বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনের একান্ত সাক্ষাৎকার

`আমি তো আর খেলে দিতে পারব না`

বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনের একান্ত সাক্ষাৎকার

উৎপল শুভ্র

৮ এপ্রিল ২০২১

`আমি তো আর খেলে দিতে পারব না`

কাজী সালাউদ্দিন। ছবি: মোহাম্মদ মানিক

শুধু ফুটবলেরই নয়, সব খেলা মিলিয়েই বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের প্রথম সুপারস্টার তিনি। অনেকে যে সীমানাটা খেলার বাইরেও ছড়িয়ে দিতে চান। সেই কাজী মোহাম্মদ সালাহউদ্দিনই বাফুফে সভাপতি হওয়ার পর পরিণত হয়েছেন চরম সমালোচনার লক্ষ্যবস্তুতে। যে ফুটবল সালাহউদ্দিনকে সালাহউদ্দিন বানিয়েছে, সেই ফুটবল ধ্বংস করে দেওয়ার অপবাদও শুনতে হচ্ছে তাঁকে। এই সবকিছু নিয়েই কাজী সালাউদ্দিনের দীর্ঘ সাক্ষাৎকারের দ্বিতীয় পর্ব।

প্রথম পর্বের পর ...

উৎপল শুভ্র: বাফুফে সভাপতি হওয়ার আগে আপনি অনেকের কাছেই দূর আকাশের তারা হয়ে ছিলেন। সত্যিকার স্টার বলতে যা বোঝায়। এখন শুধু সমালোচনাই না, রাস্তার একটা লোকও ইচ্ছা হলো আপনাকে একটা গালি দিয়ে দিচ্ছে। আপনার কি কখনো মনে হয়নি, কী দরকার এসবের মধ্যে থাকার! সব ছেড়ে-ছুড়ে চলে যাই!

সালাহউদ্দিন: একবার মনে হয়েছিল। কখন, জানেন? দুই-তিন বছর আগে আমার বিরুদ্ধে যখন টেলিভিশনে স্ক্যান্ডাল আরম্ভ করল, আমি আমার ওয়াইফকে বললাম, 'আমি তো অত সোশ্যাল না, তুমি তো দাওয়াত-টাওয়াতে যাও, কেউ তোমাকে কিছু বলে?' ও বলে, 'না তো! কী বলবে?' এরপর আমি ছেলেমেয়েকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমরা তো ব্যবসার কাজে এখানে যাও, ওখানে যাও, তোমাদের কী অবস্থা?' ওরা বলে, 'আব্বু, যেখানেই যাই তোমার ছেলে বা তোমার মেয়ে শুনলে লোকজন আমাদের এমন খাতির করে…আমরা তো বুঝি নাই আওয়ার ফাদার ইজ সো বিগ।' 

আমি যখন এয়ারপোর্টে যাই, আমি ভিআইপি ব্যবহার করি না। তারপরও আমাকে লাইনে দাঁড়াতে হয় না। আমার সামনে যারা থাকে, তারা আমাকে টান দিয়ে সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলে, ‘আপনি যান, আমার হাতে সময় আছে।’ ইমিগ্রেশন অফিসাররা আমাকে দেখে খুশি হয়, আমার সঙ্গে অনেক কথা বলে। আমি যখন লাউঞ্জে যাই, আই অ্যাম ট্রিটেড লাইক আ কিং। আমি যেটা বলছেন, আমি এটা শুধু মিডিয়াতেই দেখি। কিন্তু গত চার-পাঁচ বছর মিডিয়াতে আমাকে নিয়ে এত কিছু করার পরেও আমি কিন্তু কোনো জায়গায় রেসপেক্ট কম পাই নাই। যেখানেই যাই, আপনাদের দোয়ায় মানুষের ভালোবাসাই পেয়েছি। একটা গ্রুপ, তারা আমাকে গালাগালি করে। পয়সা দিয়ে ফেসবুকে গালাগালি করায়। আপনারা যেমন বোঝাতে চান, আমার অবস্থা যদি এতই খারাপ হতো, তাহলে আমার দেশ ছেড়ে পালানো ছাড়া উপায় থাকত না। আমি আমার ফ্যানদের প্রতি কৃতজ্ঞ। তারা আমার সাথে বিট্রে করে নাই।

শুভ্র: তবে এটা তো সত্যি, সাধারণ মানুষের মধ্যে আপনাকে নিয়ে একটা বিভক্তি তৈরি হয়েছে। অনেকেই আপনাকে তীব্রভাবে অপছন্দ করে। ফুটবলের পতনের জন্য আপনাকেই দায়ী করে। এই যে আমি এসব প্রশ্ন করছি, ২০০৮ সালে আপনি যখন প্রথম বাফুফে সভাপতি হলেন, তখন কি ভাবতে পেরেছিলেন, ১২ বছর পর আপনাকে এই জাতীয় প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে?

