মেসি ও মারাকানা: সাত বছর আগে ও পরে

উৎপল শুভ্র

১১ জুলাই ২০২১

মেসি ও মারাকানা: সাত বছর আগে ও পরে

এত বছরের চাওয়া পূরণ হলে আনন্দটা একটু বেশিই হয়!

সাত বছর আগে যে মারাকানাতে তিন বছরে তিন ফাইনালে হারার হ্যাটট্রিকের সূচনা, সাত বছর সেই মারাকানাতেই লিওনেল মেসির স্বপ্নপূরণ। অথচ এই ফাইনালটা তো মারাকানাতে হওয়ারই কথা ছিল না। কী বলবেন এটিকে? নিয়তির লিখন, নাকি ফুটবল-বিধাতার নিজ হাতে লেখা পান্ডুলিপি?

নিয়তিই তাহলে ঠিক করে রেখেছিল, সাত বছর আগে যে রণাঙ্গন থেকে রক্তাক্ত হয়ে ফিরেছেন পরাজিত সৈনিক, সাত বছর পর সেখানেই লেখা হবে তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় জয়ের গল্প! 

তিনটি কোপা ফাইনালও হৃদয়ে রক্ত ঝরিয়েছে, চোখে জল; তবে বিশ্বকাপ তো বিশ্বকাপ। সাত বছর ধরে লিওনেল মেসির নিদ্রায়-জাগরণে বারবারই হয়তো ফিরে এসেছে ২০১৪ সালের ১৩ জুলাই। ফিরে এসেছে মারাকানা। ‘আনলাকি থার্টিন’ কথাটাতে বিশ্বাস জন্মে গেছে, ব্রাজিলিয়ানদের মতো তাঁর কাছেও মারাকানা হয়ে গেছে ‘মারাকানাজো’।

দুটি দিনই শুধু এদিক-ওদিক, নইলে বলা যেত, ঠিক সাত বছর পর সেই মারাকানাই ঘুচিয়ে দিল তাঁর অর্জনে অর্জনে ভাস্বর ক্যারিয়ারের একমাত্র অতৃপ্তি। আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে একটা আন্তর্জাতিক ট্রফি। অথচ কোপা আমেরিকার এই ফাইনালটা তো মারাকানাতে হওয়ারই কথা নয়। নিয়তির খেলা নয় তো কি!  

ডিয়েগো ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনার মেক্সিকো বিশ্বকাপ জয়ের সময় জন্মই হয়নি। ১৯৯৩ সালে মেক্সিকোর বিপক্ষেই ফাইনালে বাতিস্তুতার দুই গোলে দুই বছর আগে জেতা কোপা-শিরোপা ধরে রাখার সময় ছয় বছরের বালক। ট্রফি নিয়ে আর্জেন্টিনার উল্লাসের স্মৃতি সেই বালকের মনে না-ই থাকতে পারে। বয়সের সঙ্গে সময়টাও তো মনে রাখতে হবে। আগের চারটি বিশ্বকাপের দুটিতে জয়, আরেকটির ফাইনালিস্ট এক দেশে কোপা জয় নিয়ে কি খুব একটা মাতামাতি হওয়ার কথা?

কে জানত, পরের ২৮ বছর কোনো আন্তর্জাতিক ট্রফি জয়ের স্মৃতি মনে করতে আর্জেন্টিনাকে বারবার ফিরে যেতে হবে ইকুয়েডেরের সেই কোপাতে! লিওনেল মেসি ক্লাবের হয়ে শিরোপার পর শিরোপা জিতবেন, কখনো কখনো ব্যালন ডি’অর হয়ে যাবে সাংবাৎসরিক ব্যাপার, কিন্তু ফুলেল ক্যারিয়ারে কাঁটা হয়ে থাকবে ওই একটা ব্যর্থতা। কেউ না কেউ ঠিকই মনে করিয়ে দেবে, দেশের হয়ে কিছুই তো জেতোনি। সঙ্গে ছুঁড়ে দেবে অমোঘ একটা প্রশ্নও, আন্তর্জাতিক ফুটবলে কিছুই না জিতলে সর্বকালের সেরার আলোচনায় কীভাবে আসে তোমার নাম?

ফাইনালের শেষ বাঁশি বাজতেই...

আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে শিরোপা একবার জিতেছেন বটে, তবে ট্রফি নয়। কারণ অলিম্পিকে জিতলে শুধু সোনার পদকই মেলে। বয়সের বাধ্যবাধকতায় অনেক দিনই আর জাতীয় দলের খেলা নয় বলে তা আন্তর্জাতিক ফুটবল বলেও গণ্য নয়।তারপরও আর্জেন্টিনার হয়ে কিছু জেতার কথা বললে দেখাতে হতো ২০০৮ বেইজিং অলিম্পিকে জেতা সেই সোনার পদকটাই। বেইজিংয়ের ন্যাশনাল স্টেডিয়ামে নাইজেরিয়ার বিপক্ষে সেই অলিম্পিক ফাইনালেরও নিষ্পত্তি হয়েছিল ১-০ গোলেই। তের বছর পর কোপার ফাইনালেও গোলদাতার একই নাম। অ্যাঙ্গেল ডি মারিয়া! নিয়তির খেলায় তো দেখি আরও বিশ্বাস জন্মে যাচ্ছে।

সেই অলিম্পিক ফাইনালের আগের বছরই কোপার ফাইনালে হেরে ফাইনাল-দুঃখের সঙ্গে মেসির প্রথম পরিচয়। পরের বছর ছয় ব্যালন ডি’অরের প্রথমটি জিতে শুরু বিশ্ব ফুটবলে তাঁর জয়যাত্রার। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো নামের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বীর কারণে ব্যালন ডি’অরের গল্প কখনো কখনো অন্যরকম লেখা হয়েছে। কিন্তু ফাইনালের গল্প নয়। মেসির আর্জেন্টিনা ফাইনালে নামবে এবং হারবে...কথাটা প্রায় প্রবাদে পরিণত হয়েছিল টানা তিন বছরে তিনটি ফাইনালে শূন্য হাতে ফেরায়। যার শুরুটাও এই মারাকানাতেই।

সাত বছর আগে এই মারাকানাতেই...

এই দুঃস্বপ্ন-যাত্রার শেষটাও মারাকানাতেই হবে বলে হয়তো লিখে রেখেছিলেন ফুটবল-বিধাতাই। নইলে কি আর সিনেমাটিক এই স্ক্রিপ্ট এমন বাস্তবে নেমে আসে! এই মারাকানায় মেসির সর্বশেষ ফাইনাল শেষেও টুর্নামেন্ট-সেরা গোল্ডেন বলজয়ী হিসেবে ঘোষিত হয়েছিল তাঁর নাম। সেদিন পুরস্কারটা নিতেই চাননি। ব্যক্তিগত অর্জনের এই ট্রফি দিয়ে তিনি কী করবেন! এ তো তাঁর অনেক আছে, তিনি তো মনেপ্রাণে অন্য একটা ট্রফি চেয়েছিলেন। যেটিতে ব্যক্তিকে ছাপিয়ে দলের নাম লেখা থাকে। এদিন সেই মারাকানাতেই সবই পেলেন। পরম আরাধ্য সেই ট্রফি, সেরা খেলোয়াড়ের গোল্ডেন বল, সর্বোচ্চ গোলদাতার গোল্ডেন বুট। ব্যক্তিগত একটা পুরস্কারই শুধু অন্যের হাতে গেল। কারণ সেটি সেরা গোলকিপারের।

সাত বছর পর সেই মারাকানাতেই...

কোপা আমেরিকা তো আর বিশ্বকাপ নয়। কোন দল কয়টি বিশ্বকাপ জিতেছে, তা যেমন মুখস্থ বলে দিতে পারবেন, কোপা বা ইউরোর কথা জিজ্ঞেস করলে নির্ঘাত মাথা চুলকাতে হবে। এই কোপা নিয়ে এত কথা তো শুধুই মেসির কারণে। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর আর্জেন্টিনা দলের উদযাপন যা আরও ভালো করে বুঝিয়ে দিয়েছে। দলের সবাই মিলে একজনকে শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে আবার ধরে নিচ্ছেন, আবার ছুঁড়ে দিচ্ছেন শূন্যে। তা ফুটবলে শিরোপা জয়ের পর এমন লোফালুফির দৃশ্য আর নতুন কি! কোচকে এমন সংবর্ধনা তো দেওয়াই হয়। পার্থক্য হলো, এখানে আর্জেন্টিনার কোচ বারবার শূন্যে ভাসছিলেন না, ভাসছিলেন লিওনেল মেসি।

আকাশে উড়ছেন উদযাপনের মধ্যমণি

মাঠের অন্য প্রান্তে নেইমার তখন কাঁদছেন। ফাইনালটাতে লাতিন ধ্রুপদী ফুটবলের যে প্রত্যাশা ছিল, তার ছিটেফোঁটাও পূরণ হয়নি। যে দুজনকে ঘিরে ছিল সব আলো, সেই মেসি-নেইমারও যেন নিজেদের ছায়া। পারফরম্যান্সে মিল থাকলেও শেষটায় কী পার্থক্য! একজনের মুখে হাসি, আরেকজনের চোখে জল।

