‘ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের মতো আমিও শেষ প্রান্তে’

টনি কোজিয়ারের একান্ত সাক্ষাৎকার

উৎপল শুভ্র

১১ মে ২০২১

‘ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের মতো আমিও শেষ প্রান্তে’

টনি কোজিয়ার

শুনতে হয়তো একটু বেশি শোনাতে পারে, কিন্তু ওরেল-সোবার্স-রিচার্ডসদের মতো তিনিও আমার কাছে উইন্ডিজ ক্রিকেট। দু`একটা তথ্য দিলেই পরিষ্কার হবে কারণটা। প্রথম টেস্ট ম্যাচ দেখেছেন ১৯৪৮ সালে। সাংবাদিকের ভূমিকায় প্রথম টেস্ট ১৯৫৫ সালে। ২০০৯ সালে ডমিনিকায় যখন তাঁর এই ইন্টারভিউ করি, প্রায় পাঁচ দশক ধরে টনি কোজিয়ার হয়ে আছেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের অসংবাদিত কণ্ঠস্বর। তাঁর নিজের জীবন, উইন্ডিজ ক্রিকেটের সেকাল-একাল এমন অনেক কিছু নিয়েই কথা হয়েছিল। তবে তাঁর মৃত্যুর পর থেকে শেষ কথাটাই শুধু কানে বাজে। যা দিয়ে এই ইন্টারভিউয়ের শিরোনাম করেছি।

প্রথম প্রকাশ: ৩ আগস্ট ২০০৯। প্রথম আলো।

উৎপল শুভ্র: ক্রিকেটেই তো কাটল আপনার জীবন। কীভাবে শুরু হয়েছিল এই বন্ধন?

টনি কোজিয়ার: আমার শুরুটা ছিল সাংবাদিক হিসেবে। আমার বাবা ওয়েস্ট ইন্ডিজের অনেক পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন। সেই ছোটবেলা থেকেই আমার তাই সংবাদপত্রের সঙ্গে পরিচয়। পত্রিকার লে-আউট করা, ছবি বের করা—এসব কাজে বাবাকে সাহায্য করতাম। সংবাদপত্রে কীভাবে কাজ হয়, কীভাবে ছাপা হয়—সবই আমি জানতাম। বাবা যখন সেন্ট লুসিয়ার দ্য ভয়েস  নামে ছোট একটা পত্রিকার সম্পাদক, আমি তখন বারবাডোজে স্কুলে পড়ি। স্কুলের পক্ষে ক্রিকেট খেলি। বাবা আমাকে বললেন, ক্রিকেট দেখতে চাইলে যেতে পারো। আমি বললাম, আমি ক্রিকেট কভার করতে চাই। বাবা আমার স্কুলের হেডমাস্টারকে বলে আমাকে ছুটি নিয়ে দিলেন। আমি ওয়েস্ট ইন্ডিজ-অস্ট্রেলিয়া টেস্ট কাভার করলাম। এটি ১৯৫৫ সালের কথা।

শুভ্র: বলেন কী! তখন আপনার বয়স কত?

কোজিয়ার: ১৫ বছর। কমেন্ট্রি শুরু আরও পাঁচ বছর পর। ত্রিনিদাদে বারবাডোজ-ত্রিনিদাদ খেলা। ওয়েস্ট ইন্ডিজ তখন ১৯৬০-৬১ অস্ট্রেলিয়া সফরে বলে বারবাডোজ দলে সব নতুন খেলোয়াড়। সোবার্স, হল, হান্ট, ক্যামি স্মিথ, নার্স... ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে তখন অনেক বার্বাডিয়ান। ত্রিনিদাদের রেডিও থেকে আমাকে বলল, আমি বারবাডোজের নতুন খেলোয়াড়দের চিনিয়ে দিতে সাহায্য করতে পারব কি না। তো খেলোয়াড়দের চিনিয়ে দিতে গিয়ে কমেন্ট্রিও করলাম। এর পর থেকে রেডিওতে নিয়মিতই তা করেছি। সাংবাদিকতাও চালিয়ে গেছি একই সঙ্গে। লেখালেখির কাজটাই আমার কাছে সব সময় অগ্রাধিকার পেয়েছে। শুধু ক্রিকেটই নয়; লন্ডনের ফিনান্সিয়াল টাইমস, জেমিনি নিউজ সার্ভিস, অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস এমন আরও অনেক পত্রিকা বা সংবাদ সংস্থার ইস্ট ক্যারিবিয়ান প্রতিনিধি হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করার সময় অন্য সব বিষয় নিয়েও প্রচুর লিখেছি। একসময় আর কুলোতে না পেরে শুধু ক্রিকেটেই চলে আসতে হলো।

