অবশেষে অলিম্পিক সোনা!

২০১২ লন্ডন অলিম্পিক

উৎপল শুভ্র

২১ জুলাই ২০২১

অবশেষে অলিম্পিক সোনা!

এথেন্সে রুপা জিতেছিলেন, জিতেছিলেন বেইজিংয়েও। কিন্তু মাঝের চারটি বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের তিনটিই জিতেছেন যিনি, তাঁর কাছে রুপা জয়ের মানে তো একটাই, 'সোনা হারিয়েছি।' অবশেষে লন্ডনে এসে সোনার দেখা পেয়েছিলেন ফেলিক্স। এর আগের দুটি স্বর্ণ হাতছাড়া হয়েছিল যাঁর কাছে, সেই ভেরোনিকা ক্যাম্পবেলকে পেছনে ফেলে

প্রথম প্রকাশ: ১০ আগস্ট ২০১২। প্রথম আলো

অ-ব-শে-ষে...

অ্যালিসন ফেলিক্সের মনে শুধু এই শব্দটাই গুঞ্জরিত হচ্ছিল। কত অলস দুপুর, কত বিনিদ্র রাত এই স্বপ্নের সঙ্গে একা একা কথা বলেছেন। অবশেষে, অবশেষে ধরা দিল সেই স্বপ্ন। অলিম্পিক সোনা!

‘ফাইনালি’ ‘ফাইনালি’...শব্দটা নিজেও বললেন বারবার। ‘অ-ব-শে-ষে...কত দিন ধরে এটির জন্য অপেক্ষা! আমি আনন্দে ভাসছি’—পরশু রাতে ২০০ মিটারে সোনা জয়ের পর আপ্লুত অ্যালিসন ফেলিক্সের কত কিছুই না মনে পড়েছে! সবচেয়ে বেশি চার বছর আগে বেইজিংয়ের সেই রাত।

বেইজিং অলিম্পিকের আগে দুটি বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপেই ২০০ মিটারের সোনা তাঁর। অলিম্পিকে তাই অবধারিত ফেবারিট। সেই ফেবারিটকে সন্তুষ্ট থাকতে হলো রুপা নিয়েই। অ্যালিসন ফেলিক্সের আগে শেষ করলেন ভেরোনিকা ক্যাম্পবেল-ব্রাউন। হতাশায় ট্র্যাকেই ভেঙে পড়েছিলেন অ্যালিসন।

এর চার বছর আগে এথেন্সেও এমনই হয়েছিল। ভেরোনিকা ক্যাম্পবেলের নামের শেষে তখন ‘ব্রাউন’টা ছিল না, এই যা পার্থক্য। অ্যালিসন ফেলিক্সের বয়স তখন মাত্র ১৮। অনুভূতিটাও তাই আলাদা ছিল। এথেন্সে দ্বিতীয় হয়ে মনে হয়েছিল, রুপা জিতেছেন। বেইজিংয়ে দ্বিতীয় হয়ে মনে হলো, সোনা হারিয়েছেন!

এথেন্স তাই অতটা পোড়ায়নি, যতটা পুড়িয়েছে বেইজিং। ‘মাঝের এই চার বছর আমি সারাক্ষণই বেইজিং নিয়ে ভেবেছি। মাথা থেকে ওটা সরতে দিইনি, কারণ এটাই আমাকে অনুপ্রেরণা জুগিয়ে গেছে। তবে ওই স্মৃতির সঙ্গে বসবাসটা ছিল বড় কষ্টের’—সেই কষ্ট মুছে যাওয়ায় অ্যালিসন ফেলিক্সের মুখে হাসির ফোয়ারা। 

এবারও ছিলেন প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী সেই ভেরোনিকা। অ্যালিসন-ভেরোনিকা এক যুগ ধরে অ্যাথলেটিকসে সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বিতার নাম। ২০০৪ সাল থেকে অলিম্পিক ও বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে এই দুজনের বাইরে কেউ ২০০ মিটার জেতেনি। মাঝের চারটি বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের তিনটিতেই জিতেছেন অ্যালিসন, কিন্তু অলিম্পিকে দুবারই ভেরোনিকা। ২০০৯ বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে জেতার পর অ্যালিসন তাই ভেরোনিকাকে গিয়ে বলেন, ‘তোমার একটি অলিম্পিক সোনার বিনিময়ে আমি আমার তিনটি বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের সোনা দিয়ে দিতে প্রস্তুত।’ কিন্তু অলিম্পিক সোনা তো আর এভাবে বিনিময়ের জিনিস নয়। সেটি নিজেকেই জিততে হয়। 

অবশেষে মহা আরাধ্য সেই সোনা জেতার পর অ্যালিসন আলিঙ্গন করেছেন ভেরোনিকাকে। কী ভেবে? দুজন তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বী, আবার বন্ধুও যে! ‘অলিম্পিক গেমসে দুবার ওর কাছে হারাটা মেনে নেওয়া ছিল খুব কঠিন। কিন্তু ও এমন মানুষ যে ওকে ঘৃণা করা সম্ভব নয়। আমি তো বলব, ও আমাকে অনেক সাহায্য করেছে। আমরা একে অন্যকে আরও উদ্দীপ্ত করেছি।’

