আবেগের চৌবাচ্চার মধ্যে কিছু সবুজ ঘাস

আবেগের চৌবাচ্চার মধ্যে কিছু সবুজ ঘাস

তাঁর বাবা-মায়ের দেশে প্রথম আসার সেই অনুভূতি তিনি এখনো স্মরণ করতে পারেন। ১৯৮৮ এশিয়া কাপ দিয়ে সেই যে শুরু, ক্রিকেট কভার করতে এরপর আরও অনেকবারই বাংলাদেশে এসেছেন গৌতম ভট্টাচার্য। সেই অভিজ্ঞতার বর্ণনার সঙ্গে বাড়তি হিসেবে নানা বিষয়ে ঢাকা আর কলকাতাকে নামিয়ে দিয়েছেন মজার এক প্রতিযোগিতায়।

 

বিরিয়ানি: কলকাতা

শাড়ি: ঢাকা

চাইনিজ: কলকাতা

মিষ্টি: ঢাকা

থাই: কলকাতা

ট্রাফিক: কলকাতা

আতিথেয়তা: ঢাকা

নাইট  ক্লাব: কলকাতা

মাছ: ঢাকা

রবীন্দ্রচর্চা: ঢাকা

বই-এর দোকান: কলকাতা

প্রথম সেই যে ১৯৮৮ তে ঢাকায় ক্রিকেট কভার করতে গেছিলাম, সেই সময় থেকে প্রতিবার বাংলাদেশে পা দেওয়ার সময় কেন জানি না একটা অদৃশ্য দাঁড়িপাল্লা মনের মধ্যে কাজ করতে শুরু করে । কোন শহর কিসে এগিয়ে? আজকের কোভিড-সন্ত্রস্ত কলকাতার বুকে যেমন পালস অক্সিমিটার নামক ইতিপূর্বে সম্পূর্ণ অপরিচিত এক যন্ত্রে একটু পর পর শারীরিক অবস্থা পরীক্ষা অনিবার্য হয়ে  গিয়েছে, এটা অবশ্যই তেমন দুঃখজনক রুটিন নয়। কিন্তু সেই স্কোরবোর্ডটা ঢাকা ইমিগ্রেশন পেরোলেই কেমন অজান্তে চালু হয়ে যায় আর বিভিন্ন সফরে রিভিশন হয় ।  

যেমন থাই রান্নায় বললাম কলকাতা এগিয়ে। কিন্তু কলকাতার এক রেস্তোরাঁ  মালিক, ভোজনপ্রিয় বন্ধু আছে, যে কিছুতেই মানবে না। সে অনেক শনিবার রাতে বন্ধুসহ ঢাকা ঘুরে আসে গুলশানের একটা থাই রেস্তোরাঁয় খেতে। পরের বার বাংলাদেশ সফরে আমায় ওখানে একবার যেতেই হবে। আর তারপর স্কোরবোর্ডটা বদলে যাওয়া বিচিত্র নয়। প্রথম বাংলাদেশ গেছিলাম এশিয়া কাপ কভার করতে। তার আগে শ্রীলঙ্কা, আমিরশাহী, এমনকি ইংল্যান্ড ট্যুর কভারেজ হয়ে  গিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ যাওয়ার মাহাত্ম্যই আলাদা। নিজের বাবা-মার দেশ বলে কথা। বিদেশি টুর্নামেন্ট কভারেজ কী ভয়ঙ্কর চাপ বয়ে আনে, আধুনিক সাংবাদিকমাত্রই তা জানেন। তার সঙ্গে একটা বাড়তি মোচড় ছিল, কী  দেখব সেই দেশে গিয়ে, যা বলতে গেলে আমাদের কৈশোরকে রোমাঞ্চিত করে চোখের সামনে জন্ম নিয়েছে। ঢাকাতে এক পেন ফ্রেন্ড ছিল আমার। বাংলাদেশের স্ট্যাম্প লাগানো তার চিঠি যখন আমার দক্ষিণ কলকাতার বাড়ির লেটার বাক্স থেকে বার করতাম, বুকে অদ্ভুত একটা মোচড় দিত। সেই দেশে কিনা যাচ্ছি!

