আমিনুল ইসলাম বুলবুলের একান্ত সাক্ষাৎকার। পর্ব-২

`আইসিসি ট্রফি জয়ে গ্রিনিজের চেয়ে লিপু ভাইয়ের অবদান বেশি`

উৎপল শুভ্র

১২ মে ২০২১

`আইসিসি ট্রফি জয়ে গ্রিনিজের চেয়ে লিপু ভাইয়ের অবদান বেশি`

আমিনুল ইসলাম বুলবুল

মূলত অভিষেক টেস্টে সেঞ্চুরির সৌজন্যে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন ২০০০ সালের প্রথম আলো বর্ষসেরা ক্রীড়াবিদের। এই উপলক্ষে নেওয়া দীর্ঘ সাক্ষাৎকারের দ্বিতীয় পর্বে আজ থাকছে আইসিসি ট্রফি ও বিশ্বকাপ, ব্যাটসম্যান হিসেবে নিজের শক্তি-দুর্বলতা, ঘরোয়া ক্রিকেটের দৈন্যদশা, কোচ হিসেবে কে কেমন এমন আরও অনেক প্রসঙ্গ। যেখানে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের মানসিকতা পরিবর্তন ও আইসিসি ট্রফি জয়ের মূল কৃতিত্ব দিয়েছেন গাজী আশরাফ হোসেন লিপুকে, আক্ষেপ করেছেন এডি বারলোকে হারিয়ে ফেলা নিয়ে।

প্রথম প্রকাশ: ৭ জানুয়ারি ২০০১। প্রথম আলো।

(প্রথম পর্বের পর)

শুভ্র: ১৯৯০ সালে শারজা অস্ট্রেলেশিয়া কাপে ভালোই খেললেন আপনি। দুটি ম্যাচেই নট আউট ছিলেন ৪১ ও ৩৯ রান করে। কিন্তু সে সময় আপনাকে ব্যাট করতে দেখা গেছে ৮-৯ নম্বরে।

আমিনুল: ’৯৫-তে ইংল্যান্ড ‘এ’ দল আসার আগ পর্যন্ত আমার আর আকরাম খানের নির্দিষ্ট কোনো ব্যাটিং অর্ডার ছিল না। দেখা গেল, আকরাম ৭ আমি ৮ কিংবা আকরাম ৮ আমি ৭-৬ এর ওপর উঠতেই পারছিলাম না। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তখনকার ম্যানেজার রকিবুল হাসান ভাই আমাকে চার নম্বরে ব্যাট করতে পাঠালেন। এর আগে বললেন, 'তোমাকে একটা সুযোগ দিচ্ছি। কাজে লাগাতে পারলে পাকা হয়ে যাবে।' এরপর তিন দিনের ম্যাচে ১২১ রান করার পর থেকে আমি চারেই ব্যাট করছি।

শুভ্র: শুরুতে আপনার এত নিচে ব্যাট করার কারণ কী?

আমিনুল: আসলে সে সময় আমাদের ক্রিকেট দলের কোনো নির্দিষ্ট ব্যাটিং অর্ডার ছিল না। এর একটা কারণ হতে পারে, তখন বেশি ব্যাটসম্যান খেলানো হতো। এতে রান বেশি উঠবে, কলাপস ঠেকানো যাবে--এ রকম হয়তো ভাবত আমাদের ম্যানেজমেন্ট।

শুভ্র: সে সময় বাংলাদেশ দলের দৃষ্টিভঙ্গিটা কেমন ছিল?

আমিনুল: প্রতিপক্ষ যেন ৩০০-র বেশি না করতে পারে আর আমরা যেন ১০০ পেরোতে পারি। এ ছাড়া অলআউট হবো না, এটাই ছিল আমাদের প্রধান লক্ষ্য। সে সময়ের বিচারে অবশ্য ব্যাপারটা ঠিকই ছিল বলে আমি মনে করি।

শুভ্র: এরপর অনেক টুর্নামেন্টেই আমরা পজিটিভ খেলব বলে ঘোষণা দিয়েছি, কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। তো দৃষ্টিভঙ্গির এই পরিবর্তনটা এলো কখন?

