মনে আছে অ্যান্থনি নেস্টিকে?

উৎপল শুভ্র

২১ সেপ্টেম্বর ২০২১

মনে আছে অ্যান্থনি নেস্টিকে?

অলিম্পিকে সুরিনামের জাতীয় সঙ্গীতই শুধু বাজেনি তাঁর কারণে, দেশটার নামও বিশ্বে পরিচিত করে তুলেছিলেন অ্যান্থনি নেস্টি। সিউল অলিম্পিকে ১০০ মিটার বাটারফ্লাইয়ে সোনা জিতে ভেঙে দিয়েছিলেন ম্যাট বিওন্ডির এক অলিম্পিকে মার্ক স্পিৎজের ৭টি সোনা জয়ের রেকর্ড ছোঁয়ার স্বপ্নও। অলিম্পিকে এককভাবে সাঁতারে সোনাজয়ী প্রথম কৃষ্ণাঙ্গও তিনি।

প্রথম প্রকাশ: ২৭ জুলাই ২০১২। প্রথম আলো।

চেনা অনেকের সঙ্গে অনেক দিন পর দেখা হচ্ছে। নতুন করে পরিচয় হচ্ছে অচেনা কারও সঙ্গে। আসল কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে অলিম্পিকের মেইন প্রেস সেন্টার, সংক্ষেপে এমপিসিতে সাংবাদিকেরা যেন ওয়ার্মআপ করে নিচ্ছেন। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশ থেকেই কেউ না কেউ আছেন, সংখ্যাটা ১০ হাজারের মতো। হোটেলে ট্রেনে, মিডিয়া বাসের মতো এমপিসিতেও প্রতিদিনই পরিচয় হচ্ছে কারও না কারও সঙ্গে। পরশু দুপুরে যেমন হলো ডিজনি রোমিওর সঙ্গে।

এমপিসিতে বসে কাজ করছি। পাশের চেয়ারটা টেনে বসতে বসতে প্রায় দৈত্যাকৃতি চেহারার কৃষ্ণবরণ লোকটি ধবধবে সাদা হাসি দিল। ভদ্রতার দাবিতে সেই হাসির জবাব দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, 'কোন দেশ থেকে?' 'সুরিনাম'—উত্তরটা শুনেই মুখ থেকে বেরিয়ে গেল, 'অ্যান্থনি নেস্টি!’নেস্ট সেদিন ইতিহাস গড়েছিলেন।

রোমিও (নামটা শুনে রসিকতা করেছি, তোমার জুলিয়েট কই–রোমিও হেসে বলেছে, জানতাম তুমি এই রসিকতাটা করবে, সবাই তা করে) মহা বিস্মিত, 'তুমি অ্যান্থনিকে চেনো?' আমি বললাম, বাংলাদেশে আমার বয়সী সবাই চেনে। ১৯৮৮ সিউল অলিম্পিকে ১০০ মিটার বাটারফ্লাইয়ে সোনা জিতে গায়ানার পাশে দক্ষিণ আমেরিকার ছোট্ট দেশ সুরিনামকে পুরো বিশ্বে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন অ্যান্থনি নেস্টি। মাত্র সাড়ে পাঁচ লাখ লোকের দেশ, নেস্টির ওই কীর্তির সময় জনসংখ্যা আরও কম ছিল। বাংলাদেশে আমরা আফসোসও করেছি, সুরিনাম যদি অলিম্পিকে সোনা জিততে পারে, বাংলাদেশ কেন পারে না?

নেস্টি সম্পর্কে এত কিছু জানি দেখে রোমিওই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বলল, 'ওর সঙ্গে কথা বলতে চাও?' মানে, নেস্টিকে কোথায় পাব? রোমিও জানাল, অ্যান্থনি নেস্টি এই অলিম্পিকেও এসেছেন। যুক্তরাষ্ট্রে একটা সুইমিং ক্লাবের কোচ। তাঁর আটজন ছাত্র অংশ নিচ্ছেন এই অলিম্পিকে। ওই আট সাঁতারু কেম্যান আইল্যান্ড, তিউনিসিয়া, পোল্যান্ড, ভেনেজুয়েলা, রাশিয়ার সঙ্গে সুরিনামের দুই সাঁতারুর কোচের দায়িত্বও কাঁধে তুলে নিয়েছেন। রোমিও একটু আগেই নেস্টির সঙ্গে কথা বলে এসেছেন, আমাকেও নিয়ে গেলেন মহা উৎসাহভরে।

