বাংলাদেশের স্পিনাররা কেন ফ্লাইট দিতে পারে না?

বাংলাদেশের স্পিনাররা কেন ফ্লাইট দিতে পারে না?

শুভ্র.আলাপে মেহরাব হােসেন অপি ও উৎপল শুভ্র

শেষ দিনে অলৌকিক কিছু ঘটেনি। লাঞ্চ পর্যন্তও টিকতে পারেনি বাংলাদেশ। শ্রীলঙ্কান নবীন দুই স্পিনার মিলে ১৭ উইকেট নিয়ে বাংলাদেশকে উপহার দিয়েছেন বড় পরাজয়ই। উৎপলশুভ্রডটকমের ইউটিউবে নিয়মিত আয়োজন শুভ্র.আলাপে উৎপল শুভ্র ও মেহরাব হোসেন অপি ব্যবচ্ছেদ করলেন বাংলাদেশের পরাজয়ে। আরও অনেক প্রসঙ্গ অন্য সময়ের জন্য তুলে রেখে এখানে থাকল শুধু টেস্ট নিয়ে কথাবার্তাই।

আগের চার দিন যা হয়েছে, সবটা মেনেও বাংলাদেশের পক্ষে ফল আনতে গেলে পাল্লেকেলেতে পঞ্চম দিন সকালে ব্যাট হাতে নামতে হতো রাহুল শারদ দ্রাবিড় আর ভাঙ্গিপুরাপু ভেঙ্কট সাই লক্ষ্মণের (২০০১ কলকাতা টেস্টের কথা মনে করিয়ে দেওয়াটা কি খুব প্রয়োজন?)। কিন্তু করোনা মহামারীর এই সময়টায় একজন বসে আছেন বেঙ্গালুরুতে, অপরজন সানরাইজার্স হায়দ্রাবাদের অংশ হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন ভারতের এক হোটেল থেকে অন্য হোটেলে। পাল্লেকেলেতে ব্যাট হাতে তাই নামতে হলো আগের দিনের অপরাজিত দুই ব্যাটসম্যান লিটন দাস আর মেহেদি হাসান মিরাজকেই। দ্রাবিড়-লক্ষ্মণ তো দূর অস্ত, তাঁদের ব্যাটে দেখা গেল না প্রতিরোধের ছিটেফোঁটাও । শেষ দিনে ৮০ মিনিট ব্যাট করেই বাংলাদেশ গুটিয়ে গেল ২২৭ রানে। খুব বেশি হা-হুতাশ অবশ্য হচ্ছে না, এই ফলটাই তো অনুমিত ছিল।

উৎপলশুভ্রডটকম-এর ইউটিউব চ্যানেলে বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা সিরিজ উপলক্ষে নিয়মিত আয়োজন শুভ্র.আলাপে আজ অতিথি হয়ে এসেছিলেন মেহরাব হোসেন অপি। প্রথম প্রশ্নেই যেন তাঁর বাস্তববাদিতার পরীক্ষায় নিতে চাইলেন উৎপল শুভ্র, 'শেষ দিনের পুরোটা ব্যাট করে ম্যাচ বাঁচিয়ে ফেলবে বাংলাদেশ, এমন স্বপ্ন অপি দেখেছিলেন কি না।' অপির উত্তরে তাঁকে লেটার মার্কসই দিতে হচ্ছে। হারটা যে হবেই, এ নিয়ে নিঃসংশয়ই ছিলেন তিনি। তবে হারের ব্যবধানটা ২০৯ রান না হয়ে আরও কম হবে বলে প্রত্যাশা ছিল তাঁর।

কেন পরাজয়ের ব্যাপারে সুনিশ্চিত ছিলেন তিনি, দিলেন সে ব্যাখ্যাও, 'উইকেটে যে টার্ন হচ্ছিল, আগের ব্যাটসম্যানরা কেউই কিন্তু এতে সাবলীল ছিলেন না। আপনি যদি দেখেন, আমাদের সব ব্যাটসম্যানই সেট হয়ে আউট হয়ে এসেছে। ফার্স্ট কিংবা সেকেন্ড ইনিংস দেখে মনেই হয়নি, আমাদের ব্যাটসম্যানরা তাদের স্বাভাবিক খেলাটা খেলতে পেরেছে। এ কারণেই নিশ্চিত ছিলাম, আমরা হারার পথেই আছি।'

