প্রথম ফলো অন, প্রথম ইনিংসে জয়

এক টেস্টে দুই প্রাপ্তি

উৎপল শুভ্র

১ ডিসেম্বর ২০২১

এক টেস্টে দুই প্রাপ্তি

মাঠ ছাড়ছেন ১২ উইকেট নিয়ে জয়ের নায়ক মেহেদী হাসান মিরাজ

ফলো অন আর ইনিংস পরাজয়ের সঙ্গে টেস্ট ক্রিকেটের প্রায় শুরু থেকে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ পরিচয়। তবে তা ভুক্তভোগী হিসেবে। টেস্ট অভিষেকের দেড় যুগ পর প্রথম প্রতিপক্ষকে এই যন্ত্রণা ফিরিয়ে দিতে পেরেছিল বাংলাদেশ। সেটিও আবার একই টেস্টে। ২০১৮ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সেই মিরপুর টেস্টটা তাই বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে আলাদা হয়ে আছে।

প্রথম প্রকাশ: ৩ ডিসেম্বর ২০১৮। প্রথম আলো।

যখন টেস্টের তৃতীয় দিনের শেষ সেশনের খেলা চলার কথা, মিরপুর স্টেডিয়াম তখন ভাঙা হাট। প্যাড–ট্যাড পরে ব্যাট হাতে হন্তদন্ত হয়ে মাঠে ঢুকছেন তামিম ইকবাল।

পাশের একাডেমি মাঠের নেটে অনেকক্ষণ ব্যাটিং করেছেন। চোটের কারণে অনেক দিন দলের বাইরে থাকা ওপেনারের মাঠে ফেরার প্রস্তুতি। টেস্টের তৃতীয় দিন বিকেলেই মিরপুরের মাঝ উইকেটে ব্যাটিং করার সুযোগ এসে যাবে, এটা তাঁর কল্পনা করারও কথা নয়।

কল্পনাতীত সেই ঘটনাটা তামিমকে আনন্দে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে, সেটিই স্বাভাবিক। তা ‘আনন্দ’ দিয়ে কি সবটা বোঝানো যায়? সেটি ছাপিয়ে বোধ হয় প্রতিশোধ নেওয়ার তৃপ্তি। নইলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ড্রেসিংরুমের দিকে ইঙ্গিত করে তামিম কেন বলবেন, ‘ওদের কেমন লাগছে, আমি তা খুব ভালো বুঝতে পারছি। কারণ, কিছুদিন আগে আমারও এমনই লেগেছিল।’

‘কিছুদিন আগে’ বলতে গত জুলাই। বাংলাদেশের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর। যে সফরে দুই টেস্টেই শোচনীয় হারে দগদগে ক্ষত হয়ে আছে এক ইনিংসে ৪৩ রানে অলআউট হয়ে যাওয়ার লজ্জা। সেটি হয়তো ফিরিয়ে দেওয়া যায়নি, তবে যা হয়েছে, সেটিই–বা কম কী! চট্টগ্রামের পর ঢাকা—দুই টেস্টেই পৌনে তিন দিনের মধ্যে জয়। বলে গতি আর সুইংয়ের যুগলবন্দীতে যা করেছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ, বাংলাদেশ তা করল ক্যারিবীয়দের ঘূর্ণিজালে জড়িয়ে। একেই বলে পাশার দান উল্টে দেওয়া।

ফলো অনের সংজ্ঞা নিয়ে একটা রসিকতাই তো চালু ছিল একটা সময়। ফলো অন হলো সেই জিনিস, যা বাংলাদেশ করে আর প্রতিপক্ষ করায়। যে সংজ্ঞা খেটে যেত ইনিংস পরাজয়ের ক্ষেত্রেও।

সেটিও নতুন ইতিহাস গড়ে। ইতিহাসও তো একটি নয়। প্রতিপক্ষকে ফলো অন করানো, ইনিংস ব্যবধানে জয়—বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের জন্য দুটিই তো অনাস্বাদিত এক অনুভূতি হয়ে ছিল এত দিন। দুটির সঙ্গেই ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল, তবে সেটি ভুক্তভোগী হিসেবে।

ফলো অনের সংজ্ঞা নিয়ে একটা রসিকতাই তো চালু ছিল একটা সময়। ফলো অন হলো সেই জিনিস, যা বাংলাদেশ করে আর প্রতিপক্ষ করায়। যে সংজ্ঞা খেটে যেত ইনিংস পরাজয়ের ক্ষেত্রেও। টেস্টে ১৫ বার ফলো অন করতে হয়েছে বাংলাদেশকে। প্রতিপক্ষ চায়নি বলেই সংখ্যাটা ২১ হয়নি। বাকি ছয়বার বাংলাদেশকে ফলো অন করানোর সুযোগ পাওয়ার পরও আবার ব্যাটিং করেছে বলে।

প্রথমে ব্যাটিং করে ফেললে আর ফলো অনের ভয় থাকে না। এ কারণেই ফলো অন করতে বাধ্য হওয়ার যে শর্ত—প্রথম ইনিংসে ২০০ বা এর বেশি রানে পিছিয়ে থাকা—সেটির পরও ৩১ বার বাংলাদেশের গায়ে লাগেনি ফলো অনের কলঙ্ক।

