ম্যারাডোনা ও বাংলাদেশ–এক আশ্চর্য প্রেমকাহিনি

উৎপল শুভ্র

১২ মে ২০২১

ম্যারাডোনা ও বাংলাদেশ–এক আশ্চর্য প্রেমকাহিনি

ডিয়েগো ম্যারাডোনা

ডিয়েগো ম্যারাডোনা ফুটবলার হিসেবে কেমন ছিলেন, তা নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। কিন্তু তাঁকে নিয়ে বাংলাদেশে যে উন্মাদনা, তা কিন্তু গবেষণার একটা বিষয় হতেই পারে। কোন সাত সমুদ্র তের নদী ওপারের একজন মানুষ বল পায়ে দৌড়াতে দৌড়তে কীভাবে বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে ঢুকে গিয়েছিলেন, ম্যারাডোনার মৃত্যুর পর তার কারণ খোঁজার চেষ্টা করেছিলাম।

প্রথম প্রকাশ: ২৭ নভেম্বর ২০২০। ডয়চে ভেলে বাংলা।

ম্যারাডোনার মৃত্যুর দিনে ২৫ বছরের যে যুবক, ডিয়েগো ম্যারাডোনার খেলা সরাসরি দেখার কোনো অভিজ্ঞতাই তার নেই৷ ম্যারাডোনা যখন শেষ বিশ্বকাপ খেলেছেন, তখন তো পৃথিবীতে তার আবির্ভাবই ঘটেনি৷

ম্যারাডোনা সর্বশেষ বিশ্বকাপ খেলেছেন তো মৃত্যুর ২৬ বছর আগে৷ তাও না খেলার মতোই৷ এমনিতেই সেরা সময় অনেক পেছনে ফেলে এসেছিলেন৷ তারপরও স্বপ্ন দেখেছিলেন যাওয়ার আগে রাঙিয়ে দিয়ে যাওয়ার৷ ডোপ টেস্টে ধরা পড়ে বহিস্কৃত হওয়ায় সেই বিশ্বকাপও শুরু হওয়ার আগেই শেষ৷ তারপরও ২৫ বছরের বাংলাদেশি যুবক ম্যারাডোনার মৃত্যুতে কেঁদেছে কেন?

ম্যারাডোনাকে ম্যারাডোনা বানিয়েছে ১৯৮৬ বিশ্বকাপ৷ আমাদের বয়সী কারও মনে হতেই পারে, হয়ও, মেক্সিকো বিশ্বকাপ? এই তো সেদিনের কথা৷ আসলে তো তা অনেক অনেক দিন আগের কথা। বিতর্কিত পেনাল্টিতে বিশ্বকাপ ফাইনাল হেরে মাঠেই ম্যারাডোনাকে মাঠেই অঝোরে কাঁদতে দেখার স্মৃতিতেও তো কত বছরের ধুলোর আস্তরণ৷ অথচ অনেক ২০-২২ বছর বয়সী তরুণের মুখে সেটির এমন প্রাঞ্জল বর্ণনা শুনি, যেন নিজেই তা দেখেছেন৷

প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বয়ে চলা এই ম্যারাডোনা প্রীতির রহস্যটা কোথায় লুকিয়ে? ইউটিউব তো অবশ্যই একটা বড় কারণ৷ যা খুলে দিয়েছে অতীতের এক আশ্চর্য দরোজা৷ একটা ঘটনার কথা শুনলাম বা কোনো নাম—ইউটিউবে সার্চ দিলেই তা হাজির হয়ে যাচ্ছে চোখের সামনে৷ আর খেলা ছাড়ার পরও ম্যারাডোনা এমনই এক অনন্ত খবরের উৎস হয়ে ছিলেন যে, এই নামটা প্রতিনিয়তই নেচে বেরিয়েছে চোখের সামনে৷ সেই খবর সব সময় যে প্রীতিকর হয়েছে, এমন নয়৷ ভুল কারণেই বেশি খবর হয়েছেন, আর বিতর্ক তো ছিল ছায়াসঙ্গী৷ আশ্চর্যই বলতে হবে, এ সব যেন আরও ডিয়েগো ম্যারাডোনা নামটাতে আরও বেশি মাদকতা যোগ করেছে৷ আরও অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে তাঁর আকর্ষণ।

