‘...মনে পড়বে, হিরো ছিলাম’

বাংলাদেশের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর ২০০৯

উৎপল শুভ্র

২৪ মার্চ ২০২১

‘...মনে পড়বে, হিরো ছিলাম’

টেস্ট সিরিজ জয়ী অধিনায়ক! সাকিবের হাতে ট্রফি তুলে দিচ্ছেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের কিংবদন্তি অফ স্পিনার ল্যান্স গিবস। গ্রেনাডা, ২০০৯। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মাত্রই তৃতীয় বছরে হঠাৎ পাওয়া অধিনায়কত্ব। দেশের বাইরে প্রথম টেস্ট সিরিজ জেতালেন ছক্কা মেরে। সেন্ট ভিনসেন্টে অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা ইনজুরিতে পড়ে ছিটকে যাওয়ার পর সে টেস্টেও বদলী হিসাবে অধিনায়কত্ব করেছেন। গ্রেনাডায় দ্বিতীয় টেস্টে নেমেছেন প্রথমবারের মতো টস করতে। সেই টেস্ট ও সিরিজ জয়ের রাতে গ্রেনাডার বিচ রিসোর্টে সাকিবের সঙ্গে কথা বলার অভিজ্ঞতা ধরা আছে এই লেখায়।

প্রথম প্রকাশ: ২২ জুলাই ২০০৯। প্রথম আলো।

বাঙালি ঔপন্যাসিকের কল্পনা কতটা সাহসী হতে পারে?

নায়ক ক্রিকেটার। হঠাৎ করে টেস্ট দলের অধিনায়কত্ব পেয়ে বোলিংয়ে ৮ উইকেট, ব্যাটিংয়ে অপরাজিত ৯৬। ছক্কা মেরে ম্যাচ শেষ! একদা পরাক্রান্ত এক ক্রিকেট-শক্তির বিপক্ষে টেস্ট জয়! সিরিজে হোয়াইটওয়াশ। নায়ক ম্যান অব দ্য ম্যাচ। ম্যান অব দ্য সিরিজও!

ঔপন্যাসিক লিখবেন এবং ভাববেন, একটু বাড়াবাড়িই হয়ে গেল না তো! যতই কল্পকাহিনী হোক, পাঠকের পাতে দিতে গল্পটা তো বাস্তবোচিত হতে হবে। কল্পনা আর বাস্তবের ব্যবধান ঘুচিয়ে সাকিব আল হাসান জানালেন, স্বপ্ন দেখতে জানলে আকাশই তাঁর সীমানা।

প্রথম ইনিংসে ৩ উইকেট, দ্বিতীয় ইনিংসে ৫। কিন্তু এর সবই তুচ্ছ হয়ে যেত ব্যাট হাতে ওভাবে বীরের মতো রুখে না দাঁড়ালে। ৬৭ রানে ৪ উইকেট নেই—দেশের বাইরে বাংলাদেশের প্রথম সিরিজ জয়ের স্বপ্নে তখন কালো কালো ছোপ। সাকিবের ব্যাট সব মুছে দিয়ে বাংলাদেশকে নিয়ে গেল অনিন্দ্যসুন্দর এক ভোরে।

হাতের ট্রফিটা যেমন গল্পটা বলে দিচ্ছে, তেমনি সাকিবের মুখের হাসিটাও। ২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজে টেস্ট সিরিজ জয়ের পর। ছবি: ইএসপিএন ক্রিকইনফো

খুব সহজ-সরল জীবন-দর্শন তাঁর—বেশি ভেবে জীবনকে জটিল করে তোলার কোনো অর্থ হয় না। ক্রিকেটীয় দর্শনটাও একই রকম। মাঠে নামব, খেলব—৬৭/৪-ও সেটি বদলাতে ব্যর্থ। ‘আমি কখনো কোনো প্ল্যান করে ব্যাটিংয়ে নামি না। বল যেভাবে আসবে, সেভাবেই খেলব—ব্যস্!’

