ফ্রি ফায়ার-পাবজি, না হলে বাজি!

উৎপল শুভ্র নির্বাচিত পাঠকের লেখা

রঞ্জু খন্দকার

২৫ জুন ২০২১

ফ্রি ফায়ার-পাবজি, না হলে বাজি!

এক সময় গ্রাম-গঞ্জের চিরচেনা ছবি ছিল এটি। এখন যা হারিয়ে যেতে বসেছে। ছবি: গেটি ইমেজেস

হারিয়ে যাচ্ছে লোকজ খেলাধুলা। গ্রাম-গঞ্জের শিশু কিশোরেরাও এখন মাঠের খেলা ছেড়ে মত্ত মোবাইলের ভিডিও গেমে। নতুন প্রজন্মের সুস্থ বিকাশের জন্য যা এক বড় বাধা। এ নিয়েই পীড়িত এক পাঠক লিখে পাঠিয়েছেন তাঁর নিজের গ্রামের অভিজ্ঞতা।

গ্রামের পুকুরপাড়ে গাছের ছায়ায় উঁচু করে মাচা বাঁধা। স্থানীয়ভাবে যেটাকে বলা হয় টং। তাতে বসা এক কিশোর। তার হাতের মুঠোয় স্মার্টফোন। সামনে পুকুর। তাতে টলটলে জল। কিশোরের চোখ সেদিকে নয়। তার দৃষ্টি নিবদ্ধ মুঠোফোনের পর্দায়। সেখান থেকে আসছে ঠা, ঠা গুলির শব্দ। অনলাইনে কিশোর খেলছে ব্যাটল গেম 'ফ্রি ফায়ার'।

কিশোরের পাশেই জটলা করে তরুণ-যুবকদের একটি দল বসা। তারাও মুঠোফোনে খেলছে--লুডু। ওই কিশোর-তরুণ-যুবকেরা যেদিকে পেছন ফিরে বসেছেন, সেদিকে বিস্তৃত মাঠ। কাটা ধানগাছের ফেলে যাওয়া অংশ জানান দিচ্ছে, কদিন আগেও সেখানে ছিল ফসলের সমারোহ। তা এখন খাঁ খাঁ করছে। সেই উদোম মাঠে আদুল গায়ে ঘুড়ি ওড়াচ্ছে দুই শিশু।

এই দৃশ্য গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার প্রত্যন্ত কুমারগাড়ী গ্রামের। চাইলে এটিকে বাংলাদেশের যেকোনো গ্রামের খেলাধুলার প্রতীকী চিত্রও ধরা যেতে পারে। শহরের শিশুদের মতো গ্রামের শিশুরাও এখন মাঠ খালি রেখে মুঠোফোনে আসক্ত। গোল্লাছুট, দাঁড়িয়াবান্ধা, ক্রিকেট, ফুটবল, ফেলে ফ্রি ফায়ার, ক্ল্যাশ অব ক্ল্যান, লুডো, পাবজি’র মতো ভিডিও গেমে আসক্ত।

এই লেখার শুরুতেই টংয়ের ওপর বসে থাকা যে কিশোরের উল্লেখ করা হয়েছে, তার নাম শাওন খন্দকার। পড়ে গাইবান্ধা শহরের একটা কলেজে। করোনার কারণে ক্লাস বন্ধ। তাই বাড়িতে এসেছে। অনলাইনে গেম খেলেই এখন তার বেশির ভাগ সময় কাটে।

করোনার কারণেই না হয় শাওন সময় কাটাতে বেছে নিয়েছে ভিডিও গেম। কিন্তু করোনা আসার আগে শাওন কিংবা তার বয়সী ছেলেমেয়েরা তাদের ফাঁকা সময়ের কতটা ব্যয় করেছে খেলাধুলার পেছনে? আসলে নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা দিনকে দিন হয়ে উঠছে খেলাধুলা বিমুখ! কারও কাছে মনে হতে পারে এটা একটু বেশি সরলীকরণ, কিন্তু বাস্তবতা এটাই। শারীরিক পরিশ্রম আছে, এমন খেলা খেললে শরীর সুস্থ থাকে, ভালো থাকে মন। নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা এটা যে জানে না, তা নয়। কিন্তু জেনেও তারা খেলাধুলা বিমুখ! 

গোল্লাছুট, দাঁড়িয়াবান্ধা, বউচির মতো এক সময়ের জনপ্রিয় লোকজ খেলাগুলো শহরের ছেলেমেয়েদের কাছে তো একদমই অজানা। গ্রাম-গঞ্জ থেকেও সে সব হারিয়ে যেতে বসেছে। খেলাগুলো কি, কীভাবে খেলে—গ্রামের সব শিশু-কিশোরও কি বলতে পারবে?

পারবে না। পারবে কী করে? তারাও যে মুঠোফোনের ‘আত্মঘাতী’ সংস্কৃতির বাইরে নয়! বড়দের কাছ থেকে নিয়ে গ্রামের শিশুরাও এখন মোবাইলে গেমস খেলে। ইউটিউব দেখে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিচিত হয়ে ওঠে ফ্রি ফায়ার, ক্ল্যাশ অব ক্ল্যান, লুডো, পাবজি’র মতো ভিডিও  গেমের সঙ্গে। অনলাইনে যারা গেম খেলে না, তাদেরও অবসর সময়ের বেশির ভাগই ব্যয় হয় ফেসবুকিংয়ে!

