শোয়েব নায়ক হতে পারেন, তাই বলে উলমার?

১৯৯৯ বিশ্বকাপ ক্রিকেট

উৎপল শুভ্র

১৪ মে ২০২১

শোয়েব নায়ক হতে পারেন, তাই বলে উলমার?

কোচ ও অধিনায়ক: বব উলমার আর হানসি ক্রনিয়ে মিলে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন ১৯৯৯ বিশ্বকাপে

গতির ঝড় তুলে ১৯৯৯ বিশ্বকাপের আলোড়নের নাম হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন শোয়েব আখতার। সেই বিশ্বকাপের সবচেয়ে আলোচিত চরিত্র হিসাবে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন যিনি, তিনি মাঠেই নামেননি। কিন্তু এমন কাণ্ড করেছিলেন, যা রীতিমতো হইচই ফেলে দিয়েছিল বিশ্বকাপে। দক্ষিণ আফ্রিকার দুই ক্রিকেটার অধিনায়ক হানসি ক্রনিয়ে ও অ্যালান ডোনাল্ডের কানে হিয়ারিং এইডের মতো দেখতে ছোট্ট একটা মাইক্রোফোন বসিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন মাঠে, যাতে প্রয়োজনে তিনি প্যাভিলিয়নে বসেই বুদ্ধি-পরামর্শ দিতে পারেন। বিশ্বকাপে সব দলের মাঠে নামা শেষ হওয়ার পর পর্যালোচনা লিখতে গিয়ে তাই শোয়েবের সঙ্গে নায়ক বলে মানতে হয়েছিল উলমারকেও।

প্রথম প্রকাশ: ১৮ মে ১৯৯৯। প্রথম আলো।

অ্যালেক্স ফার্গুসনের ‌‘রেড ডেভিল’দের আড়ালে বিশ্বকাপেরই এখন চাপা পড়ার যোগাড়। রোববার প্রিমিয়ার লিগ জিতেছে ম্যানইউ, গত সাত বছরে তাদের পঞ্চম শিরোপা। ২২ মে নিউক্যাসল ইউনাইটেডের বিপক্ষে এখন কাপ ফাইনাল, ২৬ তারিখে ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী বায়ার্ন মিউনিখ। লিগ আর এফএ কাপের ‌‘ডাবল’ অনেকবারই জিতেছে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, এবারের স্বপ্ন ‌‘ট্রেবল’।

তিনটি শিরোপাই জিতে ইউনাইটেড ইতিহাস গড়তে পারবে কি না, এই প্রশ্নটা বিশ্বকাপ কে জিতবে– তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে ইংল্যান্ডে। পত্রপত্রিকায় ম্যানইউয়ের জয়জয়কার, টিভিতে স্পোর্টস নিউজেও প্রিমিয়ার লিগের পর মাইকেল শুমাখারের আরেকটি ফর্মুলা ওয়ান সাফল্যেও চলে এলো বিশ্বকাপের আগে।

বিশ্বকাপ একদম নেই, তা নয়। ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিভিন্ন ভেন্যুতে খেলা হচ্ছে, আশেপাশে গেলেই টের পাওয়া যাচ্ছে উত্তাপটা। বাংলাদেশ-নিউজিল্যান্ড ম্যাচ দিয়ে ১২টি দলেরই মাঠে নামা হয়ে গেছে। প্রথম চার দিনে অঘটন বলতে যা বোঝায়, তা হয়নি। জিতেছে প্রি-টুর্নামেন্ট ফেবারিট তিন দলই। দক্ষিণ আফ্রিকা ও পাকিস্তানের পরীক্ষাটা ভালোই হয়েছে। ভারতের বিপক্ষে দক্ষিণ আফ্রিকার মতো ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে পাকিস্তানও এক সময় ম্যাচেই হেরে যাওয়ার দুঃস্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল। জ্যাক ক্যালিস আর ওয়াসিম আকরাম এই দুই ম্যাচের ফলাফল নির্ধারক পারফরমার হতে পারেন, তবে হোভ আর ব্রিস্টলে ‌‘টক অব দ্য ম্যাচ’ অন্য দুজন–বব উলমার ও শোয়েব আখতার।