বলা সহজ। করাটা কঠিন। সাকিব অনেকবারই তা করে দেখিয়েছেন। তবে এবারের মতো আর নয়। গ্রেনাডা টেস্টে বাংলাদেশ দলকে যে অজানাকে জানতে হয়েছে, অচেনাকে চিনতে, ‘২১৫ রান হয়তো খুব বড় নয়। কিন্তু আমরা কোনোদিন জয়ের কথা ভেবে চতুর্থ ইনিংস খেলিনি। জিতলে টেস্ট জিতব, সিরিজ জিতব, ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হোয়াইটওয়াশ করব—এসব চিন্তা যোগ হয়ে এই ২১৫-ই অনেক বড় হয়ে গিয়েছিল।’

শেষ পর্যন্ত আর বড় থাকেনি সাকিবের কল্যাণেই। রকিবুলের সঙ্গে ১০৬ রানের পার্টনারশিপেরও যাতে বড় ভূমিকা এবং রকিবুল সাকিবের ব্যাটিং দেখে একটুও বিস্মিত নন, ‘আমি ওর এমন অনেক ইনিংস দেখেছি। ও সব সময়ই খুব পজিটিভ ব্যাটিং করে।’

তা হয়তো করেন। কিন্তু পরিস্থিতি বিবেচনায় এটিকে সেরা ইনিংস মানছেন সাকিব নিজেও। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তিন বছরও হয়নি। কী এমন অভিজ্ঞতা? ঘটনাচক্রে সেই সাকিবই টেস্ট অধিনায়ক! সেন্ট ভিনসেন্টে শুধু মাশরাফির কাজ চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপার ছিল বলে চাপটা হয়তো একটু কমই ছিল। এমন আকস্মিকভাবে দায়িত্বটা এল যে, এসব ভাবারও সময় পাননি। কিন্তু গ্রেনাডায় শুরু থেকেই তিনি অধিনায়ক। সেটিও কোন টেস্টে? বাংলাদেশের ক্রিকেট যখন দাঁড়িয়ে ইতিহাসের দোরগোড়ায়। মাঠে সাকিবের ব্যাটিং-বোলিং-অধিনায়কত্ব দেখে তা বোঝার সাধ্য কার! মোহাম্মদ আশরাফুল নিজে সারা জীবন যে স্বপ্ন দেখে এসেছেন এবং তা পূরণ করতে না পারার ব্যথা নিয়ে এখন কাটছে তাঁর দিন, সাকিবের মধ্যে যেন রূপায়িত হতে দেখলেন নিজের স্বপ্নকে। ‘এমন বোলিং, এমন ব্যাটিং—ক্যাপ্টেনকে এমনই হতে হয়’—মুগ্ধ আশরাফুল মুহূর্তের জন্য ভুলে গেলেন বাংলাদেশের জন্য মহাস্মরণীয় এমন একটা সিরিজ তাঁকে কেমন দুঃস্বপ্ন উপহার দিয়েছে।

গায়ে লাল-সবুজ্। পাশে কিছুদিন আগেই অধিনাযকত্ব হারানো মোহাম্মদ আশরাফুল। ছবি: এপি

মোহাম্মদ আশরাফুল নিজে সারা জীবন যে স্বপ্ন দেখে এসেছেন এবং তা পূরণ করতে না পারার ব্যথা নিয়ে এখন কাটছে তাঁর দিন, সাকিবের মধ্যে যেন রূপায়িত হতে দেখলেন নিজের স্বপ্নকে। ‘এমন বোলিং, এমন ব্যাটিং—ক্যাপ্টেনকে এমনই হতে হয়’—মুগ্ধ আশরাফুল মুহূর্তের জন্য ভুলে গেলেন বাংলাদেশের জন্য মহাস্মরণীয় এমন একটা সিরিজ তাঁকে কেমন দুঃস্বপ্ন উপহার দিয়েছে।

অধিনায়ক হিসেবে যা করতে চেয়েছেন, তা-ই হয়েছে। মাহমুদউল্লাহ উইকেট পেলেন, অথচ পরের ওভারেই তাঁকে সরিয়ে নিয়ে এলেন এনামুলকে। টেস্ট ম্যাচে কেউ এমন করে নাকি! সাকিব করেন এবং এনামুলও উইকেট পেয়ে যান! ‘আমার যখন যা মনে হয়েছে, আমি তা-ই করেছি। তাতে কাজও হয়েছে। এখন এটাকে যদি ভাগ্য বলেন, বলতে পারেন’—বলে সাকিব হাসেন। ভাগ্য তো ক্রিকেটে কখনো কখনো লাগেই, তবে সাকিবের সিদ্ধান্তগুলোর পেছনে তো ক্রিকেটীয় ভাবনাও আছে। সেটিকে তিনি বড় করে দেখাতে চান না, এই যা!