এই তরুণ কোজিয়ারও অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ, মাত্র ১৫ বছর বয়সেই তো সাংবাদিকতার শুরু। ছবি: গেটি ইমেজেস

শুভ্র: তার পর তো একসময় ক্রিকেট বিশ্বে আপনার পরিচিতি হয়ে গেল ‘ভয়েস অব ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট’। এই স্বীকৃতিটা নিশ্চয়ই খুব ভালো লাগে!

কোজিয়ার: এর মূল কারণ, দীর্ঘ একটা সময় আমিই ছিলাম ওয়েস্ট ইন্ডিজের একমাত্র কমেন্টটর। ইংলিশ কমেন্টটর ছিল, অস্ট্রেলিয়ান ছিল, কিন্তু ওয়েস্ট ইন্ডিজের কেউ ছিল না। ক্যারিবিয়ানের ভিন্ন উচ্চারণ রীতির কারণে আমার কথা শুনেই লোকে বুঝে ফেলে—এই লোকটা ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান কমেন্টটর। দেশের বাইরে আমি প্রথম ক্রিকেট সিরিজ কাভার করেছি সাংবাদিক হিসেবে। ঘটনাচক্রে দেশের বাইরে কমেন্ট্রির শুরুও একই সময়ে। ১৯৬৬ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ইংল্যান্ড ট্যুর কাভার করতে গেলাম বারবাডোজের দ্য নিউজ থেকে। বিবিসিতে তখন রয় লরেন্স নামে একজন ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান কমেন্টটর ছিলেন। উনি ছিলেন জ্যামাইকান। জ্যামাইকায় তখন কমনওয়েলথ গেমস হচ্ছে বলে তাঁকে ফিরে আসতে হলো। লরেন্স জ্যামাইকান রেডিওতে চাকরি করতেন, ওখানে তাঁর অনেক দায়িত্ব ছিল। আমি তাঁর বদলে বিবিসিতে কমেন্ট্রি করলাম। ১৯৬৮-৬৯ অস্ট্রেলিয়া সফরেও একই ঘটনা ঘটল। রয় লরেন্সকে মেক্সিকো অলিম্পিকে যেতে হলো, তাঁর বদলে আমি এবিসি (অস্ট্রেলিয়ান ব্রডকাস্টিং করপোরেশন) রেডিওতে কমেন্ট্রি করলাম। এর পর থেকে একই সঙ্গে রেডিওতে কমেন্ট্রি আর সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছি।      

শুভ্র: টেলিভিশনে কমেন্ট্রি কবে শুরু?

কোজিয়ার: প্যাকারের সময়ে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ বলতে তো তখন সবাই পাগল, প্যাকার তাই ২২ জন ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানকে সাইন করিয়েছিলেন। রুডি ওয়েবস্টার ছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের ম্যানেজার। আমি তাঁকে ফোন করে বললাম, ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান কোনো কমেন্টেটর তো ওখানে নেই। আমাকে নিতে পারো কি না কথা বলে দেখো। ওয়েবস্টার কথাবার্তা বলার পর বিশ্ব একাদশের বিপক্ষে ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রথম তিন ম্যাচের জন্য পরীক্ষামূলকভাবে আমাকে নেওয়া হলো। সিরিজের পরের অংশটা ছিল অস্ট্রেলিয়া বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ। পুরোটাই করলাম। ১৯৭৮ সালে সেই শুরুর পর ১৯৯২ পর্যন্ত আমি টানা প্যাকারের চ্যানেল নাইনে কাজ করেছি। এরপর ওরা মাইকেল হোল্ডিংকে নিল, সাবেক টেস্ট ক্রিকেটারদের কমেন্টটর হিসেবে নেওয়ার চলটা তখন শুরু হয়ে গেছে।

শুভ্র: এখন তো এটা টেলিভিশনে কমেন্ট্রি করার পূর্বশর্তই হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু কমেন্ট্রি তো খেলাটা বোঝা আর সেটি সুন্দর করে বলতে পারার ব্যাপার। টেস্ট ক্রিকেটার না হলে কেউ তা পারবে না, এমন তো নয়। অনেক টেস্ট ক্রিকেটারের কমেন্ট্রিতে খেলার মজাটাই পাওয়া যায় না।