সালাহউদ্দিন: না, ভাবিনি। শুরুতে সবাই আমাকে সাপোর্ট করেছে। তবে আমি বুঝি নাই, এই চেয়ারের দিকে এত লোকের এমন টার্গেট। অথচ এটা তো প্রফিটেবল জায়গা না। এই যে আপনি, আপনার মতো লোক আমাকে এতক্ষণ ধরে ইন্টারভিউ করছেন, প্রবলেম হয়ে গেছে কি, তারা মনে করছে, এই চেয়ারে বসলেই বুঝি এটা হবে। কিন্তু তারা বোঝে না, আমি কে। আমি কী করেছি। তারা মনে করে, বিএফএফের চেয়ারের জন্যই এটা হচ্ছে। চেয়ারের কথা বলায় মনে পড়ল, আমি যখন প্রেসিডেন্ট হই, বিএফএফে চেয়ার যেটা ছিল, ইয়া বড়, বিরাট বড় একটা সিংহাসন ছিল। বিএফএফের প্রেসিডেন্ট রাজার মতো, তার জন্য সিংহাসন লাগবে না! আমি এসেই সেটা সরিয়ে ফেলেছি। কারণ আমার অফিসে এসে যদি কেউ বসে, সে যেন  ইনটিমিডেটেড ফিল না করে। একটা কথা ভুলে যাবেন না, ১৬ বছর বয়সে বাড়ি-গাড়ি রেখে ধানমন্ডি থেকে আই ওয়েন্ট টু দ্য ওয়ার। আই লাভ দিস কান্ট্রি। সেই ভালোবাসাটা আমি কাউকে বলে বোঝাতে পারব না। আমার বাবাও আমাকে যুদ্ধে যাওয়া থেকে আটকানোর চেষ্টা করেননি, কারণ তিনিও স্বাধীনতা চাইতেন। আমার এথিকসের সাথে তাই আপনি অনেকেরটা মেলাতে পারবেন না। আমি গালি দিতে পারব না। কারণ আমি ওই ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসিনি।

শুভ্র: ‘ওয়ার’ বলতে তো আপনি স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল বোঝাচ্ছেন, তাই না?

সালাহউদ্দিন: হ্যাঁ।

শুভ্র: তাহলে সেখানে যেতে বাবা বাধা দেবেন কেন? আপনি তো ভারত গিয়ে ফুটবল খেলেছেন, জীবনের কোনো ঝুঁকি তো আর ছিল না!

সালাহউদ্দিন: না, না, না, কী বলেন, আমি বর্ডার ক্রস করব কীভাবে?

শুভ্র: ও হ্যাঁ, তাই তো…আপনাকে তো আগে ইন্ডিয়া যেতে হবে।

সালাহউদ্দিন: আমি তো এক মাস ক্যাম্পে পড়ে ছিলাম। বর্ডার ক্রস করে আগরতলার ক্যাম্পে। বর্ডার ক্রস করতেই তো হেঁটে আমার পাঁচ দিন লেগেছে। দিনের বেলায় লুকিয়ে থাকতাম, রাত্রিবেলা নৌকা দিয়ে পার হতাম, পাকিস্তানি আর্মি ধরলেই তো মেরে ফেলবে। বেঁচে ফিরব কি না, এটাই তো আমি জানতাম না। খেলা তো অনেক পরের কথা।

শুভ্র: বর্তমানে ফিরি। আপনি তো বাংলাদেশের ফুটবলের রমরমা সময়টার একটা বড় অংশ। রমরমা বলতে ক্লাব ফুটবল নিয়ে উন্মাদনার কথা বলছি। বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল লেভেলে তখনো বলার মতো কিছুই করেনি। আপনি খেলা ছাড়ার পরও অনেক বছর ক্লাব ফুটবল নিয়ে ওই উন্মাদনাটা ছিল, যেটিকে আমরা ফুটবলের স্বর্ণযুগ বলি। একটা সময় যে দর্শক মাঠে যাওয়া বন্ধ করে দিল, তার অনেক কারণ আছে। সেসব আপনিও জানেন বলে আর বলছি না। আমার প্রশ্ন হলো, এই বারো বছরে আপনি ফুটবলের সেই দিনগুলো ফিরিয়ে আনার জন্য কি কোনো চেষ্টা করেছেন? আপনি শুরুতে একবার এক কোটি টাকার সুপার কাপ করে আবার স্টেডিয়াম ভরিয়ে তুলেছিলেন। কিন্তু এরপর কী করেছেন?

