‘নিজেদের খেলা নিয়ে আমাদের অসম্ভব গরিমা ছিল’

জেফ ডুজনের একান্ত সাক্ষাৎকার

উৎপল শুভ্র

২৮ মে ২০২১

‘নিজেদের খেলা নিয়ে আমাদের অসম্ভব গরিমা ছিল’

জেফ ডুজন। ছবি: পোপারফটো

ওয়েস্ট ইন্ডিজের স্বর্ণযুগের উইকেটকিপার তিনি। দশ বছরের টেস্ট কারিয়ারে কোনো সিরিজ হারার অভিজ্ঞতা নেই। ৮১ টেস্টে ২৭২ ডিসমিসালের সঙ্গে ৫টি সেঞ্চুরি বলে দেয়, ব্যাটসম্যান হিসেবেও খারাপ ছিলেন না। ব্যাটিং-কিপিং যেটাই করুন, তাতেই থাকত একটা অন্য রকম সৌন্দর্য। ২০০৯ সালে গ্রেনেডার প্রেসবক্সে যখন এই ইন্টারভিউ করি, তখন মাত্রই টিভিতে কমেন্ট্রি শুরু করেছেন জেফরি ডুজন।

প্রথম প্রকাশ: ১৯ জুলাই ২০০৯। প্রথম আলো।

উৎপল শুভ্র: আপনি ওয়েস্ট ইন্ডিজের যে খেলেছেন, ক্রিকেট ইতিহাসে আর কোনো দলে এমন ঝড়ো গতির চার ফাস্ট বোলার একসঙ্গে খেলেনি। সারা দিন অমন তীব্র গতির বলে উইকেটকিপিং করার অভিজ্ঞতাটাই প্রথমে জানতে চাই।

জেফরি দুজন: শুরুতে তো কঠিন হয়েছেই। বুঝতেই পারেন, অমন গতির বলে আমার হাত আর শরীরের ওপর কী ঝড়টাই না যেত! শুধু তো আর গতি নয়, ওই গতিতে মুভমেন্ট-বাউন্স এসবও সামলানোর ছিল। যখন শুরু করি, তখন ব্যাপারটা একটু ভীতিকরই ছিল। আস্তে আস্তে অভ্যাস হয়ে গেছে। একসময় তো এটি উপভোগই করতে শুরু করলাম।

শুভ্র: আস্তে আস্তে কি স্টাম্পের সঙ্গে আপনার দূরত্বটাও কমেছে?

ডুজন: সেটি তো উইকেট কেমন এর ওপর নির্ভর করত। শুধু তো আমার দাঁড়ানোর ব্যাপার ছিল না। আমি কোথায় দাঁড়াচ্ছি, সেটির ওপরই তো নির্ভর করত স্লিপ কোথায় দাঁড়াবে। কখনো কখনো তাই এমন হয়েছে, যেখানে দাঁড়াতে চেয়েছি, উইকেট বা পরিস্থিতির দাবি মেটাতে তার চেয়ে সামনেই দাঁড়াতে হয়েছে।

শুভ্র: আঙুল-টাঙুল নিশ্চয়ই ভেঙেছে অনেকবার!

ডুজন: তা তো ভেঙেছেই। ম্যাচের মধ্যেও কখনো কখনো অনেক ব্যাথা পেয়েছি, তা সহ্য করেই খেলে যেতে হয়েছে।

শুভ্র: টুকটাক ব্যাথার কথা বাদ দিন। আঙুল ভেঙেছে কয়বার?

ডুজন: মনে হয় দুই-তিনবার। এর বাইরে হাড়ে চিড়-টিড় ধরা…এসব তো অনেকবারই হয়ছে। অনেক ম্যাচেই আমি হান্ড্রেড পার্সেন্ট ফিট ছিলাম না। কিন্তু ওই যে বলে, যুদ্ধে নামলে গুলি খেতেই হবে। এ পর্যায়ের ক্রিকেটে মানসিক জোর দিয়েই এসব জয় করতে হয়।

গতির ঝড় সামলে উইকেটের পেছনে এমনই সব ডাইভিং ক্যাচ নিতেন ডুজন। ছবি: পোপারফটো

শুভ্র: আপনার অভিষেক টেস্টে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে রবাটস-গার্নার-হোল্ডিং-ক্রফট। পরে ক্রফটের জায়গায় এলেন মার্শাল। এঁদের যুগ শেষ হওয়ার পর পেয়েছেন অ্যামব্রোস-ওয়ালশকেও। কার বলে কিপিং করাটা সবচেয়ে কঠিন ছিল?