স্কুল বন্ধ থাকার কারণে শিক্ষার্থীরা মাঠে আসে না। আশপাশের কিশোর-তরুণদেরও মাঠের খেলাধুলায় তেমন আগ্রহ নেই। তাই মাঠটিতে বেশির ভাগ সময়ই গরু চড়ে বেড়ায়। আর ফসল ওঠার সময় ফসল মাড়াইয়ের কাজে এটিকে ব্যবহার করা হয়।

শাওনের পাশে বসে থাকা তরুণ-যুবকদের সঙ্গে কথা হয়। ছেলেবেলায় তাঁরা দাঁড়িয়াবান্ধা, গোল্লাছুট খেলেছেন। পরে ফুটবল, ক্রিকেটও। কিন্তু সেসব এখন দূর অতীতের স্মৃতি। লোকজ খেলাধুলা এখন আর হয়ই না। ফুটবল, ক্রিকেট খেলার প্রবণতাটাও কমে এসেছে। ঈদ কিংবা অন্যান্য উৎসব উপলক্ষে মাঝেমধ্যে ক্রিকেট, ফুটবল ম্যাচ হয়। এ ছাড়া বাজি হলে ম্যাচ হয়। এ পাড়ার সঙ্গে ও পাড়ার ম্যাচ, কিংবা স্থানীয় কোনো এলাকার বিবাহিতদের সঙ্গে অবিবাহিতদের ম্যাচ। নিয়মিত অনুশীলন করে মাঠে নামার চলটা হারিয়ে গেছে কিংবা হারিয়ে যেতে বসেছে।

কুমারগাড়ী গ্রামের দক্ষিণপ্রান্তে হালিমনগর দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের অবস্থান। এর পাশেই কুমারগাড়ী ১নং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। দুটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামনে বিরাট খেলার মাঠ। আম, কাঁঠাল, কৃষ্ণচূড়া গাছে ঘেরা। কিন্তু মাঠ খালি। ছেলেমেয়েদের কোলাহল নেই। 

স্কুল মাঠের পাশের এলাকার বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, স্কুল বন্ধ থাকার কারণে শিক্ষার্থীরা মাঠে আসে না। আশপাশের কিশোর-তরুণদেরও মাঠের খেলাধুলায় তেমন আগ্রহ নেই। তাই মাঠটিতে বেশির ভাগ সময়ই গরু চড়ে বেড়ায়। আর ফসল ওঠার সময় ফসল মাড়াইয়ের কাজে এটিকে ব্যবহার করা হয়।

হালিমনগর হাইস্কুলের সামান্য পূর্বদিকে ছাতিয়ানতলা এলাকায় বছরখানেক ধরে ছোট বাজার বসে। অনেকের কাছে এটি নয়াবাজার নামে পরিচিত। সেই বাজারে দোকানের সংখ্যা ১৩টি। যার চারটিতেই ক্যারম বোর্ড খেলার ব্যবস্থা। সেখানে ঠিকই ক্যারম খেলছে কিশোর-তরুণেরা। কোনো কোনো বোর্ডে খেলা হচ্ছে বাজিতে। বোর্ডের পাশে জটলা করে খেলা দেখছেন অন্যরা।

তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ক্যারম তারা মনের আনন্দেই খেলে। তবে কেউ কেউ বাজি ধরেও খেলে। অনেকে বাজি ধরে লুডুও খেলে। সবচেয়ে বেশি বাজি হয় বাইরের টুর্নামেন্টে। বিপিএল, আইপিএলের মতো টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট ম্যাচকে ঘিরে বাজি ধরা সেখানে নিত্যদিনের ঘটনা। এতে আর্থিকভাবে ক্ষতির মুখোমুখিও হয়েছেন কেউ কেউ।

বাংলাদেশের গ্রামে গঞ্জের এমন পরিচিত দৃশ্যও হয়তো এক সময় হারিয়ে যাবে

কুমারগাড়ী গ্রামের বাসিন্দা জাহাঙ্গীর কবির গাইবান্ধা সদর উপজেলার হরিণ সিংহা আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক। তিনি বললেন, 'আমরা যখন কিশোর ছিলাম কিংবা তরুণ, মাঠ দাপিয়ে বেড়াতাম। কী রোদ, কী বৃষ্টি কিছুই পরোয়া করতাম না। কিন্তু এখনকার শিশু-কিশোরেরা সম্ভবত আরামপ্রিয়। তাই তারা মুঠোফোনে ভিডিও গেম কিংবা লুড়ু-ক্যারমকেই বেছে নিয়েছে।’

লুডু-ক্যারমের বড় একটা অসুবিধা দেখছেন জাহাঙ্গীর কবির। পরিশ্রম করতে হয় না বলেই এসব খেলায় বাড়তি ‘ব্যাঞ্জনা’র জন্য ধরা হয় বাজি। পরিবারের সদস্যরা মিলে খেললে সেটা আলাদা কথা, কিন্তু যখন সমবয়সী সব কিশোররা-তরুণরা যখন খেলে, তখন হার-জিতের সঙ্গে টাকা পাওয়া কিংবা টাকা খোয়ানোর ব্যাপারটাও জড়িয়ে যায়। ‘এটা উঠতি শিশু কিংবা কিশোরদের শরীর-মন, সর্বোপরি সমাজের জন্য ভালো কিছু হতে পারে না। অভিভাবকদের এ বিষয়ে নজর দিতে হবে।'—বললেন জাহাঙ্গীর কবির।

যে দৃশ্যের অবতারণায় এই লেখার শুরু, শেষের আগে আবার ফিরে যাওয়া যাক সেখানে। কাটা ধানের উদোম জমিনে ঘুড়ি ওড়াচ্ছিল যে দুই শিশু, কিছুক্ষণ পর তাদের সঙ্গে যোগ দেয় আরেকজন। আকাশে উড়ছে এখন তিনটি রঙিন ঘুড়ি। যেন রঙিন শৈশবের প্রতীকী ছবি। এই রঙিন শৈশব রক্ষা করতে অভিভাবকদের এগিয়ে আসার বিকল্প আছে কি?

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×