তারে ধরি ধরি মনে করি...

তারে ধরি ধরি মনে করি...

গোল হয়তো করে ফেলছেন মেসিরা কোনো রকমে বা এমন ছবির মতো বাঁধিয়ে রাখা ফ্রি কিকে। তাকে ধরে রাখবেন কী করে, এই অঙ্কটা যে দিন আর্জেন্টিনা কষে ফেলবে, হয়তো পাল্টে যাবে অনেক কিছু। অথবা, আরও একটা সমাধানশূন্য ধাঁধাঁ। মেসির ওই পাসগুলো থেকে অন্তত পঞ্চাশ শতাংশ ক্ষেত্রেও গোলকিপারকে একা পেয়েও সত্যি সত্যিই গোল করবেন মার্টিনেজ-আগুয়েরোরা, একটা দিন নিশ্চয়ই আসবে তেমন!

ক্লদিও ব্রাভো যদি বাংলা জানতেন! খেলা শেষে হয়তো গুনগুন করতে শোনা যেত, ‘তারে ধরি ধরি মনে করি, ধরতে গেলেম আর পেলেম না!'

ফাউলটা যেখানে হয়েছিল, মনে মনে হয়তো তখনই জেনে গিয়েছিলেন ব্রাভো, হলো না এবার। দীর্ঘদিন লিওনেল মেসির সতীর্থ হিসাবে খেলেছেন বার্সেলোনাতে। জানেন, খুব ভালো করে জানেন, ১৮ গজের বক্সের ঠিক বাইরে, গোল থেকে ২০-২১ গজ দূরত্বে এবং প্রায় মাঝামাঝি জায়গায় ফ্রি-কিক পেলে মেসির বাঁ পা কীভাবে বাঁক খাওয়াতে পারে বলকে। তাই অতক্ষণ ধরে সামনের দেওয়াল ঠিক করলেন, নিজে জায়গা মেপে দাঁড়ালেন। কিন্তু, শেষ রক্ষা হল কই?

খেলা আসলে দুষ্ট পুনরাবৃত্তি দোষে। একই অনুশীলন, একই খেলা, একই রকম বল, একই রকম প্রতিক্রিয়া। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। একঘেয়ে সেই জিনিসই রোজ করে যেতে হয়, রুটিন! এত হাজার হাজার বার চর্চার পরও ভুল হয়, আর সেটাই খেলার মাধুর্য। ব্যাটসম্যান জানেন, আউটসুইঙ্গারে ব্যাট বাড়ানো যাবে না। নেটে কতবার করেছেন, রাহুল দ্রাবিড় হয়ে বল-ছাড়ার চর্চায় একসময় মনে হয়েছে, হ্যাঁ, হয়তো ব্যাপারটায় আমার মাস্টারি জন্মেছে। মাঠে দেখা গেল, ব্যাট বাড়িয়ে দিলেন, কানা ছুঁয়ে উইকেটকিপার বা ফার্স্ট স্লিপের হাতে জমা দিয়ে ফিরতে বাধ্য হলেন। যে জায়গায় আর্জেন্টাইন অধিনায়ক ফ্রি কিক পেয়েছিলেন, গোল করেন হামেশা। কিন্তু, একশোটায় কি একশোটাই গোল হবে, হতে পারে? হয় না, আর সেটাই খেলার মজা, সাজাও।

