পেলের শেষ ম্যাচ

অর্ধেক সান্তোস, অর্ধেক কসমস

উৎপলশুভ্রডটকম

১ অক্টোবর ২০২১

অর্ধেক সান্তোস, অর্ধেক কসমস

১ অক্টোবর ১৯৭৭। সবার ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে পেলের বিদায়

১৯৭৭ সালের ১ অক্টোবর আরও অনেক কারণেই স্মরণীয় হয়ে থাকতে পারে। তবে সেসবের মধ্যে এটাও একটা যে, এদিনই ফুটবলকে বিদায় জানিয়েছিলেন পেলে। নিউ জার্সির জায়ান্টস স্টেডিয়ামে পেলের শেষ ম্যাচে ৭৭ হাজার দর্শকের মধ্যে ছিলেন অনেক রথী-মহারথী। সান্তোস আর কসমসের মধ্যকার সেই প্রদর্শনী ম্যাচে দুই অর্ধে দুই দলের পক্ষে খেলেছিলেন পেলে।

সে এক রাজার বিদায়ের দিন। রূপকথার গল্পের শেষ চিত্রনাট্যের প্রহর। আকাশও বুঝি ওই বিদায়ে বিষন্ন ছিল খুব। নইলে খেলার মাঝপথে বৃষ্টি কেন নেমে আসবে হঠাৎ। ‘এমনকি আকাশও কাঁদছিল’-আমেরিকার মাঠ থেকে সেই বিদায়ের গল্প শোনাতে গিয়ে ব্রাজিলের একটি সংবাদপত্র করেছিল এমন শিরোনাম।

সেদিন শতাব্দীর সেরা ফুটবলার পেলের ‘বিদায়’ বলার দিন। ৪৪ বছর আগের কথা। ফুটবল রোমান্টিকদের কাছে চিরকালের জন্য স্মরণীয় এক দিন ১ অক্টোবর ১৯৭৭।

সেদিন এক প্রদর্শনী ম্যাচ আয়োজন করা হয়েছিল পেলেকে সবচেয়ে সেরা উপায়ে ‘গুডবাই’ বলার সুযোগ করে দিতে। যে ম্যাচের দুই দল পেলের প্রথম ও শেষ ক্লাব। জীবনে তাঁর দুটি মাত্র ক্লাব। প্রথমটি নিজের দেশের সান্তোস। যেটিতে খেলে পেলের সর্বকালের সেরা হয়ে ওঠা। ফুটবলের ব্যাপ্তি ছাড়িয়ে বৈশ্বিক হওয়ার ক্লাব। শেষ ক্লাব মার্কিন মুলুকের নিউইয়র্ক কসমস। ব্রাজিলের ক্লাবটির সঙ্গে কসমসের এক প্রীতি ম্যাচ খেলা হলো শেষের শেষ গল্পের দিনে।

যা শুধু একটা ম্যাচের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। পরিণত হয়েছিল উৎসবে। আমেরিকানদের কাছে ফুটবল তখনকার আগের দিনে ‘সকার’ নামের এক অবজ্ঞা। সেটিই পেলের কারণে উন্মাদনার নামে পরিণত হয়েছিল। পেলের বিদায়ী ম্যাচের উৎসবে যোগ দিতে স্টেডিয়ামমুখী মানুষের ঢল নেমেছিল। নিউ জার্সির জায়ান্টস স্টেডিয়াম ভেসে গিয়েছিল ৭৭ হাজার দর্শকের স্রোতে। সর্বকালের সেরা বক্সার মোহাম্মদ আলীও মাঠে এসে পেলের সঙ্গে শিশুসুলভ আনন্দে মেতেছিলেন। যার মাধ্যমে পেলের মার্কিন মুলুকে খেলতে যাওয়া; সেই রাজনীতিবিদ-কুটনীতিক হেনরি কিসিঞ্জারও দর্শক। বহু বিখ্যাত মানুষ এসেছিলেন মাঠে পেলের শেষদিনের সাক্ষী হতে। ছিলেন সঙ্গীত-অভিনয় জগতের অনেক হুজ হু-ও। মিক জ্যাগার, এলটন জন, রবার্ট রেডফোর্ডরাও মাঠে। খেলায় কসমস ২-১ গোলে হারায় সান্তোসকে।

পেলের ফুটবল অধ্যায় শেষ হয়ে যাওয়ার পর...

