জুড়ল কি খানিক বুকের জ্বালা, ব্রাজিল?

জুড়ল কি খানিক বুকের জ্বালা, ব্রাজিল?

গোলটা অন্যভাবেও করতে পারতেন বারবোসা। কিন্তু তা করলেন যেন বুক দিয়ে বলটাকে আদর করে নামিয়ে। প্রতীকী অর্থ তো খুঁজে নেওয়াই যায়। ছবি: গেটি ইমেজেস

মৃত্যুর আগে বারবোসা সখেদে জানিয়েছিলেন, কোনো আসামির যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হলেও চৌদ্দ বছর পর ছাড়া পেয়ে যায়, আর তাঁর হয়েছে আজীবন কারাদণ্ড। অভিশপ্ত সেই মারাকানোজোর পর পঞ্চাশ বছর বেঁচে থেকে সেই জ্বালা সহ্য করতে হয়েছিল ১৯৫০ বিশ্বকাপে ব্রাজিলের গোলকিপার বারবোসাকে। বুক দিয়ে গোলপোস্ট আগলে রাখার কথা ছিল। পারেননি। বুক দিয়ে গোল দিলেন আর এক বারবোসা, ৭১ বছর পর।

প্রেমাস্পদকে ছুঁতে-চাওয়া মানুষের সহজাত। কবীর সুমনের গানে যেমন, ‘আদরে-আদরে আড়াল করে’ রাখা। ফুটবল তো আসলে স্পর্শসুখ! এমন যা নিজের শরীরের যেকোনো অংশ কাজে লাগিয়ে খেলা সম্ভব, অন্য কোনো খেলায় যা এতটা নেই। গোলকিপার হাতও ব্যবহার করতে পারেন, বাড়তি সুবিধা। ছোট থেকে পড়ে-আসা বড় ফুটবলারদের জীবনী বা আত্মজীবনী, সবাই মনে রেখেছেন প্রথম ফুটবল পাওয়ার দিনটা, রাতটাও--‘বালিশ করে শুয়েছি’ ‘জড়িয়ে ধরে শুয়েছি'! রাত কাবার হলেই তাকে নিয়ে বেরিয়েও পড়েছেন রাস্তায়। এ স্পর্শসুখ দেখাতে যত আনন্দ, দেখতেও!

ব্রাসিলিয়া ব্রাজিলের রাজধানী-শহর। ২০১৪ বিশ্বকাপের সময় দুটি ম্যাচের জন্য টানা দিন ছয়েক সেই শহরে। বিমানবন্দরে পা দিতেই মন কেড়ে নিয়েছিল একটি বিরাট ছবি। কতগুলো পা, জড়িয়ে আছে নীলরঙা ফুটবলটাকে। কী অসাধারণ সেই ভাবনা। ফুটবলটা যেন ফুল হয়ে ফুটে আছে পায়ের বৃত্তে। সেই ছোঁয়ার সুখ, জড়িয়ে রাখার সুখ, ফুটবল পায়ে দিয়েছেন যিনি, অপার্থিব সেই অনুভূতির কথা তাঁকে আলাদা করে বলে দিতে হবে না।

নেইমারের জীবনী পড়তে গিয়ে তাই আবারও চোখ আটকে যায়, মন ফিরে যায় ব্রাসিলিয়ার বিমানবন্দরে দেখা সেই ছবিতে। জীবনীকার লুকা কাইওলিকে নেইমার বলছেন, “A bola (the ball) is like the most jealous woman in the world. If you do not treat her well, she will not love you and she can even hurt you. I love her to bits.” (বল আসলে বিশ্বের সবচেয়ে ঈর্ষাপরায়ণ সুন্দরীর মতো। তাঁকে বিন্দুমাত্র অবহেলা করেছ কি মরেছ, সে আর তোমায় ভালোবাসবে না। উল্টো আঘাতও করতে পারে। আমি তাই তাকে বড্ড ভালোবাসি!’) জীবনীকার লিখেছিলেন, ‘নেইমার বলকে শুধু ভালোই বাসে, এমন নয়। কামনা করে!’

কতগুলো পা, জড়িয়ে আছে ফুটবলকে, যেন ব্রাজিলেরই প্রতীক। ২০১৪ বিশ্বকাপে ব্রাসিলিয়ায় লেখক

এই ভালোবাসা, প্রেমাস্পদকে ছুঁয়ে-থাকার এই চাহিদাই, বলা হয়, আলাদা করে চিনিয়ে দেয় ফুটবলারের জাত। আজকের আন্তর্জাতিক শিক্ষার বাজারে সন্তানদের, বিশেষত কন্যা সন্তানকে, স্কুলেও শেখানো হয় ‘গুড টাচ’ আর ‘ব্যাড টাচ’-এর পার্থক্য। ফুটবল আবার এই একটিই জিনিস শিখিয়ে এসেছে, আদিকাল থেকে। কারও ছোঁয়া আলতো, আদুরে। কারও ছোঁয়া অসহ্য, বলই (শক্তি) সম্বল শুধু! দূরে সরে যেতে চায় মন, শরীর। বল কেনই বা ব্যতিক্রম!

