রস গ্রেগরিকে দিয়ে নতুন করে গফরগাঁও চেনা
উৎপল শুভ্র
৯ মে ২০২১
রস গ্রেগরিকে চেনেন? ব্র্যাডম্যানের দলে খেলেছেন, ক্যারিয়ারের শেষ ইনিংসে করেছেন ৮০ রান, জানতেন? না জানলেও বিব্রত হওয়ার কিছু নেই। না-ই জানতে পারেন, ২০০৫ সালের আগে আমিও তো জানতাম না। জেনেছিলাম ডেভিড ফ্রিথের সৌজন্যে, কখনো বাংলাদেশে না এসেও যিনি আমাকে গফরগাঁও চিনিয়েছিলেন!
‘তুমি গফরগাঁও চেনো? গিয়েছ কোনো দিন?’
ইংরেজিতে আপনি-তুমি ভেদ নেই। তার পরও ইংরেজি ‘you’টা বাংলায় ‘তুমি’ শোনাল প্রশ্নকর্তার বয়স ৬৮ বলে। কিন্তু বিখ্যাত ক্রিকেট লেখক—ক্রিকেট ইতিহাসবিদ হিসেবেই যাঁর বেশি পরিচিতি—তিনি বাংলাদেশের সাংবাদিকের সঙ্গে পরিচিত হয়েই গফরগাঁও নিয়ে এমন ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লেন কেন?
খুবই অবাক হয়েছিলাম। ডেভিড ফ্রিথের সঙ্গে এই পরিচয়-পর্ব ২০০৫ সালের মে মাসে। লর্ডসে বাংলাদেশ-ইংল্যান্ড টেস্ট ম্যাচ। প্রেসবক্সে আমার সামনের সারিতেই বসেছেন। নাম তো অনেক আগে থেকেই জানি, ছবিও দেখেছি। লেখাও পড়েছি অনেক, বই-টইও।
লাঞ্চের সময় নিজেই যেচে পরিচিত হলাম। বাংলাদেশের সাংবাদিক শুনেই ফ্রিথের ওই প্রশ্ন—‘তুমি গফরগাঁও চেনো? গিয়েছ কোনো দিন?’ বিস্ময়ের ধাক্কাটা সামলে আমি বললাম, ‘ট্রেনে আমার বাড়িতে যাওয়ার পথেই গফরগাঁও স্টেশন পড়ে। তবে নামিনি কখনো। গফরগাঁও বড় বড় গোল বেগুনের জন্য খুব বিখ্যাত।’
শুনে ফ্রিথের হো হো হাসি, ‘তোমার কি ধারণা, বেগুন আমার খুব প্রিয় সবজি? এ কারণেই গফরগাঁও নিয়ে আগ্রহ?’ আমি বললাম, ‘সেটি হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি দেখছি না। তবে তোমার মুখে গফরগাঁওয়ের কথা শুনে একটু অবাকই হয়েছি। ঘটনা কী?’
ফ্রিথ ঘটনা খুলে বললেন। রস গ্রেগরি নামটার সঙ্গে সেই প্রথম পরিচয়। ক্রিকেট ইতিহাস সম্পর্কে জানাশোনা নিয়ে একটু গর্বই ছিল। সেটি ধূলিসাৎ হয়ে গেল এই অজ্ঞানতায়। ফ্রিথ দ্রুতই জ্ঞানের আলো জ্বালানোর দায়িত্ব নিলেন। ব্র্যাডম্যানের দলের হয়ে খেলা দুই টেস্টে ৫১ অ্যাভারেজ, শেষ টেস্ট ইনিংসে ৮০—অথচ বিস্ময়করভাবে মাস কয়েক পর ১৯৩৮ সালের ইংল্যান্ড সফরের দলে জায়গা পাননি। এরপর তো শুরু হয়ে গেল বিশ্বযুদ্ধই। সেটিই রস গ্রেগরির গল্পটাতে যোগ করেছে অন্য মাত্রা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুদ্ধবিমানের পাইলট ছিলেন গ্রেগরি, বিমান বিধ্বস্ত হয়ে মারা গেছেন। মনোযোগী শ্রোতা পেয়ে ফ্রিথ এক নিঃশ্বাসে বলে গেলেন রস গ্রেগরি-বৃত্তান্ত। কিন্তু এখানে গফরগাঁও আসছে কোত্থেকে? কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ফ্রিথ নাটকীয় ভঙ্গিতে ঘোষণা করলেন, ‘রস গ্রেগরির বিমানটি বিধ্বস্ত হয়েছিল তোমাদের গফরগাঁওয়ে।’
এ-ও জানালেন, ঢাকায় ব্রিটিশ হাইকমিশনের লোকজনের মাধ্যমে বিমান দুর্ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজনের ভাষ্য জোগাড় করেছেন। এর সঙ্গে রস গ্রেগরির শৈশব-কৈশোর, ক্রিকেট ক্যারিয়ার ও সামরিক জীবন মিলিয়ে দ্য রস গ্রেগরি স্টোরি নামে ঢাউস একটা বইও লিখে ফেলেছেন। দুই বছর আগে প্রকাশিত বইটার কোনো কপি সঙ্গে নেই বলে আফসোস করলেন। থাকলে আমাকে উপহার দিতেন। ‘তোমাকে কী দিই-কী দিই’ বলতে বলতে ব্যাগ থেকে বের করে দিলেন একটা ডিভিডি। ১৯৩০ দশকের ক্রিকেট নিয়ে তাঁরই নির্মিত একটা ডকুমেন্টারি: নাইনটিন থার্টিস্ লেজেন্ডস্। ব্র্যাডম্যান-পন্সফোর্ড-ম্যাককেবে-গ্রিমেট-লারউড-ও’রিলিদের মতো ক্রিকেট কিংবদন্তির দুর্লভ সব ফুটেজের এক সংকলন। মাঝেমধ্যেই এটি দেখি আর ডেভিড ফ্রিথের কথা মনে পড়ে।
মনে পড়ে সেই কথাটাও, যা শুনে থ হয়ে গিয়েছিলাম। কী একটা সূত্রে খবর পেয়েছেন, বিমান দুর্ঘটনায় নিহত সবাইকে নাকি গফরগাঁওয়ে গণকবর দেওয়া হয়েছে। এরপর নির্বিকার মুখে ফ্রিথ বললেন, ‘আমার ইচ্ছা, টাকাপয়সার বন্দোবস্ত করে গফরগাঁওয়ে গিয়ে মাটি খুঁড়ে রস গ্রেগরির দেহাবশেষ খুঁজে বের করা। কী, কাজটা ভালো হবে না?’
ইচ্ছাটার মধ্যে এমনই অভিনবত্ব যে, আমি তাৎক্ষণিকভাবে প্রশ্নটার কোনো জবাব দিতে পারিনি। পরে যখন দেখা হয়েছে, বলেছি, সত্যি সত্যিই বাংলাদেশে এলে আগেই জানাতে। ডেভিড ফ্রিথ এখনো কিছু জানাননি। অনুমান করছি, বাংলাদেশে আসেনওনি। হয়তো আর আসবেনও না। বয়স হয়ে গেছে ৭৪, খোঁড়াখুঁড়ির কাজে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য একটু বেশিই!