কেন উৎপলশুভ্র.কম

কোলাজ: মনিরুল ইসলাম

কে জানত, ১৯৮৬ সালের এক রাতে পরীক্ষার পড়া বাদ দিয়ে আবেগতাড়িত হয়ে লিখতে বসা একটা চিঠিই বাকি জীবনের পথচলায় এমন গভীর ইঙ্গিতবহ হয়ে দেখা দেবে! চিঠিটা ছিল সুনীল গাভাস্কারকে নিয়ে। গাভাস্কারের প্রতি ‘অন্যায় আক্রমণের’ প্রতিবাদ করার দায়িত্বটা সেদিন নিজের কাঁধে তুলে না নিলে কে জানে, হয়তো আমার কোনো দিন ক্রীড়া সাংবাদিকই হওয়া হতো না।

যে সময়ের কথা বলছি, বাংলাদেশে তখন সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনের খুব রমরমা বাজার। সমাজ-রাজনীতি-সিনেমা-খেলা–সবকিছুই এক চিমটি থাকত সেসব ম্যাগাজিনে। ‘সাপ্তাহিক রোববার’ নামে যে ম্যাগাজিনে ছাপা হওয়া একটা চিঠি পড়ে উত্তেজিত হয়ে তার জবাব দিতে বসেছিলাম, তাতে খেলার জন্য এক চিমটির চেয়ে একটু বেশিই বরাদ্দ থাকত। সেই ছোটবেলা থেকেই নেশা বলতে দুটিই–গল্প-উপন্যাস পড়া আর খেলা। প্রথমটার উৎস বুঝতে পারি। মাকে সারা রাত জেগে উপন্যাস পড়তে দেখতাম, ক্লাস ফাইভে পড়ার সময় প্রথম উপন্যাসটাও মা-ই পড়তে বাধ্য করেছিলেন। কিন্তু খেলার নেশাটা কোত্থেকে রক্তে মিশে গেল, তা এখনো আমার কাছে রহস্যই হয়ে আছে। বাবার তো নয়ই, আমার চৌদ্দপুরুষের কারোরই খেলার সঙ্গে কোনো সংস্রব ছিল বলে শুনিনি। অথচ আমি ছোটবেলা থেকেই খেলার পাগল। নিজে তো খেলতামই, খেলা নিয়ে লেখাও গোগ্রাসে গিলতাম। খেলাকে প্রাধান্য দেওয়া রোববার আমার খুব পছন্দের ম্যাগাজিন হয়ে উঠবে, তা আর আশ্চর্য কি!

১৯৮৬ সালের সেই রাতে ফিরি। একটু আগেই হলের কমনরুমে সদ্য আসা ‘রোববার’ ম্যাগাজিনে ঠাকুরগাঁও থেকে জনৈক ডা. রেজাউল করিম রাজার একটা চিঠি পড়েছি। পড়তে পড়তেই বিরক্ত বোধ করেছি। পড়া শেষ করার পর আরও বেশি। চিঠিটার বিষয় যে সুনীল গাভাস্কার, তা তো বলেই দিয়েছি। আর চিঠির প্রতিপাদ্য হলো, সুনীল গাভাস্কার অনেক রান করতে পারেন, সেঞ্চুরির পর সেঞ্চুরিও, রেকর্ডের পর রেকর্ড; কিন্তু তা শুধু নিজের কথা ভেবেই, তাতে দলের কোনো উপকারই হয় না। এককথায়, সুনীল গাভাস্কার স্বার্থপর একজন ক্রিকেটার। আকারে বেশ বড় ওই চিঠিটাজুড়ে যা প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয়েছে, তা হলো, ব্যাটে রানবন্যা বইয়ে দিয়ে গাভাস্কার নিজে বিখ্যাত হয়েছেন, কিন্তু তা করতে গিয়ে ভারতের প্রভূত ক্ষতি সাধন করেছেন।