ভেরোনিকা ক্যাম্পবেলের সামনে ছিল ইতিহাসের হাতছানি। টানা তিনটি অলিম্পিকে একই ইভেন্টে সোনা জয়ের কীর্তি আছে মাত্র একজন মেয়ের। তবে যুক্তরাষ্ট্রের এভেলিন অ্যাশফোর্ডের তিন সোনা রিলেতে। ব্যক্তিগত ইভেন্টে টানা তিন সোনা কারও নেই। ইয়েলেনা ইসিনবায়েভার সুযোগ ছিল। পোল ভল্ট-কন্যার ব্যর্থতায় মনে হয়েছিল, নিয়তি বোধ হয় এই কীর্তিটা ভেরোনিকা ক্যাম্পবেলের জন্যই বরাদ্দ রেখেছে। নিয়তি যে অ্যালিসন ফেলিক্সের আক্ষেপ ঘোচাবে বলে ঠিক করে রেখেছে, এটা তো আর কারও জানা ছিল না। 

ছবি: গেটি ইমেজেস

সোনা দূরে থাক, ভেরোনিকার রুপা-ব্রোঞ্জও জোটেনি। হয়েছেন চতুর্থ। অথচ নিজের দুঃখ ভুলে গেছেন অ্যালিসন ফেলিক্সের আরও বড় দুঃখ ঘুচেছে বলে, ‘কত বছর ধরে আমরা একে অন্যের সঙ্গে দৌড়াচ্ছি। ও জিতেছে বলে আমি খুব খুশি। আমি তো জানি, এটির জন্য ও কেমন অধীর হয়ে ছিল।’ অলিম্পিক সোনার জন্য অ্যালিসন ফেলিক্সের হাহাকারটা প্রতিদ্বন্দ্বীদেরও মন ছুঁয়ে গিয়েছিল। নইলে ৪০০ মিটারে সোনার সঙ্গে ২০০ মিটারেরটাও যোগ করে ‘ডাবল’ জয়ের স্বপ্ন পূরণ না হওয়ার পরও সানিয়া রিচার্ডস-রস কেন বলবেন, ‘অ্যালিসন জেতায় আমার ভালো লাগছে। ওর এটা প্রাপ্য ছিল।’

গত বছর দেগু বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ২০০ ও ৪০০ মিটারে দৌড়েছিলেন অ্যালিসন। কোনোটাতেই পারেননি। তখনই ঠিক করে ফেলেন, প্রিয় ইভেন্ট ২০০ মিটার জিততে ১০০ মিটারকে ব্যবহার করবেন প্রস্তুতি হিসেবে। এ কারণেই অলিম্পিকে ১০০ মিটারেও থাকার জন্য এমন মরিয়া ছিলেন।  এ নিয়ে নাটকও কম হয়নি। অলিম্পিক ট্রায়ালে সেরা তিনজন আসবে অলিম্পিকে। গত জুনে মার্কিন ট্রায়ালে জেনেবা তারমো আর অ্যালিসন হলেন যুগ্ম তৃতীয়। দুজনেরই টাইমিং ১১.০৬৮ সেকেন্ড। ফটো ফিনিশে তারমোকে বিজয়ী ঘোষণা করা হলো। আনন্দ-টানন্দ করে সংবাদ সম্মেলনও করে ফেললেন তারমো। ঘণ্টা খানেক পর জাজরা জানালেন, দুজনকে আলাদা করা যাচ্ছে না। দুজনই তৃতীয়।

কিন্তু অলিম্পিকের জন্য একজনকে তো বেছে নিতেই হবে। প্রথমে টসের কথা ভাবা হয়েছিল। পরে ঠিক হলো, দুজন একে অন্যের সঙ্গে দৌড়াবেন। যে জিতবে, সে-ই আসবে অলিম্পিকে। অ্যাথলেটিকস ইতিহাসে অভূতপূর্ব এই দৌড় আর হয়নি, রাগে-দুঃখে তারমো সরে দাঁড়ালেন। 

এখানে ১০০ মিটারেরও ফাইনালে উঠেছিলেন। হয়েছেন পঞ্চম। তাতে একটুও মন খারাপ করেননি। বরং সেটিই তাঁকে ২০০ মিটার জিতিয়েছে বলে অ্যালিসনের বিশ্বাস, ‘১০০ মিটার আমাকে আরও ধারালো করেছে, বাঁকটা যখন ঘুরলাম এটি খুব কাজে এসেছে।’

অলিম্পিক ট্রায়ালেই ২০০ মিটারে গত ১৪ বছরের মধ্যে দ্রুততম টাইমিং (২১.৬৯) করেন। এখানে তা ছাড়িয়ে যেতে পারেননি (২১.৮৮)। তবে সেটিই যথেষ্ট হয়ে গেল ১৯৯২ সালে গুয়েন টরেন্সের পর এই ইভেন্টে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম সোনা জয়ে। অ্যালিসন ফেলিক্সের এক যুগের আক্ষেপ ঘোচাতেও।

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×