আর বাংলাদেশকে হারানোর কাজটা শ্রীলঙ্কা সম্পন্ন করেছে দুজন স্পিনারকে দিয়েই। ২০ উইকেটের ১৭টিই নিয়েছেন প্রাভিন জয়াবিক্রমা আর রমেশ মেন্ডিস। ১১-১৭৮ বোলিং ফিগারে জয়াবিক্রমা তো গড়ে ফেলেছেন অভিষেক টেস্টে কোনো বাঁহাতি স্পিনারের সেরা বোলিংয়ের কীর্তি, ভেঙেছেন আলফ ভ্যালেন্টাইনের ৭১ বছর বয়সী পুরোনো রেকর্ড (ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যানচেস্টারে তাঁর বোলিং বিশ্লেষণ ছিল ১১-২০৪)। বোলিং-হাসি মিলিয়ে জয়াবিক্রমা যে তাঁকে মন্ত্রমুগ্ধ করে ফেলেছেন, এ কথা তো উৎপল শুভ্র আগেই জানিয়েছিলেন। আজ তাই অপির কাছে জানতে চাইলেন, জয়াবিক্রমা কি তাঁকেও জয় করে নিয়েছেন?

কী বোলিংয়ে কী হাসিতে, জয়াবিক্রমা জয় করে নিয়েছেন সবাইকে। ছবি: এসএলসি

অপি বলছেন, নিয়েছেন। 'অসাধারণ লেগেছে। কোনো ডেব্যু ম্যাচে এ ধরনের পারফরম্যান্স করাটাও কিন্তু বিরাট বড় একটা চ্যালেঞ্জের ব্যাপার। তিনি যে লাইন-লেংথ মেইনটেইন করেছেন, বলের গতি যতটুকু ছিল, দ্যাট ওয়াজ আউটস্ট্যান্ডিং। আমাদের স্পিনারদের সাথে তাঁর ফার ডিফারেন্স ছিল।'

কোথায় পার্থক্য ছিল, তা-ও ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করলেন অপি। জয়াবিক্রমার করা বেশিরভাগ বলই যেখানে স্টাম্পে আঘাত করত, বাংলাদেশি স্পিনারদের ক্ষেত্রে সংখ্যাটা খুবই নগণ্য। আর টেস্ট ক্রিকেটে স্টাম্পের বাইরের বলগুলোকে তো ব্যাটসম্যানরা নিরাপদে ছেড়ে দেওয়ার পথেই বেশি হাঁটেন।

কিন্তু স্টাম্পে বল করলেও জয়াবিক্রমার বলগুলো যে 'আনপ্লেয়েবল' ছিল না, অপি জানাচ্ছেন তা-ও। আক্রমণাত্মক হতে গিয়ে উইকেট খুইয়ে এসেছেন প্রায় সবাই। এই বাজে ব্যাটিং প্রদর্শনীর কারণ হিসেবে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের অতিরিক্ত ইতিবাচক মানসিকতারই দোষ দেখছেন অপি, 'চতুর্থ দিন নাজমুল হোসেন শান্ত বলে গেলেন, "আমরা পজিটিভ থাকার চেষ্টা করেছি।" অবশ্যই পজিটিভ থাকা ভালো। তবে কিছু সময় আপনাকে নেগেটিভও হতে হবে, যেখানে আপনি জানেন, আমরা এই টেস্টটা সেভ করার জন্য যাচ্ছি। যদি আমরা একটু কেয়ারফুলি ব্যাটিং করতাম, তবে তাকে (জয়াবিক্রমা) এরকম সাকসেসফুল হতে হয়তো আমরা দেখতাম না।'