দুটো জায়গায় খেলা ছিল। ঢাকা আর চট্টগ্রাম। হোটেলের খাবার সেই দুটো শহরে কেমন ছিল বলতে পারব না, কারণ দু বেলা কোথাও না কোথাও দাওয়াত থাকত। বাংলাদেশি আতিথেয়তার সঙ্গে সেই প্রথম পরিচয়। ফেরার দিন ফ্লাইট ধরার আগে হুড়মুড়িয়ে তখনকার ঢাকা স্টেডিয়ামের কাছে একটা দোকান থেকে জীবনের প্রথম ভিসিডি প্লেয়ার কিনেছিলাম। কলকাতায় তখন ভিসিডি প্লেয়ারের দাম দ্বিগুণ ছিল। কলকাতা কাস্টমস কৃতজ্ঞচিত্তে সামান্য ডিউটি নিয়ে সেটা পাস করে দেয়। কারণ ফিরেছিলাম এশিয়া কাপজয়ী ভারতীয় দলের সঙ্গে। যার শিরোমনি ছিলেন মোহিন্দর  অমরনাথ। ইমরান নেই, মিঁয়াদাদ নেই। হীনবল পাকিস্তান। কিন্তু তা নিয়েই এমন স্পিনের জূজূ কাদির ভারতের ওপর তৈরি করেন যে, তারা ম্যাচ হারতে বসেছিল। বাঁচিয়ে দেন মোহিন্দর।

ফিরেই রিচার্ড হ্যাডলির সামনে বেঙ্গালুরুতে ভারত। কৃতজ্ঞ অধিনায়ক বেঙ্গসরকার নির্বাচকদের বলেন যে, গোটা বাংলাদেশ সফরে রবি শাস্ত্রী তাঁকে  প্রচন্ড ভুগিয়েছেন। শাস্ত্রীকে বাদ দিয়ে যেন মোহিন্দরকে সহ-অধিনায়ক  করা হয়। রাজ সিংহ দুঙ্গারপুর তখন চেয়ারম্যান অফ সিলেক্টর্স। তিনি বললেন, ও, তার মানে এরা দল করতে চাইছে। শাস্ত্রীকে বহালতবিয়তে রেখে তিনি বাদ দিয়ে দিলেন কিনা মোহিন্দরকে। আজ চির বিস্ময়কর সেই বাদ পড়া। তারপর যা ঘটেছিল, সেটাও একইরকম ঐতিহাসিক। মোহিন্দর সাফ বলে দেন, এরা একদল জোকার ।

প্রথম বাংলাদেশ সফরের আর একটা ঘটনা মনে আছে সোনারগাঁও হোটেলে ডিনার চলাকালীন। রাত্তির দশটা নাগাদ আমরা কয়েকজন সাংবাদিক বসে খাচ্ছি। হঠাৎ পেছন থেকে সুনীল গাভাস্কর এসে হাজির। সদ্য এক বছর আগে রিটায়ার করেছেন এবং তুঙ্গ জনপ্রিয়তা। খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে তাঁকে। আমাকে এবং দেবাশিস দত্তকে বললেন, যে ইন্টারভিউ আমার নিয়েছিলে, সেটা কি ছাপতে চলে গ্যাছে? কোনোভাবে ফেরানো যায় আমার একটা মন্তব্য? সাংবাদিকেরা এই পরিস্থিতিতে যা বলে থাকে, আমরা সেটাই বললাম। কাগজ প্রায় ছাপা হয়ে গ্যাছে। গাভাস্কার অনুতাপের ঘাড়  নাড়লেন।

কী  ছিল মন্তব্যটা? "বেঙ্গসরকারকে বাদ দিলে মুম্বইয়ের সেরা ব্যাটসম্যান এখন এই ছেলেটা। চোখ রাখুন ওর দিকে। আমি তো আপ্লুত।"

ছেলেটির নাম সচিন তেন্ডুলকর। ছেলেই, কারণ তখন বয়েস পনেরো। সবে রঞ্জিতে আবির্ভাব ঘটেছে এবং গাভাস্করের মনে হয়েছিল, এখনই তিনি প্রশংসা করলে কিশোরের সেটা বইতে অসুবিধে হবে।