কোজিয়ার: আমিও এটা বুঝতে পারি না। আমার তো মনে হয়, তরুণ অনেক দর্শক সাবেক টেস্ট খেলোয়াড়দেরও শুধু কমেন্টটর হিসেবেই চেনে। অনেক কমেন্টটর সম্পর্কেই অনেককে অবাক হয়ে বলতে শুনেছি, ও, উনি টেস্ট ক্রিকেটারও ছিলেন নাকি! আমি জানি না, টেলিভিশন কোম্পানিগুলো কমেন্টটর নেওয়ার সময় কী মানদণ্ড বিবেচনা করে। তবে এটা বুঝতে পারি, আস্তে আস্তে এটি সাবেক টেস্ট ক্রিকেটারদের সম্পত্তি হয়ে যাচ্ছে। আমি আর ভারতের হার্শা ভোগলে ছাড়া টেস্ট ক্রিকেটারের বাইরে আর কোনো আন্তর্জাতিক কমেন্টটর তো নেই-ই।

বিভিন্ন দেশের কমেন্ট্রি বক্সেই কেটেছে তাঁর জীবনের অনেকটা সময়। ছবি: ইউটিউব

শুভ্র: এটা কি কমেন্ট্রির জন্য ভালো হচ্ছে?

কোজিয়ার: এটা আমি বলতে পারব না। তবে একটা ব্যাপার বুঝি, গ্রেট প্লেয়ারদের মধ্যে ইগোর সমস্যা থাকে। যে কারণে আমি যখন ইংল্যান্ডে কমেন্ট্রি করি, বেশির ভাগ সময় দেখি আমাকে জিওফ্রি বয়কটের সঙ্গে দেওয়া হয়। হার্শা ভোগলেরও হয়তো বয়কটের সঙ্গেই বেশি পড়ে। অন্যদের হয়তো বয়কটের সঙ্গে মেলে না অথবা বয়কটের ওদের সঙ্গে।

শুভ্র: বয়কটকে নিয়ে তো বাজারে অনেক গল্প প্রচলিত। আপনার অভিজ্ঞতা কী?

কোজিয়ার: ডিফিকাল্ট। ভেরি ডিফিকাল্ট। আত্মগরিমা খুব বেশি। ওর সঙ্গে কমেন্ট্রি করাও সহজ কাজ নয়। তবে আমি মানিয়ে নিই। কমেন্ট্রি করার সময় আমি সব সময় আমার সীমাটা মনে রাখি। কখনো ভুলি না যে, আমি টেস্ট ক্রিকেটার নই।

শুভ্র: রেডিও বাদ দিয়ে শুধু টেলিভিশন ধরলেও আপনার কমেন্ট্রি-জীবন তিন দশকের বেশি হয়ে গেল। এখনো তো আপনার কমেন্ট্রি শোনার জন্য লোকে বসে থাকে। কীভাবে ধরে রাখলেন জাদুটা?

কোজিয়ার: আমার সত্তর হতে চলল। কাজ করি ফ্রিল্যান্সার হিসেবে। জানি না, এই সিরিজের পর পরের কাজটা কোথায় পাব। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের মতো আমিও বোধ হয় শেষ প্রান্তে চলে এসেছি। তবে দুঃখ নেই। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের দুই প্রজন্মকে দেখেছি। দুই প্রজন্ম নয়, তিন প্রজন্ম। যখন শুরু করি, ওরেল-ওয়ালকট-উইকসের শেষটা দেখেছি। এরপর দুঃসময়টাও—১৯৬৯ থেকে ১৯৭৩ পর্যন্ত ওয়েস্ট ইন্ডিজ একটা টেস্টও জেতেনি। তবে এই দুঃসময় কেটে যাবে বলে সবারই বিশ্বাস ছিল। এর পরই তো এল সেই স্বর্ণযুগ। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে তা শেষ হয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দেখা দিলেও কেউ কল্পনাও করতে পারেনি যে, অবস্থাটা এত খারাপ হবে। এবার আর আমি এ থেকে বেরিয়ে আসার কোনো আশা দেখি না। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট এখন মৃত্যুশয্যায়। আমার ধারণা, এটা মরেই গেছে।

শুভ্র: সেই সময় আর এই সময়ে সবচেয়ে বড় পার্থক্য কী দেখেন?