তাঁকে নিয়ে বাংলাদেশের এক সাংবাদিকের আগ্রহ দেখে নেস্টি যারপরনাই বিস্মিত। খুবই মৃদুভাষী ভদ্রলোক। সুরিনাম থেকে কীভাবে অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন, সেই রহস্যটা আগেও কিছুটা জানা ছিল। সেটি আরও পরিষ্কার হলো নেস্টির কথায়। ছাত্রজীবনেই আমেরিকা পাড়ি জমিয়েছিলেন বলেই জিততে পেরেছেন অলিম্পিক সোনা, 'সুরিনামে এখনো খুব উন্নত প্রশিক্ষণের সুযোগ নেই, তখন তো আরও ছিল না।'

তবে অলিম্পিকে তো উড়িয়েছেন সুরিনামের পতাকাই। ওই সাফল্যের পর তাঁর ছবি দিয়ে স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশিত হয়েছে, স্বর্ণমুদ্রা ও রৌপ্যমুদ্রাও। ব্যাংক নোটে তাঁর ছবি ছাপা হয়েছে, সুরিনাম এয়ারওয়েজ একটি বিমানের নাম দিয়েছে তাঁর নামে। এখনো সুরিনামে জাতীয় বীর। বছরে বেশ কয়েকবার যাওয়া-আসা হয়। ডিসেম্বরে তো অবশ্যই। যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার আগে সুরিনামের যে ক্লাবে ছিলেন, প্রতিবছর ডিসেম্বরে সেটি ‘অ্যান্থনি নেস্টি ইন্টারন্যাশনাল সুইমিং' নামে একটা প্রতিযোগিতার আয়োজন করে।নেস্টি এখন

এবারের অলিম্পিক শুরুর আগে বাংলাদেশ নিয়ে একটা খবর বিশ্ব মিডিয়ায় সাড়ম্বরে প্রচারিত হয়েছে। যথারীতি ভালো কোনো খবর নয়। যদিও সেটিকেও বাংলাদেশের একটা ‘অলিম্পিক রেকর্ড' বলে চালিয়ে দেওয়া যায়। বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ, যারা অলিম্পিকে কোনো পদক জেতেনি। ২০৪টি দেশের মধ্যে ৮০টিই অলিম্পিকে কোনো পদক জেতেনি, তবে বেশির ভাগ দেশই পুঁচকে। পদক না জেতা দেশের তালিকায় জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বে অষ্টম বাংলাদেশের পর আছে মিয়ানমার (২৫তম) ও নেপাল (৪৫তম)।

জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বে ১৯৫তম টোঙ্গার অলিম্পিকে রুপা আছে, ব্রোঞ্জ আছে ১৮১তম বারবাডোজের। কম জনসংখ্যা নিয়ে সফলতম দেশ বাহামা (১৭৭তম)-- অলিম্পিকে ১০টি পদক, যার চারটিই সোনা। বাংলাদেশের জন্য আরও গ্লানিকর হলো, সেই ১৯৮৪ সাল থেকে অলিম্পিকে অংশ নিয়ে এলেও কখনোই অলিম্পিকের জন্য নির্ধারিত মানদণ্ড অর্জন করে অংশ নিতে পারেননি কেউ। আইওসির 'ওয়াইল্ড কার্ড' বদান্যতাতেই বাংলাদেশের অলিম্পিক ভ্রমণের সুযোগ।

এত সব কথা তো আর নেস্টিকে বলা যায় না। শুধু বললাম, আপনার ওই সাফল্যের পর আমরা বলেছি, সুরিনাম পারলে বাংলাদেশ পারবে না কেন? নেস্টি হাসলেন, 'তা হলে তো আমি অনুপ্রেরণার কাজ করেছি।' কিন্তু পেশাদারির এই যুগে শুধু অনুপ্রেরণা দিয়ে কি আর কিছু হয়!

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×