ঢাকার মাঠেই সেই কিশোরে=কেই যখন দেখলাম ---সাল  ও সময় দশ বছর এগিয়ে ১৯৯৮। তিনি তো শুধু নন, প্রতিদ্বন্দ্বী ব্রায়ান লারাও এসে পড়েছেন। ঢাকার ময়দান জুড়ে তখন ক্রিকেটের রামধনু। আমি সেই ক্রিকেটমেলার ভেতর দুটো রাজনৈতিক কপি করি। একটা এরশাদের বাড়িতে তাঁর ইন্টারভিউ। যার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির গলফ পার্টনার এবং ক্রিকেট কর্তা সৈয়দ আশরাফুল হক। অন্যটা প্রচণ্ড মৌলবাদী বিক্ষোভে অন্তরীণ থাকা তসলিমা নাসরিনের ইন্টারভিউ। সৌজন্যে প্রথম আলোর ডাকসাইটে সম্পাদক মতি ভাই। দুটোই খুব বিতর্কিত হয়ে গেল। এরশাদ বললেন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রেমিকা থাকা দোষের নয়। অন্য সব কবির সাত খুন মাফ। কেবল আমি প্রেম করলেই সমস্যা? বললেন তাঁর প্রাক্তন বান্ধবী জিনাত কীভাবে তাঁকে ঠকিয়েছেন। মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে দুটো বার হতে হুলুস্থূল। মানবজমিন পত্রিকা লিখেছিল যে, আনন্দবাজার তাদের সিআইএ এজেন্টকে কভারেজে পাঠিয়েছে। শুভানুধ্যায়ীরা খুব চিন্তিত হয়ে পড়লেন আমার নিরাপত্তা নিয়ে। শেষ পর্যন্ত অপ্রীতিকর কিছু ঘটেনি। কিন্তু সেই প্রথম দেখি সুজলা সুফলা চির অতিথিবৎসল দেশের অসহিষ্ণু মুখ।

অন্তত আটটা ঢাকা সফর করেছি। জমিয়ে প্রতিবার ইলিশ খেয়েছি। রবীন্দ্রচর্চার গভীরতা দেখে মুগ্ধ হয়েছি। ছায়ানটে গেছি। জামদানি কিনে নিয়ে গেছি। মানুষের উষ্ণতা ভোগ করেছি। রমনা পার্কে হেঁটেছি। ঢাকার কাগজে লিখেছি।একগাদা সাংবাদিকের সঙ্গে প্রগাঢ় হয়েছে।

এশিয়া কাপ আবার এসে পড়ল ২০০০ সালে। জুনেই। এবারও ঝড় নিয়ে। কারণ গড়াপেটা ও হ্যান্সি ক্রোনিয়ে  নিয়ে তুমুল গন্ডগোল চলছেই। প্লাস কপিল দেব নিয়েই সাংঘাতিক অভিযোগ করেছেন মনোজ প্রভাকর। কপিল যেহেতু ভারতীয় দলের কোচ, গোটা ঢাকা মিডিয়া ভারতীয় দলের গতিবিধি নজরে রেখেছে। সেই টিমে আবার আজহার। তিনিও সন্দেহের ভয়াল ছায়ায়। রাতে কপিল এলেন আমাদের ঘরে । কথা শুনে বোঝা গেল, আর ইন্ডিয়ান টিমকে কোচিং করাবার মানসিকতা  নেই তাঁর। কাউকে বিস্মিত না করে ভারত বিদায় নিল টুর্নামেন্ট থেকে।

