`ব্যাটসম্যান কঠিন টেন্ডুলকার, বোলার আকরাম-ওয়ার্ন`

ক্রিস কেয়ার্নসের একান্ত সাক্ষাৎকার

উৎপল শুভ্র

৩০ মে ২০২১

`ব্যাটসম্যান কঠিন টেন্ডুলকার, বোলার আকরাম-ওয়ার্ন`

ক্রিস কেয়ার্নস। ছবি: অলস্পোর্ট

নিউজিল্যান্ড থেকে বেরোনো সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক ক্রিকেটারদের তালিকা করুন, ক্রিস কেয়ার্নসের নাম তাতে থাকবেই। তাঁর ব্যাটিং-বোলিং দুটিতেই একটা উদ্দামতা ছিল। যা দর্শকপ্রিয় হওয়ার নিশ্চিত রেসিপি। এই ইন্টারভিউটা নিয়েছিলাম ২০০১ সালের ক্রিসমাসের আগের সন্ধ্যায়। মাঠে অ্যাপয়েন্টমেন্ট মিস করার পরও টিম হোটেলে কথা বলতে রাজি হয়েই মন জিতে নিয়েছিলেন কেয়ার্নস।

এই সাক্ষাৎকারটা যে সময়কার, ব্যাটসম্যান বা বোলার—দুই হিসেবেই দলে আসতে পারতেন বলে জ্যাক ক্যালিসকেই বিশ্বের সেরা অলরাউন্ডার বলে মানতেন বেশির ভাগ মানুষ। তবে ক্রিস কেয়ার্নসকে ‘নাম্বার ওয়ান’ বলে মনে করতেন—এমন লোকের সংখ্যাও কম ছিল না। অন্তত দর্শকপ্রিয়তার বিচারে এই নিউজিল্যান্ডর অনেকটাই এগিয়ে তখন। কেয়ার্নসের ব্যাটিং তখন ক্রিকেটের সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক দৃশ্যগুলোর একটি। চোখের পলকে ম্যাচের ভাগ্য পরিবর্তন করে দেওয়ার ক্ষমতা ছিল এই বিগ হিটারের। বোলিংটাও যে খারাপ করতেন, তা নয়। ক্যারিয়ার শেষ করেছেন ৬২ টেস্টে ৩৩২০ রান ও ২১৮ উইকেট নিয়ে। ২১৫ ওয়ানডেতে রান ৪৯৫০, উইকেট ২০১টি। রেকর্ডটা আরও ভালো হতে পারত ইনজুরির সঙ্গে কিছুদিন পর পরই কেয়ার্নসের দেখা না হলে। বাবা ল্যান্স কেয়ার্নস নিউজিল্যান্ডের পক্ষে ৪৩ টেস্ট খেলেছেন, বিগ হিটার হিসেবে নাম ছিল তাঁরও। সেই ছোটবেলা থেকে বাবার সঙ্গে মাঠে যাওয়া, ড্রেসিংরুমে বসে কাছ থেকে তারকা দেখা—ক্রিস কেয়ার্নস সব সময়ই ক্রিকেটার হতে চেয়েছেন।

উৎপল শুভ্র: অনেকের মতেই আপনি বর্তমান বিশ্বের সেরা অলরাউন্ডার। আপনি এক্ষেত্রে কাকে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করেন?

ক্রিস কেয়ার্নস: ক্যালিস, পোলক…আসলে র‍্যাঙ্কিং, র‍্যাঙ্কিংই। এটি এমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। নিজের দিনে যে কেউ সফল হতে পারে। আমি র‍্যাঙ্কিংয়ের একটাই তাৎপর্য বুঝি, এটা আপনার ধারাবাহিকতা সম্পর্কে ধারণা দেয়। আপনি র‍্যাঙ্কিংয়ের এক নম্বর মানে আপনার পারফরম্যান্সে কনসিস্ট্যান্সি আছে। তবে ক্যালিস, পোলক, ক্লুজনার--ওরাও দারুণ খেলোয়াড়। নিজেদের দিনে ওদের যে কেউ দুর্দান্ত অলরাউন্ড পারফরম্যান্স দেখাতে পারে।

শুভ্র: আপনার শুরুটাও কি অলরাউন্ডার হিসেবে?

