তাঁকে নিয়েই যেন ওই পঙ্‌ক্তিগুলো 

উৎপল শুভ্র

৮ জুলাই ২০২১

তাঁকে নিয়েই যেন ওই পঙ্‌ক্তিগুলো 

মাহমুদউল্লাহরই ছবি, তবে হারারে টেস্টের নয়

কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে তাঁকে টেস্টের জন্য `বাতিল` বলে দিয়েছিলেন। নির্বাচকেরাও সুবোধ বালকের মতো তা মেনে নিয়েছিলেন। মাহমুদউল্লাহ আবারও টেস্ট ক্রিকেটে ফিরে জবাব দিয়েছিলেন সেঞ্চুরিতে। প্রায় আড়াই বছর পর শুধু কোচের নামটাই বদল হয়েছে, নইলে ঘটনা আবার একই রকম। মাহমুদউল্লাহ যেন আবুল হাসানের কবিতার নীরবে সয়ে গিয়ে মুক্তো ফলানোর সেই `ঝিনুক`।

প্রথম প্রকাশ: ২ ডিসেম্বর ২০১৮। প্রথম আলো।

টনি কোজিয়ারকে বিশ্বাসই করানো যাচ্ছিল না যে ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে মাহমুদউল্লাহর টানা চার ম্যাচে সেঞ্চুরি আছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের কণ্ঠস্বরে পরিণত বর্ষীয়ান ধারাভাষ্যকার বলে দিলেন অবিশ্বাসের কারণটাও, ‘কী বলছেন, তাহলে ও আট নম্বরে নামছে কেন?’

গ্রেনাডার সেন্ট জর্জেস মাঠের প্রেসবক্সে বাংলাদেশের সাংবাদিক বলতে শুধুই আমি। ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাংবাদিক মাত্র দুজন। তাঁদের একজন ক্লাইভ লয়েডের বিখ্যাত সেই ‘পেস কোয়ার্টেটে’র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য কলিন ক্রফট। তিনিও প্রশ্নটার উত্তর শুনতে আগ্রহী।

আমি রসিকতার আশ্রয় নিয়ে বললাম, ‘তাহলে বোঝেন, বাংলাদেশের ব্যাটিং লাইনআপ কেমন শক্তিশালী!’ বলতে না–বলতেই টিনো বেস্টকে পুল করে একটা চার মারলেন মাহমুদউল্লাহ। কোজিয়ার মাথা ঝুঁকিয়ে বললেন, ‘ইয়েস, হি লুকস লাইক আ ব্যাটসম্যান।’

সেটি ২০০৯ সালের জুলাই। সেন্ট ভিনসেন্টে আগের টেস্টে অভিষেক হয়েছে মাহমুদউল্লাহর। দুই ইনিংস মিলিয়ে নিয়েছেন ৮ উইকেট। কোজিয়ার তাই নিঃসন্দেহ হয়ে গেছেন তাঁর পরিচয় নিয়ে—‘অফ স্পিনার, যে একটু-আধটু ব্যাটিং করতে পারে।’ আমি যতই বলি, আসলে তা উল্টো—‘ব্যাটসম্যান, যে একটু-আধটু অফ স্পিন করতে পারে’, কোজিয়ার অবিশ্বাসের চোখে তাকান।

কাল মিরপুরে মাহমুদউল্লাহর সেঞ্চুরি দেখতে দেখতে কেন যেন স্বর্গীয় টনি কোজিয়ারের কথা খুব মনে পড়ছিল। বেঁচে থাকলে ওয়েস্ট ইন্ডিজের এই টেস্ট নির্ঘাত দেখতেন। মাহমুদউল্লাহর পরিচয় সম্পর্কে তাঁর মনে আর কোনো সংশয় থাকত না। ভুল বললাম। কোজিয়ারের সেই সংশয় তো কবেই কেটে যাওয়ার কথা।

২০১৮ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে মিরপুরে সেঞ্চুরির পর মাহমুদউল্লাহ। এই সেঞ্চুরির পরই লিখেছিলাম এই লেখাটা। ছবি: গেটি ইমেজেস

ক্রিকেটই ছিল তাঁর জীবন। বাবা ছিলেন বারবাডোজের এক সংবাদপত্রের সম্পাদক। সেই সুবাদে কৈশোরেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের সঙ্গী হয়ে অস্ট্রেলিয়া ট্যুর কাভার করতে গেছেন। ক্রিকেট–বিশ্বের কোথায় কী হচ্ছে, সব ছিল নখদর্পণে। কোজিয়ার নিশ্চয়ই পরের বছরই জেনেছেন, ভারতের বিপক্ষে ৯৬ রানে অপরাজিত মাহমুদউল্লাহ শুধু সঙ্গীর অভাবে সেঞ্চুরি করতে পারেননি। আগের টেস্টে করেছেন ৬৯। সুনীল গাভাস্কারের সঙ্গে ছিল গভীর বন্ধুত্ব। তাঁর কলামটাও না পড়ার কথা নয়, যেখানে গাভাস্কার মাহমুদউল্লাহ সম্পর্কে লিখেছেন, ‘বিশ্বের সেরা আট নম্বর ব্যাটসম্যান’।

এর মাসখানেক পর নিউজিল্যান্ড সফরে হ্যামিল্টনের সবুজ বাউন্সি উইকেটে মাহমুদউল্লাহর সেঞ্চুরি টিভিতে যদি না-ও দেখে থাকেন, খবরটা নিশ্চয়ই পেয়েছেন। কৌতূহলভরে সেই সেঞ্চুরির পর মাহমুদউল্লাহকে নিয়ে প্রথম আলোয় ছাপা হওয়া নিজের লেখাটা খুঁজে বের করলাম। শুরুতে ফলো অনের প্রসঙ্গটুকু বাদ দিলে মিরপুরের ইনিংসটি সম্পর্কেও যা একই রকম প্রাসঙ্গিক—