বাংলাদেশে ক্রিকেট উৎসবের মেজাজ কোন স্তরে পৌঁছতে পারে, তার প্রথম আন্দাজ পাই তাদের খেলা সর্বপ্রথম টেস্ট দেখতে গিয়ে। ওটা স্রেফ দর্শক হিসেবে দেখতে এসেছিলাম সেই পুরোনো দেশের মাটির টানে।সেবারই আন্দাজ পাওয়া উচিত ছিল যে, বাংলাদেশের ক্রিকেট সমর্থন কোন স্তরে  পৌঁছতে যাচ্ছে। আমার মতে, ক্রিকেট সমর্থনের বিচারে সত্তর ও নব্বই দশক বিশ্বক্রিকেটে যদি ইডেনের হয়,.তারপর থেকে আজ পর্যন্ত পরিষ্কার মিরপুরের। ওই সমবেত চিৎকার বাদ  দিলাম। ফ্যানদের পাগলামি বাইরে রাখছি। ২০১১ বিশ্বকাপের সময় তো প্রধানমন্ত্রী হাসিনাকে দেখে মনে হয়েছিল, উনি সানন্দে গলারিতে বসে ম্যাচ দেখতে রাজি আছেন। এতটাই ভালোবাসেন ক্রিকেট ও বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের। আর বাংলাদেশ খেললে গোটা শহরের মেজাজ যেন একটা ব্যাটের মধ্যে এসে যায়। এটা হারিয়ে যাওয়া কলকাতায় এককালে বহমান ছিল বলে বারবার ঢাকায় তা আবিষ্কার করে এত নস্টালজিয়া হয়।

অন্তত আটটা ঢাকা সফর করেছি। জমিয়ে প্রতিবার ইলিশ খেয়েছি। রবীন্দ্রচর্চার গভীরতা দেখে মুগ্ধ হয়েছি। ছায়ানটে গেছি। জামদানি কিনে নিয়ে গেছি। মানুষের উষ্ণতা ভোগ করেছি। রমনা পার্কে হেঁটেছি। ঢাকার কাগজে লিখেছি। একগাদা সাংবাদিকের সঙ্গে সম্পর্ক প্রগাঢ় হয়েছে। যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও বেড়েছে। আর হ্যাঁ, কুখ্যাত সেই ট্র্যাফিক জ্যামে অবশ্যই পড়েছি। বিশেষ করে মিরপুর স্টেডিয়াম যাওয়ার সময়। কোথাও মনে হয়, যে শহরবাসীর এত প্রাণপ্রাচুর্য, তাদের নির্ঘাত ভবিষ্যতে দেখব, এটারও সমাধান বার করে ফেলবে।

বিদেশি সাংবাদিক হিসেবে কখনও বিদেশি রাষ্ট্রে বসে দূরত্ব অনুভব করিনি। বাংলাদেশি সাংবাদিক বন্ধুরা হৃদয় পেতে দিয়েছেন বারবার। ওই একবার সিআইএ এজেন্ট হিসেবে অভিহিত হওয়া আর টিভি ক্রিকেট শোতে আচমকা প্রশ্ন শোনা, ফারাক্কার জল আপনারা দিচ্ছেন না কেন, বাদ দিলে বাংলাদেশের ক্রিকেট কভারেজের অভিজ্ঞতা কেমন, জানেন ?

আবেগের একটা বিশাল চৌবাচ্চার মধ্যে ভেসে থাকা সবুজ ঘাস আর ব্যাট-বল দেখা।

পাল্টা আবেগে আমাদের মন অনুরণিত হয়, যখন ধানমন্ডিতে শেখ মুজিবের বাসভবনে সেই শেষ সজ্জার নিদর্শনগুলো দেখি। তখন হৃদয় এত রক্তাক্ত হতে থাকে যে, ইন্দিরা গান্ধীর পুরোনো বাড়িতে তাঁকে কীভাবে হত্যা করেছিল বডিগার্ডরা, সেই শোককে ছাপিয়ে যায় ।

বাংলাদেশ আসলে অবিরাম একটা আবেগের নেটওয়ার্কের আসা যাওয়া। কখনো  হতাশ করে, আবার বেশির ভাগ সময় পুলক জাগায়।

তাই প্রতিবার ঠিক দেশে ফেরার সময় দু শহরের তুলনামূলক দাঁড়িপাল্লা ফেলে ওই গানটাই মনের মধ্যে বাজে--আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি / তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী।

* গৌতম ভট্টাচার্য: ভারতের নামী ক্রিকেট ও বিনোদন সাংবাদিক।

আরও পড়ুন... 
উৎপল শুভ্র-কে শুধু পদ্মা কেন, গঙ্গা-পারও চেনে

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×