নর্থ আমেরিকান সকার লিগে খেলতে ১৯৭৫ সালে কসমসে সই করেন পেলে। তাঁর বয়স তখন ৩৫। হেনরি কিসিঞ্জার এক ক্যাফেতে বসেছিলেন পেলেকে নিয়ে। সেখানে কথা বলে বলে ফুটবল সম্রাটকে রাজি করান কসমসে খেলতে। আসলে কিসিঞ্জার এবং কসমসের উদ্দেশ্য ছিল, আমেরিকান ফুটবলকে তুলে ধরতে পেলের ব্র্যান্ড ব্যবহার করার। তারা সফলও হয়েছিলেন। যার প্রমাণ পেলের বিদায়ের দিনে কানায় কানায় পরিপূর্ণ স্টেডিয়াম।

কেন আমেরিকায় গিয়েছিলেন পেলে? ইতিহাস বলছে, ২.৮ মিলিয়ন ডলারে তিন বছরের চুক্তিতে পেলে নাম লেখান কসমসে। ওই চুক্তিতে বিশ্বের সবচেয়ে দামী অ্যাথলিট হয়ে যান পেলে। অথচ তখন ক্যারিয়ারের অস্তাচলে রাজা!

শেষ ম্যাচে খেলতে নামার আগে আবেগতাড়িত পেলে বলেছিলেন, ‘জীবনে সবকিছুর চেয়ে ভালোবাসাটাই মূল্যবান।’ সেই ভালোবাসার মূল্য দিতে গিয়ে আমেরিকান ফুটবলের দৃশ্যপটটাই বদলে দিয়েছিলেন এই কিংবদন্তি।

ম্যাচের শেষ বাঁশি বাজার পর পেলে। গায়ে তখন নিউইয়র্ক কসমসের সবুজ জার্সি

পেলের শেষ ম্যাচের দিনে কসমসের গোল বারের নিচে দাঁড়ানো মানুষটি শেপ মেসিং। তখন তার ২৭ বছর বয়স। তাঁর চোখে পেলে শুধু বৈশ্বিক আইকনই ছিলেন না, ছিলেন প্রায় ধর্মীয় গুরুর মতো। পেলের উচ্চতার সঙ্গে মেলানো যায় না আর কোনো কিছুকেই। কেন তিনটি বিশ্বকাপ জেতা পেলের আমেরিকায় শেষ করা উচিত, এ নিয়ে মেসিং একবার বলেছিলেন, ‘তিনি স্পেন বা ইতালিতে যেতে পারতেন। শিরোপা জিততে পারতেন। কিন্তু কসমসে এলে গোটা একটা দেশ জিতে নিতে পারতেন।’ সেটাই করেছিলেন পেলে। ফুটবল দিয়ে ফুটবলের অনুর্বর ভূমি আমেরিকাও জিতে নিয়েছিলেন।

পেলের পাশাপাশি তখন আরও তারকার মেলা বসেছিল আমেরিকান ফুটবলে। ১৯৭০ বিশ্বকাপজয়ী ব্রাজিল দলের অধিনায়ক কার্লোস আলবার্তো, জার্মানির বিশ্বকাপ জেতা অধিনায়ক ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার, ইতালিয়ান স্ট্রাইকার জিওর্জিও চিনাগ্লিয়া, হল্যান্ডের ইয়োহন ক্রুইফ, ইয়োহান নিসকেন্স, জার্মানির জার্ড মুলার, নর্দান আয়ারল্যান্ড ও ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের জর্জ বেস্টরা বিভিন্ন দলে খেলতেন।

কিন্তু সবার ওপরে পেলে। সেই দিনগুলো মনে করে মেসিং বলছেন, ‘সোজা কথায় পেলে ফুটবলকে আকর্ষণীয় বানিয়ে দিয়েছিলেন। মিক জ্যাগার, এলটন জন, রবার্ট রেডফোর্ডরা খেলা দেখতে আসতেন। শেষ ম্যাচে মাঠে ছিলেন মোহাম্মদ আলী। তখন পেলে আর মোহাম্মদ আলী ছিলেন বিশ্বের সেরা দুই অ্যাথলেট। মোহাম্মদ আলী এসে দর্শকদের চুমু ছুড়ে দিলেন। মোহাম্মদ আলীয় কিছু কাজও করলেন। তারপর লকার রুমে গিয়ে পেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন।’

মোহাম্মদ আলীও এসেছিলেন পেলেকে বিদায় জানাতে

আবেগমথিত পেলে প্রথমার্ধটা খেলেন সান্তোসের হয়ে। করেন সান্তোসের একমাত্র গোলটিও। যেটি হয়ে থাকে তাঁর ক্যারিয়ারের শেষ গোল। ১,৩৯০তম ম্যাচে রেকর্ড ১,৩০১তম গোল। পেলে দ্বিতীয়ার্ধে মাঠে নামেন কসমসের জার্সিতে।

সামার অব সেভেন্টি সেভেনে যখন অস্ত গেল পেলের ফুটবলের পথ, তখন অন্য কিছুও ছিল আলোচনায়। দুদিনের ব্ল্যাক আউট মানুষের নাভিশ্বাস তুলে দিয়েছিল। ‘সন অব স্যাম’ ডাকনামের সিরিয়াল কিলার ডেভিড বার্কোইটজ আতঙ্কিত করে রেখেছিল। এর মাঝে পেলের বিদায় বিরহের রাগিনী বাজালেও সেটা ছিল এক পশলা শীতল হাওয়া।

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×