ডুজন: এ প্রশ্নটা আমাকে প্রায়ই শুনতে হয়। তবে উত্তর দেওয়াটা খুব কঠিন। কারন আমি যেসব ফাস্ট বোলারকে কিপিং করেছি, তারা প্রত্যেকেই নিজের মতো করে অনন্য। যে কারণে প্রত্যেকেই ছিল ভিন্ন রকম চ্যালেঞ্জ। কোনো একজনকে কঠিন বলাটা কঠিন।

শুভ্র: বোলার হিসেবে তাঁরা কে কেমন ছিলেন, এটা তো আপনারই সবচেয়ে ভালো বুঝতে পারার কথা।

ডুজন: ওই যে বললাম, প্রত্যেকেই তাঁর মতো। ম্যালকম মার্শাল যেমন বল খুব সুইং করাত। বাতাসে খুব মুভমেন্ট ছিল ওর বলে। উচ্চতাকে কাজে লাগিয়ে বল বাউন্স করাতে জোয়েল গার্নার আবার বেশি ব্যবহার করত সিমটা। কার্টলি অ্যামব্রোস ছিল খুব অ্যাকুরেট। ওর বলে রান করা ছিল কঠিন। এর আগে অ্যান্ডি রবার্টস ও মাইকেল হোল্ডিংয়ের কথা যদি বলেন, ওরা ছিল আবার অন্য রকম। হোল্ডিং উইকেটে বল ঠুকত না। যে কারণে পিচে পড়ার পর ওর বলের গতি বেড়ে যেত। ব্যাটসম্যানদের মতো আমিও অনেক সময় এতে চমকে গেছি। কিপিং করতে শুরু করার পর বোলাররা কে কেমন, প্রথমে আমাকে এটা বুঝতে হয়েছে।

ম্যালকম মার্শাল ছিলেন ডুজনের কাছে একটা পূর্ণাঙ্গ প্যাকেজ।  ছবি: গেটি ইমেজেস

শুভ্র: কার বলে কিপিং করা খুব কঠিন, সেটি না হয় বলতে না পারলেন, কিন্তু সেরা কে—এটা বলুন।

ডুজন: প্রত্যেকেই তাঁরা দুর্দান্ত বোলার। তবে একজনকে যদি বেছে নিতেই হয়, আমি ম্যালকম মার্শালের কথা বলব। সবার ভালো গুণগুলো মিলেই যেন তৈরি হয়েছিল ও। আমি বলব, ফাস্ট বোলার হিসেবে ম্যালকম ছিল একটা পূর্ণাঙ্গ প্যাকেজ। খুব দ্রুত উইকেট ও ব্যাটসম্যানকে বুঝে নিয়ে সে অনুযায়ী বোলিং করত।

শুভ্র: এবার একটু কিপিং প্রসঙ্গে আসি। সেরা উইকেটকিপারদের নিয়ে আলোচনায় স্পিনে কিপিংয়ের পরীক্ষা না দেওয়াটা আপনার বিপক্ষে যায় (ডুজনের ২৭২ ডিসমিসালের মধ্যে মাত্র ৫টি স্পিন বোলিংয়ে)। এ ব্যাপারে আপনি কী বলেন?

ডুজন: এটা তো আমার দোষ না। আমাদের দলে কোনো বিশেষজ্ঞ স্পিনার তেমন খেলেইনি। আমরা সব সময় ফাস্ট বোলারদের ওপরই নির্ভর করেছি। রেকর্ডই বলে দেবে, তা করে সব ধরনের উইকেটেই আমরা সফল।

শুভ্র: আপনার দেখা সেরা উইকেটবিপার কে?

ডুজন: বব টেলর। ওর ধারে কাছেও কেউ নেই।

শুভ্র: টেলরের পর? বর্তমানে যাঁরা আছে তাঁদের মধ্যে?

ডুজন: এখন যারা আছে, শুধু কিপিংয়ের বিবেচনায় কাউকেই আমি খুব বেশি নম্বর দিই না। কিছুদিন আগেও যদি যাই, অ্যাডাম গিলক্রিস্ট উইকেটকিপার হিসেবে খুবই সাধারণ মানের। শুধু কিপিংয়ের কথা বললে জ্যাক রাসেল খুব ভালো ছিল।

জ্যাক রাসেলের উইকেট কিপিংয়ের ভক্ত ছিলেন ডুজন। ছবি: স্কাই স্পোর্টস

শুভ্র: আপনার সময়ের ওয়েস্ট ইন্ডিজ তো ক্রিকেট রূপকথার অংশ। ওই দলে অনেক গ্রেট খেলোয়াড় ছিল, কিন্তু এর বাইরে আর কী ছিল যে, পনেরো বছর অমন রাজত্ব করা গেল?

