আবার সেই মারাকানায়

রিও ২০১৬ অলিম্পিকের দিন–রাত

উৎপল শুভ্র

২০ জুলাই ২০২১

আবার সেই মারাকানায়

ছবি: গেটি ইমেজেস

মারাকানা একটা নদীর নাম, কিন্তু ফুটবল-বিশ্ব তো মারাকানাকে স্টেডিয়াম হিসেবেই চেনে। ২০১৪ বিশ্বকাপ কাভার করতে গিয়ে মারাকানায় এতবার গিয়েছিলেন যে স্টেডিয়ামটা উৎপল শুভ্র হাতের তালুর মতোই চিনে ফেলেছিলেন। রিও অলিম্পিক কাভার করতে সেখানে যেতেই তাই তাঁকে পেয়ে বসল নস্টালজিয়ায়, মনে পড়ছিল হিল্ডারডো বেলিনির ওই অমর ছবিটার পেছনের গল্পও।

প্রথম প্রকাশ: ১১ আগস্ট ২০১৬। প্রথম আলো

পাতালরেলের ট্রেনে গিজগিজে ভিড়। বসতে পারার তো প্রশ্নই ওঠে না, দাঁড়ানোই কঠিন। এর মধ্যেও কান পেতে ছিলাম, কখন শুরু হবে অননুকরণীয় সেই লাতিন ধারাভাষ্য। যেটির একটি শব্দই বুঝব, যখন শেষে নাটকীয়ভাবে ঘোষণা করা হবে পরের স্টেশনের নাম—মা-রা-কা-না, মা—রা—কা—না!

কই, অন্য সব স্টেশনের আগে যেভাবে বলা হয়েছে, মারাকানার নামও দেখি একইভাবে হলো। বুঝলাম, ওটা ছিল বিশ্বকাপ ফুটবলের বিশেষ আয়োজন। ট্রেন মারাকানার আগের স্টেশন সাও ক্রিস্তভাও ছেড়ে আসার পরই শুরু হয়ে যেত ফুটবল ম্যাচের মতো করে ধারাভাষ্য। মনটা একটু খারাপই হয়ে গেল। ওটা চালিয়ে যাওয়াই কি ভালো ছিল না!

মারাকানা একটি নদীর নাম। রিও শহরের মাঝখানের ওই এলাকাটারও। কিন্তু বাকি বিশ্বের কাছে মারাকানা মানেই তো ফুটবল। মারাকানা মানেই ১৯৫০ বিশ্বকাপ ফাইনাল—ব্রাজিলিয়ান ফুটবলে চিরকালীন দুঃখের নাম ‘মারাকানাজো’। ২০১৪ বিশ্বকাপ ফাইনালকে আর্জেন্টাইনরাও এমন কোনো নাম দিয়েছে কি না কে জানে! মেসিদেরও তো স্বপ্নভঙ্গ এই স্টেডিয়ামেই।

এই সেই মারাকানা। ছবি: গেটি ইমেজেস

গত পরশু রাতে মারাকানা মেট্রো স্টেশনে যাঁরা নামলেন, তাঁরা অবশ্য ফুটবল নয়, ভলিবল দেখতে যাচ্ছেন। মারাকানার পাশেই ইনডোর স্টেডিয়ামে। স্টেশন থেকে বেরিয়ে ওভারব্রিজে উঠতেই চোখের সামনে মারাকানা। যা দেখে দুই বছর আগের বিশ্বকাপ ফুটবলের নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত। সঙ্গী বাংলাদেশের সাংবাদিকের অনুভূতিটা ভিন্ন। এই প্রথম মারাকানা-দর্শন এবং স্বাভাবিকভাবেই অভিভূত। তাঁর অনুরোধেই মারাকানা ঘিরে একটা চক্কর দিতে হলো। 

একসময় এই স্টেডিয়ামে দুই লাখ লোক খেলা দেখতে পারত। বেশির ভাগই ওই ট্রেনে যেমন এলাম, তেমন গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে। ১৯৫০ বিশ্বকাপ ফাইনালে কানায় কানায় পূর্ণ মারাকানা কোনো ফুটবল ম্যাচে সবচেয়ে বেশি দর্শকের অবিনশ্বর রেকর্ড করে বসে আছে। সবার বসার ব্যবস্থা করে আধুনিকায়নের পর দর্শক ধারণক্ষমতা নেমে এসেছে অর্ধেকে। ‘পুরোনো’ মারাকানার আশপাশের এলাকাটাও নাকি আগে খুব একটা ভদ্রস্থ ছিল না। এখন তা দারুণ সুন্দর। স্টেডিয়াম ঘিরে বাঁধানো রাস্তা। যেটিতে দুই বছর আগের সেই দৃশ্যই দেখতে পেলাম। স্বাস্থ্য ধরে রাখতে হোক বা পুনরুদ্ধার করতে, অনেকেই দৌড়াচ্ছেন।

মারাকানায় বেলিনির মূর্তি। ছবি: উইকিমিডিয়া কমন্স

বিশ্বকাপের সময় এতবার এসেছি যে, এই স্টেডিয়ামের সবকিছুই চেনা। সঙ্গী সাংবাদিকের ‘গাইড’ হয়ে গেলাম তাই। কিন্তু ব্যর্থ গাইড! তাঁকে দেখাব বলে ঘুরছি, কিন্তু হিল্ডারাডো বেলিনির মূর্তিটা আর খুঁজে পাচ্ছি না। পরে কখনো দেখানো যাবে ঠিক করে যখন মারাকানা ঘিরেই উল্টো পথ ধরে ভলিবল স্টেডিয়ামের দিকে যাচ্ছি, তখনই হঠাৎ সামনে তিনি। ব্রাজিলের প্রথম বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক। এক হাতে ফুটবল, আরেক হাতে উঁচিয়ে ধরা জুলে রিমে ট্রফি। উঁচু একটা বেদির ওপর দাঁড়িয়ে হিল্ডারাডো বেলিনি। বেদির গায়ে লেখা ১৯৫৮ বিশ্বকাপজয়ী ব্রাজিল দলের খেলোয়াড়দের নাম। 

