যাদের কাছে হারল বাংলাদেশ

ক্রিকেট ঐতিহ্যে কানাডা কিন্তু চমকে দেওয়ার মতোই ধনী

বিশ্বকাপ ক্রিকেট ২০০৩

উৎপল শুভ্র

১৩ মে ২০২১

ক্রিকেট ঐতিহ্যে কানাডা কিন্তু চমকে দেওয়ার মতোই ধনী

অভাবিত কিছু পেয়ে যাওয়ার আনন্দের উদযাপন তো এমনই হবে। ২০০৩ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি কিংসমিডে কানাডিয়ান উৎসব

একজনেরও ওয়ানডে খেলার অভিজ্ঞতা নেই-এমন এক দল নিয়েই কানাডা হারিয়ে দিয়েছিল বাংলাদেশকে। সেই খেলোয়াড়দের কেউই আবার পেশাদার নন, সবাই সারা সপ্তাহ কাজ করে শুধু ছুটির দিনে ক্রিকেট খেলেন। শিক্ষক, ছাত্র, সেলসম্যান, ইঞ্জিনিয়ার সব পেশার লোক ছিলেন ওই দলে। তবে জানা না থাকলে কানাডার ক্রিকেট ঐতিহ্যের কথা জেনে কিন্তু আপনি অবাক হয়ে যাবেন।

প্রথম প্রকাশ: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৩। প্রথম আলো।

১০ ফেব্রুয়ারি দুপুরে ডারবান বিমানবন্দর থেকে হোটেলে আসছি। হোটেলের গাড়িতে সঙ্গী এক কানাডিয়ান ভদ্রলোক। ব্যবসার কাজে ডারবান এসেছেন। পরিচয় জানার পর বললেন, ‘এখানে এসে কার কাছ থেকে যেন শুনলাম, কানাডাও নাকি বিশ্বকাপ ক্রিকেটে খেলছে!’

সেই কানাডিয়ান ভদ্রলোকের সঙ্গে এটাই শেষ দেখা। তবে ক্রিকেটের প্রতি তাঁর যতটুকু আগ্রহ (বলা ভালো অনাগ্রহ) দেখলাম, তা থেকে অনুমান করছি ১১ ফেব্রুয়ারি কানাডা কত বড় কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেছে, ডারবানে থেকেও হয়তো তা জানতে পারেননি তিনি।

জোসেফ হ্যারিস তাতে একটুও মন খারাপ করবেন না। কানাডিয়ানদের মনে ক্রিকেটের কতটুকু জায়গা, কানাডার ক্রিকেট অধিনায়কের তা ভালোমতোই জানা। বাংলাদেশকে হারিয়ে যে বিশাল আপসেটটি ঘটিয়ে ফেলল তাঁর দল, সেটি কানাডায় কতটা সাড়া ফেলবে--এই প্রশ্নের জবাবে যেমন বললেন, ‘আজ তো মঙ্গলবার, তাই না? আজ হকি ম্যাচ আছে’ বলে এমন একটা মুখভঙ্গি করলেন, যার অর্থ যেখানে হকি খেলা আছে, তখন ক্রিকেট বিশ্বকাপের খবর নেওয়ার সময় কোথায়? একদম কারোরই সময় হবে না, তা ঠিক নয়। খবরটা ঠিকই জানবেন খেলোয়াড়দের আত্মীয়স্বজন আর তাদের নিয়োগকর্তারা!

যাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশকে হারিয়েছিল কানাডা, সেই জোসেফ হ্যারিস। পেশায় যিনি ইঞ্জিনিয়ার। ছবি: গেটি ইমেজেস​​​​

বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের মতো সেই নিয়োগকর্তা সে দেশের ক্রিকেট বোর্ড নয়। কানাডার খেলোয়াড়দের কেউই পেশাদার নন, সবাই সারা সপ্তাহ কাজ করে শুধু ছুটির দিনে ক্রিকেট খেলেন। শিক্ষক, ছাত্র, সেলসম্যান, ইঞ্জিনিয়ার সব পেশার লোক আছে এই দলে। অধিনায়ক জোসেফ হ্যারিস যেমন ইঞ্জিনিয়ার, বাংলাদেশের ব্যাটিংকে তাসের ঘর বানিয়ে ফেলা অস্টিন করডিংটন একজন প্লাম্বার (কলমিস্ত্রি)।