এমন বর্ণময় চরিত্র শুধু ফুটবল কেন, আর কোনো খেলার ইতিহাসেই তো খুঁজে পাওয়া কঠিন৷ কঠিন না বলে অসম্ভবও বলে দেওয়া যায় অনায়াসে৷ লার্জার দ্যান লাইফ বলতে কী বোঝায়, ম্যারাডোনার জীবন যেন তারই একটা ডকুমেন্টারি৷ ৬০ বছরের জীবনটা কাটিয়ে গেছেন একেবারে নিজের ইচ্ছামতো৷ মাঠে বল পায়ে যেমন যা ইচ্ছা করতে পারতেন, মাঠের বাইরেও উড়িয়েছেন ইচ্ছাঘুড়ি৷ পরের মুহূর্তে কী করবেন, অন্য কেউ তা অনুমান করবে কীভাবে, নিজেই কি তা জানতেন নাকি! ফুটবলার হিসাবে কত বড় ছিলেন, সেই তর্ক এত দিনে অনেকটাই মীমাংসিত৷ তবে শুধু ফুটবল মাঠের কীর্তিই বিশ্ব জুড়ে ম্যারাডোনাকে ঘিরে এমন উন্মাদনার একমাত্র কারণ নয়৷ খামখেয়ালি চরিত্রেরও তাতে বড় ভূমিকা৷

ফুটবলই জীবন, ফুটবলেই খ্যাতি, ফুটবলেই মরণ।  ছবি: সিএনএন

বিদ্রোহী আর প্রতিবাদী সত্ত্বারও৷ কে কী ভাববে, কে কী বলবে, তার থোড়াই তোয়াক্কা করে অকপটে নিজের মনের কথা বলে গেছেন সারা জীবন৷ তাতে ফিফা রাগ করল না যুক্তরাষ্ট্র ক্ষুব্ধ হলো, এ সবে কখনোই তাঁর কিছু আসে যায়নি৷ বুয়েনস এইরেসের বস্তি থেকে খ্যাতির শীর্ষে ‍উঠে আসা আর্জেন্টিনিয়ান যেন তৃতীয় বিশ্বের বঞ্চিত নিপীড়িত সব মানুষের প্রতিনিধি৷ হাতে আঁকা উল্কিতে চে গেভারা, পায়ে বন্ধু ফিদেল কাস্ত্রোর৷ সবকিছু মিলিয়ে প্রতিষ্ঠানবিরোধী এমন এক ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছিল যে, ডিয়েগো ম্যারাডোনা শুধুই একজন ফুটবলারের সীমানা ছাড়িয়ে হয়ে উঠেছিলেন জনতার নায়ক৷

বাংলাদেশে বোধ হয় আরও বেশি৷ শুধু বাংলাদেশ না বলে বাঙালি বললে বোধ হয় তা আরও ঠিক হয়৷ বাংলাদেশের মতো পশ্চিম বাংলাতেও একদা ব্রাজিল অধ্যুষিত ফুটবল জনমানসে আর্জেন্টিনার ছবি এঁকে দেওয়ার কাজটা ম্যারাডোনাই করেছেন৷ লিওনেল মেসির কথা বলবেন না৷ মেসি এই সমর্থন ভোগ করছেন উত্তরাধিকার সূত্রেই৷ খ্রিস্টপূর্ব আর খ্রিস্ট পরবর্তী সময়ের মতো বাঙালির ব্রাজিল-আর্জেন্টিনায় ভাগ হয়ে যাওয়ারও পরিষ্কার একটা বিভাজনরেখা আছে৷ ম্যারাডোনার কীর্তিধন্য সেই ১৯৮৬ বিশ্বকাপ৷ আট বছর আগে আর্জেন্টিনা প্রথম বিশ্বকাপ জিতেছে৷ আর্জেন্টিনিয়ানদের সেই আনন্দে এই ভূখন্ডের কেউ শরিক হয়ে ছিল বলে জানা যায় না৷ আমজনতার অনেকেই হয়তো প্রথম শুনেছিল এই দেশটির নাম৷