আমিনুল: সত্যিকারভাবে পরিবর্তনটা আসে বিশ্বকাপের বিশ্বকাপের আগে যখন রব হান্ট ও গর্ডন গ্রিনিজ একসঙ্গে কাজ করা শুরু করলেন, যদিও এর আগেই আমরা কেনিয়াকে হারিয়ে ওয়ানডেতে প্রথম জয় পেয়েছি। তবে পজিটিভ খেলার মানসিকতাটা গড়ে তোলার পেছনে বড় একটা ভূমিকা রেখেছিলেন গাজী আশরাফ হোসেন লিপু। বিশ্বকাপের প্রস্তুতিমূলক ম্যাচগুলোতে আমাদের খেলায় পজিটিভ অ্যাপ্রোচটা দেখা যেতে শুরু করে। প্রথম আমরা এসেক্সকে হারালাম, এরপর জিতলাম মিডলসেক্সের বিপক্ষে। এ জয়গুলো শুধু ইতিবাচক মানসিকতাই গড়ে তোলেনি, দলের আত্মবিশ্বাসও অনেকখানি বাড়িয়ে দিয়েছিল--যা বেশ বড় একটা ভূমিকা রেখেছে বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে হারাতে। কিন্তু দলটা আমরা ধরে রাখতে পারিনি। দেশে ফিরেই চারজন খেলোয়াড় অবসর নিয়ে নেন। আসলে এই ব্যাপারটা আমাদের বারবার পিছিয়ে দিয়েছে। যে সময়ই কোনো সিরিজে বাংলাদেশ মোটামুটি ভালো করেছে, দেখা গেছে তারপরই চার-পাঁচজন খেলোয়াড় বাদ পড়ে গেছেন দল থেকে। এটা টিম স্পিরিট গড়ে ওঠার ব্যাপারে বাদ সেধেছে। প্রতিবার আমাদের নতুন করে শুরু করতে হয়েছে। সময় লেগেছে অনেক। তারপরও বলতে হয়, বাংলাদেশ জাতীয় দলে প্রথম পজিটিভ চিন্তাধারাটা যোগ করেছিলেন লিপু ভাই।

বাংলাদেশ দলের মানসিকতা বদলের কৃতিত্ব লিপুকে দিতে চান বুলবুল। ছবি: সংগৃহীত​​​​​​

শুভ্র: ব্যাটসম্যান বুলবুলের কথায় আসি। ব্যাটসম্যান হিসেবে আপনার শক্তিশালী দিক কোনটি?

আমিনুল: এ মুহূর্তে আমার বড় শক্তি বলব, আমার মনোসংযোগ করার ক্ষমতাকে। এক সময় আমার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা ছিল এটাই। কিন্তু তা কাটিয়ে উঠতে পেরেছি আমি এবং একই সঙ্গে সব ধরনের শট সাবলীলভাবে খেলতে পারছি এখন।

শুভ্র: অভিষেক টেস্টে ১৪৫ রানের অসাধারণ ইনিংসটির পর আর জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন নেই যে, আপনার খেলা সেরা ইনিংস কোনটি। তবে এই ১৪৫ রানের আগে আপনার খেলা সেরা ইনিংস বলবেন কোনটিকে?

আমিনুল: দু-তিনটি ইনিংসের কথা খুব বেশি মনে পড়ছে। একটা আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচে। ঢাকা স্টেডিয়ামে সে ম্যাচে ৫৭ বলে ৭৮ না কত করে জিতিয়েছিলাম মোহামেডানকে। আরেকটি সার্ক ক্রিকেটে ভারত ‘এ’ দলকে হারালাম যে ম্যাচে। ৬৪ রান করেছিলাম আমি, উইকেট ছিল খুব খারাপ, ভীষণ আন্ডার প্রিপেয়ার্ড। ওই ইনিংসটা কখনোই ভুলব না।

শুভ্র: ব্যাটসম্যান হিসেবে আপনার দুর্বল দিক বলবেন কোনটিকে? জেনুইন পেস বা ইনকামিং বলে আপনার দুর্বলতার কথা বলে অনেকে।

আমিনুল: অফ স্টাম্পের লাইনে একটু ওপরের বলে ইদানীং আমার একটু সমস্যা হচ্ছে। আউট সুইংয়ে আমি একটু সমস্যায় ভুগি। অভিষেক টেস্টে দ্বিতীয় ইনিংসে আগারকারের যে রকম বলে আউট হলাম। তবে আমি খুব খাটছি সমস্যাটা কাটিয়ে উঠতে।

ভেতরে ঢোকা বল খেলতে সমস্যা হচ্ছিল বুলবুলের। ছবি: গেটি ইমেজেস

শুভ্র: বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে কাজ করা বিদেশি কোচদের প্রায় সবাইকেই তো আপনি পেয়েছেন। তাঁদের সম্পর্কে আপনার কী মূল্যায়ন?