গাভাস্কারের মাহাত্ম্য আমি আরও অনেক পরে বুঝেছি। তখন ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের তুমুল সাপোর্টার এবং স্বাভাবিকভাবেই প্রিয় ব্যাটসম্যান ভিভ রিচার্ডস। কিন্তু চিঠিটা পড়ে মনে হলো, গাভাস্কারের প্রতি এ চরম অন্যায় এবং অবশ্যই এর প্রতিবাদ করা উচিত। পরে বিআইটি হয়ে কুয়েটে রূপান্তরিত খুলনা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়ি তখন। পরীক্ষা নামের বিভীষিকা চলছে এবং পরের দিনের পরীক্ষাটাই সবচেয়ে কঠিন। আমি সেই পরীক্ষার পড়া বাদ দিয়ে গাভাস্কারকে নিয়ে লেখা ওই ‘অন্যায়’ চিঠির প্রতিবাদ লিখতে বসলাম। পরদিন ডাকে তা পাঠিয়েও দিলাম সাপ্তাহিক রোববার-এর ঠিকানায়। এত বড় চিঠি, আদৌ ছাপা হবে কি না, কে জানে! আমাকে অবাক করে দিয়ে পরের সংখ্যাতেই তা ছাপা হয়ে গেল। সেই প্রথম মুদ্রিত অক্ষরে নিজের নাম দেখা! সে যে কী আনন্দ!

নিজের চিঠি নিজেই বারবার পড়লাম, বন্ধুদেরও পড়ালাম। পড়তে পড়তে নিজের যা মনে হচ্ছিল, বন্ধুরাও তাল মেলানোয় তা বিশ্বাসই করে ফেললাম। পত্রপত্রিকায় খেলা নিয়ে যেসব লেখা ছাপা হয়, চিঠিটা বোধ হয় সেসবের তুলনায় খারাপ হয়নি। আমিও লিখতে পারি।

সেই বিশ্বাস থেকেই রোববারে পরপর বেশ কয়েকটা চিঠি লিখে ফেললাম। তা ছাপাও হলো। কী নিয়ে লিখেছিলাম, তার বেশির ভাগই মনে নেই। শুধু একটা স্পষ্ট মনে করতে পারি। যে চিঠিটা ছিল ওয়াসিম আকরাম নিয়ে লেখা। মাত্রই বিশ্ব ক্রিকেটে আবির্ভাব ঘটেছে, ডানেডিনে জীবনের দ্বিতীয় টেস্টেই নিয়ে নিয়েছেন ১০ উইকেট। সেই চিঠি সংবলিত ‘রোববার’ ম্যাগাজিনটা হারিয়ে না ফেললে আজ দাবি করতে পারতাম, ওয়াসিম আকরাম যে সর্বকালের সেরাদের একজন হতে যাচ্ছেন, সেই ভবিষ্যদ্বাণী আমি আগেই করেছিলাম!

থাক, এ নিয়ে আফসোস করে আর কী হবে! হারিয়ে গেছে তো আরও কত কিছুই। পত্রলেখক থেকে খেলা নিয়ে নিবন্ধ বা ফিচার লেখায় উত্তরণের ঘটনাটা বরং বলার সময় এসেছে। সাপ্তাহিক 'রোববারে নিয়মিত চিঠি লেখার সময়টাতেই বেশ ঢাকঢোল পিটিয়ে ‘বর্তমান দিনকাল’ নামে একটা ম্যাগাজিন বেরোল। সেই সময়ের তুলনায় যথেষ্টই আধুনিক। ঝকঝকে ছাপা, প্রচলিত ধারার ব্যতিক্রম হয়ে পাতায় পাতায় রঙিন ছবি এবং পুরোটাই খেলা। সেই ম্যাগাজিনের দ্বিতীয় বা তৃতীয় সংখ্যায় ছোট্ট একটা ঘোষণায় চোখ আটকে গেল। আপনি কি খেলা নিয়ে আগ্রহী? খেলা নিয়ে লিখতে চান? তাহলে আপনার লেখা পাঠিয়ে দিন আমাদের এই ঠিকানায়...স্মৃতি থেকে লিখছি বলে একটু এদিক-ওদিক হতে পারে, তবে মোটামুটি এমনই ছিল ভাষাটা। যা দেখার পর আমি সেই রাতেই ক্লাইভ লয়েডকে নিয়ে একটা লেখা লিখে ফেললাম। কিছুদিন আগেই অবসর নিয়েছেন লয়েড, ওয়েস্ট ইন্ডিজকে যেন আর আগের মতো পরাক্রান্ত লাগছে না। এটাই ছিল বিষয়। তখন লেখায় কাব্য করার খুব ঝোঁক ছিল। সেটির ছাপ ছিল হেডিংয়েও–ক্লাইভ লয়েড: ক্রিকেটের অনুপম শিল্পী।