সালাহউদ্দিন: লাস্ট ইলেকশনের আগে সর্বশেষ বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপের একটা একজাম্পল দিই। ব্রুনাই আসছে আর আর আফ্রিকা থেকে দুইটা টিম। টেলিভিশনের টক শোতে সবাই এমন বলতে আরম্ভ করল, যেন আমি রাস্তা থেকে টিম ধরে নিয়ে আসছি। টেলিভিশনে বলছে, এটা নখরাবাজি, চিটিং; রাস্তা থেকে টিম ধরে আনছে, জোর করে চ্যাম্পিয়ন হয়ে প্রাইম মিনিস্টারের কাছে যাবে। অথচ সবগুলা টিমই কিন্তু ফিফা র‍্যাঙ্কিংয়ে আমাদের ওপরে। টেলিভিশনে, পেপারে যখন এই কথাগুলো প্রচার করা হয়, তখন কোন লোকটা মাঠে আসবে খেলা দেখতে?

এবার নির্বাচনের পরে, করোনার মধ্যে নেপালকে যখন আনলাম, প্রথমে ভাবলাম টিকিট দেব পাঁচ হাজার। পরে দিলাম দশ হাজার, তারপর বিশ হাজার টিকিট দিলাম…

শুভ্র: আমি কিন্তু জাতীয় দলের খেলার কথা বলছিলাম না। ইন্টারন্যাশনাল ফুটবলে দর্শক হয়, কিন্তু ফুটবল তো মূলত ক্লাবের খেলা, ক্লাব ফুটবলে দর্শক না হলে তো…

সালাহউদ্দিন: আসছি, আমি সেই কথায় আসছি। আপনি যখন নেগেটিভ ভাবতে থাকবেন, সবই নেগেটিভ হতে থাকবে। এই যে অনেকে বলে, খেলা হয় না। টি-স্পোর্টস আসাতে সবচেয়ে লাভ হয়েছে আমার। এখন আর টক শোতে এসে লোকে বলে না, খেলা হয় না। আপনি বলছেন, দেশের ফুটবল মরে গেছে। আবার আপনারাই বলছেন, বারো বছর লিগ হয়েছে, বারো বছর ফেডারেশন কাপ হয়েছে। তখন বলত, খেলা হয় না, দেশে খেলা নাই। টি স্পোর্টস আসাতে ওই টক শোগুলো কিন্তু বন্ধ হয়ে গেছে। কারণ মানুষ তো দেখছে যে, খেলা হচ্ছে। আমি শুধু বলব, দুইটা বছর শুধু পজিটিভ থাকুক মিডিয়া, মাঠ আবার দর্শকে ভরে যাবে। আবাহনী-মোহামেডান নিয়েই তো আমাদের ফুটবলে মাতামাতিটা ছিল। মোহামেডান অনেক দিন ধরে ডাউন। এ কারণে আবাহনী ওয়াজ ভেরি ক্যাজুয়াল, কারণ এমনিতেই তো চ্যাম্পিয়ন হচ্ছিল। এখন কিন্তু আবাহনীকে গা ঝাড়া দিয়ে উঠতে হবে। কারণ এখন বসুন্ধরা আসছে, সাইফ আসছে। এই দলগুলাকে আমিই ঢুকিয়েছি। আরও অনেক কিছু করার আছে। ফুটবল হতে হলে আমার মিডিয়া লাগবে, পাবলিক লাগবে, গভর্নমেন্টকে লাগবে, প্লেয়ারদের লাগবে। যতক্ষণ পর্যন্ত এই চারটা এক না হবে, কিছুই হবে না। আপনারা আসেন আমার সাথে, তিন থেকে চার বছরের মধ্যে অন্য কোনো খেলার নামই থাকবে না এ দেশে। আপনি আমার ভুলগুলা ধরে দেন, আমার ভুল হলে আমাকে পানিশমেন্ট দেন। অথবা আমাকে শিক্ষা দেন। আমি তো সবজান্তা না। আপনার কিছু মনে হলে আমাকে বলেন, সালাউদ্দিন ভাই, এটা কারেকশন করেন, এটা নিয়ে বসেন… 

শুভ্র: ফেডারেশনে কী সেই পরিবেশটা আছে? আপনি কি অন্যদের কথা শোনেন, নাকি একনায়কের মতো ফেডারেশন চালান?