আমিনুল: আমার প্রথম কোচ ছিলেন মুদাসসর নজর। তিনি আমাদের মেন্টাল অ্যাপ্রোচটায় প্রথম পরিবর্তন এনেছিলেন, জোর দিয়েছিলেন আমাদের ফিটনেস এবং ফিল্ডিংয়ের ওপর। এরপর এলেন মহিন্দর অমরনাথ। আমরা যে এতদিন ধরে খেলছি: আতহার ভাই, নান্নু ভাই-ফারুক ভাই কদিন আগেও জাতীয় দলে ছিলেন, আমি-আকরাম এখনও খেলছি--এর পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান অমরনাথের। আসলে যে ক'জন কোচই এসেছেন, আমাদের ব্যাপারে তাঁদের ধৈর্যটা ছিল প্রশংসনীয়, তাঁরা কেউই কখনও বিরক্ত হননি। বলেননি, ‘না, তোমাদের দিয়ে কিছু হবে না।’ ম্যাচের পর ম্যাচ হেরে গেছি আমরা। কিন্তু তাঁরা উৎসাহ দিয়ে গেছেন। তাঁদের সবাই ছিলেন ‘গ্রেট’ ক্রিকেটার। অমরনাথ, গর্ডন গ্রিনিজ সবাই। হয়তো বাজে শট খেলার জন্য খেলোয়াড়দের ধমকেছেন। কিন্তু কখনোই নেতিবাচক কিছু বলেননি। তবে বাংলাদেশের ক্রিকেটে একটা বড় ধাক্কা খেয়েছে এডি বারলোর অসুস্থতাজনিত বিদায়ে। এরকম একটা ক্রিকেট ব্রেইন বাংলাদেশের ক্রিকেটের এই সময়ে খুবই দরকার ছিল।

এডি বারলোর বিদায়টাকে বড় ধাক্কা বলছিলেন বুলবুল। ছবি: ডেইলি স্টার

শুভ্র: গ্রিনিজের বিদায়টাকে আপনি কীভাবে দেখেন?

আমিনুল: গ্রিনিজের বিদায়টা সম্পূর্ণ বোর্ড এবং গ্রিনিজের ব্যাপার ছিল। কেন, কী হয়েছে--তা সবাই জানেন, আমার নতুন করে বলার কিছু নেই। যেহেতু উনি আমাদের সঙ্গে অনেকদিন ছিলেন, তাই তাঁর এভাবে চলে যাওয়াটা সবার খারাপ লেগেছে। কিন্তু যেহেতু বিবাদটা তাঁর বোর্ডের সঙ্গে, তাই আমাদের কিছু করার ছিল না।

শুভ্র: সিনিয়র ক্রিকেটারদের অনেকে একটু অন্যরকম বলেন, যেমন মিনহাজুল আবেদীন নান্নু তাঁর এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন--বাংলাদেশের ক্রিকেটে সে অর্থে গ্রিনিজের কোন অবদান নেই। অধিনায়ক হিসেবে আপনি কোচ গ্রিনিজের খুবই কাছাকাছি ছিলেন। আপনি এ প্রসঙ্গে কী বলেন?

আমিনুল: আইসিসি ট্রফি জেতার কিছুদিন আগে গ্রিনিজ আমাদের সঙ্গে কাজ শুরু করেন। তাই আমি বলব, এই ট্রফি জয়ের কৃতিত্ব যদি কারও থাকে, তবে সেটা তখনকার ম্যানেজার লিপু ভাইয়ের। হ্যাঁ, গ্রিনিজ ছিলেন, তিনি ভালো ভালো কথা বলে আমাদের উদ্বুদ্ধ করেছেন ঠিকই। কিন্তু সত্যিকারভাবে টিম স্পিরিটটা গড়ে তোলার পেছনে বিরাট অবদান ছিল লিপু ভাইয়ের। গ্রিনিজ স্রেফ ভাগ্যবান যে, তিনি তখন সঙ্গে ছিলেন। তবে বাংলাদেশের ক্রিকেটে তাঁর অবদান একেবারে খাটো করে দেখা উচিত হবে না। আইসিসি ট্রফির পর ধাপে ধাপে আমরা এগিয়েছি, এক সময় পাকিস্তানকে হারালাম। তাই তাঁর কোচিং নিয়ে সমালোচনার কিছু নেই। তবে আমি বলব, আইসিসি ট্রফি জয়ে গ্রিনিজের চেয়ে লিপু ভাইয়ের কৃতিত্ব বেশি।

