আফ্রিকার হয়েও আফ্রিকার নয়

২০১২ লন্ডন অলিম্পিক

উৎপল শুভ্র

২১ জুলাই ২০২১

আফ্রিকার হয়েও আফ্রিকার নয়

ছবি: গেটি ইমেজেস

টানা তিনটি অলিম্পিকে ১০ হাজার মিটারে সোনা জয়ের হাতছানি ছিল কেনেসিসা বেকেলের সামনে। কিন্তু তাঁকে পেছনে ফেলে লন্ডন অলিম্পিকে এই ইভেন্টে স্বর্ণ জিতেছিলেন মো ফারাহ। সোমালিয়াতে জন্মালেও যিনি ততদিনে হয়ে গিয়েছেন গ্রেট ব্রিটেনের।

প্রথম প্রকাশ: ৬ আগস্ট ২০১২। প্রথম আলো

নিজেকে কি চিমটি কেটেছিলেন গালেন রাপ? আসলেই কি রুপা জিতেছেন! তাঁর যে বিশ্বাস হচ্ছিল না। সংবাদ সম্মেলনে এসেই বললেন, ‘দূরপাল্লার দৌড়ে ইউএসএ আর ব্রিটেনের পদক—আমার কাছে ভুতুড়ে লাগছে!’

মঞ্চে গালেন রাপের পাশে বসে যে দুজন, তাঁদের দেখে অবশ্য বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। একজনের পদবি ‘বেকেলে’। ১০ হাজার মিটার দৌড়ের সঙ্গে যা সমার্থকই হয়ে গেছে প্রায় এক দশক। প্রায় দেড় যুগ ধরে ১০ হাজার মিটারের সোনাজয়ীর যে চেহারা দেখে বিশ্ব অভ্যস্ত, অন্যজন ঠিক সে রকম। কালো, লিকলিকে। সমস্যা করছে সামনে নামাঙ্কিত বোর্ডটা। সেখানে লেখা ‘গ্রেট ব্রিটেন’।

গ্রেট ব্রিটেনের অ্যাথলেট জিতেছেন ১০ হাজার মিটারের সোনা! বিস্ময়চিহ্নটা উঠে যাবে, যখন জানবেন এখন যতই গ্রেট ব্রিটেনের হন, মোহাম্মদ ফারাহ আসলে সোমালিয়ান। গত পরশু রাতের ১০ হাজার মিটারে তার পরও যুগবদলের গান। ১৯৮৪ সালের পর প্রথম এই ইভেন্টের সোনাটা আফ্রিকার বাইরে গেল। আসলেই কি তা গেল? মো ফারাহ (মোহাম্মদটা সংক্ষেপে মো-ই হয়ে গেছে এখানে আসার পর) তো আফ্রিকানই। ইতিহাস যদি হয়ে থাকে, সেটি গড়েছেন গালেন রাপই। আফ্রিকায় জন্মাননি, এমন কারও এই ইভেন্টে অলিম্পিক পদক সেই ১৯৮৮ সালের পর প্রথম।

বেকেলে-যুগেরও কি অবসান? গত দুটি অলিম্পিকই বিজয়মঞ্চ বেকেলেকে দেখে এসেছে। এবার যিনি ব্রোঞ্জ জিতলেন, তিনিও বেকেলে। তবে তাঁর নামের প্রথম অংশ ‘কেনেনিসা’ নয়, তারিকু। কেনেনিসা বেকেলের ছোট ভাই। এথেন্স ও বেইজিংয়ে সোনাজয়ী কেনেসিসা বেকেলের সামনে ছিল ইতিহাসের হাতছানি। এই ইভেন্টে টানা তিনটি অলিম্পিক যে কেউ জেতেনি। আরেক ইথিওপিয়ান হেইলে জেব্রেসেলাসি পারেননি। এথেন্সে জেব্রেসেলাসি-যুগের অবসান ঘটানো বেকেলেও পারলেন না।