সালাহউদ্দিন: আমার তো মনে হয়, আমি পৃথিবীর একমাত্র প্রেসিডেন্ট, যার দরজা সবসময় খোলা। কোনো অ্যাপয়েন্টমেন্ট লাগে না। আমার যখন কারও সাথে কথা বলতে হয়, আমার রুম লোকে ভরা থাকে, আমি পাশের ঘরে গিয়ে কথা বলি। তারা পাশের ঘরে যায় না। এটা আমার পারসোনালিটির সাথে যায় না। কিন্তু আমি ফুটবলের জন্য এটা করি।

আপনি পান্থপথে আমার অফিসে আসেন। গোটা বিল্ডিংয়ের মধ্যে নাইনথ ফ্লোরে শুধু আমি একা বসি। নাইনথ ফ্লোরে শুধু একজন পিয়ন আছে। আর কেউ ঢুকতে পারে না। এমন না যে, আপনি ঢুকতে পারবেন না, তবে সেজন্য আলাদা একটা চাবি লাগবে। কিন্তু আমি যখন বিএফএফে আসি, আমার কাছে টম-ডিক-হ্যারি যে কেউ যখন ইচ্ছা আসতে পারে।

শুভ্র: আচ্ছা, আমি যদি আপনাকে নাম ধরে একটা প্রশ্ন করি… একটু আগে আপনি যে আপনার চেয়ারটার প্রতি লোভের কথা বললেন, টিপু ভাই মানে গোলাম সারোয়ার টিপু তো এর মধ্যে পড়েন না। উনি আমার খুব পছন্দের একজন মানুষ। তাঁর বিএফএফ প্রেসিডেন্ট হওয়ার কোনো শখ আছে বলে আমার মনে হয় না। তারপরও টিপু ভাইয়ের মতো মানুষ কেন আপনার প্রতিপক্ষ ফুটবলারদের যে একটা দল আছে, সেটিতে চলে গেলেন?

সালাহউদ্দিন: খুব কঠিন একটা প্রশ্ন করেছেন আপনি। উত্তর দিতে গিয়ে আমার বুক ফেটে যাবে, তা-ও উত্তরটা দেব। টিপু ভাই আমার খুব পছন্দের একজন মানুষ ছিলেন। আমি তাঁকে খুব শ্রদ্ধা করতাম। আমি যখন (ন্যাশনাল টিম ম্যানেজমেন্ট কমিটির প্রধান হিসাবে) প্রথম ফেডারেশনে আসি, আমি ওনাকে একটা বেতন দিয়ে হেড কোচ বানিয়েছিলাম। উনি একদিন ফ্যাক্টরিতে এসে আমাকে বললেন, আমার সাথে তো সম্পর্ক খুব ভালো, অনেক বছরের সম্পর্ক, সেই সুরেই বললেন, 'সালাহউদ্দিন, আমার এই বেতনে হয় না, আমার বেতন বাড়াও।' আমি বললাম, 'বাড়াতে পারব না।' বলার পরও আমি তাঁকে আমি পারসোনালি টাকা দিতাম। অফিস থেকে টাকাটা দিয়ে বাড়তি টাকাটা হাতে দিতাম। পরে তাঁকে আমার বরখাস্ত করতে হলো, কারণ হি ওয়াজ অ্যা ফেইলিওর। তারপর থেকেই দেখি, টিপু ভাই আমার বিরুদ্ধে জঘন্য কথাবার্তা বলতে আরম্ভ করলেন। সেটাও এমন সব লোকদের সাথে মিলে যারা নো বডি নাও। পনের-বিশ বছর আগে ফুটবল খেলেছে, কোনো সোশ্যাল স্ট্যান্ডিং নাই, ফাইনান্সিয়াল স্ট্যান্ডিং নাই। তাদের সঙ্গে মিলে টিপু ভাই টেলিভিশনে আমার সম্পর্কে যা-তা বলতে শুরু করলেন। আই ফেল্ট সো স্যাড। তিনি তো জানেন যে, তিনি মিথ্যা কথা বলছেন। তারপরও আমি কিন্তু টিপু ভাইয়ের বিরুদ্ধে একটা কথা বলি নাই। আজ আপনি জিজ্ঞেস করলেন বলে বললাম। আমি ওনাকে খুব শ্রদ্ধা করতাম, বড় ভাইয়ের মতো দেখতাম। ওনার সোনালী ব্যাংকের চাকরিটা শেখ কামালকে বলে আমি দিয়েছি। ওনাকে আমি মোটর সাইকেল কিনে দিয়েছি। এখন আমি ওনার ইন্টারভিউ দেখি আর আমার চোখ দিয়ে পানি পড়ে। মনে হয়, আমি তাহলে মানুষই চিনতে পারি নাই কোনোদিন।

শুভ্র: সেই কবে উনি কোচের চাকরি হারিয়েছেন বলে টিপু ভাইয়ের মতো লোক আপনার বিরুদ্ধে বানিয়ে বানিয়ে কথা বলবেন?