জয়াবিক্রমা যে তরিকায় বল করে সাফল্য পেলেন, বাংলাদেশি স্পিনাররা ব্যর্থ হলেন তার উল্টোপথে হেঁটেই। শুভ্র.আলাপে গত কয়েকদিনে এ প্রসঙ্গে মত নেওয়া হয়েছে প্রায় সব আমন্ত্রিত অতিথিরই, উৎপল শুভ্রও এবারের সিরিজে শেষবারের মতো মনে করিয়ে দিলেন, 'ফ্লাইট দেয়াটা আমাদের স্পিনারদের দক্ষতার জায়গা না, তাঁরা একটু ওয়ানডে স্টাইলে বল করতেই অভ্যস্ত। টার্ন আদায় করা, ফ্লাইটে ব্যাটসম্যানদের বোকা বানানো খুবই কঠিন তাই তাঁদের জন্য। টেস্ট ম্যাচে গিয়ে এ জন্যে আমরা তাই বড় রকমের মার খেয়ে যাই।'

এই দুজনের ঘূর্ণিতেই ম্যাচ ও সিরিজ হেরেছে বাংলাদেশ। ছবি: এসএলসি

মিরাজের ফ্লাইট কম দেওয়ার কারণ হিসেবে শেষ দুই বছরে তাঁর বেশি বেশি ওয়ানডে আর টি-২০ খেলাকেই কারণ হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা করলেন অপি। যা শুনে উৎপল শুভ্র যৌক্তিক প্রশ্নটাই তুললেন, তা কি রবিচন্দ্রন অশ্বিন কিংবা রবীন্দ্র জাদেজার চেয়েও বেশি? বাংলাদেশের স্পিনাররা সারা বছরে যতগুলো টি-টোয়েন্টি খেলেন, অশ্বিন-জাদেজারা তো কখনো কখনো এক আইপিএলের দুই মাসেই তো এর চেয়ে বেশি খেলে ফেলেন। কিন্তু এরপরও তাঁদের টেস্ট বোলিংয়ে আইপিএলের প্রভাবটা টের পাওয়া যায় না কেন? তাঁরা তো ঠিক ভিন্ন ভিন্ন ফরম্যাটে মানিয়ে নেন নিজেদের। বাংলাদেশের স্পিনাররা কেন পারেন না? এটা কি স্কিলের ঘাটতি, নাকি মানসিকতার সমস্যা?

স্কিলের ঘাটতির কথা স্বীকার করে নিয়ে অপি আরেকটা কারণের দিকেও দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। এই স্কিলের তফাৎটা তৈরি হয় ভারতের স্পিনাররা আইপিএলের মতো ঘরোয়া ক্রিকেটেও প্রচুর ম্যাচ খেলেন বলে। তাই টেস্ট ম্যাচে কিংবা টি-টোয়েন্টি ম্যাচে কীভাবে বল করতে হয়, এই কৌশলটা তারা খুব সহজেই রপ্ত করে ফেলেছেন। ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচের পর্যাপ্ত অভিজ্ঞতা না থাকাতেই বাংলাদেশি স্পিনাররা বল করার কৌশলটা শিখতে চেষ্টা করেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে গিয়ে। তখন দলে জায়গা ধরে রাখার চেষ্টাটাও খেলোয়াড়দের মনে প্রভাব ফেলে বলে অভিমত তাঁর।

সিরিজে বাংলাদেশের ফিল্ডিংটা সবচেয়ে দৃষ্টিকটু অপির। ব্যাটিং-বোলিংয়ের পাশাপাশি বাংলাদেশের ফিল্ডিংয়েও প্রচুর উন্নতির সুযোগ দেখেন অপি। এই ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের বাদবাকি দলগুলোর চাইতে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে আছে বলেই মনে হচ্ছে তাঁর। 'এটা এমন একটা জায়গা যেখানে ব্যাটিং-বোলিংয়ে খারাপ করেও ভালো কিছু করার সুযোগ থাকে' বলে তিনি বলছেন, একাদশে থাকা সবারই তো এখানে অবদান রাখার সুযোগ আছে। এজন্য করণীয়টা কী, তা সবারই জানা থাকার কথা। তারপরও তা মনে করিয়ে দিলেন। ব্যাটিং-বোলিং অনুশীলনের পাশাপাশি বাংলাদেশের ফিল্ডিং সেশনের দৈর্ঘ্য বাড়ানো। উৎপল শুভ্র দলীয় প্র্যাকটিসের বাইরের আলাদাভাবে অনুশীলন করার ওপর জোর দিলেন। ১৯৯৯ বিশ্বকাপে জন্টি রোডস ও হার্শেল গিবসের একটা ফিল্ডিং প্র্যাকটিস সেশন দেখার অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতার কথাও শেয়ার করলেন দর্শকের সঙ্গে। এরপর এ নিয়ে জন্টি রোডসের সঙ্গে কী কথা হয়েছিল, তা-ও। গল্পটা অনেক বড়। রোডসের মূল কথাটাই শুধু এখানে জানানো যাক। প্র্যাকটিসে আপনি যা করতে পারেন না, মাঠে তা কীভাবে করবেন? ওখানে তো আরও চাপ, আরও অনেক বেশি ভ্যারিয়েবলস্।