লেখা পাঠিয়ে দিয়ে অধীর অপেক্ষায় দিন গুনছি। প্রতি সপ্তাহে বর্তমান দিনকাল আসে, আমি আক্ষরিক অর্থেই কম্পিত বক্ষে পাতা ওল্টাই। কিন্তু আমার লেখাটা খুঁজে পাই না। মন ভেঙে দেওয়া এমন তিন/চারটি সংখ্যা দেখার পর লেখাটা ছাপা হওয়ার আশা যখন ছেড়েই দিয়েছি, তখনই রোদে পোড়া একটা গনগনে দুপুর আমাকে আনন্দে ভাসিয়ে নিয়ে গেল। সেই মুহূর্তটা এখনো মনে করতে পারি, অনির্বচনীয় সেই অনুভূতিটাও। লেখা যে ছাপা হয়েছে, তা আবিষ্কার করার ঘটনাও খুব নাটকীয়। পরে কোনো এক সময় সেই গল্প করা যাবে।

সেই শুরু, এরপর বলতে গেলে ‘বর্তমান দিনকাল’-এর প্রায় প্রতি সংখ্যাতেই আমার লেখা ছাপা হতে থাকল। আমি ওই ম্যাগাজিনের কাউকে চিনি না, আমাকেও চেনেন না তাঁদের কেউ । ডাকে লেখা পাঠাই, নিয়মিত তা ছাপা হয়। লেখার চেয়ে লেখার বিষয় নিয়ে বেশি ভাবতে হয়। কারণ, আমার সঙ্গে তো কারও যোগাযোগ নেই। এটা অনুমান করা তো আর কঠিন কিছু নয় যে, খুব কমন বিষয়গুলো নিয়ে লিখলে তা ওয়েস্ট পেপার বিনে চলে যাবে। পরের সংখ্যার জন্য অবধারিত সেসব বিষয় নিশ্চয়ই বর্তমান দিনকালসংশ্লিষ্ট কেউই লিখে ফেলেছেন, বা আদ্দিষ্ট হয়ে অন্য কেউ। আমাকে তাই বেছে বেছে এমন একটা বিষয় বের করতে হয়, যা অন্য কেউ লিখবে না।

জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু করার আগে খেলা নিয়ে লেখালেখি শুরুর স্মৃতিটা খুব মনে পড়ছিল বলে তা এমন বিস্তারিত বলে ফেললাম। এবার মনে হয় একটু রাশ টানা উচিত। পরের অংশটা তাই সংক্ষেপে সারি। বর্তমান দিনকালে নিয়মিত লেখা ছাপা হতে থাকার স্বাভাবিক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছিল আত্মবিশ্বাস ও সাহস একটু বেড়ে যাওয়া। তখন বাংলাদেশের প্রায় সব দৈনিক পত্রিকাতেই সাপ্তাহিক খেলার পাতা ছিল। সেখানেও লেখা পাঠাতে শুরু করলাম। ছাপাও হতে থাকল। এর মধ্যে একবার ঢাকায় এসে বর্তমান দিনকালের অফিসে দেখা দিয়ে এলাম, পত্রিকার কর্তাব্যক্তিরা একটু অবাকই হলেন। কঠিন কঠিন বিষয়ে যেসব ‘জ্ঞানগর্ভ’ লেখা লিখেছি, তার সঙ্গে আমার চেহারা বা বয়স, অথবা দুটোই মেলাতে যে ভীষণ সমস্যা হচ্ছিল তাঁদের। বর্তমান দিনকাল অফিসে এক ক্রীড়া সাংবাদিকের সঙ্গে পরিচয়ের সূত্র ধরে একটা চক্কর দিয়ে এলাম বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামেও। সেই ছোটবেলা থেকে যাঁদের লেখা পড়ে এসেছি, তাঁদের অনেকের সঙ্গেই আলাপ-পরিচয় হলো। সেই সূত্রে খুলনায় ফেরার পর লেখার ক্ষেত্রও বাড়ল।