সালাহউদ্দিন: এটা তো আমারও প্রশ্ন। টিপু ভাই তো খুব ভালো কথা বলতে পারেন। হতে পারে, উনি দেখলেন, আমার বিরুদ্ধে বললে উনি টেলিভিশনে আসতে পারেন। আমার দোষগুলো বলেন সবসময়, কিন্ত কখনো এসে বলেন নাই, আমার এটা করা উচিত, ‘ওটা করো', কখনোই না। এটা আমার জীবনের অত্যন্ত দুঃখজনক একটা অধ্যায়। আমার কষ্টটা বেশি, কারণ টিপু ভাইকে আমি বড় ভাইয়ের মতো দেখতাম, এখনো দেখি।

জাকারিয়া পিন্টু আমার সম্পর্কে কী বলল, তাতে আমার কিচ্ছু যায়-আসে না। কারণ আমি জানি, জাকারিয়া পিন্টু রাস্তার লোক। কিন্তু টিপু ভাই, এই ব্যবসাটা করা তাঁর উচিত হয় নাই। আমার সম্পর্কে বলে উনি লাইমলাইটে আসতে চেয়েছেন। দিস ইজ অ্যা ভেরি স্যাড স্টোরি।

শুভ্র: আপনার কি কখনো মনে হয়েছে, টিপু ভাইকে একটা ফোন করি, করে জিজ্ঞেস করি, আপনি এসব কেন বলছেন?

সালাহউদ্দিন: আমি করতাম। কিন্তু কেন করি না, জানেন? তিনি যা করছেন, জেনে করছেন। টিপু ভাই না জেনে কোনো কিছু করার লোক না। তিনি একটা স্ট্র‍্যাটেজি নিয়েছেন, 'আমি এটা করব'।

"জীবনের সব ক্ষেত্রেই একটা লক্ষ্য থাকতে হয়। একটা স্বপ্ন থাকতে হয়। আমি বাস্তবতা থেকে বেরিয়ে চেষ্টা করতে চেয়েছিলাম। আমি পুরো জাতিকে একটা স্বপ্নে এক করতে চেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, চেষ্টা করলে হয়তো কাছাকাছি যেতে পারব। পারি নাই।"

শুভ্র: অন্য প্রসঙ্গে আসি। আপনি যখন বাংলাদেশকে ২০২২ কাতার বিশ্বকাপে নিয়ে যাবেন বলে ‘ভিশন ২০২২’ ঘোষণা করেছিলেন, ব্যক্তিগতভাবে আমি তা পছন্দ করেছিলাম। কারণ ক্রিকেটের ভরা বাজারে ফুটবলকে আলোচনায় রাখতে ওটাকে একটা মাস্টারস্ট্রোক বলে মনে হয়েছিল। আমার মতো অনেকেরই মনে হয়েছিল, সামনে একটা লক্ষ্য, একটা স্বপ্ন তো থাকাই উচিত। কিন্তু যেহেতু আমরা এর কাছাকাছিও যেতে পারিনি, এটা একটা রসিকতায় পরিণত হলো। এখনো এটা নিয়ে ট্রল হয়। তো আপনি এটা কী ভেবে বলেছিলেন? এর পেছনে চিন্তাটা কী ছিল? এটা বলেছিলেন বলে এখন কি বিব্রত বোধ করেন?