ইউরোয় রবিবার ওয়েম্বলিতে ইংল্যান্ড-ক্রোয়েশিয়া খেলা চলছে। ইংরেজ গোলকিপারকে কোচ সাউথগেটের নির্দেশই হবে, জোরে শট নিয়ে বিপক্ষ বক্সে পাঠিয়ে দাও–ডাইরেক্ট! তেমন কোনো বলে, বা, হঠাৎ সামনে চলে আসা একটা বল। ফিল ফোডেন নামের এক তরুণের বাঁ পা সামনে এগোল, শূন্যে উঠল, চকিত ছোঁয়ায় বলটা পায়ের ভৃত্য হয়ে জমা! যাঁরা গত শতাব্দীর নয়ের দশক থেকে আন্তর্জাতিক ফুটবল নিয়মিত দেখেছেন, মানসপটে ভেসে উঠতে বাধ্য অন্য এক বড়সড় চেহারা, জিনেদিন জিদানের। অবিকল ওভাবেই শুধু নয়, প্রায় মুখ-সমান উচ্চতায় থাকা বলকেও পা অতটা তুলে ওভাবে পোষ মানিয়ে নিতেন এক লহমায়। ফোডেনের বয়স কম, চেহারা বড়সড় বললে রীতিমত মানহানির মামলা করে দেবেন তাঁর ম্যানচেস্টার সিটি কোচ। মুহূর্তটা থেকে গেল আরও, ফুটবলার ইংরেজ বলেই।

যেভাবে বলটা নামালেন ইংল্যান্ডের ফোডেন, তা মনে করিয়ে দিল জিনেদিন জিদানকে। ছবি: গেটি ইমেজেস
পরে ঢুলুঢুলু চোখে রাতশেষে ভোর হব-হব করছে যখন, অন্য দৃশ্য। নেইমার বল নিয়ে এগোচ্ছেন, ভেনেজুয়েলার গোলরক্ষক এগিয়ে আসছেন। নিজের প্রেমিকাকে (বল) আড়াল করলেন আগুয়ান আততায়ীর হাত থেকে, বেরিয়ে গেলেন নিজের বাঁদিকে, বল নিয়ে, পেছনে মাটিতে শুয়ে ভেনেজুয়েলার গোলরক্ষক, অসহায়। সেই মুহূর্তেই নেইমার বুঝেছিলেন, তিন কাঠি থেকে খানিকটা সরে এসেছেন। তিনি যেখানে, বল গোলে রাখা কঠিন কৌণিক অঙ্কের খেলায়। কিন্তু, সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা কাউকে বল পাঠিয়ে দিতে পারলে, গোলের সুযোগ শতকরা এক শ ভাগ। আর, এই ভাবনার সেকেন্ডের কয়েক ভগ্নাংশ সময়, নেইমারের চোখও বক্সে। দেখছেন কে উঠে আসছেন, কাকে দেওয়া যায়, একটা মুহূর্তের জন্যও তাকালেন না পায়ে লেগে থাকা বলের দিকে।

অবহেলা নয়, বিশ্বাস! যাকে পায়ে রেখেছি আদরে, সে যে ছেড়ে যাবে না। গাব্রিয়েল বারবোসাকে ছুটে আসতে দেখে তুলে দিলেন প্রথম পোস্টের গায়ে। বারবোসাও তেমন, বুকে নিলেন স্পর্শসুখ! মাথা নামাতে পারতেন, পা তুলে দিতে পারতেন, বল লক্ষ্য করে এক পা সরেও যেতে পারতেন ডানদিকে, তারপর বল ওই উচ্চতা থেকে নেমে এলে পা দিয়ে 'নরমাল' গোল। কিন্তু ব্রাজিলের ফুটবলে এখনও, খুব অল্প হলেও, এক-আধটা মুহূর্ত থাকে, সাধারণ-গড়পড়তা-রোজনামচা থেকে বেরিয়ে আসে। অকস্মাৎ। বুক দিয়ে বারবোসার গোলের পুরোটাই তেমন। এর মধ্যে বুক চিরে রক্ত দেওয়ার শক্তিমত্ততা ভক্তি দেখানোর কোনও চেষ্টা নেই। আছে স্বতস্ফূর্ততা আর নিজস্বতা। ভালোবাসার বলকে বুক দিয়ে ছুঁয়ে দেওয়াও, পেনাল্টি বক্সের ভিড়ের মাঝেই। নিখাদ আনন্দ!

