বয়স ৩৪, দল ক্ষয়িষ্ণু বার্সা...তবুও মেসিই সেরা!

মাইকেল কক্স

৩ আগস্ট ২০২১

বয়স ৩৪, দল ক্ষয়িষ্ণু বার্সা...তবুও মেসিই সেরা!

আরও একবার বার্সাকে টানতে হবে একা একাই। ছবি: কোয়ালিটি স্পোর্টস

মেসি এখন পুরোপুরি মুক্ত, দলবদলের ভাষায় যাকে বলে `ফ্রি এজেন্ট`। চাইলেই মেসি চুক্তি করতে পারেন নেইমারের পিএসজি বা গার্দিওলার সিটির সঙ্গে। তবে মেসি সম্ভবত এই ক্ষয়ে যাওয়া বার্সাতেই থাকবেন। যা প্রমাণ করতে তাঁর বার্সা ছাড়া দরকার বলে মনে করেন অনেকে, সেটি তো বার্সাতে থেকেও প্রমাণ করা সম্ভব।

সাবেক আর্জেন্টাইন ফরোয়ার্ড, রিয়াল মাদ্রিদের সাবেক কোচ এবং ফুটবল দার্শনিক হোর্হে ভালদানো গত বছরের এরকম সময়েই মেসিকে নিয়ে মন্তব্যটা করেছিলেন, 'বার্সার জন্য মেসি এখন দুধারী তলোয়ার। বার্সা ওকে ছেড়ে দিতেও পারছে না, আবার ধরে রাখতেও অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে।'

গত মৌসুমের এই সময়ে বার্সার দিকে একবার ঘুরে তাকানো যাক। অখ্যাত কিকে সেতিয়েনের অধীনে ট্রফিহীন একটা মৌসুম শেষ করেছে তারা, যার মধ্যে আছে বায়ার্নের বিরুদ্ধে সেই লজ্জাজনক ৮-২ ব্যবধানে পরাজয়, কিকেকে বরখাস্ত করে কোম্যানকে নিয়োগ করা নিয়েও বিস্তর জল ঘোলা, লুইস সুয়ারেজকে তাঁর ইচ্ছের বিরুদ্ধে ক্লাব ছাড়তে বাধ্য করা...সব মিলে ত্যক্ত-বিরক্ত লিওনেল মেসি জানিয়ে দিলেন, তিনিও আর থাকতে চান না এই ক্লাবে।

শেষ পর্যন্ত ক্লাবের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে দলের সাথে যোগ দিলেও মাঠের মেসি যেন ছিলেন ছায়া হয়ে। মৌসুমের প্রথম ৮ ম্যাচে মাত্র ৩ গোল তাঁর, যার ২টা স্পট-কিক থেকে। মনে হচ্ছিল, যেন শরীরটা পড়ে থাকলেও মেসির মনটা আর ন্যু ক্যাম্পে নেই।

কোথায় হারাল বার্সার সেসব দিন! ছবি: এফসি বার্সেলোনা

মেসিকে নিয়ে এই দুঃসময়ের কথাটাই কি ভালদানো আন্দাজ করতে পেরেছিলেন? আংশিক হলেও পুরোটা অবশ্যই নয়। এই যে দেখুন না, বার্সার সাথে চুক্তিবদ্ধ থাকার পরেও (ক্লাবের দাবি অনুযায়ী) গত বছর এই সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই মেসির গায়ে চাপিয়ে দিচ্ছিলেন ম্যানচেস্টার সিটি বা পিএসজি’র জার্সি; অথচ এ বছর এখনো আনুষ্ঠানিক চুক্তি না থাকার পরেও মেসি ঠিক ঠিক ব্লগরানাদেরই। মেসির ক্লাব ছাড়া নিয়ে সামান্যতম গুঞ্জনও নেই।

মেসির হাতে এখন দুটি বিকল্প। প্রথমটা বেশ রোমান্টিক, কিছু দিন আগে রোনালদিনহো যেমন বলেছেন; বার্সার হয়ে সহস্রাধিক ম্যাচ খেলার গৌরব নিয়ে ক্যারিয়ারের শেষটা মেসি এখানেই করলেন, বার্সাও এরপর মেসির সম্মানে ১০ নম্বর জার্সিটি চিরতরে তুলে রাখল। আর অন্য বিকল্পটা হতে পারে, ক্লাব ছেড়ে মেসি স্পেনের বাইরের কোনো ক্লাবে খেলে নিজেকে আবারও প্রমাণ করলেন, সেই সাথে তাঁকে নিয়ে ওঠা নানান সমালোচনা চিরতরে বন্ধ করে দিলেন।