কেয়ার্নস: হ্যাঁ, আমি শুরু থেকেই বোলিং-ব্যাটিং দুটোই সমানভাবে করছি। তবে বোলিংটা আমার কাছে সব সময়ই বাড়তি গুরুত্ব পেয়েছে। বোলিংকে বলতে পারেন আমার প্যাশন। আর ব্যাটিংটা আমি উপভোগ করি। যখনই ব্যাট করতে নামি, একটা আনন্দ অনুভব করি আমি, বলকে মাঠের বিভিন্ন প্রান্তে পাঠানোটা আমার কাছে দারুণ মজার একটি ব্যাপার বলে মনে হয়।

শুভ্র: আপনার ব্যাটিংয়ের বিশেষত্বই তো বিগ হিট। বর্তমান ক্রিকেটে এমন কেউ কি আছে, যাঁর বিগ হিটিং সামর্থ্য আপনার মনেও ঈর্ষা জাগিয়েছে?

কেয়ানর্স: ল্যান্স ক্লুজনার ইজ আ বিগ হিটার বল। গত বিশ্বকাপে দারুণ কিছু ইনিংস খেলতে দেখেছি ওকে। গিলক্রিস্ট আরেকজন। ওকেও আপনার অলরাউন্ডার বলতে হবে। ব্যাটিং-বোলিং দুটোই পারে, এমন খেলোয়াড়দেরই সাধারণত অলরাউন্ডার বলা হয়। কিন্তু অ্যাডাম গিলক্রিস্ট আর অ্যান্ডি ফ্লাওয়ারও অলরাউন্ডার। কিপিংয়ের পাশাপাশি ওদের ব্যাটিংও দারুণ। তাই ওদেরও তো দুটো শক্তির দিক আছে, ওরাও অলরাউন্ডার। গিলক্রিস্ট দারুণ খেলোয়াড়, একই সঙ্গে বিগ হিটারও।বিগ হিটার হিসেবে বাবার পদাংকই অনুসরণ করেছিলেন ক্রিস কেয়ার্নস। ছবি: অলস্পোর্ট

শুভ্র: আপনি যখন ব্যাট করেন তখন তো কোনো বোলারকেই সমস্যা বলে মনে হয় না। তারপরও এমন কোনো বোলার কি আছে, যাঁকে খেলতে আপনার সমস্যা হয়েছে?

কেয়ার্নস: ওয়াসিম আকরাম। আমি যত বোলারকে খেলেছি, তার মধ্যে ও-ই সেরা। নব্বইয়ে সেরা ফর্মে থাকা শেন ওয়ার্নকে খেলাও ছিল খুব কঠিন। ওয়াসিম আকরাম আর শেন ওয়ার্নই আমার খেলা সেরা দুই বোলার।

শুভ্র: এই কদিন আগে ম্যাকগ্রার মতো বোলারকেও অনায়াসে বিশাল ছক্কা মেরেছেন আপনি। এ রকম স্মরণীয় বিগ হিট অনেকই আছে আপনার। এর মধ্য থেকে কোনো একটিকে বেছে নিতে পারেন আপনি?

কেয়ার্নস: না, আসলে যেকোনো ভালো বোলারের বলে ছক্কা মারাটাই দারুণ ব্যাপার। আমি আমার সবগুলো ছয়ই সমানভাবে উপভোগ করেছি। কোনো একটিকে বেছে নেওয়া কঠিন। সবগুলোই আমার কাছে সমান প্রিয়।

শুভ্র: এখন পর্যন্ত আপনার খেলা সেরা ইনিংস কোনটি?

