ক্রিকেট সমর্থকদের মনস্তত্ত্ব এবং কিছু কথা 

দুলাল মাহমুদ

৮ আগস্ট ২০২১

ক্রিকেট সমর্থকদের মনস্তত্ত্ব এবং কিছু কথা 

বাংলাদেশের ক্রিকেট সমর্থকদের মনস্তত্ত্ব বোঝা বড় কঠিন। কখন যে তা কোন রূপ নেয়, তা একটা গবেষণার বিষয় হতে পারে। কিন্তু এক সময় ক্রিকেট খেলেছেন বা ক্রিকেটের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাঁরাও যখন রাতারাতি ভোল পাল্টে ফেলেন, তখন একটু বিস্মিত হতে হয় বৈকি!

আমাদের দেশের ক্রিকেট সমর্থকদের মনস্তত্ত্ব বোঝার মতো কঠিন কাজ আর কিছু হতে পারে না। তাঁরা যে আসলে কী চান, তা অনুধাবন করা ক্রিকেট-বিধাতার পক্ষেও সম্ভব নয়। এটা বোঝার জন্য যদি কোনও প্যারামিটার থাকতো, নিশ্চিত করেই বলা যায়, সেটা বিকল হয়ে যেতে খুব একটা সময় লাগত না। চিন্তা-ভাবনার এতটা উত্থান-পতন যে কোনও অস্থির শেয়ার বাজার তো বটেই, রক্তচাপের অস্বাভাবিক উঠা-নামাকেও অনায়াসে হার মানাবে। এ নিয়ে গবেষণা হলে নিঃসন্দেহে অভাবিত সব তথ্য উদঘাটিত হতে পারে। 

ক্রিকেটকে গৌরবময় অনিশ্চয়তার খেলা হিসেবে অভিহিত করা হয়। এটা তো অজানা নয়, অনিশ্চয়তা ছাড়া ক্রিকেটে আর কিছুই নিশ্চিত নয়। তবে উইলিয়াম শেক্সপিয়ারকে উদ্ধৃত করে লেখা যায়, 'টু বি অর নট টু বি'। হতেও পারে, না-ও হতে পারে। কী হতে পারে কী পারে না, সেই অনিশ্চয়তাই তো ক্রিকেটের মাধুর্য। আগেই যদি সব জানা যায়, তাহলে আর খেলার আনন্দ থাকে না। ক্রিকেট খেলার রং তো বর্ষার আকাশের মতো প্রতি মুহূর্তে বদলে যায়। দুর্দান্ত একটি বল, অসাধারণ একটি ক্যাচ, অপ্রত্যাশিতভাবে একটি রান আউট, দারুণ একটি বাউন্ডারি, একটি ভুল সিদ্ধান্ত কিংবা মুহূর্তের অন্যমনস্কতায় খেলার ধারা পাল্টে যেতে পারে। একজন ক্রিকেটারের মনের গতিপ্রকৃতির সঙ্গেও খেলার জয়-পরাজয় জড়িয়ে থাকে। বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে এক ইনিংসে পাঁচ উইকেট নিতে পারেন, আবার তাঁর এক ওভারে পাঁচটি ছক্কা হতেই পারে। এটাই তো ক্রিকেটের আকর্ষণ। 

শুধু কি তাই? প্রকৃতির মেজাজ-মর্জি তো খেলায় দারুণ প্রভাব বিস্তার করে। হঠাৎ দমকা হাওয়া, খানিকটা বৃষ্টি, রোদ ঝলমলে আকাশ কিংবা ঘন কুয়াশা বা শিশির বদলে দিতে পারে খেলার চিত্রপট। এছাড়া ক্রিকেট মাঠে কত কিছুই না ঘটে, আপাত দৃষ্টিতে তাকে তুচ্ছ মনে হলেও খেলার গতিক পরিবর্তনে তার ভূমিকাকে মোটেও অস্বীকার করা যায় না। অর্থাৎ পারিপার্শ্বিক অবস্থার সঙ্গে ক্রিকেট খেলার সাফল্য-ব্যর্থতা অনেকখানি নির্ভরশীল। সব মিলিয়ে সম্ভব আর অসম্ভবের দোলাচলে দুলতে থাকে ক্রিকেট ম্যাচের ভাগ্য। ক্রিকেটে আজকে হিরো কাল জিরো কিংবা উল্টোটাও হতে সময় লাগে না। আগের সিরিজের প্লেয়ার অব দ্য সিরিজ সৌম্য সরকার পরের সিরিজেই সুপার ফ্লপ। ক্রিকেটে হরহামেশাই এমনটা হয়। এসবই তো পুরনো কথা। 