সালাহউদ্দিন: হ্যাঁ, আমি বলেছিলাম। আপনিই কিন্তু আপনার প্রশ্নের মাঝে আমার উত্তরটা দিয়ে দিয়েছেন। জীবনের সব ক্ষেত্রেই একটা লক্ষ্য থাকতে হয়। একটা স্বপ্ন থাকতে হয়। আমি বাস্তবতা থেকে বেরিয়ে চেষ্টা করতে চেয়েছিলাম। আমি পুরো জাতিকে একটা স্বপ্নে এক করতে চেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, চেষ্টা করলে হয়তো কাছাকাছি যেতে পারব। পারি নাই। পারব কীভাবে? আমি এসে দেখেছি, অ্যাকাউন্টে ১০ টাকা নাই, এই নাই, ওই নাই। এর মধ্যেও আমি চেষ্টা করেছি আর আপনারা মিডিয়া আমাকে গালি দিয়ে গেছেন। আর স্পনসররা সব চলে গেছে। 

আমার মেয়ে জার্মানি থাকে, প্রতি দুই সপ্তাহে একবার আসে। ব্যবসাগুলোর জন্য আমাকে দিয়ে কাজ করাতে আসে। সাত দিন থেকে চলে যায়, আবার আসে। আমি তো সারাদিন ফেডারেশন নিয়েই পড়ে থাকি। আমি ভাগ্যবান, আমার ছেলে-মেয়ে বড় হয়ে গেছে, আমার ব্যবসার সেভেনটি পার্সেন্ট ওরা হ্যান্ডল করতে পারে। আমি সব ছেড়ে শুধু ফুটবল নিয়ে আছি। আমাকে চার-পাঁচটা বছর শুধু সাপোর্ট দেন। ইউ উইল হ্যাভ অ্যা ফুটবল টিম।

শুভ্র: কিন্তু এই প্রশ্নটা তো লোকে করবেই, বারো বছরেই আপনি কিছু করতে পারেন নাই, চার-পাঁচ বছরে আর কী করতে পারবেন?

সালাহউদ্দিন: বারো বছরের কথা বলছেন, আপনি যখন বারো তলা একটা বিল্ডিং বানান,  প্রথম দুই বছর তো চলে যায় নিচে ঢালাই করতেই। বারো বছরে আমাকে আবার দিয়েছেন দশ কোটি টাকা, বিশ কোটি টাকা, দিয়ে আবার বলেও দিয়েছেন, এই টাকাটা কোথায় খরচ করতে হবে। আমার কথা বিশ্বাস না করলে আপনি আসেন, আমার বারো বছরের অডিট রিপোর্ট দেখেন। অনেক অফিসে তো অডিটই হয় না। আপনি আমার বারো বছরের অডিট কালকে চান, কালই আপনাকে দিয়ে দেবে। আমি আপনাকে ২০ টাকার পর্যন্ত হিসাব দিতে পারব। আরেকটা কথা বলি, আমি যে এত দেশের বাইরে যাই, বিএফএফ থেকে একটা পয়সাও আমি কখনো নিই নাই। ফিফা-এএফসি কখনো টিকিট পাঠায়, না পাঠালে নিজের টাকায় টিকিট কাটি। নিজের টাকায় হোটেলে থাকি। এই যে কদিন আগে বাংলাদেশ দল নেপালে খেলে এলো, আমরা আট-দশজন গিয়েছিলাম। সবার খরচ আমি দিয়েছি। বিএফএফ থেকে এক টাকাও নিইনি। আল্লাহ দিলে আমার অনেক আছে, টাকাপয়সার জন্য আমি বিএফএফে আসি নাই।

শুভ্র: আমার প্রশ্নটা তো আর্থিক কোনো ব্যাপার নিয়ে ছিল না। আমি বলছি, বারো বছর তো কম সময় না। আপনি বারো বছরের প্রথম টার্মে বেশ কিছু ভালো কাজ করেছেন। প্রথম চাওয়াটা তো ছিল নিয়মিত খেলা, সেটা হয়েছে। জাতীয় দলের জন্য সুযোগ-সুবিধা অনেক বেড়েছে। কিন্তু পরের আট বছর নিয়ে প্রশ্ন আছে। আপনি ব্যর্থ, নাকি আপনার কাছে সবার প্রত্যাশাটাই বেশি ছিল? 

সালাহউদ্দিন: আমার হাতে তখন ম্যাটেরিয়াল ছিল না। আস্তে আস্তে তো আমি সব করার চেষ্টা করেছি। জাতীয় দল এখন কোথাও যাওয়ার আগে ট্রেনিং করে। নিয়মিত ম্যাচ খেলে। সাত দিন আগে, চৌদ্দ দিন আগে কাতারে যায়। কোচিং স্টাফের পেছনে মাসে ৩৫-৩৬ হাজার ডলার খরচ করি। কিন্তু আমি তো আর খেলে দিতে পারব না। 

শুভ্র: আপনার বিরুদ্ধে আরেকটা বড় একটা অভিযোগ, নেপাল-ভুটানেরও যেখানে একাডেমি আছে, বাফুফে কেন এত দিনেও একটা একাডেমি করতে পারল না? দুবার শুরু করার পরও কেন তা বন্ধ হয় গেল?