কেয়ার্নস: অবশ্যই কেনিয়া (২০০০ নকআউট বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে সেঞ্চুরি)। এটি ছিল বিরাট এক ম্যাচ, তাতে নিউজিল্যান্ডকে ট্রফি জিততে সাহায্য করেছে এমন একটা ইনিংস খেলতে পারাটা দারুণ ব্যাপার। কোনো সন্দেহ নেই, এটিই আমার সেরা ইনিংস।ভারতের বিপক্ষে নাইরোবিতে সেই জয় এনে দেওয়ার পর। মিনি বিশ্বকাপ ২০০০। ছবি: অলস্পোর্ট

শুভ্র: এর কিছুদিন পরই ইনজুরিতে পড়লেন আপনি। ও রকম দুর্দান্ত ফর্মে থাকার সময় ইনজুরিটা নিশ্চয়ই বিশাল এক হতাশা হয়ে এসেছিল আপনার জন্য?

কেয়ার্নস: (মাথা নাড়তে নাড়তে) এটা ছিল খুবই হতাশার, খুবই হতাশার। প্রায় বছর তিনেক দল হিসেবে খুব ভালো সময় কাটছিল আমাদের। তা ছাড়া আমি তখন ছিলাম আমার খেলার একেবারে তুঙ্গে। সে সময় এই ইনজুরিতে পড়া ভয়াবহ এক আঘাত হয়ে এসেছিল আমার জন্য। ইনজুরি থেকে ফেরার পর যে সমস্যাটা হচ্ছে তা হলো, মানুষ আশা করে আপনি যে অবস্থায় খেলা ছেড়েছিলেন, সেই রূপই ফিরবেন। কিন্তু এটা তো কখনোই সম্ভব নয়। আত্মবিশ্বাস বলেন, ছন্দ বলেন—এসব ফিরে পেতে সময় লাগবেই। তবে খেলাটা এমনই। এখানে সব সময়ই প্রত্যাশা থাকবে। তবে আমার খুব একটা সমস্যা হয়নি। কারণ আমার ক্যারিয়ারে অনেকবারই ইনজুরিতে পড়েছি। তাই আমি ভেঙে না পড়ে ইতিবাচক চিন্তা করতেও শিখেছি।

উৎপল শুভ্রর অনুরোধে ক্রিস কেয়ার্নস বেছে নিয়েছিলেন তাঁর চোখে সেরা টেস্ট একাদশ

শুভ্র: আপনার যে রেকর্ড, তাতে কি আপনি সন্তুষ্ট?

কেয়ানর্স: আমার আরও বেশি ম্যাচ খেলা উচিত ছিল। ইনজুরির কারণে যে সময়টা আমাকে খেলার বাইরে থাকতে হয়েছে, তা থাকতে না হলে আজ আমি ২০০ টেস্ট উইকেটের কাছাকাছি নয়, ৩০০ টেস্ট উইকেটের কাছাকাছি থাকতাম। এটা ভাবলে খুব খারাপ লাগে। তবে এ নিয়ে হাহুতাশ করে তো আর লাভ নেই। এ কারণেই আমি যা পেয়েছে, সেগুলোর কথা ভাবি। এমন অনেক কিছু করেছি, যা অনেক মানুষের স্বপ্নের ব্যাপার। তাই আমার হয়তো খুশিই থাকা উচিত।

শুভ্র: আপনি যাঁদের বিপক্ষে বল করেছেন, তাঁদের মধ্যে সেরা কে?

কেয়ার্নস: টেন্ডুলকার, অবশ্যই টেন্ডুলকার। মধ্য নব্বইয়ে ব্রায়ান লারাও ছিল দুর্দান্ত। এখন অ্যাডাম গিলক্রিস্টকে বল করা খুব কঠিন। তবে টেন্ডুলকারই সেরা।

শুভ্র: কী কারণে?

কেয়ার্নস: ব্যাটিংয়ের সময় পুরো ব্যাপারটির ওপর ওর নিয়ন্ত্রণ। কোনো কিছুতেই বিচলিত হয় না ও। টেন্ডুলকার ভারতের হাতে গোনা কয়েকজন খেলোয়াড়ের একজন যে দেশের মতো দেশের বাইরেও রান করেছে। ওর ব্যাটিং দেখতেও দারুণ। যদি আমি আউট না-ও করতে পারি, মিড অফে দাঁড়িয়ে ওর ব্যাটিং দেখতে আপত্তি নেই আমার। পেস, স্পিন, সিমিং উইকেট, বাউন্সি উইকেট—সব কিছুতেই টেন্ডুলকার সমান স্বচ্ছন্দ। গ্রেট প্লেয়ার!