কোলাজ: মনিরুল ইসলাম

ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া শেষ করে ঢাকায় আসার পর আরও বেশি। দৈনিক পত্রিকা-ম্যাগাজিন–সবখানেই লিখি। সন্ধ্যার পর স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতির অফিসে নিয়মিত আড্ডা দিই। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে সহপাঠীদের সঙ্গে তেমন যোগাযোগই নেই, খেলা দেখা আর খেলা নিয়ে লেখা নিয়েই আমি ব্যস্ত। তখনো কিন্তু ক্রীড়া সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নেওয়ার কথা সেভাবে ভাবিইনি। সারা জীবনই আমি হৃদয়চালিত মানুষ। মন যা বলে, তা-ই করি। সেই সময়টাতে আরও বেশি। খেলা দেখছি, খেলা লিখছি–ভালো লাগছে; ঠিক আছে, কিছুদিন এভাবেই চলুক; ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি তো আর উড়ে যাচ্ছে না। পেশা হিসেবে ইঞ্জিনিয়ারিংই করব, খেলা নিয়ে লেখালেখিটা তখনো নাহয় নেশাই হয়ে থাকবে।

নেশা আর পেশা কীভাবে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল, খেলা নিয়ে লেখালেখিই হয়ে গেল জীবন–সেই কাহিনি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন উপলক্ষে বলা হয়েছে। তারপরও এটুকু বলি, ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারিতে আজকের কাগজ পত্রিকাটা না বেরোলে আমার হয়তো পেশাদার ক্রীড়া সাংবাদিক হওয়া হতো না। মহাবিরক্তি সয়ে মাস ছয়েক কাজ করার পর এর কিছুদিন আগেই ইঞ্জিনিয়ারিং চাকরি ছেড়েছি। তরুণ এক সম্পাদকের নেতৃত্বে আরও একঝাঁক তরুণ মিলে নতুন একটা দৈনিক পত্রিকা বের করছে, সেই ডাকে সাড়া দেওয়ায় তাই কোনো বাধাই নেই।

মনে মনে একটা মিশনও ছিল। সংবাদপত্রে খেলার খবর পড়ি, আর প্রায়ই মনে হয়, এটা তো এভাবে না লিখে ওভাবে লেখা যেত। এই ছবিটাতে তো একটা গল্প আছে, এমন দায়সারা ক্যাপশনের বদলে কত সুন্দর করে তা লেখা যেত! আজকের কাগজে যোগ দেওয়া মানেই এসব ভাবনা কাজে লাগানোর সুযোগ। লাগালামও। বাংলাদেশের সাংবাদিকতায় নতুন এক ধারার সূচনা করেছিল আজকের কাগজ। এটাকে যদি বিপ্লব বলেন, খেলার পাতা সেই বিপ্লবের পুরোভাগেই ছিল। অবাধ স্বাধীনতা পেয়ে যথেচ্ছ এক্সপেরিমেন্ট করেছি। সাংবাদিকতায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকাটা যাতে সাহায্যই করেছে। এটা এভাবে করতে হয়, এভাবে করাটাই নিয়ম–এই শৃঙ্খল কখনো বেঁধে রাখেনি। নিজে যেহেতু নিবিষ্ট পাঠক ছিলাম, সবই চিন্তা করেছি পাঠকের দৃষ্টিকোণ থেকে। এভাবে লিখলে যদি পড়তে ভালো লাগে, তাহলে কেন তা লেখা হবে না?