ছবি: গেটি ইমেজেস

পরশু রাতে অলিম্পিক স্টেডিয়ামে সবচেয়ে আবেগঘন মুহূর্তটিরও জন্ম হলো এতেই। সোনা জেতার পর মো ফারাহ চোখ বড় বড় করে মাথা চাপড়াতে শুরু করলেন। প্রায় ছয় মাইল দৌড়ানোর পর ক্লান্তিতে শুয়ে পড়ার কথা, ফারাহ এদিকে দৌড় দেন, ওদিকে দৌড় দেন। যেন তাঁর বিশ্বাসই হচ্ছিল না। একটু পর মেয়ে রিয়ানা দৌড়ে গেলেন ট্র্যাকে। তাঁকে জড়িয়ে ধরে যখন রীতিমতো ঝাঁকাচ্ছেন ফারাহ, যমজ সন্তানের অপেক্ষায় দিন গুনতে থাকা স্ত্রী তানিয়াও যোগ দিলেন। আলোকচিত্রীদের আবদার মেটানোর পর ল্যাপ অব অনারটা স্ত্রী-কন্যাকে নিয়েই দিতে চেয়েছিলেন। দিলেন না কেন? ‘রিয়ানার জুতা খুলে যাচ্ছিল। আমি বললাম, জুতা খুলে রেখে চলো স্টেডিয়ামটা চক্কর দিই। ও রাজি হলো না। দর্শকদের অমন চিৎকারে ও একটু ঘাবড়েই গিয়েছিল।’ 

তা দর্শকেরা চিৎকার করল বটে। সোনা জয়ে সেটিরও ভূমিকা দেখছেন ফারাহ, ‘ওরা এমন উৎসাহ না দিলে হয়তো পারতাম না। সবাই “গো মো” বলে চিৎকার করছিল, এমন চাঙা লাগছিল যেন ১০ কাপ কফি খেয়েছি।’ এই দেশ তাঁকে আপন করে নিয়েছে। মো ফারাহও এই দেশকে। এ কারণেই সোমালিয়ার পক্ষে এই সোনাটা জিতলে বেশি খুশি হতেন কি না প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘এটাই আমার দেশ। আট বছর বয়সে এখানে এসেছি। এরপর থেকে এটিকেই নিজের দেশ ভেবে এসেছি।’ আফ্রিকান এক সাংবাদিক অবশ্য তার পরও প্রশ্ন করলেন, এখন যতই গ্রেট ব্রিটেনের হয়ে যান, সোমালিয়ায় জন্ম, জিবুতিতে বেড়ে ওঠা—আফ্রিকান তরুণদের জন্য কোনো বার্তা নেই তাঁর? সাফল্যের একমাত্র যে ‘রেসিপি’, সেটিই বার্তা ফারাহর, ‘ওদের উদ্দেশে শুধু একটা কথাই বলব, যদি তুমি মনেপ্রাণে কিছু পেতে চাও আর সে জন্য পরিশ্রম করো, তাহলে অবশ্যই সফল হবে। ঠিক সময়ে ঠিক সমর্থনটা অবশ্য জরুরি। ফুটবল খেলার সময় আমি এক রানিং কোচের চোখে পড়ি, তিনিই আমাকে অ্যাথলেটিকসে নিয়ে আসেন। পরিশ্রমের সঙ্গে সঠিক সমর্থনটা পেলে যেকোনো কিছুই সম্ভব।’

ছবি: গেটি ইমেজেস

মো ফারাহই এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ। ইংল্যান্ডে আসার পর মানিয়ে নিতে অনেক কষ্ট হয়েছে। স্কুলে ভাষাগত সমস্যায় ছিলেন সবার রসিকতার পাত্র। সেই ফারাহ এখন দারুণ ইংরেজি বলেন। কথাও বলেন খুব গুছিয়ে। পরিশ্রমের সঙ্গে ত্যাগ স্বীকারও কম করেননি। ট্রেনিংয়ের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে  গেছেন বিখ্যাত কোচ আলবার্তো সালাজারের স্কুলে। যেখানে স্ত্রী-কন্যার কথা ভুলে মনপ্রাণ সঁপে দিয়েছেন একটা কাজেই। ফারাহর ভাষায় ‘হার্ড ট্রেনিং’। সাবেক ম্যারাথনার আলবার্তো সালাজারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ মো ফারাহ ও গালেন রাপ দুজনই। ফারাহটা না হয় বোঝা গেল, গালেন রাপও তাঁর সঙ্গে সুর মেলাচ্ছেন কেন?

গালেন রাপেরই বেশি বলার কথা, তিনি আলবার্তো সালাজারের অনেক পুরোনো ছাত্র। ১৯৬৪ সালের পর ১০ হাজার মিটারে যুক্তরাষ্ট্রের কেউ অলিম্পিকে পদক জেতেনি। দূরপাল্লার দৌড়ে এই পদক-বন্ধ্যাত্ব ঘোচাতে সালাজার সেই কবে থেকেই তৈরি করছিলেন রাপকে। ফারাহ তো যোগ দিলেন গত বছর। সালাজারের স্কুলেই দারুণ বন্ধুত্ব হয়ে যায় ফারাহ-রাপের। অলিম্পিক সোনা-রুপায় আরও দৃঢ় হলো সেই বন্ধুত্বের বন্ধন।

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×