এই ফাইনাল বারবার ফিরিয়ে যাচ্ছিল ২০১৪ বিশ্বকাপে। নেইমারের কান্নাও এলো ফিরে যাওয়ার আরেকটি উপলক্ষ হয়ে। সেই বিশ্বকাপের শুরু থেকেই ব্রাজিল দাপিয়ে বেড়ানো আর্জেন্টিনিয়ান সমর্থকেরা নতুন দলীয় সঙ্গীত বানিয়ে নিয়েছিল সদ্য বাঁধা একটা গানকে। স্টেডিয়ামে-মেট্রোতে-রাস্তায় যে গান শুনতে শুনতে আমারও যা প্রায় মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। অদ্ভুত একটা অভিজ্ঞতাও হয়েছিল একবার। সাও পাওলো থেকে বিমানে রিওতে আসছি। পাশেই সিট পড়েছে দুই আর্জেন্টিনিয়ানের। একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, আরেকজন আর্কিটেক্ট। গানটার প্রসঙ্গ তুলতেই উড়ন্ত বিমানে সৌম্যদর্শন ষাটোর্ধ্ব ওই দুজন গলা ছেড়ে তা গাইতে শুরু করে দিলেন। তাঁদের দেখাদেখি বিমানের পেছন দিকে থাকা বাকি সব আর্জেন্টিনিয়ানরাও। সে কী আবেগ! 

নিজেদের মাঠে, ব্রাজিলের ফুটবল-তীর্থে কোপা জিততে না পারার দুঃখে নেইমারের অমন অঝোর কান্না আক্ষরিক অর্থেই সত্যি বানিয়ে দিল আর্জেন্টিনিয়ানদের সেই গানটিকে---

ব্রাজিল আমাকে বলো, নিজের ঘরে
এমন নতজানু হয়ে থাকতে কেমন লাগছে
অনেক বছর চলে যাওয়ার পরও শপথ করে বলতে পারি
ম্যারাডোনা তোমাদের কেমন বোকা বানিয়েছিল
ক্যানি (ক্যানিজিয়া) কেমন চমকে দিয়েছিল
এখনো আমরা তা ভুলিনি
সেই ইতালি (বিশ্বকাপ ১৯৯০) থেকে শুরু করে
এখনো তোমরা কেঁদেই যাচ্ছ
এবার তোমরা দেখবে মেসিকে
বিশ্বকাপ হবে আমাদের
পেলের চেয়ে ম্যারাডোনা বড়।

ফাইনালে মারাকানার গ্যালারিতে হাজার কয়েক দর্শকের মধ্যে আর্জেন্টিনিয়ানদের বেশ বড়সড় একটা দলও ছিল। টিভিতে যতটুকু দেখলাম, তাতে সেই উপস্থিতি ছিল যথেষ্টই সরব। ‘বিশ্বকাপ’-এর জায়গায় ‘কোপা’ বসিয়ে এই গানটাও তাঁরা গাইছিলেন কি না, তা অবশ্য ঠিক বুঝতে পারলাম না। এই ফাইনালের আগে আর্জেন্টিনা সর্বশেষ কোনো শিরোপা জেতার পর ব্রাজিল দুটি বিশ্বকাপ জিতেছে, কোপা জিতেছে ৫টি। এই দুই দেশের সমর্থকদের মধ্যে রেষারেষির যে নমুনা নিজেই দেখেছি, তাতে এটা অনুমান করার প্রয়োজন পড়ছে না যে, আর্জেন্টিনিয়ানরা ব্রাজিলের এই সাফল্য দেখে জ্বলেপুড়ে মরেছে। মারাকানায় সেই ব্রাজিলকে হারিয়ে ২৮ বছর পর শিরোপা জয়ের আনন্দে ব্রাজিলিয়ানদের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দেওয়ার এই সুযোগ তাদের ছাড়ার কথা নয়।

মেসির মুখে যখন স্বপ্নপূরণের হাসি, নেইমারের চোখে স্বপ্নভঙ্গের অশ্রু

ধ্রুপদী ফুটবল দেখতে না পাওয়ার হতাশার কথা বলছিলাম। ধ্রুপদীর বদলে যা হলো, তা মারদাঙ্গা ফুটবলও বলতে পারেন। যাতে আর্জেন্টিনার দায়ই বেশি। প্রেজেন্টেশন সেরিমনিতে সেই আর্জেন্টিনা দলকেই যখন ব্রাজিলিয়ান খেলোয়াড়দের গার্ড অব অনার দিতে দেখলাম, মনটা সত্যি ভরে গেল।

জয়ের আনন্দ কখনো দুকূলপ্লাবী হয়ে মাত্রাজ্ঞানকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতেই পারে, পরাজয়ের বেদনা নীল থেকে গাঢ় নীল হয়ে কখনো কাঁদাতে পারে দিনের পর দিন...কিন্তু শেষ পর্যন্ত খেলা তো খেলাই। শুধুই একটা খেলা!

চুপিচুপি একটু সাবধান করে দিই, ব্রাজিলিয়ানদের এখন এটা বলতে যাবেন না যেন!

আরও পড়ুন:

মেসির স্বপ্নপূরণ ডি মারিয়ার গোলে

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×