ক্রিকেট কোচিংকে একবিংশ শতাব্দীতে নিয়ে যাওয়া বব উলমার আবারও হেঁটেছেন নতুন এক পথে। অধিনায়ক হানসি ক্রনিয়ে আর ফাস্ট বোলার অ্যালান ডোনাল্ডের কানে হিয়ারিং এইডের মতো দেখতে ছোট্ট একটা মাইক্রোফোন লাগিয়ে দিয়ে মাঠে নামিয়ে দিয়েছেন উলমার। কয়েক বছর আগে শারজায় মাস্টার্স ক্রিকেটে কমেন্টটরদের সঙ্গে খেলোয়াড়দের এমন যোগাযোগের ইতিহাসই উলমারকে অনুপ্রাণিত করেছিল কি না, কে জানে।

প্যাভিলিয়নে বসে কোচের অধিনায়ককে পরামর্শ দেয়ার ব্যাপারটিতে অনেকেই আপত্তি তুলবেন, তুলেছেনও। আইসিসি ম্যাচ রেফারি তালাত আলী প্রথম ড্রিঙ্কস ব্রেকের সময়ই সমাপ্তি ঘটিয়েছেন উলমারের নতুন এক্সপেরিমেন্টের। তবে কে জানে, থার্ড আম্পায়ারের ধারণার মতো দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আসা এই ধারণাও একদিন নিয়মিত ব্যাপারে পরিণত হয় কী-না! দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেটের প্রাণপুরুষ আলী ব্যাখার বাংলাদেশের ম্যাচ দেখতে এসেছিলেন চেমসফোর্ডে। সাংবাদিকদের তিনি জানালেন, এই বিশ্বকাপে আর এ নিয়ে চাপাচাপি করবেন না, তবে ডোমেস্টিক ক্রিকেটে এটি চালু করে দেখতে চান। এই বিশ্বকাপ শেষেই দক্ষিণ আফ্রিকা ছাড়ছেন উলমার, তার আগে কি নতুন কিছু দিয়ে গেলেন এই ‌‘ল্যাপটপ কোচ'?

হানসি ক্রনিয়ের কানে উলমারের মন্ত্রণা

দক্ষিণ আফ্রিকা-ভারত ম্যাচে সৌরভ গাঙ্গুলী-জ্যাক ক্যালিসকে ছাপিয়ে আলোচনায় উঠে এসেছেন বব উলমার। পাকিস্তান-ওয়েস্ট ইন্ডিজ ম্যাচে মাঠের বাইরে যেতে হয়নি। সেরা পারফরম্যান্সের খবর ছাপিয়ে ব্রিস্টলের নায়ক হয়ে উঠেছেন শোয়েব আখতার। গত দু্ই-তিন মাস ধরেই স্পট লাইটটা থাকছে এই স্পিডস্টারের ওপর। পাকিস্তান ইংল্যান্ডে পা রাখার পর থেকেই কাউন্টি গুলো টাকার বস্তা দিয়ে দৌড়াচ্ছে তাঁর পেছনে। কাউন্টি ক্রিকেটে তিনি খুবই আগ্রহী এবং এখানেও খুব সফল হবে বলে আত্মবিশ্বাস আছে তাঁর– এটুকু জানিয়ে ‌‘বাকি কথা পরে হবে’ ভঙ্গি করে বসে আছেন শোয়েব।

বিশ্বকাপ পারফর‍ম্যান্স দিয়ে দামটা আরও বাড়ানোর উদ্দেশ্য, প্রথম ম্যাচেই সেই উদ্দেশ্য অনেকখানি সফল শোয়েবের। শেরউইন ক্যাম্পবেলকে আউট করা বলটি নিয়ে বিস্তর কথা হচ্ছে সাংবাদিকদের মধ্যে। ব্রিস্টলে স্পিডোমিটার ছিল না, শোয়েবের বলের গতি নিয়ে আরও বেশি জল্পনার সুযোগ করে দিয়েছে এটি। ১০০ মাইল গতিতে বল করে ক্রিকেটের ক্রিকেটের প্রথম ‌‘সেঞ্চুরিয়ান’ বোলার হতে যাচ্ছেন এই পাকিস্তানি– শোনা যাচ্ছে এই ভবিষ্যদ্বাণীও।