আরও যা মজার, ওই এক শয় সত্তরবার অমন গোল দেখার পর, একাত্তরতমটির সময়ও মুগ্ধতা আবার মাত্রা ছাড়ায়। কপালকুণ্ডলায় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে মনে করে ‘আহা কী দেখিলাম, জন্মজন্মান্তরেও ভুলিব না’, ‘দূরাদয়শ্চক্রনিভস্য তণ্বী তমালতালীবনরাজিনীলা…’ ইত্যাদি। তিন পা এসে বলে বাঁ পায়ের ইনসাইড দিয়ে আদরের চাপড়। ব্রাভো গোললাইনে দাঁড়িয়ে যেমন আশা করেছিলেন, একেবারে তাই-ই। বলটা বাঁক খাচ্ছে, ব্রাভো শরীর ছুড়েছেন বলের উদ্দেশে, যতবারই মনে হচ্ছে, পেয়ে যাবেন ঠিক, আরও একটু বেঁকে গেল, শেষে জালের কোলে! ওই যে, ধরি ধরি মনে করলাম, পেলেম না। নেহাতই একটা ফ্রি কিক, এমন গোল কতগুলো করেছেন পরিসংখ্যানবিদ হিসাব রেখেছেন, মুগ্ধ দর্শক আমরা বারবার দেখে বিস্ফারিত চোখে ভেবেছি, এত সহজ, এত সুন্দরও হয়! আর তাই তো আমাদের রাতজাগা চোখে মুগ্ধতার আবেশ ছড়িয়ে আমরা বাকি সময়টুকুও বড় বড় চোখে তাকিয়ে থাকি পুনরাবৃত্তির আশায়।

সেই বাঁ পা নিরাশ করে না। আরও অন্তত গোটা তিনেক বল বেরোয়। সব চিলি-মাথা ছাড়িয়ে ঠিকই গিয়ে পড়ে লাউতারো মার্তিনেজদের মাথায়-পায়ে। কখনো ব্রহ্মতালু দিয়ে হেডে শূন্য গ্যালারিতে, কখনো পায়ে-বলে সংযোগের বেসিক ব্যাকরণ মানতে ব্যর্থ। সবই ওই গঞ্জালো হিগুয়েইন-সিনড্রোম! গোলসংখ্যা আর বাড়ে না। তারপর, বার্সেলোনার আরও এক প্রাক্তন সতীর্থ আর্তুরো ভিদাল খুঁজে নেন তাঁর সেই মুহূর্ত। ভার-বাহী কলম্বিয়ার রেফারি উইলমার রোলদানের সিদ্ধান্তে মন ভাঙে আর্জেন্টিনার। তিনকাঠির তলায় কোনো এক সার্জিও গোয়কোচিয়াকে মনে করিয়ে পেনাল্টি আটকেও দেন তরুণ এমিলিয়ানো মার্টিনেজ। কিন্তু ফিরতি বলে গোল করে যান ভার্গাস। আর, আর্জেন্টিনা আবারও পয়েন্ট হারিয়ে শুরু করে কোপা অভিযান।

আর্জেন্টাইন-ভক্তদের হৃদয় এফোড়-ওফোড় করে দেওয়া গোল। ছবি: গেটি ইমেজেস

এ গল্পও বহুচর্চিত, দেশের হয়ে আর্জেন্টিনার পারফরম্যান্সের মতোই। ২৮ বছর আন্তর্জাতিক আসরে সিনিয়র স্তরে ট্রফি-খরা তো আর এমনি এমনি নয়। কোপায় খেলতে আসার ঠিক আগেই দুটো ম্যাচ খেলেছিলেন মেসিরা। বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে সেই দুটি ম্যাচে চিলির বিরুদ্ধে ১-১, কলম্বিয়ার বিরুদ্ধে ২-২। এবার টানা তৃতীয় ম্যাচে ড্র। কোচ লিওনেল স্কালোনিও ক্যাপ্টেন লিওনেলের মতোই অসহায়। জানেন, গোল হয়তো করে ফেলছেন মেসিরা কোনো রকমে বা এমন ছবির মতো বাঁধিয়ে রাখা ফ্রি কিকে। তাকে ধরে রাখবেন কী করে, এই অঙ্কটা যে দিন আর্জেন্টিনা কষে ফেলবে, হয়তো পাল্টে যাবে অনেক কিছু। অথবা, আরও একটা সমাধানশূন্য ধাঁধাঁ। মেসির ওই পাসগুলো থেকে অন্তত পঞ্চাশ শতাংশ ক্ষেত্রেও গোলকিপারকে একা পেয়েও সত্যি সত্যিই গোল করবেন মার্টিনেজ-আগুয়েরোরা, একটা দিন নিশ্চয়ই আসবে তেমন!

