নিজের নাম `হনুমান` রাখতে চেয়েছিলেন গাভাস্কার

দেবাশিস দত্ত

১৬ জুন ২০২১

নিজের নাম `হনুমান` রাখতে চেয়েছিলেন গাভাস্কার

সুনীল গাভাস্কারের সঙ্গে তাঁর পরিচয়ের ৪৪ বছর হতে চলল। দীর্ঘ পথ চলায় ক্রিকেটার-সাংবাদিক পরিচয় ছাপিয়ে হয়ে উঠেছেন বন্ধুই। তাই, গাভাস্কারের অন্দরমহলের আগাপাশতলা তাঁর জানা। উৎপলশুভ্রডটকম-এর পাঠকদের জন্য তেমনই কিছু অজানা গল্প বললেন কলকাতার নামী সাংবাদিক। জানালেন গাভাস্কারের `সুনীল` নামের উৎসও।

সুনীল গাভাস্কারকে নিয়ে লেখা মানেই আনন্দ যেমন, সমস্যাও! আনন্দ, কারণ সেই ১৯৭৮ সাল থেকে পরিচয়। ৪৪ বছর হতে চলল। দেশে-বিদেশে কত ঘটনা, একসঙ্গে থাকা, ঘোরা, লেখা। সময়ে-অসময়ে ওঁকে বিরক্ত করা। হুটহাট ওঁর বাড়ি চলে যাওয়া মুম্বাইয়ে, একেবারে পরিবারের লোক হয়ে ওঠার গল্পের মহাসাগর থেকে ছেঁচে কয়েকটা মুক্তো তুলে আনার চেষ্টা করতে হবে এই লেখায়, এমনই দাবি উৎপল শুভ্রর। আবার, সমস্যাও তো সেটাই! কতগুলো ঘটনা বলব, কীভাবে বলব? কী করেই বা মাত্র দু-একটা বেছে নেব? যাক গে, চেষ্টা করি!

প্রথমেই বলে রাখি, আমার দেখা শ্রেষ্ঠ মানুষেরও নাম সুনীল গাভাস্কার। যেমন বুদ্ধি তেমন ঠাণ্ডা মাথা। উর্বর ক্রিকেট মস্তিষ্ক, সেটা তো না বললেও চলে। ক্রিকেট-সংক্রান্ত যেকোনো টেকনিক্যাল প্রশ্ন উঠলে বরাবরই প্রথম ফোনটা করেছি তাঁকেই। তিনজনের শরণাপন্ন হই সাধারণত—গাভাস্কার, জিওফ বয়কট এবং গ্রেগ চ্যাপেল। তিনজন থাকেন বিশ্বের তিনটি প্রান্তে। টেকনিক্যাল কোনো একটা ইস্যু নিয়ে পরপর তিনজনকে ফোন করলে তিন প্রান্ত থেকেই মোটামুটি একই উত্তর পাওয়া যায়। সামান্য তফাৎ থাকে ঠিকই, তবে সেটা উপেক্ষণীয়। অবাক হয়ে যাই ভেবে যে, কী করে ওঁরা একই রকম বলতে পারেন, পরস্পরের থেকে এতটা দূরে থেকেও। আবার, উল্টো দিক দিয়ে ভাবলে অবাক হওয়ার তো কিছু নেই! ক্রিকেটের টেকনিক সম্পর্কে তিনজন এতটাই জানেন যে, ওঁরা একই রকম বলবেন, এতে আর আশ্চর্য কী!

সুনীল গাভাস্কারের সঙ্গে লেখক

যাক গে, নিজের প্রসঙ্গে ফেরা যাক। গাভাস্কারকে নিয়ে আমার অভিজ্ঞতার ঝুলি রামায়ণ-মহাভারতের মতোই বিশালকায়। অন্য যেকোনো লেখার মধ্যেই তাই যখন-তখন উঠে আসেন তিনি। সেই ঝুলি থেকে দুটো বিশেষ গল্প বলি, আশা করি উৎপলের ওয়েবসাইটের পাঠকদের পছন্দ হবে।

প্রথম, কেন এবং কীভাবে তাঁর নাম ‘সুনীল’ রাখা হয়েছিল? বেশির ভাগ মানুষই এটা জানেন না। ছোটবেলায় গাভাস্কাররা থাকতেন মুম্বাইয়ের ভাটিয়া হাসপাতালের কাছে চিকলওয়াড়ি অঞ্চলে। একটা ছোট বাড়িতে। ইউ আকৃতির বাড়ি, মাঝে খেলার জায়গা, যাকে কষ্টেসৃষ্টে মাঠ বলা যেতে পারে! আর তার পাশেই একটা হনুমানজির মন্দির, হিন্দিতে যিনি বজরংবলি নামেই পরিচিত। তা সেই পবনপুত্র হনুমানের বিরাট ভক্ত ছিল মনোহর-মীনাল গাভাস্কারের একমাত্র পুত্র। এতটাই যে, তাঁর নাম ‘হনুমান’-ই রাখতে হবে, বাবা-মায়ের কাছে রীতিমতো জেদ করত সেই ছোট্ট ছেলে। অনেক ভেবে তাকে আটকানো হতো এই বলে যে, এই নামে যখন স্কুল-কলেজে পরিচিত হতে হবে, নানা সমস্যা হতে পারে। বিশেষ করে নাম নিয়ে বিদ্রূপও শুনতে হতে পারে, যা একেবারেই কাম্য নয়। ছোট ছেলের বায়না অবশ্য সেসব শুনতে একেবারেই রাজি নয়। তখন উপায় খুঁজে বের করতে ‘হনুমান’ নামের প্রতিশব্দ খোঁজার চেষ্টায় লেগে পড়েছিলেন মনোহর-মীনাল দম্পতি।