আজকের কাগজ থেকে ভোরের কাগজ হয়ে প্রথম আলো–প্রায় তিন দশক সাংবাদিকতার বিবর্তনই শুধু দেখিনি, প্রত্যক্ষভাবে এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকায় হয়তো পরোক্ষভাবে নিজেও কিছু ভূমিকা রেখে থাকতে পারি। ইতিহাসের অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে এই সময়ের সাংবাদিকতা সবচেয়ে বেশি পরিবর্তনের সাক্ষী। সবচেয়ে বড় যে পরিবর্তনের কথা বলতে হয়, তা হলো, আমার সাংবাদিকতা শুরুর সময় এবং এরপরও আরও অনেক দিন সংবাদপত্রই ছিল বিস্তারিত সংবাদ পাওয়ার একমাত্র মাধ্যম। তরুণ প্রজন্ম যে সময়টার কথা এখন কল্পনাও করতে পারবে না। টেলিভিশন-অনলাইন-সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এখন যেভাবে প্রতিনিয়ত খবরে ভাসিয়ে দিচ্ছে, তাতে সেই সময়টার কথা ভাবলে নিজেরই তো একটু অবাক লাগে। আগে পাঠক খবর জানতে পত্রিকা পড়ত, এখন খবর জেনে তারপর পত্রিকা পড়ে। সংবাদপত্রের জন্য এ এক কঠিন চ্যালেঞ্জ।

দাবি করতেই পারি, বাংলাদেশে ক্রীড়া সাংবাদিকতাই সবার আগে এই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিল এবং তা জয় করার একটা পথও সম্ভবত দেখিয়ে রেখেছিল। বোঝাতে সুবিধা হবে বলে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথাই বলি। আমার সাংবাদিকতা জীবন শুরুর সময়টায় আজকের মতো ঘরে বসে দেশ-বিদেশের খেলা দেখার কোনো সুযোগ ছিল না। পাঠক মূলত পত্রিকা পড়েই খেলার বিস্তারিত জানতেন। তখন ক্রীড়া সাংবাদিকের জন্য চ্যালেঞ্জ ছিল, পাঠকের না-দেখা খেলাটা লেখার মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা। একসময় দেশে ডিশ অ্যান্টেনা এলো, লেখার ধরনেও পরিবর্তন আনাটা হয়ে দাঁড়াল সময়ের দাবি। যে পাঠকের জন্য লিখছি, তাঁর অধিকাংশই তো খেলা দেখেছেন, এক্সপার্টদের কমেন্ট্রি শুনেছেন, খেলাটা যদি ক্রিকেট হয়, ম্যাচ শেষে দুই অধিনায়ক ও ম্যান অব দ্য ম্যাচের ইন্টারভিউও। পরে ম্যাচ নিয়ে আরও নানা কিছু। সবকিছু জানা হয়ে গেছে, এমন একটা ম্যাচের খবর পরদিন পাঠক কেন পড়বেন?

কোলাজ: মনিরুল ইসলাম

পড়বেন তখনই, যদি লেখায় বাড়তি তথ্য থাকে, খেলাটা নিয়ে লেখকের নিজস্ব উপলব্ধির কথা থাকে এবং সবচেয়ে যা গুরুত্বপূর্ণ, লেখার উপস্থাপন ভঙ্গিতে কোনো নতুনত্ব থাকে। শুধুই নৈর্ব্যক্তিকভাবে ম্যাচের ঘটনাপ্রবাহ বর্ণনা করে গেলে পাঠকের তাতে বিরক্ত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা; কারণ, এসব তো তিনি নিজেই দেখেছেন। না দেখে থাকলেও কোনো না কোনোভাবে জেনে গেছেন। দেখা বা জানার পর নিজস্ব একটা ব্যাখ্যাও দাঁড় করিয়েছেন। পরদিন লেখা পড়ার তাড়না তিনি তখনই বোধ করবেন, যদি সেই ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ পেশাদার ক্রীড়া সাংবাদিকের সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়ার সুযোগ থাকে। স্কুপ বা এক্সক্লুসিভ কোনো নিউজ ছাড়া খেলার অন্য কোনো লেখায় তাই ক্রীড়া সাংবাদিকের নির্মোহ থেকে শুধু ঘটনা বর্ণনা করে যাওয়ার সুযোগ আছে বলে আমি মনে করি না; বরং সেই ঘটনা তাঁর মনে কী অভিঘাত সৃষ্টি করেছে, বা সেটির তাৎপর্য কিংবা গুরুত্ব কী, সেই কথাটা পাঠককে জানাতে হবে। তা বোঝাতে গিয়ে প্রসঙ্গক্রমে খেলার বাইরের অনেক কিছুও লেখায় চলে আসতে পারে।