কোচ হিসেবে গ্রিনিজকে খাটো না করলেও তাঁকে ভাগ্যবান মানছেন বুলবুল। ছবি: গেটি ইমেজেস

শুভ্র: বাংলাদেশের বিদেশি কোচের মধ্যে আপনার সবচেয়ে ভালো লেগেছে কাকে?

আমিনুল: এডি বারলোকে। বিদেশি কোচ যাঁরাই এসেছেন, যথেষ্ট অবদান ছিল আমাদের ক্রিকেটে, যে কারণে আমরা আজ টেস্ট খেলতে পারছি। কিন্তু এডি বারলোর অবদান সীমাহীন। টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার ব্যাপারেও তাঁর ভূমিকা অনেক। বাংলাদেশের ক্রিকেটের হঠাৎ দু-তিনটি সিঁড়ি এক লাফে পেরিয়ে যাওয়ার কৃতিত্বটা আমি তাঁকেই দেব।

শুভ্র: এ মুহূর্তে বাংলাদেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় সমস্যাটা কী বলে মনে হয় আপনার?

আমিনুল: সার্বিকভাবে বাংলাদেশের ক্রিকেটে নেতিবাচকের চাইতে ইতিবাচক দিকই এখন বেশি। আগামী পাঁচ বা ১০ বছরে বাংলাদেশের ক্রিকেট কোথায় যাবে, তার পরিকল্পনা এরই মধ্যে ক্রিকেট বোর্ড করে ফেলেছে। যেমন: শ্রীলঙ্কা থেকে চারজন কোচ আনা এবং অনূর্ধ্ব-১৯, ১৭, ১৫, ১৩ দল তৈরি করা, যাতে খেলোয়াড় সরবরাহের পাইপ লাইনটা থাকে। এটাকে আমি সবচেয়ে বড় পজিটিভ দিক বলব। আর নেতিবাচক দিক বলতে মাঠ সমস্যা, উইকেট সমস্যা এবং ঘরোয়া ক্রিকেটের কাঠামো। সবার আগে আমাদের উইকেটের দিকে নজর দিতে হবে। দক্ষিণ আফ্রিকা, পাকিস্তানের বাউন্সি উইকেটে আমাদের ব্যাটসম্যানরা রীতিমতো নাজেহাল হয়েছে। সামনে হয়তো অস্ট্রেলিয়াতে খেলব আমরা। তাই ভালো মানের উইকেট তৈরিতে নজর দিতে হবে। এছাড়া মূল যে সমস্যা তা হলো, ঘরোয়া ক্রিকেট কাঠামো। এটায় পরিবর্তন আনা উচিত।

শুভ্র: এবারের জাতীয় লিগে কী কী সমস্যা চোখে পড়ল?

আমিনুল: উইকেটই প্রধান। বেশির ভাগ জায়গাতেই উইকেটের ঠিকমতো পরিচর্যা হয়নি। একই মাঠে ফুটবল খেলাও হয়। মোট কথা মানসম্পন্ন নয়। এছাড়া অন্যান্য সুযোগ সুবিধাও অপ্রতুল। ঢাকার বাইরে ভালো হোটেল নেই। ড্রেসিংরুমগুলোও সব চলনসই বলা যাবে না। আসল কথা এখন আমরা টেস্ট খেলছি। আর সে জন্য যে ধরনের ঘরোয়া কাঠামোর প্রয়োজন, তা একেবারেই নেই আমাদের।

সাক্ষাৎকারের প্রথম পর্ব: এটা ছিল একটা স্বপ্ন এবং স্বপ্নটা সত্যি হয়েছে

(চলবে)

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×