ওয়েস্ট ইন্ডিজ অধিনায়ক ফ্লয়েড রেইফার আগের তিন ইনিংসেই মাহমুদউল্লাহর বলে আউট হয়েছেন। রেইফার আসতেই তাই নিয়ে এলেন মাহমুদউল্লাহকে, ‘এক বোলারের বলে বারবার আউট হলে ওই বোলারকে ব্যাটসম্যানের একটু ঝামেলা লাগেই।’ প্রথম ইনিংসে দাঁড়িয়ে যাওয়া ট্রাভিস ডাওলিন দ্বিতীয় ইনিংসেও সেই হুমকি দিচ্ছেন, সাকিব নিয়ে এলেন এনামুলকে, ‘ডানহাতি ব্যাটসম্যানের বেরিয়ে যাওয়া বল খেলতে একটু সমস্যা হয়ই।’

কী সহজ-সরল ব্যাখ্যা! যেমন সহজ ব্যাখ্যা মাত্র ৪ রানের জন্য প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি না পাওয়ার দুঃখের, ‘এর আগে আমি টেস্টে ৯৬ রানে আউট হয়েছি। এবার নটআউট থাকলাম, আমি তো উন্নতিও বলব!’ বলেন আর হাসেন। হাসতে পারেন, কারণ ওই যে সেভাবে রবীন্দ্রনাথ না পড়েও ‘সত্যরে লও সহজে’ জীবনদর্শন, ‘একবার হিসাব করেছিলাম; দেখলাম জয়ের জন্য লাগে ৩০ রান, সেঞ্চুরির জন্য ২৮। তখনই বলেছি, বাদ দে, ওটা হচ্ছে না।’

"না, না, আমি এর চেয়ে অনেক বড় বড় জিনিস কল্পনা করি। বিশ্বকাপ জেতাচ্ছি, আমি ম্যান অব দ্য ম্যাচ। ম্যান অব দ্য সিরিজও। ম্যান অব দ্য ম্যাচের কথা ভাবার পর মনে হয় ম্যান অব দ্য সিরিজটাই বা ছাড়ব কেন? সব পেতে ইচ্ছা করে।"

গ্রেনাডার অর্জনের মাহাত্ম্যে অবশ্য ঠিকই আলোড়িত, ‘এত কিছু পাব চিন্তাও করি নাই। এই ম্যাচে এর চেয়ে বেশি কিছু হওয়া সম্ভব ছিল না।’ ক্রিকেটই ধ্যানজ্ঞান হয়ে যাওয়ার পর স্বপ্ন দেখার অলস দুপুরগুলোও কি ছুঁতে পেরেছিল এমন কিছু? এবার বেরিয়ে আসেন আসল সাকিব, ‘না না, আমি এর চেয়ে অনেক বড় বড় জিনিস কল্পনা করি। বিশ্বকাপ জেতাচ্ছি, আমি ম্যান অব দ্য ম্যাচ। ম্যান অব দ্য সিরিজও। ম্যান অব দ্য ম্যাচের কথা ভাবার পর মনে হয় ম্যান অব দ্য সিরিজটাই বা ছাড়ব কেন? সব পেতে ইচ্ছা করে।’

অনেক দিন পর যখন এই গ্রেনেডা টেস্টের দিকে ফিরে তাকাবেন, দেশের বাইরে প্রথম সিরিজ জয়-ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হোয়াইটওয়াশ—বাংলাদেশের ক্রিকেটে ঐতিহাসিক এসব তাৎপর্যময়তার বাইরে ব্যক্তিগত স্মৃতি কী মনে পড়বে? ‘মনে পড়বে আমি হিরো ছিলাম। অন্য অনেক কিছু বোধ হয় ভুলে যাব। কিন্তু এটা ভোলার চান্স নাই।’

বলতে বলতে সাকিব আল হাসান হাসেন। বিশাল এক বাগানবাড়ির মতো গ্রেনাডা বিচ রিসোর্টের বাতাসে ফুলের গন্ধ, ভেসে আসছে সাগরের জলকল্লোল, পাশের সুইমিং পুলের নীল জলে চাঁদের ছায়া পড়েছে—সাকিবকে যে কী সুন্দর দেখায়!

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×