শুরুতে অনেকের অস্বস্তি থাকলেও বাংলাদেশের ক্রীড়া সাংবাদিকতায় এই মতবাদের চর্চা ক্রমশ সাংবাদিকতার অন্য ক্ষেত্রগুলোতেও অনুসৃত হয়েছে বলেই দেখতে পাই।

নতুন ওয়েবসাইট কী এবং কেন, তা জানাতে গিয়ে নিজের ক্রীড়া সাংবাদিক হয়ে ওঠার গল্প এবং বাংলাদেশে ক্রীড়া সাংবাদিকতার বিবর্তন নিয়ে বেশ বড় একটা আলোচনাই ফেঁদে বসলাম দেখছি। আপনার ধৈর্যচ্যুতি ঘটার আগে যে প্রশ্নের উত্তর পেতে লেখাটা পড়তে শুরু করেছিলেন, এবার মনে হয় তা দেওয়া উচিত–কেন এই ওয়েবসাইট? কেন উৎপলশুভ্রডটকম?

উদ্দেশ্যটা এককথায় বলা কঠিন। এক-এক করে বলি। প্রথম কারণটা একান্তই ব্যক্তিগত। এত বছর প্রচলিত ধারার ক্রীড়া সাংবাদিকতা করার পর নিজেকে নতুন এক চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড় করানো। মুক্ত-স্বাধীন থেকে খেলা নিয়ে লেখার বাইরেও আরও অনেক কিছু করা। এক দিনে তো আর সব হবে না। তারপরও পাঠক/দর্শককে মোটামুটি একটা ধারণা দিয়ে রাখি।

পাঠকের পাশে দর্শক যোগ করাটা যুগের দাবি। যে দাবি মেটাতে এই ওয়েবসাইটে লেখার সঙ্গে ভিডিও থাকবে। ইউটিউব চ্যানেলে একেবারে টাটকা কোনো ঘটনার বিশ্লেষণ যেমন থাকবে, তেমনি চিরকালীন অনেক কিছুও নতুন আঙিকে বিশ্লেষণের চেষ্টা।

তবে সবার আগে বোধ হয় জানিয়ে দেওয়া উচিত, উৎপলশুভ্রডটকম প্রচলিত অর্থে নিউজপোর্টাল নয়। নতুন খবরও এখানে থাকতেই পারে, তবে এই ওয়েবসাইটে মূলত থাকবে বিশ্লেষণ। খবরের পেছনের খবর, কোনো ঘটনার তাৎপর্য বা সম্ভাব্য সুদূরপ্রসারী প্রভাব নিয়ে আলোচনা, সাদাকে সাদা বলা, কালোকে কালো। শুধু ক্রিকেট বা ফুটবলে সীমাবদ্ধ না থেকে আমরা যেগুলোকে ‘ছোট খেলা’ বলি, সেসব খেলার ন্যায্য দাবির পক্ষেও আওয়াজ তোলার কাজটাও করতে চাই এখানে। বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে একটা বদলের ডাক দেওয়ারও কি সময় হয়নি এখন?

