‘প্রতিবেশী’ যখন কোপাকাবানা

রিও ২০১৬ অলিম্পিকের দিন–রাত

উৎপল শুভ্র

২০ জুলাই ২০২১

‘প্রতিবেশী’ যখন কোপাকাবানা

পাখির চোখে ক্রাইস্ট ডি রিডিমার ও কোপাকাবানা। ছবি: গেটি ইমেজেস

রিও অলিম্পিক কাভার করতে গিয়ে উৎপল শুভ্র প্রথমে উঠেছিলেন এক হোটেলে। তবে হোটেল ভাড়ার উচ্চমূল্যের কারণেই হোক বা একঘেয়েমির কারণে, পরে উঠেছিলেন এক অ্যাপার্টমেন্টে। কোপাকাবানার ঠিক ওপরে দাঁড়ানো ওই অ্যাপার্টমেন্টে তাঁর একঘেয়েমিতে ভোগার কোনো কারণ ছিল না। সাগর তো কখনো একঘেয়ে হয় না!

প্রথম প্রকাশ: ১০ আগস্ট ২০১৬। প্রথম আলো

রিও ডি জেনিরোর কথা বললে প্রথমেই কী মনে পড়ে?

সম্ভাব্য উত্তর দুটি। এক. ক্রাইস্ট দ্য রিডিমার। দুই. কোপাকাবানা সৈকত।

সবার এক-দুই যে এমন হবে, অবশ্যই তা নয়। আগে-পরেও হতে পারে। তবে রিওর সবচেয়ে বিখ্যাত ল্যান্ডমার্ক বলুন বা প্রতীক, তা এই দুটিই। ঘটনাচক্রে এই অলিম্পিকে যে দুটিকেই ‘প্রতিবেশী’ হিসেবে পেলাম।

প্রথমে যে হোটেলে উঠেছিলাম, সেটি কোপাকাবানা সৈকত থেকে মিনিট তিন-চারেক হাঁটা দূরত্বে। হোটেলের জানালা দিয়ে তাকালে সৈকতফেরত মানুষের দেখা মিলত। তবে সাগর বা সৈকত দেখা যেত না। দেখা যেত ক্রাইস্ট দ্য রিডিমার।

‘প্রতিবেশী’ বলাটা অবশ্য বাড়াবাড়ি হয়ে গেল। গুগলে সার্চ দিয়ে দেখলাম, কোপাকাবানার বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে ক্রাইস্ট দ্য রিডিমারের দূরত্ব ১০ থেকে ১৩ কিলোমিটার। তারপরও এটিকে কাছে মনে হওয়ার কারণ এর উচ্চতা। যে পাহাড়ের মাথায় এই বিখ্যাত মূর্তি, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সেটির উচ্চতা ৩২২৬ ফুট। আট ফুট উচ্চতার পাদানিসহ মূর্তির উচ্চতা ১২৫ ফুট। দুটি মিলিয়ে রিওর অনেক রাস্তা থেকেই চোখে পড়ে দুই দিকে দুই হাত ছড়িয়ে বরাভয় দেওয়া যিশুকে। আর ক্রাইস্ট দ্য রিডিমারের সামনের চত্বরটা থেকে প্রায় পুরো রিও ডি জেনিরো শহর। পাহাড় আর সাগরের মিতালি পাতানো রিও কেন অনেকের চোখেই বিশ্বের সবচেয়ে ‘রোমান্টিক শহর’, সেটির কারণও বোঝা যায়।

দুই দিন ওই হোটেলে কাটিয়ে একটা অ্যাপার্টমেন্টে এসে উঠেছি। দুই বেডরুম-ড্রয়িং-রান্নাঘর মিলিয়ে পূর্ণাঙ্গ একটা বাসা। খেলা কাভার করতে বাইরে এসে জীবনে অনেক হোটেলে থেকেছি। অ্যাপার্টমেন্টে এই প্রথম। হোটেলের অগ্নিমূল্য একটা কারণ। যা বোঝাতে একটা উদাহরণ দেওয়ার লোভ সামলাতে পারছি না। আটলান্টিকো কোপাকাবানা নামে যে হোটেলটিতে উঠেছিলাম, সেটিতে দুই রাত থাকতে গুনতে হয়েছে এক হাজার ডলার। অলিম্পিকের মাঝামাঝি অঙ্কটা আরও বাড়ার কথা। সবচেয়ে ভয়ংকর তথ্য হলো, অলিম্পিক শেষ হয়ে যাওয়ার পরদিনই এই হোটেলের দৈনিক ভাড়া নেমে আসবে ছয় হাজার টাকারও নিচে!