তার চেয়েও অবাক করার মতো তথ্য হলো, এই দলে কানাডায় জন্ম নেওয়া খেলোয়াড় আছেন মাত্র দুজন। বাকিরা নয়টি ভিন্ন দেশ থেকে অভিবাসী হয়েছেন কানাডায়। ভারত, পাকিস্তান, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, জ্যামাইকা, বারবাডোজ, জ্যামাইকা... ক্রিকেট খেলে এমন প্রায় সব দেশের খেলোয়াড়ই আছে কানাডা দলে। অধিনায়ক জোসেফ হ্যারিস রসিকতা করে বললেন, ‘একবার ভেবেছিলাম আমরা জাতিসংঘের টুপি মাথায় খেলতে নামি।’

বিশ্বকাপে খেলতে আসার জন্য কানাডার খেলোয়াড়দের সবাইকে ছুটি নিতে হয়েছে কাজ থেকে। বিশ্বকাপের মতো একটা ‘ফালতু’ ব্যাপারের জন্য ছুটি চাওয়াটা অনেক নিয়োগকর্তারই পছন্দ হয়নি। যে কারণে 'বেতন পাবেন না', শুধু এই শর্তেই ছুটি মঞ্জুর হয়েছে অনেকের। ২৪ বছর পর বিশ্বকাপে ফিরেই এমন একটা ঘটনা ঘটিয়ে ফেলার পরও এই সিদ্ধান্তের পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন না কানাডিয়ান খেলোয়াড়রা। মাদ্রাজে জন্মানোর পর বারবাডোজ হয়ে কানাডায় অভিবাসী হওয়া হ্যারিস ম্যাচ-উত্তর সংবাদ সম্মেলনে মুখে একটু দুঃখের ছায়া নিয়েই বললেন, ‘কানাডা আসলে হকি নেশন। আইস হকি নিয়েই ওখানে যত মাতামাতি।’ ক্রিকেটটা কানাডায় একদমই মনোযোগ পায় না বলেই খেলোয়াড়দের কাছে এই জয়ের মহিমাটা অনেক বেশি--‘বাংলাদেশের মতো একটি ক্রিকেটিং নেশনকে হারানোটা আমাদের জন্য স্বপ্ন পূরণের মতো ব্যাপার। গত দু বছর ধরে এই স্বপ্নই দেখে এসেছি আমরা।’

এই বিশ্বকাপে কানাডার যে টার্গেটের কথা বলছেন অধিনায়ক, তাতে বলতে হয় তাদের স্বপ্নের অর্ধেকটা পূরণ হয়েছে বাংলাদেশের বিপক্ষে জয়ে। ‘আমরা বিশ্বকাপে দুটি দলকে টার্গেট করেছিলাম। আর বাকি দলগুলোর বিপক্ষে কিছুটা হলেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার লক্ষ্য নিয়ে এসেছিলাম আমরা।’ এরপরই হেসে বললেন, ‘দুটি দলকে টার্গেট করেছিলাম বলেছি, তবে আরেকটি দলের কথা আমি বলব না।’
না বললেও সেটি যে কেনিয়াই হবে, তা বুঝতে কোনো সমস্যা নেই।

বিশ্বকাপে দুটি দলকে হারানোর লক্ষ্য নিয়ে এসেছিল কানাডিয়ানরা, বাংলাদেশকে হারিয়ে অর্ধেকটা পূরণ করেছিল ঠিকই। ছবি: গেটি ইমেজেস

বাংলাদেশকে হারিয়ে দেওয়ার পর কানাডার স্বপ্নটিকে আর অবাস্তব বলার উপায় নেই। তবে যে দলের খেলোয়াড়দের কারও ওয়ানডের অভিজ্ঞতা নেই, দক্ষিণ আফ্রিকা আসার আগে গত ছয় মাস যারা কোনো ম্যাচই খেলেনি, তাদের জন্য লক্ষ্যটা অনেক বড়ই ছিল। কানাডায় বছরের ছয় মাসই থাকে শীত, এবার তাপমাত্রা নেমে গিয়েছিল শূন্যেরও ২০ ডিগ্রি নিচে। শুধু ইনডোরে প্র্যাকটিস করেই বিশ্বকাপ প্রস্তুতি নিতে হয়েছে তাদের।
ক্রিকেট উন্মাদনার বিচারে দুই দেশের কোনো তুলনাই চলে না, তুলনা চলে না গত কয়েক বছরের পারফরম্যান্সেও। তবে একটা দিক থেকে কানাডা এগিয়ে। বাংলাদেশের চেয়ে ২০ বছর আগেই বিশ্বকাপ ক্রিকেটে খেলেছে কানাডা। 