তবে দ্বিতীয় বিকল্পটা শুনতে যত সহজ মনে হচ্ছে, বাস্তবে আসলে তত সোজাসাপটা নয়। প্রথম প্রশ্নটাই ধরুন, বার্সা ছাড়তে চাইলে মেসির সম্ভাব্য গন্তব্য কী হতে পারে? হয় গুরু পেপ গার্দিওলার ম্যানচেস্টার সিটি, নয় তো প্রিয় বন্ধু নেইমারের পিএসজি। তারকায় ঠাসা এবং নিয়মিত ঘরোয়া শিরোপার স্বাদ নেয়া এই দুই দলে মানিয়ে নিতে মেসির কি খুব একটা সমস্যা হবে? এখানে মেসির চ্যালেঞ্জই বা কতটুকু থাকবে? হ্যাঁ, এই দুই দলই মহাদেশের সর্বোচ্চ সম্মান উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতার জন্য মরিয়া। কিন্তু বাস্তবতা হলো, কাঙ্ক্ষিত শিরোপার স্বাদ না পেলেও এই  দুটি দল এখনই চ্যাম্পিয়নস জেতার মতো ভালো ও যোগ্য। গত মৌসুমের ফাইনালের আগে সিটিই ছিল পরিষ্কার ফেবারিট। তার আগের মৌসুমের ফাইনালে বায়ার্নের বিপক্ষে পিএসজি লড়ড়েছিল সেয়ানে-সেয়ানে।

জাভি-ইনিয়েস্তাহীন মেসিও মেসিই আছেন। ছবি: গেটি ইমেজেস

মেসির জাদুতে হয়তো সিটি বা পিএসজি সেই শেষ চৌকাঠটা উতরে যাবে। কিন্তু মেসির জন্য কি সত্যিই সেটি বাড়তি কোনো যোগ্যতা প্রমাণের উপলক্ষ হবে? বার্সার হয়ে ইতোমধ্যেই তো অন্তত ১০টি বৈশ্বিক ও মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা তিনি জিতিয়ে দেখিয়েছেন। একবার জিতেছেন মৌসুমের ৬টি শিরোপার সবকটিই। সিটি বা পিএসজি যে উচ্চতায় উঠতে চায়, মেসি তো ক্যারিয়ারের সিংহভাগ সময় সেই উচ্চতাতেই পায়চারি করেছেন।   

আবার এর উল্টো চিত্রটাও দেখুন। বাজিকরদের হিসাবে, ২০২১-২২ মৌসুমের চ্যাম্পিয়নস লিগের ফেবারিটের তালিকায় প্রথম স্থানে ম্যান সিটি, তৃতীয় স্থানে পিএসজি। বার্সেলোনা আছে সপ্তম স্থানে। মেসি ক্যাম্প ন্যুতে থাকছেন ধরে নিয়েই বাজিকরদের চোখে বার্সা সপ্তম ফেবারিট। কিন্তু মেসি বার্সা ছেড়ে দিলে বাজিকরদের হিসেবে বার্সেলোনা নেমে যাবে দশম স্থানে। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে, ২০১৪-১৫ মৌসুমের চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ী সেই বার্সার ধারে-কাছেও নেই বর্তমান বার্সেলোনা দলটি। পারফরম্যান্সের বিচারে এই বার্সেলোনা ইউরোপের শীর্ষ চার-পাঁচটি ক্লাবের মধ্যেও থাকে না।মেসির চতুর্থ চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের পর কেটে গেছে ছয় বছর

মেসির ক্লাব ছাড়া উচিত কি না, সেই প্রশ্নের উত্তরও কিন্তু এখানে লুকিয়ে আছে। ফুটবল রোমান্টিকরা যেমন ভাবতেই পারেন, ক্লাবকে এই দুরবস্থা থেকে উদ্ধারের জন্য মেসির চেয়ে আর কার নিবেদন বেশি থাকতে পারে? মেসির তাই শেষ একটা চেষ্টা করাই উচিত। অন্য দিকে মেসির সমালোচকরা অনেক দিন ধরেই বলে আসছেন, ‘পারলে তুলনামুলক ক্ষীণ শক্তির কোনো দলে খেলে দেখাক, কত বড় ফুটবলার সে’। বলা বাহুল্য, জাভি-ইনিয়েস্তাদের সময়ের তুলনায় এই বার্সা যে সত্যিই হীনবল। বার্সার সেই সোনালি সময় অনেক আগেই অস্তাচলে। মেসি যদি অবসরের আগে আসলেই বার্সাকে পেপ গার্দিওলা বা লুইস এনরিকের আমলের দলে পরিণত করতে পারেন, তাহলে তো সমালোচনকারীদেরও জবাব দেয়া হবে যাবে।   