দক্ষিণ আফ্রিকা ও পাকিস্তান বড় একটা পরীক্ষাই দিয়েছে। ফেবারিট অস্ট্রেলিয়ার জন্য প্রথম ম্যাচটি ছিল আরেকটি ওয়ার্ম আপ ম্যাচের মতোই। উস্টারে স্কটল্যান্ডই বরং জয়ী হয়েছে এক অর্থে। বাংলাদেশের মতো স্কটিশদেরও এটাই প্রথম বিশ্বকাপ। তবে বাংলাদেশ যেখানে প্রথম ওয়ানডে খেলেছে ১৩ বছর আগে, বিশ্বকাপ অভিষেক ম্যাচটিই স্কটল্যান্ডের প্রথম একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ। সে ম্যাচ শেষে মাথা উঁচু করেই মাঠ ছেড়েছে স্কটল্যান্ড। তবে স্টিভ ওয়াহর মাঠ ছাড়তে সমস্যা হয়েছে আবারও। ওয়েস্ট ইন্ডিজের অভিজ্ঞতা এখনো ভীতিপ্রদ রকম টাটকা। সেখানে মৃত্যুভয়ে আক্রান্ত অস্ট্রেলীয় অধিনায়ককে এদিনও ড্রেসিংরুমে ফিরতে প্রচুর ধাক্কাধাক্কি করতে হয়েছে, তাঁর পিঠে পড়েছে অনাকাঙ্খিত অনেক উৎসাহের চাপড়। ম্যাচ নিয়ে তেমন কিছু বলার ছিল না, সংবাদ সম্মেলনে তাই নিরাপত্তা নিয়েই আবারও সোচ্চার হয়েছেন স্টিভ। ‌‘বারবার বলতে বলতে আমি ক্লান্ত, কিন্তু একটা কিছু করা না হলে কেউ মারাত্মকভাবে আহত হতে যাচ্ছে’–আবারও বলেছেন স্টিভ।

স্টিভ ওয়াহ এখন অন্তত একজন সঙ্গী পাবেন তাঁর এই ‌‘জেহাদে’। ওভাবে পরাজয়ের পর ভারতীয় অধিনায়ক মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন তো রীতিমতো নিগৃহীত হয়েছেন এক দর্শকের হাতে। গালাগালিও চলেছে একই সঙ্গে। দর্শক আচরণ নিয়ে আপত্তি শোনা যাচ্ছে বেশ জোরেশোরেই। অর্জুনা রানাতুঙ্গা সম্পর্কে ভয়াবহ এক মন্তব্য করে দুই ম্যাচের স্থগিত সাসপেনশন ও জরিমানার শাস্তি পাওয়া শেন ওয়ার্ন মুখে আপত্তি না তুলে নিজেই দায়িত্ব নিয়েছেন জবাব দিয়ে দেয়ার। দর্শক অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে তাদের উদ্দেশে বাজে অঙ্গভঙ্গি করেছেন এই লেগ স্পিনার। ম্যাচ রেফারি রঞ্জন মাদুগালের দৃষ্টি এড়িয়ে না গেলে হয়তো জরিমানার বোঝা আরও বাড়ত ওয়ার্নের।

রঙ ঝলমলে তিনটি দিনের পর সোমবার মোটামুটি একটা নিরুত্তাপ দিন কেটেছে বিশ্বকাপের। একটি মাত্র খেলা। বাংলাদেশের জন্য বিরাট এক উপলক্ষ হলেও এই ম্যাচ নিয়ে বাকি ক্রিকেট বিশ্বের কোনো আগ্রহ ছিল না। আগ্রহ না থাকাটা যে ভুল হয়েছে– বাংলাদেশ তা প্রমাণ করতে পারল কই!

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×