খুঁজতে খুঁজতেই পেয়েছিলেন ‘সুনীল’ নামের একটা মানে বজরংবলি-ও। ছেলেকে ডেকে বোঝানো হয়। শুরুতে আপত্তি করলেও এক সময় যা মেনে নেয় ওই এক রত্তি ছেলে। হনুমানের আরেক নাম যে আসলেই বজরংবলি, এর প্রমাণ হিসেবে বই খুলে দেখাতে হয়েছিল অবশ্য সে জন্য।

বিভিন্ন হনুমান মন্দিরে পুজো দেওয়া তখন থেকেই গাভাস্কারের নিত্য অভ্যাস। আরাধ্য দেবতার পুজো দিতেই হবে, একাত্তরে ভারতীয় দলে প্রথম ডাক পেলেন। অনেক দিনের জন্য চলে যেতে হবে ওয়েস্ট ইন্ডিজে। হনুমানজির পুজার কী হবে! সফরে যাওয়ার আগে বিরাট চিন্তায় পড়েছিলেন এটা নিয়েও। অবশেষে ছোটবেলার এক বন্ধুর হাতে দশ টাকা দিয়ে গিয়েছিলেন। আর বলে গিয়েছিলেন, প্রতি শনিবার যেন নিয়ম করে তাঁর নামে পুজো দেওয়া হয়। মজার ব্যাপার হলো, এতটা ভক্ত হলেও, গত ৪৪ বছরের আলাপে তাঁর আরাধ্য দেবতাকে নিয়ে বিশেষ করে না খোঁচালে কখনো একটিও শব্দ ব্যয় করেন না তিনি!

গাভাস্কারকে নিয়ে লেখা নিজের বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে অমিতাভ বচ্চনের ডানে দাঁড়ানো লেখক

আরও একটা গল্প বলি, ওই একাত্তর সিরিজেরই। সবাই জানেন, প্রথম টেস্ট সিরিজে বিদেশে, ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে ৭৭৪ রান করেছিলেন গাভাস্কার। এখনো রান সংখ্যাটা মুখস্থ সবার। ওয়েস্ট ইন্ডিজে যেখানে প্রতিটি সমুদ্র সৈকতে বেড়ে ওঠেন ফাস্ট বোলাররা, যেখানকার পিচ মানেই ব্যাটসম্যানদের বধ্যভূমি, সেই ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ থেকে প্রথম টেস্ট সিরিজে ৭৭৪ রান! সেই অসম্ভব কৃতিত্বের ক্রিকেটীয় আলোচনা আপাতত তুলে রাখা যাক। সফর থেকে দেশে ফেরার পর মা মীনালের হাতে সুনীল তুলে দিয়েছিলেন একটি খাম। ওপরে লেখা ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ-১৯৭১। আর ভেতরে? ৭৭৪ টাকা। প্রতিটি রানের জন্য একটি করে টাকা। শুরু হয়েছিল এক অনবদ্য গল্প। প্রতিটি টেস্ট সিরিজ খেলেন গাভাস্কার আর শেষে বাড়ি ফিরে মায়ের হাতে তুলে দেন আরও একটি খাম। টেস্ট জীবনে গাভাস্কারের রানের সংখ্যাটাও অনেকেই মনে রেখেছেন–১০,১২২। প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে টেস্টে দশ হাজার রানের সীমানা পেরিয়েছিলেন তিনি। সুনীলের মা মীনালের কাছে প্রতিটি খাম সযত্নে রক্ষিত। এবং সব খামের টাকা মিলিয়ে ওই দশ হাজার এক শ বাইশ টাকা।

গাভাস্কারের মা মীনাল এখন থাকেন ওরলি সি ফেস-এর স্পোর্টসফিল্ড-এর নবম তলার ফ্ল্যাটে। ২ হাজার ৮০০ স্কয়ার ফিটের ফ্ল্যাট। মুম্বাইতে থাকলে গাভাস্কার এখনো ওখানেই থাকেন। ‘আই’ (মা) মীনালের জন্মদিন ১৫ আগস্ট। দেশে থাকলে যেখানেই থাকুন না কেন, সকালে এসে মাকে প্রণাম করে আশীর্বাদ নিয়ে যাবেনই। এই মায়ের হাত ধরেই ক্রিকেটে স্ট্রেট ড্রাইভ মারার শিক্ষা গাভাস্কারের। দোতলার বারান্দায় ছোট সুনীলের স্ট্রেট ড্রাইভে মায়ের নাক ফেটে রক্ত পড়েছিল। খেলা ছেড়ে মাকে নিয়ে পড়ে ছিল ছেলে। মা কিন্তু রক্ত মুছে আবারও বল করার জন্য প্রস্তুত। অত্যন্ত ঘাবড়ে যাওয়া সুনীল তখন আর খেলতে চাইছে না। মাই তাকে খেলতে বাধ্য করেছিলেন তখন, খেলার মাঠে অমন কতই তো হয় বলে।