ক্রিকেটীয় এই অনিশ্চয়তার থেকেও রহস্যময় বাংলাদেশের কথিত ক্রিকেট পণ্ডিতরা। তারা গিরগিটির মতো এত ঘন ঘন রং বদলান, একদমই তার থই পাওয়া যায় না। প্রতি মুহূর্তে খেলার দৃশ্যপট পাল্টাতে থাকলে পরিবর্তন হয়ে যায় তাঁদের পর্যবেক্ষণ। আগের মতামতের সঙ্গে পরের মতামতের কোনো সামঞ্জস্য থাকে না। ক্রিকেট যাঁরা বোঝেন না, তাঁদের কথা গুরুত্ব না দিলেও চলে। কিন্তু যাঁরা খেলাটা বোঝেন বলে অনুমিত হয়, তাঁদের অভিমত দেখে রীতিমতো থমকে যেতে হয়। 

সবচেয়ে অবাক লাগে, ক্রিকেট খেলেছেন কিংবা ক্রিকেট খেলার সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে সংশ্লিষ্ট, তাঁদের পাণ্ডিত্যের বহর দেখলে। এমনভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেন, যার সঙ্গে বাস্তবতার কোনো সামঞ্জস্য পাওয়া যায় না। তাঁদের যত সব পাণ্ডিত্য, খেলা হয়ে যাওয়ার পর। ভাবটা এমন, খেলায় কী কী ঘটবে, তিনি যেন সব আগেই জানতেন। তখন জানানোর তাগিদ অনুভব করেননি। খেলা শেষ কিংবা ক্রিকেটারের পারফরম্যান্সের পর জাদুকর সেজে রঙিন রুমালের ভিতর থেকে পায়রা উড়িয়ে মুগ্ধ করতে চান। পায়রা যে আগেই দৃশ্যমান, সেই বোধটুকু থাকে না। 

খেলার পর অবশ্যই ভুল-ত্রুটি নিয়ে নিয়ে কাটাছেঁড়া হতেই পারে। তার তো একটা যৌক্তিকতা থাকতে হবে। কোথায় গলদ ছিল, কেন ভুলটা হলো কিংবা কোন সিদ্ধান্তটা যথাযথ হয়নি, সেটা টেকনিকালি ও যুক্তি দিয়ে বোঝানো যেতে পারে। তাতে দেশের ক্রিকেট যেমন উপকৃত হতে পারে, তেমনিভাবে ক্রিকেট অনুরাগীদের জানাশোনার ভাণ্ডারও সমৃদ্ধ হওয়ার সুযোগ থাকে। কিন্তু সমালোচনার নামে ক্রিকেটার ও ক্রিকেট সংশ্লিষ্টদের অমার্জিতভাবে এক রকম গালাগালি করে অপদস্ত বা হেয় করাটা 'ইটস্ নট ক্রিকেট'। 

ক্রিকেট পণ্ডিতদের তৎপরতা অনেক বেশি চোখে পড়ে, বাংলাদেশ হেরে গেলে। অসুস্থ বা মৃত প্রাণীর মাংস খাওয়ার জন্য দূর থেকে নজর রাখা শকুন যেমন ঝাঁপিয়ে পড়ে, তেমনিভাবে বাংলাদেশের ক্রিকেট বা ক্রিকেটারদের ব্যবচ্ছেদ করার অপেক্ষায় থাকেন এই পণ্ডিতরা। তখন বোধ করি তাঁদের পাণ্ডিত্যের ধার অনেক বেড়ে যায়। ক্রিকেট সংশ্লিষ্ট সবাইকে তীব্র সমালোচনায় বিদ্ধ করতে একটা প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। অপ্রাসঙ্গিকভাবে এমন সব বিষয় যুক্ত করা হয়, তার কোনো আগামাথা পাওয়া যায় না। জয়ের জন্য যখন প্রশংসা করা হয়, হারার পর তো সেই ধারাবাহিকতা থাকার কথা। কিন্তু সমালোচনার ক্ষেত্রে প্রতিফলন ঘটে বিপরীতমুখী চিত্র। ক্রিকেট পণ্ডিতদের এত বিদ্যা-বুদ্ধি, তারপরও নিজেকে এত লঘু করে তোলেন, তার নিশ্চয়ই অদৃশ্য কোনো এজেন্ডা থাকতে পারে। না হলে এমন দ্বিমুখী অভিমতের কোনো কারণ থাকতে পারে না।

