‘অলিম্পিক নগরী’ তাহলে এমনই হয়!

২০০৪ অলিম্পিক

উৎপল শুভ্র

২০ জুলাই ২০২১

‘অলিম্পিক নগরী’ তাহলে এমনই হয়!

২০২ দেশ, ১৬ হাজারের বেশি অ্যাথলেট, সাংবাদিকের সংখ্যাও দশ হাজারের ওপরে। ব্যারন পিয়ের দ্য কুবার্তা মারা গিয়েছেন অনেক কাল হলো, তবে ওপার থেকে নিশ্চয়ই তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছেন। বিশ্বমানবতার জয়গান গাইবেন খেলার মাধ্যমে, তাঁর এমন স্বপ্ন নিয়ে শুরু করা অলিম্পিক যে পূর্ণ মহিমায় ধরা দিয়েছিল এথেন্সে।

প্রথম প্রকাশ: ১২ আগস্ট ২০০৪। প্রথম আলো

‘অলিম্পিক নগরী’ বলতে কী বোঝায়, এই অভিজ্ঞতা ছিল না আগে। গত পরশু দুপুরে এথেন্সে পা রাখার পর থেকে বুঝতে পারছি, ‘অলিম্পিক নগরী’ ব্যাপারটা আসলে কী। এখনো অনেক দেখতে বাকি, তবে গত ৩০ ঘণ্টায় যা দেখলাম, তাতে অলিম্পিক গেমসকে শুধু খেলাধুলার বৃত্তে আটকে রাখাটাকে খুবই অন্যায় বলে মনে হচ্ছে। শুধু খেলাধুলা কেন, বলুন তো এই পৃথিবীতে আর কোন উপলক্ষকে কেন্দ্র করে বিশ্ব মানবের (মানবীরও) এমন মিলনমেলা বসে?

২০২টি দেশ অংশ নিচ্ছে ২৮তম অলিম্পিক গেমসে, অ্যাথলেটের সংখ্যা ১৬ হাজার। সাংবাদিকদের সংখ্যাটাও জেনে নিন। মাথাপিছু হিসাব করলে প্রতি দেড়জন অ্যাথলেটের জন্য একজন করে সাংবাদিক! এথেন্স অলিম্পিক কাভার করছেন ১০ হাজার সাংবাদিক। তাদের দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি কাল অলিম্পিক স্টেডিয়াম থেকে এক কিলোমিটার দূরত্বের মেইন মিডিয়া সেন্টারে (এমপিসি) উপস্থিত। কত বিচিত্র চেহারা, কত বিচিত্র ভাষা...সবচেয়ে মজার ব্যাপার, বিশ্বের সব টাইম জোনের লোক হাজির বলে সব সময়ই কাউকে না কাউকে ডেডলাইন পেরিয়ে যাওয়ার টেনশনে আক্রান্ত দেখা যাচ্ছে। 

বিশ্বের সব টাইম জোনেরই সাংবাদিক উপস্থিত বলে সব সময়ই থাকে ডেডলাইন পেরিয়ে যাওয়ার তাড়া। ছবি: গেটি ইমেজেস

গত পরশু এথেন্স আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ফ্লাইট নেমেছে পাঁচ শরও বেশি। বিমানবন্দরে ‘অলিম্পিক পরিবার’-এর জন্য এমনই বিশেষ ব্যবস্থা যে, অলিম্পিক ছাড়া অন্য কোনো কারণে যাঁরা এথেন্সে এসেছেন, তাঁদের এমন মনে হওয়া খুবই স্বাভাবিক যে, তাঁরা এখানে একেবারেই অনাহূত অতিথি। এই সময়ে এথেন্স এসে তাঁরা অন্যায় করে ফেলেছেন। যদিও পর্যটকদের বেশির ভাগই রথ দেখার সঙ্গে কলা বেচার মতো করে হলেও গায়ে মাখবেন অলিম্পিকের উত্তাপ। 

বিমানবন্দর থেকে মিডিয়া ভিলেজ, মিডিয়া ভিলেজ থেকে এমপিসিতে আসতে-যেতে যত রাস্তা পেরোতে হলো, সব কটির দু'পাশই অলিম্পিকের ব্যানার আর ফেস্টুনে সাজানো। পুরো এথেন্সই আসলে তা-ই। একটি ব্যানার আলাদা করে নজর কাড়ল : এথেন্স ২০০৪, ওয়েলকাম হোম। সেই কোন প্রাচীনকালে এখানেই অলিম্পিকের উদ্ভব, ১৮৯৬ সালে আধুনিক অলিম্পিকের সূচনাও এই এথেন্সেই। ১০৮ বছর পর এটি তো আসলে অলিম্পিকের ঘরে ফেরাই।

সেই অলিম্পিক এখন কড়া নাড়ছে দরজায়। পুরো এথেন্সই যেন রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছে এই মহালগ্নের। আগামীকাল সন্ধ্যায় ২৮তম অলিম্পিকের উদ্বোধন এবং অলিম্পিকের এই আনুষ্ঠানিকতাটুকুর টেলিভিশন-দর্শকই সবচেয়ে বেশি। চার হাজার মানুষ নিয়ে সাড়ে তিন ঘণ্টার এমন বিশাল এক আয়োজন যে নির্বিঘ্নেই সম্পন্ন হবে, আয়োজকদের সেই আত্মবিশ্বাস দিয়েছে গত পরশুর ড্রেস রিহার্সাল।

অলিম্পিকের মশাল বয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ছবি: গেটি ইমেজেস