১৯৭৯ সালের বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করার পথে আইসিসি ট্রফিতে বাংলাদেশকেও হারিয়েছিল কানাডা। তবে সেই বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৪৫ রানে অলআউট হওয়ার কারণেই সবাই মনে রেখেছিল কানাডাকে, আর কোনো কারণে নয়। ১৪ বছর এক দিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে সবচেয়ে কম রানের রেকর্ড হয়ে ছিল এটি। তবে কিছুদিন আগে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৩৮ রানে অলআউট হয়ে সেই লজ্জা থেকে কানাডাকে মুক্তি দিয়েছে জিম্বাবুয়ে। তবে কানাডার ওই ৪৫ বিশ্বকাপে সর্বনিম্ন রানের রেকর্ড হয়ে আছে এখনো। ১১ ফেব্রুয়ারির পর বিশ্বকাপে কানাডা বললে এখন আর কারও ওই ৪৫-এর কথা মনে হবে না। মনে হবে বাংলাদেশের বিপক্ষে জয়ের কথাই।

ইতিহাসের প্রথম আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচের এক দল ছিল কানাডা, যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে সে ম্যাচ পত্র-পত্রিকায় আলোচনার ঝড় তুলেছিল বিস্তর। ছবি: উইকিপিডিয়া

ক্রিকেট ঐতিহ্যেও কানাডা কিন্তু যথেষ্টই ধনী। এতটাই যে, তা বিশ্বাস করাই কঠিন। সেই অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি কানাডায় ক্রিকেটের প্রচলন। সেখানে খেলাটা এতই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল যে, ১৮৬৭ সালে কানাডার প্রথম প্রধানমন্ত্রী জন এ ম্যাকডোনাল্ড এটিকে ঘোষণা করেছিলেন ‘জাতীয় খেলা’ বলে! এর চেয়েও আশ্চর্য হলো, ক্রিকেট ইতিহাসে দুই দেশের জাতীয় দলের মধ্যে প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচটিতেও ছিল কানাডা, ১৮৪৪ সালে নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত ম্যাচটির অন্য দলটির নামও বিস্ময় জাগানোর মতো--আমেরিকা!

ক্রিকেট ইতিহাসের প্রথম সফরটিও হয়েছিল কানাডাতেই। ১৮৫৯ সালে কানাডা সফরে গিয়েছিল ইংল্যান্ড দল। স্যার ডন ব্র্যাডম্যান, আর্থার মেইলি, চ্যাপেল ব্রাদার্সদের মতো খেলোয়াড়ও খেলে এসেছেন কানাডায়। স্যার ডন ব্র্যাডম্যান খেললে যা হওয়ার কথা, যথারীতি হয়েছিল তা-ই। ওয়েস্টার্ন ওন্টারিওর বিপক্ষে ২৬০ রানের একটি ব্র্যাডম্যানীয় ইনিংস দেখতে পেয়েছিল কানাডিয়ানরা। হ্যাঁ, তখন শুধু অভিবাসীরা নয়, কানাডিয়ানরাও ক্রিকেট দেখতে মাঠে আসত!

ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া ইতিহাসের প্রথম টেস্ট ম্যাচটি খেলারও ৩০ বছর আগে আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছে যে দুটি দেশ, সেই আমেরিকা আর কানাডায় ক্রিকেট খেলাটা কেন মরে গেল, তা ক্রিকেট ইতিহাসবিদদের গবেষণার বিষয় হতে পারে। এখন হয়তো তা হবেও। ২৪ বছর পর বিশ্বকাপে ফিরেই যে কাণ্ড ঘটাল কানাডা, তাতে এ ব্যাপারে আগ্রহী লোকের অভাব হওয়ার কথা নয়।
তবে কোনো কানাডিয়ান এ কাজটি করবেন বলে মনে হয় না!

আরও পড়ুন: কানাডার কাছে হারের পর...
                     যেভাবে রচিত হলো দুঃস্বপ্ন

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×