ম্যারাডোনার আবির্ভাব ঘোষণা করা ১৯৮২ বিশ্বকাপেও সক্রেটিস-জিকো-ফ্যালকাওদের ব্রাজিলেই মজে ছিল বাংলাদেশ৷ পরের বিশ্বকাপেই যেটি ভোজবাজির মতো বদলে গেল৷ ম্যারাডোনার অতিমানবীয় পারফরম্যান্স তো অবশ্যই বড় কারণ৷ তবে আরও কিছু অনুষঙ্গেরও বড় ভূমিকা তাতে৷ সেবারই প্রথম বিশ্বকাপের সবগুলো ম্যাচ সম্প্রচারিত হলো বিটিভিতে৷ সাদা-কালো থেকে বিটিভির রঙিন যুগে উত্তরণ ঘটেছে বেশ আগেই, তবে তা মধ্যবিত্তের ড্রয়িংরুমে ঢুকতে সময় লেগেছে৷ রঙিন টেলিভিশন মধ্যবিত্তের নাগালে আসার সময়টার সঙ্গে মিলে গেছে ১৯৮৬ বিশ্বকাপ আর সেই বিশ্বকাপেই ম্যারাডোনার ওই জাদুকরী ফুটবল৷ রঙিন ছবিতে আরও রঙিন হয়ে উঠেছেন ফুটবল জাদুকর৷ ছোটখাট গড়নের ২৫ বছর বয়সী এক কোকড়াচুলো যুবক বল পায়ে ড্রিবল করতে করতে ঢুকে গেছেন বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে৷

এতটাই যে, আর্জেন্টিনিয়ানদের কাছেও তা পরিণত হয়েছে এক বিস্ময়ে৷ ম্যারাডোনার কারণে বাংলাদেশের অনেক মানুষ যেমন আর্জেন্টিনাকে চিনেছে, ম্যারাডোনাকে নিয়ে উন্মাদনার কারণেই আর্জেন্টিনার অনেকেও বাংলাদেশকে৷ আমি বলছি আর্জেন্টিনা ঢাকায় খেলে যাওয়ার আগের কথা৷ ২০০৬ বিশ্বকাপ কাভার করতে গিয়েও তো উত্তর দিতে হয়েছে সে দেশের সাংবাদিকদের কৌতুহলী প্রশ্নের, বাংলাদেশে আসলেই কি আর্জেন্টিনার পতাকা ওড়ে?

বাংলাদেশে কখনো আসেননি। তবে তাঁকে নিয়ে উন্মাদনার কথা নিশ্চয়ই শুনে গেছেন। ছবিটাকে তাই বাংলাদেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ বলে ধরে নেওয়াই যায়।  ছবি: এপি

২০০৪ সালে এথেন্স অলিম্পিকের সময়কার একটা অভিজ্ঞতার কথা তাহলে বলি৷ মিডিয়া সেন্টারে পাশে বসেছেন লোলচর্ম এক সাংবাদিক৷ অলিম্পিক বা বিশ্বকাপে সাংবাদিকদের আলাপ শুরুই হয় কে কোন দেশ থেকে এসেছেন এই প্রশ্ন দিয়ে৷ বর্ষীয়ান ওই সাংবাদিক আর্জেন্টিনার শুনেই আমার মুখ থেকে বেরিয়ে গেছে, ‘আর্জেন্টিনা! ডিয়েগো ম্যারাডোনা৷' আমার পরিচয় পাওয়ার তাঁর প্রশ্নেও ম্যারাডোনার অশরীরী উপস্থিতি থাকল৷ প্রশ্নও একটা নয়৷

‘ম্যারাডোনা বিশ্বকাপ থেকে বহিস্কৃত হওয়ায় সত্যি সত্যিই কি বাংলাদেশে প্রতিবাদ মিছিল বেরিয়েছিল?'

'আর্জেন্টিনা ১৯৯০ বিশ্বকাপ ফাইনালে হারার পর সত্যিই কি এক সমর্থক আত্মহত্যা করেছিলেন?'

দুটি ঘটনার কথাই কোথাও পড়ে থাকবেন৷ কিন্তু ওই সাংবাদিকের কাছে অনুমিতভাবেই তা অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়েছে৷ এ কারণেই এত দিন পর নির্ভরযোগ্য একটা সূত্র পেয়ে নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা৷ তা করেই তিনি থামলেন না৷ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আরও প্রশ্ন করে বাংলাদেশে ম্যারাডোনা-উন্মাদনা নিয়ে নিজের পত্রিকায় একটা স্টোরিও লিখে ফেললেন৷ শিরোনামটা করেছিলেন আমার কথা দিয়েই৷

বাংলাদেশ ও  ম্যারাডোনা—এ এক আশ্চর্য প্রেমকাহিনি!

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×