লারা-গিলক্রিস্টের কথা বলেছিলেন, তবে শেষ পর্যন্ত সেরা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন টেন্ডুলকারকে

শুভ্র: বর্তমান ক্রিকেট যেভাবে চলছে, সে ব্যাপারে কোনো আপত্তি আছে আপনার?

কেয়ার্নস: আপত্তি বলতে অনেক সাবেক ক্রিকেটার যখন বলে যে, তাঁদের সময় খেলাটা অনেক ভালো ছিল, তখন আমার অসহ্য লাগে। আমি বলর যাঁরা এমন বলে, তাঁরা ক্ষুদ্রমনা, নির্বোধ। এক যুগের সঙ্গে আরেক যুগের তুলনা করাটাই আমার মতে ঠিক নয়। খেলা অন্য রকম, পৃথিবী অন্য রকম—সব কিছুই তো অন্য রকম। আমি বিশ্বাস করি এক যুগের ‘গ্রেট’ প্লেয়ার যেকোনো যুগেই ‘গ্রেট’ প্লেয়ার হওয়ার ক্ষমতা রাখে। এটাই আপনাকে মনে রাখতে হবে। বিভিন্ন যুগের মধ্যে তুলনা চলে না। আপনি যা পাচ্ছেন, সেটিই উপভোগ করতে হবে। ম্যাচ পাতানো ও ঘুষ কেলেঙ্গারি আমাকে খুব ক্ষুব্ধ এবং একই সঙ্গে ব্যথিতও করে। এই বিষবৃক্ষ সমূলে উপড়ে ফেলতে না পারলে বড় বিপদ হবে। তবে সব মিলিয়ে আমি তো দিন দিন ক্রিকেটকে আরও বিশাল হতেই দেখছি।

শুভ্র: আশির দশকে বিশ্ব ক্রিকেট চারজন ‘গ্রেট’অলরাউন্ডার পেয়েছিল। বর্তমান অলরাউন্ডাররা কি তাঁদের সঙ্গে তুলনীয়?

কেয়ার্নস: আমি তো আগেই বলেছি, এমন তুলনায় আমি যেতে চাই না। আমি ইমরানের বিপক্ষে কেমন করতাম, বোথামকে আউট করতে পারতাম কি না কিংবা কপিল আমার বোলিংয়ে ঝড় তুলতে পারত কি না—এর সবই জল্পনার ব্যাপার। আমি এমন কিছুতে যেতে চাই না। আমি বলব ওরা সবাই ‘গ্রেট’ প্লেয়ার। ওদের খেলা দেখতে আমার খুব ভালো লেগেছে। আশা করতে দোষ কী, আজ থেকে ১০/১৫ বছর পর তরুণ কোনো অলরাউন্ডার হয়তো বলবে ক্রিস কেয়ার্নসের খেলা আমি খুব পছন্দ করতাম।

বোলার ক্রিস কেয়ার্নস

শুভ্র: ক্যারিয়ার শেষ করার আগে কী অর্জনের স্বপ্ন দেখেন?

কেয়ার্নস: নিউজিল্যান্ডের হয়ে একটা বিশ্বকাপ জিততে চাই। এটা যেন একটা নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, নিউজিল্যান্ড বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে উঠবে, কিন্তু এরপর আর এগোতে পারবে না। ’৯৯ বিশ্বকাপে মাত্রই কাফ ইনজুরি থেকে ফিরেছিলাম আমি, তাই সেভাবে মেলে ধরতে পারিনি নিজেকে। এর পরপরই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে  অনেক ভালো করেছিলাম। এটা আমার একটা বড় আফসোস। আমরা খুব ভালো খেলছিলাম, তাই সেমিফাইনালে পাকিস্তানের কাছে ওভাবে হেরে যাওয়াটা ছিল খুবই হতাশাজনক। আমরা ফাইনালে গেলে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড দুর্দান্ত একটা ফাইনাল হতো।

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×