প্রাথমিক শিক্ষা ওখানে বলেই সুনীলের বুনিয়াদ এতটা শক্ত। ভবিষ্যতে বিশ্বসেরা ফাস্ট বোলারদের বিরুদ্ধে খেলার সময় হেলমেটহীন গাভাস্কার ছোটবেলাতেই জেনে গিয়েছিলেন, রক্তপাত হলেও ভয় পাওয়ার কিছু নেই। দৃঢ়চেতা হওয়া, কোনো পরিস্থিতিতেই ভয় না পেতে শেখার শিক্ষা যে মায়ের কাছে! দুনিয়ার সব মা-ই চেয়ে থাকেন, ছেলে যেন সবার সেরা হয়ে ওঠে। ব্যতিক্রম ছিলেন না গাভাস্কারের ‘আই’। আগলে রেখেছিলেন যেমন, ভুল করেননি প্রয়োজনীয় শিক্ষা দিতে, একেবারে ছোট বয়সেই।

আর দ্বিতীয় গল্পটা বাবা মনোহরের। বাবা ছিলেন উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান। ছুটির দিনে খেলতে যেতেন যখন, নিয়ে যেতেন ছেলেকে। ছোট ছেলে চেয়ারে বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ যেন পড়ে না যায়, মনোহর বলতেন সেই গল্প–'চেয়ারগুলোকে উল্টো করে দিতাম, থুতনিটা চেয়ারের উঁচু হেলান দেওয়ার অংশে রেখে সুনীল খেলা দেখত আমাদের।' দাদারের মাধবী নামের এক বাড়িতে তত দিনে চলে এসেছিলেন গাভাস্কাররা। ওই বাড়ি থেকেই উত্থান। এখন সেই বাড়িটা আর নেই। একটা সময় মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষ বাসে-গাড়িতে চেপে আসতেন ওই বাড়িটা দেখার জন্য, যে বাড়ি থেকে উঠে এসেছিলেন ক্রিকেট ইতিহাসের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ওপেনার। পরে মনোহর আবার চলে গিয়েছিলেন পুনেতে। মৃত্যু হয়েছিল বেঙ্গালুরুতে, জামাই গুণ্ডাপ্পা বিশ্বনাথের বাড়িতে থাকাকালীন। গাভাস্কারের বোন কবিতার স্বামী বিশ্বনাথ, ভারতীয় ক্রিকেটের আরেক রত্ন। এবং এই দুই ক্রিকেটারের বন্ধুত্বের গল্পগুলোও তো একই রকম আকর্ষণীয়।

গাভাস্কারকে নিয়ে লেখা এই বইয়ের প্রকাশনা উৎসবে অমিতাভ বচ্চন ছাড়াও আছেন ভারতীয় ক্রিকেটের আরও দুই নক্ষত্র গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথ। লেখক তো আছেনই ও শচীন টেন্ডুলকার

যা বলছিলাম, বাবা মনোহর বলে গিয়েছিলেন বলেই সুনীল কখনো রাজনীতিতে যাননি। একবার পরিস্থিতি এমন, রীতিমতো জোর করা হয়েছিল পলিটিক্সে আসতে। যা করতেন এমন পরিস্থিতিতে বরাবর, বাবার কাছে গিয়ে জানতে চেয়েছিলেন সুনীল, কী করবেন। সোজাসুজি জানিয়েছিলেন বাবা মনোহর, যা বলেছিলেন সেদিন সুনীলকে, পরে গাভাস্কার নিজেও এই লেখককে বলেছেন যেমন, সরাসরি ওঁর বাবার মুখেও শুনেছিলাম একই কথা। ‘মাই সন হ্যাজ প্লেড আ নোবল গেম। হোয়াই শুড হি বি ইনভলভড ইন আ ডার্টি গেম?’ (আমার ছেলে মহান খেলার সঙ্গে জড়িত, কেন সে নিজেকে নোংরা খেলায় জড়াবে?)

বাহাত্তর বছর বয়স হয়েছে, আগামী ১০ জুলাই তিয়াত্তরে পা দেবেন গাভাস্কার। এত দিনেও যখন পা রাখেননি রাজনীতির আসরে, সম্মান জানিয়ে এসেছেন বাবার উপদেশকে, আর সে-পথে পা বাড়াবেন না, নিশ্চিত।

বাবা-মায়ের প্রতি এই শ্রদ্ধা এবং সম্মান প্রদর্শনের প্রশ্নেও যে অদ্বিতীয় হয়েই রয়েছেন সুনীল গাভাস্কার!

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×