টেস্টের মাঝখানে কোচ রাসেল ডমিঙ্গো ব্যাটিং ব্যর্থতার কারণ হিসেবে যে দুই দিন ফিল্ডিং করে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের ক্লান্তির কথা বলেছেন, তা নিয়ে তীব্র আপত্তি জানালেন অপি। দুদিন ফিল্ডিং করে ক্লান্ত হওয়াটা স্বাভাবিক, কিন্তু তা প্রকাশ্যে বলাটা দলে একটা নেগেটিভ মেসেজ দেয়, আপত্তিটা সে কারণেই। কথাটা শুনে উৎপল শুভ্র এমন গম্ভীর মুখে 'ডমিঙ্গাের তো এমনই বলার কথা। টেস্ট ইতিহাসে কোনো দলের দুদিন ফিল্ডিং করার ঘটনা তো এই প্রথম' বলে টিপ্পনী কাটলেন যে, অপি প্রথমে তা বুঝতেই পারেননি। বুঝতে পারার পর তাঁর মুখেও হাসি। তখন উদাহরণ হিসেবে সামনে এসে গেলেন শ্রীলঙ্কান অধিনায়ক দিমুথ করুনারত্নে। যিনি প্রথম টেস্টে প্রায় দুদিনের বেশি ফিল্ডিং করার পর ডাবল সেঞ্চুরি করেছেন। শুভ্র মনে করিয়ে দিলেন, সেই টেস্টের প্রথম ২৪ ঘণ্টাই মাঠে ছিলেন করুনারত্নে।

আরও একবার বিজয়-স্মারক স্টাম্প উঠেছে প্রতিপক্ষ দলের খেলোয়াড়দের হাতে। ছবি: এসএলসিসিরিজ-উত্তর সংবাদ সম্মেলনে এসে মুমিনুল হক বলে গিয়েছেন, এই পরাজয়েই সব শেষ দেখছেন না। এই সিরিজ থেকে ইতিবাচক অনেক কিছুই খুঁজে নেওয়ার আছে বলে জানিয়েছেন তিনি। শুভ্র.আলাপের অতিথি মেহরাব হোসেন অপিকেও জিজ্ঞাসা করা হলো, এই সিরিজ থেকে কিছু ইতিবাচক দিক কী আছে, যা সামনে বয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে?

বোলারদের টানা বল করে যাওয়া, তাসকিনের প্রত্যাবর্তন, তামিমের ব্যাটিং, প্রথম টেস্টে শান্ত-মুমিনুলের বড় ইনিংসের পাশাপাশি পাঁচ দিনে টেস্ট নিয়ে যাওয়াতেই সন্তুষ্টি খুঁজছেন তিনি, 'এটা একটা পজিটিভ দিক যে, আমরা এখন পাঁচ দিন পর্যন্ত নিতে পারি টেস্ট ম্যাচ। লাস্ট দুই বছরে অনেক অনেক শক্তিশালী দলের ম্যাচ কিন্তু তিন-সাড়ে তিন দিনে শেষ হয়ে গিয়েছে। এই সিরিজটাকে আমরা একটু আলাদা করে যদি দেখি, দুটি টেস্ট ম্যাচই কিন্তু পাঁচ দিনে গড়িয়েছে। আমরা পাঁচ দিন দাঁড়িয়ে থেকে লড়াই করতে পারছি, এটাও আমার কাছে বিরাট অ্যাচিভমেন্ট মনে হয়।'

একুশ বছর টেস্ট খেলেও পাঁচ দিনে টেস্ট নেওয়াতেই সার্থকতা? উৎপল শুভ্র আবার একটু টিপ্পনীই কাটলেন।

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×