মেসির ফ্রি-কিক গোল যতই সুন্দর হোক, অপ্রত্যাশিত নয়। বারংবার দেখতে দেখতে খানিকটা হলেও অভ্যস্ত চোখ। কিন্তু ইউরোয় চেক প্রজাতন্ত্রের হয়ে প্যাট্রিক শিক যে গোল করলেন স্কটল্যান্ডের বিরুদ্ধে, অবিশ্বাস্য ছাড়া কী বলবেন তাকে? মাঠে বিপক্ষের অর্ধে ঢুকেই দেখে নিয়েছিলেন, স্কটিশ গোলরক্ষক মার্শাল এগিয়ে আছেন অনেকটা। আবারও একটা বাঁ পা ঝলসে উঠল। বাঁক খেয়ে অতটা পথ পেরিয়ে ঠিক মাটি ছুঁল গোললাইন পেরিয়ে তো বটেই, নেটেরও শেষ সীমানায়। মার্শাল পিছিয়েছিলেন পড়িমড়ি। বুঝতে পেরেছিলেন, তাঁর জন্য অপেক্ষায় এক চরম অস্বস্তিকর মুহূর্ত, শেষ পর্যন্ত চেষ্টাও করেছিলেন ফিরতে। ভেবেছিলেন হয়তো, ধরতে পারবেন। পারেননি। নিখুঁত হওয়ার চেষ্টা করা একরকম, নিখুঁত হয়ে যাওয়া আর এক রকম। বারবার চেষ্টা করতে করতেই, এক-দুবার হয়ে যায়। যখন হয়ে যায়, অবিশ্বাসী চোখ নিয়ে তাকাই আমরা। এমনও হয়, হতে পারে?

মেসির উল্লাসটা একদিন ম্যাচের শেষ অব্দি স্থায়ী হবে। ছবি: গেটি ইমেজেস

বিমূঢ় ডেভিড সিম্যানকে মনে থাকবেই ফুটবল-পাঠকের। ২০০২ বিশ্বকাপে তাঁকে অবসর নিতে প্রায় বাধ্যই করেছিল এমনই এক শট, নিখুঁত হয়ে ওঠার প্রত্যাশী কোঁকড়াচুলো রোনালদিনহোর ডান পা। ইংরেজ মিডিয়া আজও হতাশায় যাকে ‘সেন্টার করতে চেয়েছিল’ লিখে চলেছে, গত প্রায়-কুড়ি বছর ধরে। কুড়ি-তিরিশ গজ দূর থেকে গোল ফ্রি কিকে হয়, হয়েই থাকে, প্রত্যাশিত। কিন্তু সাইডলাইনের ধার থেকে প্রায় ৩৫ গজ দূরে দাঁড়িয়ে কেউ কি করে ভাবতে পারে বলটা গোলকিপারের মাথা টপকে গোলে রাখার কথা, এই প্রশ্নটাতেই ধাক্কা খায় প্রচলিত বিশ্বাস। সচরাচর যা হয় না তা-ই যে আসলে আচম্বিত, অপ্রত্যাশিত। ইংল্যান্ড এবং সিম্যান সেই ধাক্কায় আজও কাতর। গ্রেটরা তাই-ই করেন যা হতে পারে; যা হতে পারে না তাতে বিশ্বাস রেখে কাজে দেখিয়ে দেওয়াটাই জিনিয়াসের কাজ---ফুটবলেরও প্রাচীন প্রবাদ।