বেলিনির ওই ট্রফি উঁচিয়ে ধরার আলাদা একটা তাৎপর্য আছে। বিশ্বকাপটা হয়েছিল সুইডেনে। সুইডিশ ফটোগ্রাফাররা সব ছিলেন উচ্চতায় খাটো। তখন তো সবকিছু এমন সাজানো-গোছানো হতো না। ট্রফি হাতে বেলিনির ছবি তুলতে তাই ধাক্কাধাক্কি চলছে। তাঁদের সুবিধার জন্যই এক হাতে ট্রফিটা ওভাবে উঁচিয়ে ধরেছিলেন বেলিনি। সেই থেকে এটি হয়ে গেছে ট্রফি জয়ের পর উদযাপনের সার্বজনীন ভঙ্গি।`৫০-এর সেই ম্যাচ। ছবি: গেটি ইমেজেস

ভলিবলে সকাল থেকেই একটার পর একটা ম্যাচ হচ্ছে। আমরা এসেছি ব্রাজিল-কানাডা ভলিবল ম্যাচ দেখতে, সেটি শুরু হতে তখনো ঘণ্টা দুয়েক বাকি। কোথাও বসে একটু চা খেয়ে নিয়ে নিলে কেমন হয়! মারাকানার আশপাশে দোকানপাটের অভাব নেই। ক্যাফেও আছে। কিন্তু ‘চা চাই’ এটাই তো বোঝাতে পারছি না। ব্রাজিলে এই এক সমস্যা। লোকজন খুব ভালো, সাহায্য করতে উদ্গ্রীব। কিন্তু তা করতে হলে তো কথা বুঝতে হবে। রাস্তাঘাটে ইংরেজি জানা কাউকে পাওয়া মানে হাতে চাঁদ পাওয়া। পেছন থেকে ইংরেজিতে ‘আপনারা আসলে কী চাইছেন’ কথাটা তাই কানে মধুবর্ষণ করল। ফুটবলার জিকোর সঙ্গে চেহারায় আশ্চর্য মিল, চমৎকার ইংরেজি বলেন। রাস্তায় দাঁড়িয়ে বেশ কিছুক্ষণ আড্ডা হলো ৪৬ বছরের ভিনটেল ভিটার সঙ্গে। পেশায় তড়িৎ প্রকৌশলী। মারাকানার ঠিক পাশেই নিজের অ্যাপার্টমেন্ট। যা জানার পর কথাবার্তা অবধারিতভাবেই ফুটবলে গড়াল। আর সব ব্রাজিলিয়ানের মতোই নেইমারের দল নিয়ে চূড়ান্ত হতাশ। পেলে-ম্যারাডোনা নিয়ে কোনো আলোচনাই করতে রাজি নন এবং আর্জেন্টিনাকে চূড়ান্ত অপছন্দ করেন। 

সেই ছোট্টটি থাকতে প্রথম কবে মারাকানায় ম্যাচ দেখেছিলেন, তা মনে করতে পারলেন না। তবে মারাকানায় দেখা স্মরণীয়তম ম্যাচের ক্ষেত্রে সেই সমস্যা নেই। ফ্লু-ফ্ল্যা নামে বিখ্যাত ‘রিও ডার্বি’ ফ্লুমিনেন্স-ফ্ল্যামেঙ্গো শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচ, যেটিতে জিততেই হতো ফ্লুমিনেন্সকে। সেই ম্যাচ কীভাবে ১-১ থেকে ফ্ল্যামেঙ্গোর পক্ষে ২-১ হলো, সেখান থেকে ২-২—সবকিছু বলার পর মুখে একটা হাসি ছড়িয়ে পড়ল ভিনটেলের। খেলার একেবারে শেষ দিকে উড়ে আসা একটা ক্রসে পেট লাগিয়ে গোল করে ফ্লুমিনেন্সকে জিতিয়ে দিলেন রেনাটো গানসো। ‘রেনাটো’ লিখলাম, তবে ভিনটেল বলেছিলেন ‘হেনাতো’, ব্রাজিলিয়ানরা ‘আর’কে ‘হ’ উচ্চারণ করে। যে কারণে রোনালদো এখানে হোনালদো।

ফ্লুমিনেন্সের অমন অদ্ভুতুড়ে জয়ের কথা বলার সময় মুখের হাসিটা দেখেই অনুমান করেছিলাম। জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হওয়া গেল, ভিনটেল ফ্লুমিনেন্সের সমর্থক। বাবা আবার ছিলেন ফ্ল্যামেঙ্গোর পাগল ভক্ত। নিজের কৈশোরে ফ্লুমিনেন্স ভালো করছিল দেখে ভিনটেল ও তাঁর ভাই বাবার ‘প্রতিপক্ষ’ হয়ে যান। গৃহশান্তি তো তাতে মাঝেমধ্যে একটু বিঘ্নিত হতোই।

শুনে নিজের কৈশোর-তারুণ্যের সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেল। ‘ফ্লু-ফ্ল্যা’র মতো আমাদেরও তো আবাহনী-মোহামেডান ছিল!

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×