৭০ হাজার দর্শক সেই ড্রেস রিহার্সালের সাক্ষী, তারপরও উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটিকে গোপন রেখে দেওয়ার পরিকল্পনা এতটাই সফল যে, স্থানীয় পত্রপত্রিকাতেও এর বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া গেল না। কাল সংবাদ সম্মেলনে এথেন্স ২০০৪-এর সাংগঠনিক কমিটির প্রধান জিয়ান্না অ্যাঞ্জেলোপোলস দাসকালাকিকে বেশি আনন্দিত দেখাল এতেই। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সবাই যা অনুমান করতে পারেন, জানালেন শুধু সেটুকুই। পশ্চিমা সভ্যতার জন্মস্থল গ্রিসের গৌরবোজ্জ্বল অতীত হয়ে থাকবে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের বড় একটা অংশ। গ্রিস যে শুধু অতীত রোমন্থন করেই বেঁচে নেই, আধুনিকতার বাড়ানো হাতেও হাত মিলিয়েছে, সেটিও বুঝিয়ে দেওয়া হবে এতে। এটা জানতে অ্যাঞ্জেলোপোলসকে লাগে নাকি! 

২০২টি দেশ, ১৬ হাজার অ্যাথলেট...আধুনিক অলিম্পিকের স্বপ্নদ্রষ্টা ব্যারন পিয়ের দ্য কুবার্তার স্বপ্ন নিশ্চয়ই এতটা বিস্তৃত ছিল না। বেঁচে থাকলে তাই বড় আনন্দ পেতেন কুবার্তা। তবে সেই আনন্দের পাশে বড় একটা বিষাদও চুপটি করে শুয়ে থাকত। কুবার্তা তো খেলার মাধ্যমে মানবতার জয়গান শুনতে চেয়েছিলেন, চেয়েছিলেন এক পতাকার নিচে সারা বিশ্বকে দাঁড় করাতে। ২০২টি দেশের ১৬ হাজার অ্যাথলেট পূরণ করছে তাঁর সেই স্বপ্ন, কিন্তু অলিম্পিক সম্পর্কিত যেকোনো স্থাপনার বাইরেই ওগুলো কী?

মানুষের হিংসা থেকে মানুষকে বাঁচাতে এই যে বিশাল আয়োজন, সেটি কুবার্তাকে নিশ্চিতভাবেই খুব ব্যথিত করত। বিশ্বকে বদলে দেওয়া ১১ সেপ্টেম্বরের পর প্রথম অলিম্পিক, এথেন্স অলিম্পিকের অঘোষিত মাসকট হয়ে উঠেছে তাই মেটাল ডিটেক্টর। ইউনিফর্ম গায়ে নিরাপত্তাকর্মী এর লোগো। অলিম্পিক আয়োজনের ব্যয় যে বাজেটকে এত পেছনে ফেলে দিল, তার মূল কারণও এটিই। এথেন্স অলিম্পিকে শুধু নিরাপত্তা খাতেই ব্যয় ১.২ বিলিয়ন ইউরো (প্রায় ৮ হাজার ৬০০ কোটি টাকা)।

চলছে অলিম্পিক আয়োজনের শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। ছবি: গেটি ইমেজেস

‘অলিম্পিক নগরী’র বর্ণনা দিয়েছিলাম শুরুতে। এথেন্সের এমন অলিম্পিক নগরী হয়ে ওঠা সব এথেন্সবাসীর যে ভালো লাগছে, তা কিন্তু নয়। অ্যাথলেট-কর্মকর্তা-সাংবাদিকরা তো আছেনই, এর সঙ্গে হাজার হাজার পর্যটকের ভিড় মিলিয়ে অলিম্পিক চলাকালে এই শহর আর বাসযোগ্য থাকবে না ভেবে গত কয়েক দিন ধরেই এথেনিয়ানরা দলে দলে ছুটি কাটাতে বাইরে চলে যাচ্ছেন। হয়তো এ রকম কিছু আঁচ করেই হোটেলের কর্মচারী, নিরাপত্তা ও পরিছন্নতা কর্মী— এমন কিছু পেশার লোকজনের আগস্ট মাসে ছুটি নেওয়া আগেই অবৈধ বলে ঘোষণা করেছে গ্রিক সরকার। তাদের তাই থাকতেই হচ্ছে এবং তাদের অনেকের কাছেই ভালো লাগছে না অলিম্পিক।

কাল দুপুরে এথেন্সের রাস্তায় যারা প্রতিবাদ মিছিল বের করল, তাদের অলিম্পিক-বিরাগের সঙ্গে অবশ্য অন্য কোনো কিছুর তুলনা চলে না। অলিম্পিক স্থাপনা নির্মাণের সময় মৃত্যু হয়েছে যে ১৩ জন শ্রমিকের, তাদের আত্মীয়-পরিজন কাল মিছিল বের করে প্রতিবাদ জানাল আয়োজকদের ‘অবহেলা’র। এবারের অলিম্পিকে বিজয়ীরা যা পাবে, তা আগেই পেয়ে গেলেন ওই ১৩ জন। মৃতদের সমাধিতে দেওয়া হলো জলপাই শাখার মালা। 

মরিস গ্রিন নতুন রেকর্ড করে ১০০ মিটার জিতুন বা থর্প-ফেলপস দ্বৈরথে সুইমিংপুলে রচিত হোক নতুন ইতিহাস; কালকের ওই মিছিলে যারা এসেছিলেন, তাদের কাছে অলিম্পিকের অর্থের কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। এথেন্স ২০০৪ তাদের কাছে দীর্ঘশ্বাস আর কান্না ছাড়া কিছুই নয়।

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×