ব্রাজিল জুড়ে নিরানন্দের বাজারে এইটুকুই তো দিতে পারে ফুটবল। একটু হাঁফ ছেড়ে বেঁচে নেওয়া, অতিমারির অতি-মৃত্যুকে খানিকের তরে সরিয়ে রাখা মন থেকে। শাসক চিরকালই এমন চেয়ে এসেছে। নজর ঘুরিয়ে দিতে চেয়েছে আসল সমস্যা থেকে। তাই সরকারিভাবেই যেখানে চার লক্ষ আশি হাজারের বেশি মানুষ মারা গিয়েছেন, যে দেশে টিকাকরণে অনীহা সরকারেরই, দশ দিনের নোটিশে আয়োজক হতে রাজি হয়ে যায় মহাদেশীয় ফুটবলের, এই একটাই আশায় যে, মানুষ দিনের অনেকটা অংশই কাটিয়ে দেবে ওই খেলা নিয়ে। দৃষ্টি সরে যাবে সরকারি ঔদাসীন্য এবং কোভিড নিয়ন্ত্রণে চরম ব্যর্থতা থেকে। আর বিষয়টাও এমন, যা আবার দেশের সকলের বড্ড প্রিয়! দক্ষিণ আমেরিকার ফুটবলের সঙ্গে রাজনীতির এই সম্পর্কটা এমনই থেকে গিয়েছে চিরকাল। সে আটাত্তরের আর্জেন্টিনা হোক বা দু’হাজার চৌদ্দর ব্রাজিল। দেশীয় সমস্যার হাত থেকে সরকারকে বাঁচানোর একমাত্র উপকরণ হয়ে উঠে এসেছিল ফুটবল। এবারও সেই লক্ষ্যেই এগোতে চেয়েছে ব্রাজিল। দেখা যাক, ভেনেজুয়েলার বিরুদ্ধে উদ্বোধনী ম্যাচে পেনাল্টিতে নিজের ৬৭তম গোল পাওয়া নেইমার পরিত্রাতা হয়ে উঠতে পারেন কি না, এবার।

ছবিটার একটা অন্য ব্যঞ্জনা আছে না! ছবি: গেটি ইমেজেস

গাবিগোল বলা হচ্ছে যাকে, গাব্রিয়েল বারবোসার পদবি আবার ব্রাজিলের হৃদয়জুড়ে থেকে যাওয়া চির ক্ষতকে মনে পড়িয়ে দেয়। বুক দিয়ে ব্রাজিলকে আগলে রাখতে চেয়েছিলেন মোয়াসির বারবোসাও, সেই পঞ্চাশের মারাকানায়, নিজেদের দেশে বিশ্বকাপের শেষ ম্যাচে, উরুগুয়ের বিপক্ষে। দয়া করে কেউ সেই ম্যাচকে ‘বিশ্বকাপ ফাইনাল’ বলার ভুল করবেন না। সেবার বিশ্বকাপে প্রাথমিক গ্রুপ পর্যায়ের পর দ্বিতীয় আরও একটি গ্রুপ তৈরি হয়েছিল, চার দল সেখানে লিগ ভিত্তিতে খেলেছিল তিনটি করে ম্যাচ। ব্রাজিল বনাম উরুগুয়ে ছিল সেই প্রতিযোগিতার শেষ ম্যাচ। এবং কার্যত ফাইনাল বলাটাও ঠিক নয়, কারণ, ড্র করলে ব্রাজিল চ্যাম্পিয়ন হতো। নকআউট বলে কোনও পর্বই ছিল না, যেখানে কোয়ার্টার বা সেমিফাইনাল বলেই কিছুর অস্তিত্ব নেই, ‘ফাইনাল’ থাকবে কী করে!

সেই ম্যাচে ব্রাজিলের গোলরক্ষক ছিলেন মোয়াসির বারবোসা। তিনিই খেয়েছিলেন দুটি গোল। মারাকানায় হাজির দু’লক্ষ মানুষের চোখে সহজ ভিলেন। তিনিই নাকি হারিয়েছেন। নিজের দেশে ব্রাজিল পারেনি বিশ্বকাপ জিততে, ওই গোলকিপারের জন্যই। মৃত্যুর আগে বারবোসা সখেদ জানিয়েছিলেন, কোনো আসামির যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হলেও চৌদ্দ বছর পর ছাড়া পেয়ে যায়, তাঁকে সত্যিই আজীবন নির্বাসিত করেছিল ব্রাজিল। অভিশপ্ত সেই মারাকানোজোর পর পঞ্চাশ বছর বেঁচে থেকে সেই জ্বালা সহ্য করেছিলেন বারবোসা।

বুক দিয়ে আগলে রাখার কথা ছিল মোয়াসির বারবোসার। পারেননি। বুক দিয়ে গোল দিলেন আর এক বারবোসা, ৭১ বছর পর। জুড়ল কি খানিক বুকের জ্বালা, ব্রাজিলের?

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×