সালাহউদ্দিন: আমাকে আজকে ফান্ড দেন। কালকে একাডেমি করে দেব।

শুভ্র: ফান্ড জোগাড় করার দায়িত্ব তো আপনার।

সালাহউদ্দিন: সবই আমার দায়িত্ব, আপনারা কী করবেন?

শুভ্র: এই যে আপনি যদি ভালো করেন, তখন বলব, খুব ভালো। খারাপ করলে বলব, করেন নাই কেন?

সালাহউদ্দিন: একাডেমি আছে। পাবলিসিটি নাই, কিন্তু একাডেমি আছে। এখন যত বাচ্চা-টাচ্চারা খেলছে, সব আমার একাডেমির প্লেয়ার।

শুভ্র: কোথায় সেই একাডেমি, কীভাবে চলে, কত বছরের ছেলেরা তাতে আছে, একটু বিস্তারিত বলবেন?

সালাহউদ্দিন: এখানে আছে ১৪ থেকে ১৮ বছরের ছেলেরা। এটা ফর্টিসে চলত। ওটাকে শিফট করে নিয়ে আসা হচ্ছে কমলাপুরে। আমি মন্ত্রীর সঙ্গে বসে চার মাস ধরে কাজ করে কমলাপুরে একাডেমির জন্য জায়গা করে দিয়েছি।

শুভ্র: এটা কি বাফুফের একাডেমি, নাকি ফর্টিসের, নাকি ফর্টিসের সঙ্গে বাফুফের পার্টনারশিপ?

সালাহউদ্দিন: বাফুফের, বাফুফের। আগে ছিল ফর্টিসের সঙ্গে পার্টনারশিপ। ওই একাডেমিতে আমি খরচা করেছি পাঁচ কোটি টাকা। আপনি আসেন, হিসাব দিয়ে দেব।

শুভ্র: একাডেমির কথা যখন উঠলই, সিলেটের একাডেমি নিয়েও তো অনেক কথা হয়েছে। সে সময়ের ফিফা প্রেসিডেন্ট সেপ ব্ল্যাটার একাডেমির জন্য যে টাকাটা দিয়েছিলেন, তা নাকি একাডেমির পেছনে খরচ করা হয়নি, অথচ দেখানো হয়েছে একাডেমির খরচ হিসাবে... 

সালাহউদ্দিন: হুঁ, এটা তো আমার বাবার জমিদারি! একাডেমির টাকা অফ কোর্স একাডেমিতেই খরচ করা হয়েছে। টাকাটা এসেছিল বাংলাদেশ ব্যাংকে, বাংলাদেশ ব্যাংক টাকাটা বিএফএফে দিয়েছে। বিএফএফ ওই টাকা দিয়ে দেড় বছর একাডেমি চালিয়েছে। তারপর টাকা শেষ, একাডেমি শেষ। ৬০ লক্ষ ডলার আপনি আমার কাছে চান না, আমি আপনাকে দিয়ে দেব। এটা কোনো টাকা? আপনারা তো স্টোরির জন্য স্টোরি করেছেন। কাম টু দ্য রিয়েল ওয়ার্ল্ড। হাজার হাজার কোটি টাকা আজ ক্রিকেট বোর্ডের কাছে। অথচ ক্রিকেট তো জিতেই না এখন।

শুভ্র: বারবার যে টাকার সমস্যার কথা বলছেন, আপনার কি কখনো মনে হয়, আপনি ক্রিকেট বোর্ডের প্রেসিডেন্ট হলে অনেক ভালো হতো?

সালাহউদ্দিন: আমি যদি ক্রিকেট বোর্ডের প্রেসিডেন্ট হতাম, তাহলে দেয়ার ইজ সেভেনটি পার্সেন্ট চান্স, আমরা বিশ্বের টপ দুইটা টিমের একটা হতাম। কারণ কমপিটিশন নেই, আর টাকারও অভাব নাই।

শুভ্র: তাহলে ভবিষ্যতে কি বিসিবি প্রেসিডেন্ট হওয়ার ইচ্ছা আছে আপনার?