কোজিয়ার: আমিই একমাত্র সাংবাদিক হিসেবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ট্যুর কাভার করতে যেতাম। সাংবাদিক হয়েও আমি ছিলাম দলেরই অংশ। খেলোয়াড়দের সঙ্গে চলাফেরা-ওঠাবসা। সোবার্স-হল এমন অনেকের সঙ্গেই ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব এখনো অটুট। তবে ওরা যখন খেলতে নামত, তখন আমি যথারীতি সাংবাদিক। কেউ বাজে শট খেললে সমালোচনা করেছি, ওরা তাতে কিছু মনে করেনি। এখন আর অবস্থাটা সে রকম নেই।

ব্যক্তিগত সম্পর্ক যেমনই হোক, পেশাদারিত্বের সঙ্গে কখনো আপস করেননি। ছবি: গেটি ইমেজেস

শুভ্র: এখন তো মিডিয়ার সঙ্গে খেলোয়াড়দের অনেক দূরত্ব।

কোজিয়ার: এখন খেলোয়াড়েরা মিডিয়ার ব্যাপারে অস্বস্তি বোধ করে। ওরা খেলে অনেক টাকা পায়, ওদের কাছে এটা বিরাট একটা চাকরি। খারাপ খেললে মিডিয়ায় এ নিয়ে সমালোচনা। এরপর বাদ পড়লে ওরা নির্বাচকদের দোষ না দিয়ে মিডিয়াকে দোষ দেয়। ফালতু ব্যাপার।

শুভ্র: এর আগেও আপনার মুখে শুনেছি কথাটা—ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট এখন মৃত। এ অবস্থাটা কেন হলো?

কোজিয়ার: অনেক কারণ মিলে আজ এ অবস্থা। এখন যারা ক্রিকেট প্রশাসনে আছে, খেলাটির প্রতি তাদের ভালোবাসা নেই। আগে সাবেক খেলোয়াড়েরা খেলা চালাত, ক্রিকেটের প্রতি তাদের গভীর ভালোবাসা ছিল। এখন তো ক্রিকেট তথাকথিত ব্যবসা, প্রশাসনে যারা আছে তারা শুধু নিজেদের তুলে ধরতেই ব্যস্ত। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ড জিনিসটা কী, এটাও বুঝতে হবে। গায়ানা, ত্রিনিদাদ, বারবাডোজ, জ্যামাইকা, লিওয়ার্ড ও উইন্ডওয়ার্ড আইল্যান্ডের প্রতিনিধি মিলে এই বোর্ড। ওখানে গিয়ে সবাই শুধু নিজেদের স্বার্থের কথাই ভাবে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের কথা নয়। আইসিসিরও একই অবস্থা। সব দেশের প্রতিনিধি নিয়ে যদি আইসিসি হয়, তাহলে খুবই স্বাভাবিক যে সেখানে গিয়ে সবাই নিজের স্বার্থই হাসিল করতে চাইবে।

শুভ্র: আইসিসির ফিফার মতো হওয়াটা এর সমাধান হতে পারে, তাই না?

কোজিয়ার: ফিফা কীভাবে কাজ করে তা জানি না। তবে এটা দেখি, কোনো সদস্য দেশ ফিফার নীতিমালা মেনে না চললে ফিফা তাদের সাসপেন্ড করে দেয়। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেটের আজ যে অবস্থা, ফিফা হলে নিশ্চিত ওয়েস্ট ইন্ডিজকে সাসপেন্ড করে দিয়ে বলা হতো, আগে সব ঠিকঠাক করো, তার পর খেলতে এসো।

শুভ্র: আপনি তো অনেকেরই প্রিয় কমেন্টটর। আপনার প্রিয় কমেন্টটর কে?

কোজিয়ার: সে রকম কেউ নেই। আমি যে ম্যাচে কমেন্ট্রি করি, কমেন্ট্রি করার সময় ছাড়া অন্য কমেন্টটরদের কথা শুনি না। এই সিরিজে দেখলেন না, কমেন্ট্রি শেষ করেই আমি প্রেসবক্সে এসে বসি। টেলিভিশনে খেলা দেখার সময় শুনি। তবে প্রিয় কমেন্টটর বলতে কেউ নেই।

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×