গত মৌসুমে কিন্তু মেসি সেটার প্রমাণ কিছুটা হলেও দিয়েছেন। ভাঙাচোরা একটা দল, যেটা লিগের ১০ম রাউন্ড শেষে ১৩তম স্থানে ছিল, সেই দলটাকে ৩৪তম রাউন্ড শেষে মেসি এমন জায়গায় নিয়ে গিয়েছিলেন, যেখান থেকে শিরোপা ভাগ্যটা বার্সার নিজের হাতেই ছিল। দল হিসেবে শিরোপাটা উদ্ধার করতে না পারলেও লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা, সর্বোচ্চ সুযোগ তৈরি করা, সর্বোচ্চ ড্রিবল করার ব্যক্তিগত অর্জনগুলো শেষ পর্যন্ত মেসির দখলেই ছিল। যে কয়টা ম্যাচে মেসি মাঠে নেমেছিলেন, তার অর্ধেকের বেশি ম্যাচে ম্যান অব দ্য ম্যাচও হয়েছেন।          

গড়পড়তা একটা দলকে মেসির সাফল্য এনে দেওয়ার আরেকটা উদাহরণ হতে পারে আর্জেন্টিনার সাম্প্রতিক কোপা আমেরিকা জয়। যদিও ফাইনালে ১-০ জয়ে তাঁর সরাসরি প্রভাব খুব একটা দেখা যায়নি, তবে পুরো টুর্নামেন্ট বিবেচনায় অধিনায়ক মেসিই ছিলেন আসরের সর্বোচ্চ গোলদাতা এবং সেরা খেলোয়াড়।

আর কি কিছু প্রমাণ করার আছে? ছবি: গেটি ইমেজেস

১৬ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে জাতীয় দলের হয়ে মেসির শিরোপা মাত্র একটিই কেন, এই প্রশ্নের উত্তর দেয়া খুব কঠিন। তবে এই কোপা আমেরিকাটা না পেলে মেসির ক্যারিয়ার অপূর্ণ থাকত, সেটাও যুক্তিতে টেকে না। সতীর্থদের চেয়ে ফুটবলীয় দক্ষতায় যোজন-যোজন এগিয়ে থাকা মেসি, জাতীয় দলে নিজের সেরাটা ঢেলে দিতে কখনোই কার্পণ্য করেননি। বিশ্বকাপ, কোপা আমেরিকা বা যুব বিশ্বকাপ—যে টুর্নামেন্টেই তিনি খেলেছেন, আসরের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হয়েছেন। 

এ কারণেই গত মৌসুমের শুরুটা এত অগোছালো কাটলেও মৌসুম শেষে মেসির ব্যক্তিগত শ্রেষ্ঠত্ব অব্যাহতই ছিল। হয়তো তাঁর মুকুটে একাদশ লা লিগা শিরোপাটি যোগ হয়নি বা পঞ্চম চ্যাম্পিয়নস লিগ ট্রফিটাও তাঁর বগলদাবা হয়নি। কিন্তু এই যে ১০টি লা লিগা আর ৪টি উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ তিনি জিতলেন, এগুলোই তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে বিতর্ককে থামিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট নয় কি? নিষ্ফলা আক্রমণ, ভঙ্গুর ডিফেন্স আর সাদামাটা মাঝমাঠের কুশলীদের নিয়ে খেলেও মেসিই কিন্তু এবারের ব্যালন ডি’অরের সবচেয়ে পরিষ্কার দাবিদার।

বার্সার সাথে মেসির চুক্তির অঙ্ক কী হতে যাচ্ছে বা ক্লাবের আর্থিক অবস্থা কী, সেসব এক পাল্লায় থাক। ব্যক্তি মেসির খেলোয়াড়ি নৈপুণ্য কিন্তু এখনো আগের মতোই দুর্দান্ত। আগের মতো গতি তাঁর খেলায় নেই, এটা সত্যি। কিন্তু লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা, সেরা ড্রিবলার আর সর্বোচ্চ সুযোগ সৃষ্টিকারী খেলোয়াড়টিকে দলে পেতে যেহেতু আপনাকে কোন 'ট্রান্সফার ফি' খরচ করতে হচ্ছে না, সেহেতু চুক্তির অঙ্কে কিছুটা ছাড় তো খেলোয়াড়টি পেতেই পারে।

বয়স ৩৪ হয়ে গেলেও মেসি এখনো পৃথিবীর সেরা ফুটবলার। বিশ্বের যেকোনো দল সামর্থ্যের সবটুকু খরচ করে হলেও তাঁকে পেতে চাইবে। আর এই বিলাসিতা করার সবচেয়ে সেরা সুযোগটা পাচ্ছে এফসি বার্সেলোনা।

'দ্য অ্যাথলেটিক' থেকে ভাষান্তর: আজহারুল ইসলাম

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×