“অমোঘ নিয়তির মতো ধেয়ে আসছে ফলো অন, দাঁড়িয়ে গেলেন বুক চিতিয়ে। ‘চিতিয়ে’-‘টিতিয়ে’ কথাগুলো মাহমুদউল্লাহর ব্যাটিংয়ের সঙ্গে একেবারেই যায় না। একটু আগে ব্যবহৃত ‘চোখ ধাঁধানো’ কথাটাও যেমন তাঁর ব্যাট চালানোর সঙ্গে বেমানান মনে হচ্ছে। মাহমুদউল্লাহর ব্যাটিং চোখ ধাঁধিয়ে দেয় না, চোখে মায়াঞ্জন বুলিয়ে দেয়। তাঁর প্রিয় ব্যাটসম্যান মহেন্দ্র সিং ধোনি, ভেঙ্কট লক্ষ্মণ হলে ভালো মানাত। অফ সাইডে যতবার ড্রাইভ করলেন, তাঁকে তো লক্ষ্মণ বলেই মনে হলো ততবার। অলক কাপালির পর বাংলাদেশের ক্রিকেটে এমন দৃষ্টিনন্দন ব্যাটসম্যান আর আসেনি।” (প্রথম আলো, ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১০)।

ব্যাটিংই নাকি একজন ব্যাটসম্যানের ব্যক্তিত্বের আয়না। মাহমুদউল্লাহর মতো আর কারও ক্ষেত্রে বোধ হয় কথাটা এত সত্যি নয়। মানুষ মাহমুদউল্লাহ যেমন শান্ত, ধীরস্থির, নরমসরম; তাঁর ব্যাটিংও তেমন। নরম, পেলব, অলস আভিজাত্যে চোখের জন্য প্রশান্তি। কোলাহল একটু থেমে আসা ইনিংসের শেষ দিকেই যেন সেটি বেশি খোলতাই হয়। মাঝখানে তিন-চার-পাঁচে ব্যাটিং করেও সেঞ্চুরি পাননি। প্রথম সেঞ্চুরিটা আট নম্বরে খেলে। দ্বিতীয়টা ছয় নম্বরে। সাত নম্বরে তৃতীয় ও সর্বশেষটি।

হ্যামিল্টনে প্রথম সেঞ্চুরিটি করেছিলেন নিজের পঞ্চম টেস্টে। এরপর অপেক্ষা আর অপেক্ষা। ৪০ টেস্ট শেষেও ওই একটিই সেঞ্চুরি। ক্রিকেট রহস্য করতে এমনই ভালোবাসে যে, এরপর মাত্র তিন টেস্টের মধ্যেই তিন গুণ সেই সেঞ্চুরির সংখ্যা! প্রথম আর দ্বিতীয় সেঞ্চুরির মাঝখানে পৌনে নয় বছর। দ্বিতীয় আর তৃতীয় সেঞ্চুরির মাঝে মাত্র ষোলো দিন।

মাঝের সময়টায় কত কিছুই না দেখতে হয়েছে মাহমুদউল্লাহকে! টেস্ট দল থেকে বাদ পড়েছেন। পড়তেই পারেন। কত বড় বড় ব্যাটসম্যানও তো বাদ পড়েছেন। কিন্তু মাহমুদউল্লাহর বাদ পড়াটা তো স্বাভাবিক ছিল না। বাদ পড়লেন বাংলাদেশের শততম টেস্টের দল থেকে। সেটিই সারা জীবনের জন্য ক্ষত হয়ে থাকার জন্য যথেষ্ট। সে সময়ের কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে তাতেই থামলেন না। সিরিজের মাঝপথে তাঁকে শ্রীলঙ্কা থেকে দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়ার বন্দোবস্ত করে কাটা ঘায়ে ছড়িয়ে দিতে চাইলেন নুনের ছিটা। নিয়তির কী নির্মম পরিহাস, কিছুদিন পর সেই হাথুরুসিংহে যখন শ্রীলঙ্কা দল নিয়ে সফরে এলেন, সেই মাহমুদউল্লাহই টেস্ট সিরিজে বাংলাদেশের অধিনায়ক! ক্রিকেট কখনো কখনো নিষ্ঠুর হয় বটে, আবার কখনো তা এভাবেই যাঁর যেটা প্রাপ্য সেটি বুঝিয়ে দেয়।

বুঝিয়ে না দিলেও মাহমুদউল্লাহ কোনো অভিযোগ করতেন না। তখনো করেননি। কখনোই নয়। ভেতরে ভেতরে রক্তাক্ত হয়েছেন, কিন্তু মুখে কখনোই সেটির প্রকাশ ঘটেনি। অভিযোগ-অনুযোগ তাঁর ধাতেই নেই। আবুল হাসানের কবিতার ওই পঙ্‌ক্তিগুলো যেন তাঁকে নিয়েই লেখা—

ঝিনুক নীরবে সহো
ঝিনুক নীরবে সহো,
ঝিনুক নীরবে সহে যাও
ভিতরে বিষের বালি, মুখ বুজে
মুক্তা ফলাও।

আরও পড়ুন:
মাহমুদউল্লাহ শূন্য রানে আউট হলেও প্রশ্নগুলো থাকতই!

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×