ডুজন: আমাদের দলে গ্রেট সব খেলোয়াড় ছিল, এটা অবশ্যই বড় ভূমিকা রেখেছে। আর যে একটা বিষয়ের ভূমিকা ছিল, তা হলো নিজেদের পারফরম্যান্সের ব্যাপারে আমাদের অসম্ভব গরিমাবোধ। আমরা যে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সব মানুষের প্রতিনিধিত্ব করছি, এ ব্যাপারেও আমরা খুব সচেতন ছিলাম। এসবের সঙ্গে খেলোয়াড়দের সামর্থ্য মিলেই আমরা অমন একটা দল হতে পেরেছিলাম।

শুভ্র: ওই দলকে নেতৃত্ব দিয়ে ক্লাইভ লয়েড পরিসংখ্যানে সর্বকালের সেরা অধিনায়কদের একজন। কিন্তু কেউ কেউ এমন বলে, ওই দলে যেসব খেলোয়াড় ছিল, তাতে যে কেউই এমন সাফল্য পেত। আপনি কী বলেন?

ডুজন: কারও এমন ধারণা থাকতে পারে। অনেকে এমন বলেও। কিন্তু কথা হলো, আপনার হাতে যত প্রতিভাবান খেলোয়াড়ই থাকুক, সেই প্রতিভাকে কাজে লাগাতে জানতে হয়। খেলোয়াড়দের সবাইকে একতাবদ্ধ দল হিসেবে খেলানোর একটা ব্যাপার থাকে। এখানেই আসেন অধিনায়ক। আমি যে দুজন  অধিনায়কের নেতৃত্বে খেলেছি—ক্লাইভের পর এল ভিভ রিচার্ডস—দুজনই দারুণভাবে এই কাজটা করতে পেরেছিল বলেই আমরা এমন সাফল্য পেয়েছি।

শুভ্র: আপনারা যখন দিনের পর দিন, কখনো বছরের পর বছর জিতে গেছেন, কখনো আত্মতৃপ্তি ভর করেনি? যখন অনেক সময়ই জানতেন, নিজেদের সামর্থ্যের পুরোটা খেলতে না পারলেও আপনারাই জিতবেন।

ডুজন: সব খেলোয়াড়, সব দলেরই ভালো-মন্দ দিন আসে। আমাদেরও কখনো কখনো বাজে দিন কেটেছে। আমরা তা মেনে নিয়েই ভুলটা খুঁজে বের করে পরদিন তা শুধরানোর চেষ্টা করেছি। তবে  আত্মতৃপ্তির যে কথা বলছেন, দলের মধ্যে আমি কখনোই এমন কিছু দেখেছি বলে মনে পড়ে না।

ডুজনের চোখে রিচার্ডসের মতো কেউ না। ছবি: গায়ানা ক্রনিকল

শুভ্র: ভিভ রিচার্ডস প্রসঙ্গে একটু আগে আপনি বলছিলেন, তাঁর মতো কেউ ছিল না, কেউ আসবেও না। কোথায় ভিভ রিচার্ডস বাকি সবার চেয়ে আলাদা হয়ে যান?

ডুজন: প্রথম কথা, ও যা করেছে, আর কোনো ব্যাটসম্যানকে আমি তা করতে দেখিনি। সব সময় চ্যালেঞ্জ নিয়ে সব ধরনের বোলিংয়ের ওপর ও আধিপত্য করেছে। সব খেলোয়াড়েরই কোনো না কোনো দুর্বলতা থাকে। কিন্তু আমি ভিভের তেমন কোনো দুর্বলতা খুঁজে পাইনি। ব্যাটিং সামর্থ্য তো ছিলই, এর সঙ্গে ও মানসিকভাবে ছিল খুব শক্ত। আর ছিল নিজের পারফরম্যান্স নিয়ে অসম্ভব গরিমাবোধ। প্রতিবার মাঠে নামাটাকে ও একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিত আর সেই চ্যালেঞ্জে বেশির ভাগ জিততও। খেলোয়াড়ি সামর্থ্য ছাড়াও এটাই ওকে বাকিদের চেয়ে আলাদা করে দিয়েছিল।

শুভ্র: অনেক সময় ভিভ রিচার্ডস নাকি ঘোষণা দিয়ে সেঞ্চুরি করতেন!

ডুজন: এটা আমি জানি না। কখনো শুনিওনি। আমি শুধু একটা কথাই বলব, ভিভ ছিল একেবারেই অন্য রকম একজন। ব্যতিক্রমী এক খেলোয়াড়। আমি বিশ্ব ক্রিকেটে ওর মতো এমন আধিপত্য করে আর কাউকে খেলতে দেখিনি। ভিভই একমাত্র ব্যাটসম্যান, যে ব্যাট করতে নামলে ফিল্ডাররা পিছিয়ে যেত। সচরাচর কী হয়, নতুন ব্যাটসম্যান এলে ফিল্ডাররা কয়েক পা এগিয়ে আসে। কিন্তু ভিভ নামার পর কাভার আরও পিছিয়ে যেত…আর কোনো ব্যাটসম্যানের ক্ষেত্রেই আমি এমন দেখিনি।

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×