কোলাজ: মনিরুল ইসলাম

কতটুকু কী পারব, সময়ই তা বলে দেবে। তবে একটা প্রতিশ্রুতি তো অন্তত দিয়েই রাখতে পারি, এখানে যা কিছু লেখা হবে, যা কিছু বলা, তাতে কোনো পক্ষপাত থাকবে না। কোনো পিছুটান তো নয়ই।

এই ওয়েবসাইটের বিভিন্ন বিভাগে একটু ঘুরে এলেই দেখতে পাবেন, খেলা নিয়ে আমার এত বছরের লেখালেখি থেকে নির্বাচিত কিছু লেখা এরই মধ্যে এখানে বিদ্যমান। এই সংখ্যা ক্রমশই বাড়ানোর ইচ্ছা। নিজের লেখার নিয়ে মোহাচ্ছন্ন থাকা অবশ্যই এর কারণ নয়। বরং অনেক লেখাই আবার পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে, এটা কী লিখেছিলাম! ভুলে এডিট করতেও শুরু করে দিয়েছিলাম দু-একটা লেখা। পরে জিভ কেটে যা আছে, তা-ই রেখে দিয়েছি। ভালো-মন্দ মিলিয়ে সেই সময়ের আমেজটাই যেন পাঠক পান। পুরোনো লেখা দেওয়ার আসল কারণ অন্য। আজ ক্রিকেটে উৎসাহী ২০ বছরের যে তরুণ, বাংলাদেশ প্রথম টেস্ট খেলার সময় তো তার জন্মই হয়নি। বাংলাদেশের অভিষেক টেস্টের ম্যাচ রিপোর্ট পড়ার আগ্রহ তো তার থাকতেই পারে।

এমন আরও কত কিছুই তো আছে, যা বারবার ফিরে দেখার মতো। এমন তো প্রায়ই হয়, হঠাৎ কোনো পাঠক পুরোনো কোনো লেখা আবার পড়ার আগ্রহ জানিয়ে বার্তা পাঠান। সব সময়ই তা লেখার গুণে, তা হয়তো নয়; বরং নির্দিষ্ট কোনো ম্যাচ, নির্দিষ্ট কোনো পারফরম্যান্স, নির্দিষ্ট কোনো ঘটনা এমনই মনে দাগ কেটে যায় যে, আবারও তা নিয়ে পড়তে ইচ্ছা করে। আপনার মনে এমন কোনো ইচ্ছা জাগলে তা জানাতে পারেন। নতুন কোনো বিষয়ে আমার মতামত জানার আগ্রহ হলে, তা-ও। এ জন্য 'আপনার পাতা' নামে আলাদা একটি বিভাগই আছে, যা আক্ষরিক অর্থেই আপনার পাতা, আপনাদের পাতা। এই ওয়েবসাইটে প্রকাশিত কোনো লেখা বা ভিডিও নিয়ে ভিন্নমত জানানোর সুযোগ আছে। এর ভালো-মন্দ, দেশ-বিদেশের যেকোনো খেলা বা খেলোয়াড় নিয়ে আপনার কিছু বলার থাকলে চিঠি লেখার সুযোগ। কোনো প্রশ্ন থাকলে তা-ও করে ফেলতে পারেন নির্দ্বিধায়। আপনার প্রশ্ন আর আমার উত্তর নিয়ে হয়তো সূচনা হতে পারে নতুন কোনো আলোচনার। অর্ণবের গানের পঙ্‌ক্তি ধার নিয়ে বলি, হোক কলরব! এই ওয়েবসাইটকে আরও অনেক কিছুর সঙ্গে তর্কবিতর্কের একটা ফোরাম হিসেবেও গড়ে তোলার যে লক্ষ্য, আপনার সক্রিয় অংশগ্রহণেই শুধু তা সফল করে তোলা সম্ভব।

শুধু ভিন্নমতই জানাবেন, চিঠি লিখবেন, আর প্রশ্ন করবেন, তা কেন? চাইলে, এখানে লিখতে পারেন আপনিও। সেই লেখা তা শুধু 'আপনার পাতা' বিভাগেই পড়ে থাকবে না, কখনো হয়তো জায়গা করে নেবে হোম পেজেও। আপনি যেমন লিখবেন, তেমনি এই ওয়েবসাইটে লিখবেন বাংলা ভাষায় সেরা ক্রীড়া লেখকেরা। অতিথি কলামে সাবেক ও বর্তমান খেলোয়াড়দের কলামই-বা থাকবে না কেন?