আর ভাবনা নিয়ে একা রাস্তা পেরোতে চাইবেন যাঁরা, ফুটবল ইতিহাস ২০২১-এর ১৪ জুনের পর নিশ্চিতভাবেই লিখে ফেলবেন প্যাট্রিক শিকের নাম। চেক প্রজাতন্ত্র এগিয়ে থাকা দল, ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের বিজ্ঞাপিত স্কটল্যান্ডের তুলনায়। তারা দু গোলে জিতলেন, দুটি গোলই শিকের, তিন পয়েন্ট পেয়ে পরের পর্বে যাওয়ার দিকেও এগোলেন খানিকটা–এই সব নীরস তথ্য দু-দিন পরই আর মনে রাখবেন না কেউ। যা মনে থাকবে, ওই নামটা, প্যাট্রিক শিক, এবং ওই গোলটা, হোক না টেলিভিশনেই, সরাসরি দেখার অবিশ্বাস্য অনুভূতি।

আরও একটা ইতিহাস ধরতে চাওয়ার মতোই নাম–লুকাস মাসোপুস্ত। আসলে নামটা নয়, পদবিটা, মাসোপুস্ত। সাবেক চেকোস্লোভাকিয়ার হয়ে খেলতেন আর এক মাসোপুস্ত, জোসেফ। সে গত শতাব্দীর পাঁচ ও ছয়ের দশকের গল্প। বাষট্টিতে বিশ্বকাপ ফাইনালে ব্রাজিলকেও যিনি পিছিয়ে দিয়েছিলেন শুরুতে। দু'পায়ে বল এপাশ-ওপাশ করতেন এমন দক্ষতায়, ফুটবলে ওই বিশেষ কাজটির নামই হয়ে গিয়েছিল মাসোপুস্ত-স্লালোম (Masopust-Slalom)। ফুটবলারের নামে বিখ্যাত হয়ে আছে সেই তালিকায় ‘ক্রুয়েফস টার্ন’ ও ‘পানেনকা পেনাল্টি’-র মতোই। আর, মাসোপুস্তের কাজটা ক্রুয়েফ বা পানেনকার অন্তত বছর দশেক আগে, মনে রাখলে ভালো। পথপ্রদর্শকের ভূমিকায়।

শিকের পঞ্চাশ গজি গোলের সেই শট। ছবি: টুইটার

এতটাই বিখ্যাত ছিলেন জোসেফ এবং তাঁর বলদক্ষতা, পেলে পর্যন্ত বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, ‘ওঁর পায়ের কাজ দেখে মনে হয়, ব্রাজিল ছাড়া আর কোথাও জন্ম হতেই পারে না!’ ১৯৬২ সালে, সঙ্গত কারণেই, তিনি ইউরোপের ব্যালন ডি’অর জয়ী। বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বে পেলে যখন আহত, খোঁড়াচ্ছেন, চেকোস্লোভাকিয়ার ফুটবলাররা আবারও কড়া ট্যাকল করতে চেয়েছিলেন। জোসেফই তখন আটকেছিলেন, পেলেকে একবারও কড়া ট্যাকল করতে দেননি সতীর্থদের, নিজেই এগিয়ে গিয়ে পেলেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পাসটা করতে দিচ্ছিলেন। এমন খেলোয়াড়ি মানসিকতার কারণে পেলে আপ্লুত তো বটেই, ফুটবল-বিশ্বও তাঁকে দিয়েছিল অনন্য সম্মান। তাঁর সময়েই চেক ফুটবলের নাম হয়ে গিয়েছিল ‘ক্যাট অ্যান্ড মাউস’। এ পা থেকে ও পায়ে বল, মাঝে ওই ‘ধরতে-পারলে-ধর্’ ছাড়াও ছোট পাসের তীব্র গতিময়তা যার অন্যতম প্রধান কারিগর ছিলেন জোসেফ। এই লুকাস মাসোপুস্তের সঙ্গে তাঁর রক্তের সম্পর্ক নেই, বলছে ইন্টারনেট। ঠিকই বলছে। কিন্তু ফুটবল-পাঠককে অতীতবিলাসী করে তোলার জন্য তো যথেষ্ট ওই উল্লেখটাই–মাসোপুস্ত।

ইউরো-কোপার এই ফুটবল অতিমারির বাজারে দিনটাই যেন ওই ‘ ধরি ধরি মনে করি’... 

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×