বাংলাদেশ তো ক্রিকেটের কোনো পরাশক্তি নয়। এত শক্তিশালী দল নয় যে বলে কয়ে যে কোনো দলকে হারিয়ে দেবে। হঠাৎ হঠাৎ জয়ের দেখা পাওয়া কিংবা কোনো কোনো ক্রিকেটারের ব্যক্তিগত ক্যারিশমা দেখানোটাই আশাবাদের সঞ্চয় করে। দল জিতলে কিংবা কোনও ক্রিকেটার ভালো খেললে তা নিয়ে চলে অন্তহীন মাতামাতি। কিন্তু দল হারলে কিংবা কেউ খারাপ খেললে চোখের পলকে দৃশ্যপট পাল্টে যায়। কারও কারও এমন মনোভাব, বাংলাদেশকে সব ম্যাচ জিততে হবে এবং প্রত্যেক ক্রিকেটারকে প্রতিটি ম্যাচে পারফরম্যান্স করতে হবে। বাংলাদেশ কোনো ম্যাচ হারলে কিংবা কোনো ক্রিকেটার খারাপ খেললে তাঁর চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করা হয়। সম্ভবত উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে নিজেদের জীবনের যত অপারগতা, যত ব্যর্থতা, যত রাগ-ক্ষোভ ঢেলে দেওয়া হয়। 

সফরকারী অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে বাংলাদেশ টি-টোয়েন্টি সিরিজ জয় করবে, এমনটা কজন ভাবতে পেরেছিলেন? বলতে গেলে অসম্ভবকে সম্ভব করেছে বাংলাদেশ। এটা বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অনেক বড় সাফল্য। অথচ সিরিজ জয়ের পর বাংলাদেশের পরাজয় এবং কোনো কোনো ক্রিকেটারের ব্যর্থতা নিয়ে যেভাবে টীকাটিপ্পনী ও তীব্রভাবে তিরস্কার করা হচ্ছে, তা কি স্বাভাবিক? 

বাংলাদেশ জিতলে অনেকেই খুব একটা খুশি হন বলে মনে হয় না। জয়টাকে সহজভাবে মেনে নিতে পারেন না। সেটা তাঁদের হাবভাবে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। নানান রকম খুঁত বের করে নিজের বিদ্যা জাহির করার প্রয়াস চালান। অবশ্য কারও কারও কাছে বাংলাদেশের পরাজয়টাই যেন পরম আরাধ্য। তা হলে যেন নিজের মনোবাসনা চরিতার্থ করা সম্ভব হয়। না হলে এত নেতিবাচক মনোভাব হয় কী করে? 

এ দেশের মানুষের আশা-আকাঙ্খার অন্যতম নির্ভরতা হয়ে উঠেছে ক্রিকেট। এই খেলাটি নিয়ে নানান রকম আলোচনা-সমালোচনা হবে, সেটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু ক্রিকেট খেলার সঙ্গে যাঁরা সম্পৃক্ত আছেন বা ছিলেন, কিংবা ক্রিকেট খেলাটা বোঝেন, তাঁদের কাছে তো অন্য রকম প্রত্যাশা করা যেতে পারে। তাঁরা খেলাটা বুঝতে বা বোঝাতে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে পারেন। তাঁদের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ আর গঠনমূলক আলোচনা বা সমালোচনা ক্রিকেটীয় সংস্কৃতি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ফলপ্রসূ ভূমিকা রাখতে পারে। ক্রিকেটে এগিয়ে নিতে হলে ক্রিকেট সংস্কৃতি হৃদয়ে ধারণ করাটাও অপরিহার্য। তাহলে জয়ের আনন্দের পাশাপাশি পরাজয়ের বেদনার মর্মটাও অনুধাবন করা যায়। এটার গুরুত্বকে মোটেও হালকা করে দেখার অবকাশ নেই। খেলায় শক্তিশালী দল জিতবে। দুর্বল দল হারবে। অবশ্য মাঝে মাঝে অঘটনও ঘটে। তা না হলে অস্ট্রেলিয়ার মতো দল বাংলাদেশের কাছে সিরিজ হারে কী করে? ক্রিকেটের প্রতি অনুরাগ থাকলে এই বোধটুকু অন্তত আহরণ করতে হবে।

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×