এতক্ষণ যা যা বললাম, সেগুলোর কোনোটাই গৌণ নয়। তবে এগুলোর বাইরেও বড় একটা সামাজিক আন্দোলনের মঞ্চ হয়ে উঠতে চায় এই ওয়েবসাইট। খেলার মূল যে উদ্দেশ্য–শারীরিক ও মানসিক বিকাশ– সেই চেতনায় সবাইকে উজ্জীবিত করতে সমস্বরে একটা স্লোগান তুলতে চাই এখানে–খেলা হোক খেলার আনন্দে। শিশুরা খেলুক, কিশোরেরা খেলুক, খেলার আনন্দে খেলুক সব বয়সের মানুষ। বিকেলবেলায় আবার মুখরিত হয়ে উঠুক বিরান পড়ে থাকা খেলার মাঠগুলো। শুধু লেখায় সেই আহ্বান জানানোতেই দায়িত্ব শেষ মনে করলে সেই সুবচন নিশ্চিত নির্বাসনে যাবে। অতিমারিসৃষ্ট এই দুর্যোগকাল শেষ হলে মাঠে নেমেই সবাইকে মাঠে আসার ডাক দেওয়ার পরিকল্পনাও আছে।

পরিকল্পনা আছে আরও অনেক কিছুরই। এক দিনে হয়তো সব হবে না। তবে এটা কে না জানে, দীর্ঘতম যাত্রাও সূচিত হয় একটি পদক্ষেপের মাধ্যমেই। প্রথম পদক্ষেপটা আমিই ফেললাম, এর পরের প্রতিটিতেই আপনাকে যেন সঙ্গে পাই।

আপাতত একটা কৃতজ্ঞতা জানানোর সময় হয়েছে। শুরু থেকেই সিটি ব্যাংকের অকুণ্ঠ সমর্থন না পেলে এই ওয়েবসাইট এত দ্রুত আলোর মুখ দেখত বলে মনে হয় না। সিটি ব্যাংককে প্রকাশ্যে ধন্যবাদ না জানানোটা তাই অকৃতজ্ঞতার শামিল হবে। নাম উল্লেখ করেই ধন্যবাদ দিতে চাই সিটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান আজিজ আল কায়সার টিটো এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিনকে। এই ওয়েবসাইটের স্বপ্ন বাস্তবায়নে বড় ভূমিকা এই দুজনের। ইপিলিয়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান রিয়াজউদ্দিন আল মামুনের সমর্থনের কথাও বলতে হয়। নতুন একটা যাত্রা শুরুর আগে একটু নার্ভাসনেস তো থাকেই। মামুন ভাই তা জেনে দারুণ একটা কথা বলেছিলেন, ‘মাঠে নেমে যান। জীবনটাকে আর্ট ফিল্ম বানাবেন কেন, তা একটা থ্রিলার হোক।’ একটা ওয়েবসাইট আলোর মুখ দেখার আগেই যারা বিজ্ঞাপন দিয়ে দিয়েছেন, তাদের ধন্যবাদ না জানালেও তো অন্যায় হয়।

সাংবাদিকতা ক্যারিয়ারের তিন দশকের মাথায় এসে নতুন এই যাত্রা শুরু করতে আরও অনেকেই অনেকভাবে সাহায্য করেছেন। নাম বলতে গেলে সেই তালিকা অনেক দীর্ঘ হয়ে যাবে। শুধু এটুকু বলি, আপনাদের নাম আমার হৃদয়ে লেখা আছে।

সবকিছুর পর কথা তো সেই একটাই–এই ওয়েবসাইটের সাফল্য-ব্যর্থতা, সব পরিকল্পনার বাস্তবায়ন অনেকটাই নির্ভর করছে আপনার ওপর।

আশা করছি, আপনারা পাশেই আছেন। পাশেই থাকবেন।

উৎপলশুভ্রডটকমে আপনাদের স্বাগতম।