ভূমিকা রাখছে। বহু দর্শক একেবারেই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন এ খেলা থেকে। ফিক্সিংয়ের বিস্তারে সবচেয়ে বড় ক্ষতি হচ্ছে ক্রিকেটের সাথে দর্শকদের বিচ্ছেদ ঘটাতেই। বিশ্বাসের অভাবে নষ্ট হয় সম্পর্ক। ফিক্সিং নষ্ট করছে ক্রিকেটপ্রেমীদের সাথে ক্রিকেটের সম্পর্ক, ফিক্সিংয়ের কারণে উৎপাদিত আর সব ক্ষতি ভুলে সবচেয়ে বড় ক্ষতি তাই এটিকেই মনে হয়।

আর এখন তো ফিক্সিংয়ের আঁতুড়ঘর হিসেবে বিবেচিত ফ্র‍্যাঞ্চাইজি লিগে সয়লাব ক্রিকেটাঙ্গন। ওঝা আইসিসির 'অ্যান্টি করাপশন ইউনিট' লেগে আছে এ বিষ ঝাড়তে, তবু মনে হয়--এ বিষের নেইকো শেষ!

আমার দর্শকমনও তাই বিশ্বাস-অবিশ্বাসের পেন্ডুলাম দুলতেই থাকে, অঘটন দেখলেই মন বলে ফিক্সিং। বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের এ অন্তর্দ্বন্দ্বে পড়ে খেলা দেখার আনন্দই না হারিয়ে ফেলি! এ দোলাচলে পড়ে খেলা উপভোগ করা থেকেই না বঞ্চিত হয়ে যাই! তাই তো ফিক্সিং সংশয় 'এক কানে গ্রহণ ও অপর কানে নির্গমন' করে খেলা উপভোগের চেষ্টায় থাকি।

আপনিও কি এই ফর্মুলাটাই প্রয়োগ করছেন? নাকি আগামীতে সেটা প্রয়োগ শুরু করবেন বলে ভাবছেন?

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×