অলিম্পিকের কারণে হোটেল ভাড়া চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়ে যাওয়াটা অ্যাপার্টমেন্টে এসে ওঠার মূল কারণ। এখানেও ভাড়া স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অনেক বেশি। তবে হোটেলের তুলনায় একটু সহনীয়। হোটেলের বাড়তি আরাম-আয়েশ ত্যাগ করতে রাজি হওয়ার আরেকটা কারণ,  অলিম্পিকের পুরোটা সময়ের জন্য এক হোটেলে রুম নেই। একবার ভেবেছিলাম, অন্য সব ট্যুরে যেমন শহর থেকে শহরে ঘোরার ব্যাপার থাকে, অলিম্পিকে তো আর তা নেই। এখানে না হয় হোটেল থেকে হোটেলই হোক। তিন দিন এক হোটেলে তো পরের চার দিন অন্য কোথাও। এক রুমে টানা ১৯ থেকে ২০ দিন থাকতে হওয়ার একঘেয়েমিও তাতে কাটবে। কিন্তু অলিম্পিকের দৌড়াদৌড়ির মধ্যে বারবার চেক আউট-চেক ইনের ঝামেলাটা বেশি হয়ে যায় বলে সেই পরিকল্পনা বাদ দিয়ে এই অ্যাপার্টমেন্টে। যেখানে অলিম্পিকের পরদিন পর্যন্ত টানা থাকা যাবে।

পাখির চোখে ক্রাইস্ট ডি রিডিমার, সঙ্গে কোপাকাবানা। ছবি: গেটি ইমেজেস

একঘেয়েমিতে আক্রান্ত হওয়ার কোনো ভয়ও নেই। কারণ অ্যাপার্টমেন্টটা দাঁড়িয়ে ঠিক কোপাকাবানার ওপরে। মাঝখানে শুধু রাস্তা। সাততলার জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেই আটলান্টিক মহাসাগর। সাগর কখনো একঘেয়ে হয় না।

কোপাকাবানা আরও নয়। দিন-রাত সব সময়ই যেখানে কিছু না কিছু হচ্ছে। দিনভর সৈকতে মানুষের ভিড়, সন্ধ্যার পর সৈকতের পাশের অগুনতি রেস্টুরেন্টে। সৈকতছোঁয়া রাস্তা অ্যাভেনিডা আটলান্টিকোয় (আটলান্টিক অ্যাভিনিউ) পর্যটকদের মিছিল। বিচিত্র সব স্যুভেনির নিয়ে ফেরিওয়ালারা ঘুরে বেড়ান। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার দারুণ বুদ্ধি যাঁদের। বিশ্বকাপ ফুটবলের সময় দেখেছিলাম, বিশ্বকাপ ট্রফির রেপ্লিকা নিয়ে ঘুরে বেড়াতে। এখন তাঁদের অনেকের হাতে দেখছি অলিম্পিকের সোনার পদক। ফিতা-টিতা লাগানো। আসলটার কাছাকাছিই দেখতে। বাংলাদেশের তো কখনো অলিম্পিকে সোনা জেতা হবে মনে হয় না। যাওয়ার আগে নকল সোনার পদকই কয়েকটা কিনে নিয়ে যাব ভাবছি।

কোপাকাবানায় একঘেয়ে না লাগার কারণ শুধুই সাগর নয়। কোপাকাবানা কখনো ঘুমায় না। রুমে ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে যায়। কোপাকাবানা তখনো সরগরম। এই অলিম্পিকে বিচ ভলিবলের ভেন্যু বলে আরও বেশি উৎসবমুখর। রাত তিনটা-চারটার সময়ও সৈকতের পাশে পায়ে চলার পথটাতে কাউকে না কাউকে দেখি। এত রাতে তাঁরা এখানে কেন, জানতে খুব কৌতূহল হয়।

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×