সালাহউদ্দিন: নো, নো, আই অ্যাম অ্যা ফুটবলার। ফুটবলই আমার জীবন। আপনারা আমাকে ভালো-খারাপ যা-ই বলেন, আমি জানি, আমাকে সবচেয়ে আদর করে কারেন্ট ফুটবলাররা। কারণ আমি ওদের কর্মসূচি রেডি রেখেছি, ওদের টাকা দিচ্ছি, খেলার সুযোগ দিচ্ছি, সব দিচ্ছি। ওরা জানে, আমি না থাকলে ওদের পচা হোটেলে থাকতে হবে।। এখন ওরা ফাইভ-স্টার হোটেল ছাড়া থাকে না। আমি এক জার্সি পরে ম্যাচ খেলে রাতের বেলা ধুয়ে আবার পরের দিন খেলতাম। আর এখন ওরা ম্যাচ খেলে এসে জার্সি কোথায় ফেলে দেয় জানে না, আরেকটা ফ্রেশ জার্সি পরে। আমার জীবনে যা যা পাই নাই, যা যা পাওয়ার স্বপ্ন ছিল, সব আমি ওদের দিয়েছি।

শুভ্র: অপ্রিয় বিষয় নিয়েই তো সব কথা হলো। এবার একেবারেই অন্যরকম একটা প্রশ্ন। আপনার সময়ে আপনি ছিলেন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় তারকা, এখন সেটা সাকিব আল হাসান। সাকিবকে আপনি খেলোয়াড় হিসেবে, তারকা হিসেবে কীভাবে রেট করেন?

সালাহউদ্দিন: হি ইজ আ গুড প্লেয়ার, অ্যা স্টার। নো কোশ্চেন অ্যাবাউট ইট।

শুভ্র: আপনাদের কখনো দেখা হয়েছে? 

সালাহউদ্দিন: হ্যাঁ।

শুভ্র: কী কথা হয়েছে আপনাদের মধ্যে?

সালাহউদ্দিন: এই তো জিজ্ঞাসা করেছে, 'কেমন আছেন সালাউদ্দিন ভাই?' আমিও বলেছি, 'তুমি কেমন আছো?' আর কী কথা হবে, আমার অনেক ছোট তো।

শুভ্র: আপনি কি ক্রিকেট খেলা দেখেন? আপনি তো ভালো ক্রিকেটারও ছিলেন, অনেক মানুষ যা জানেই না।

সালাহউদ্দিন: না, এখন আর আমি ক্রিকেট দেখি না।

শুভ্র: কেন? এটা কি ক্রিকেটের ওপর রাগ?

সালাহউদ্দিন: আরে না, না। যেদিন থেকে ওই যে টোয়েন্টি ওভার, টি-২০ কী কী এলো, খেলাটা অনেক বেশি কমার্শিয়াল হয়ে গেল। তারপর থেকে ক্রিকেট দেখা বাদ দিয়েছি। শোনেন, ক্রিকেটটা কীভাবে সারভাইভ করে গেল, জানেন? শুধুমাত্র ভারতের কর্পোরেট হাউজগুলোর জন্য। ওরা অ্যাড দেয়। নইলে কয়টা দেশ ক্রিকেট খেলে?

শুভ্র: টি-টোয়েন্টি না দেখলেন, টেস্ট ম্যাচ কি দেখেন?

সালাহউদ্দিন: হ্যাঁ, টেস্ট ম্যাচ সুযোগ পেলে দেখি। এবার যখন নেপালে ছিলাম, ভারত-ইংল্যান্ড ওয়ানডে হচ্ছিল। আমি রাত্রিবেলা হোটেল রুমে একলা একলা বসে খেলা দেখেছি। এই অনেক দিন পরে ক্রিকেট দেখলাম।

শুভ্র: এখন যারা খেলেন, তাদের মধ্যে আপনার প্রিয় ক্রিকেটার কে?

সালাহউদ্দিন: এখন কেউ নাই।

শুভ্র: তাহলে অলটাইম? আপনি যখন খেলতেন, তখন কি কেউ ছিলেন?

সালাহউদ্দিন: গ্যারি সোবার্স।

শুভ্র: শেষ প্রশ্ন। স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশের স্পোর্টসের সবচেয়ে বড় সুপারস্টার কে? কাজী সালাউদ্দিন না সাকিব আল হাসান?

সালাহউদ্দিন: আমার নামটা না জড়ালে এটার উত্তর দিতে পারতাম।

শুভ্র: তাহলে কি আমি বলব, সালাহউদ্দিনের পর বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সুপারস্টার সাকিব আল হাসান?

সালাহউদ্দিন: না, না, না (হাসি) এই প্রশ্নটার উত্তর আমি আপনাকে দেব না।

পড়ুন প্রথম পর্ব...

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×