ইনিংস পরাজয়ের সঙ্গে বাংলাদেশের পরিচয় তো ফলো অনের চেয়েও নিবিড় ছিল। ৩৮টি টেস্টে দুবার ব্যাটিং করেও প্রতিপক্ষের প্রথম ইনিংসের রান ছুঁতে পারেনি বাংলাদেশ।

ফলো অন আর ইনিংস পরাজয়ের যন্ত্রণায় নিজেরাই শুধু পুড়েছে বাংলাদেশ, প্রতিপক্ষকে তা ফেরত দেওয়ার সুযোগই পায়নি। সেই সুযোগ অবশ্য আগেই এসেছিল। গত মাসে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে এই মিরপুরেই। সে টেস্টের অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ তা না করিয়ে ভালোই করেছেন। তাহলে তো আর একই টেস্টে ফলো অন করানো আর ইনিংস ব্যবধানে জেতার এমন যুগলবন্দী হয় না!

আট বছরেরও বেশি সময় পর দ্বিতীয় টেস্ট সেঞ্চুরি পেয়েছিলেন মাহমুদউল্লাহ। ছবি: এএফপি

একদা পরাক্রান্ত ওয়েস্ট ইন্ডিজ অনেক দিনই রাজ্যপাট হারানো এক রাজা। সোনালি অতীতের স্মৃতি রোমন্থন করে দীর্ঘশ্বাস ফেলাই যার নিয়তি। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের অধোযাত্রা বোধ হয় তলানি ছুঁয়ে ফেলল এই সিরিজে। অনুমিতভাবেই যেটিকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের ‘সবচেয়ে কালো অধ্যায়’ বলে রায় দিয়ে দিয়েছে সে দেশের সংবাদমাধ্যম। বাংলাদেশের তাতে কী আসে যায়! প্রতিপক্ষকে ফলো অন করিয়ে ইনিংস ব্যবধানে জেতার প্রথম কীর্তিটা যে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষেই হলো, ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালে সেটি বরং অবধারিত ছিল বলে মনে হতেই পারে। টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের অনেকগুলো ‘প্রথম’–এর সঙ্গে যে জড়িয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের নাম!

আসুন, একটা তালিকা করে ফেলি—

প্রথম ইনিংস ডিক্লেয়ার?

—ওয়েস্ট ইন্ডিজ (সেন্ট লুসিয়া, ২০০৪)।

টেস্টের দুই ইনিংসেই ডিক্লেয়ার?

—ওয়েস্ট ইন্ডিজ (চট্টগ্রাম, ২০১১)

টেস্ট সিরিজে প্রতিপক্ষকে ধবলধোলাই?

—ওয়েস্ট ইন্ডিজ (২০০৯)

দেশের বাইরে প্রথম টেস্ট সিরিজ জয়?

—ওয়েস্ট ইন্ডিজ, সেই ২০০৯ সালেই।

পাঁচ শ ছাড়ানো স্কোর?

—ওয়েস্ট ইন্ডিজ (৫৫৬, ঢাকা, ২০১২)

ফলো অন করানো আর ইনিংস ব্যবধানে জয় এই তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন।

নয় বছর আগে–পরে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে দুটি সিরিজ জয়ে যেমন মিল আছে, তেমনি অমিলও। সবচেয়ে বড় অমিল, ২০০৯ সালের ওয়েস্ট ইন্ডিজ ছিল শুধু নামেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ। বোর্ডের সঙ্গে টাকাপয়সা নিয়ে গন্ডগোল করে অধিনায়ক ক্রিস গেইলের নেতৃত্বে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মূল খেলোয়াড়েরা ধর্মঘটে। কোনোমতে জোড়াতালি দিয়ে একটা দল দাঁড় করিয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ বোর্ড। সেন্ট ভিনসেন্টে প্রথম টেস্টের আগের দিনও বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা জানতেন না, পরদিন কাদের সঙ্গে খেলতে হবে!

নয় বছর পর ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে আরেকটি ২–০। এবারও অধিনায়ক সেই সাকিব। নয় বছর আগে তিনি ম্যান অব দ্য সিরিজ, এবারও তা–ই। ছবি: এএফপি

সবচেয়ে বড় মিল? ২–০ টেস্টে সেই সিরিজজয়ী বাংলাদেশ দলের অধিনায়কের নাম সাকিব আল হাসান। রেকর্ড যদিও বলবে, প্রথম টেস্টে অধিনায়ক ছিলেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। সেটি শুধু রেকর্ডের খাতিরেই। বোলিংয়ের সময় চোট পেয়ে মাঠ ছাড়া মাশরাফির বদলে অধিনায়কত্ব করতে হয়েছিল সাকিবকেই। নয় বছর পর ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে আরেকটি ২–০। এবারও অধিনায়ক সেই সাকিব। নয় বছর আগে তিনি ম্যান অব দ্য সিরিজ, এবারও তা–ই।

ইতিহাস এভাবেই ফিরে আসে!

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×