উপমহাদেশের হকির এখন ওটুকুই সম্বল!

২০০৪ অলিম্পিক

উৎপল শুভ্র

২১ জুলাই ২০২১

উপমহাদেশের হকির এখন ওটুকুই সম্বল!

ভারত-হল্যান্ড হকি ম্যাচে ডাচ সমর্থকও ছিল। তবে চারপাশে ‘জিতেগা জিতেগা, ইন্ডিয়া জিতেগা’ বলে তীব্র চেঁচামেচির মধ্যে ডাচ সমর্থকরা বলতে গেলে নীরবই হয়ে ছিলেন। মাঠের খেলায় জিতল অবশ্য ডাচরাই। উপমহাদেশের হকির বোধ হয় ওই তারস্বরে গলা ফাটানোটাই সম্বল এখন।

প্রথম প্রকাশ: ১৭ আগস্ট ২০০৪। প্রথম আলো

এক পাশে গম্ভীর ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে উঁচু উঁচু সব পাহাড়, অন্য দিকে সাগর। আর কাগজ উড়িয়ে নেওয়া বাতাস। সেই বাতাসে শীতের আমেজ। ছয় দিনের এথেন্স-বাসে এই প্রথম। হেলেনিক স্পোর্টস কমপ্লেক্সে স্বাগতম!

অলিম্পিক স্টেডিয়াম থেকে বাসে ৪৫ মিনিটের পথ, বেসবল-সফটবল-ফেন্সিং স্টেডিয়াম পেরিয়ে হকি স্টেডিয়ামে ঢুকতেই যেন স্বাগত জানাল এক টুকরো উপমহাদেশ। গত পরশু রোববার, সময় সন্ধ্যা। সন্ধ্যা, তবে এথেন্সের সন্ধ্যা বলেই তখনো ঝলমলে রোদ। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় পাকিস্তানের খেলা, সেটি শেষ হতেই ভারত। গ্যালারি থেকে চাঁদ-তারার ভিড় সরতেই তার জায়গা নিয়ে নিল তেরঙা পতাকা। চিরশত্রু দু'দেশের পতাকা, কিন্তু অভিন্ন পরিণতি। ’৯২ অলিম্পিকের চ্যাম্পিয়ন জার্মানির কাছে ১-২ গোলে হারল পাকিস্তান, গত দুবারের চ্যাম্পিয়ন নেদারল্যান্ডসের কাছে ১-৩ গোলে ভারত। চাঁদ-তারা আর তেরঙাগুলো ভোজবাজির মতো উধাও, হকির পরাশক্তি হিসেবে ভারত-পাকিস্তানের উধাও হয়ে যাওয়ার মতোই।

একসময় অলিম্পিক হকি মানেই ছিল ভারত। ধ্যানচাঁদের স্টিকে আঠা লাগানো আছে কি না, তা নিয়ে আলোচনা হতো। বার্লিন অলিম্পিকের সময় এমনকি এডলফ হিটলারও যুদ্ধবিগ্রহের মতো জরুরি কাজ পাশে ফেলে রেখে ধ্যানচাঁদের কব্জির পেলবতা নিয়ে গবেষণাটাকে জরুরি মনে করেছিলেন। ১৯২৮ থেকে ১৯৫৬ পর্যন্ত টানা ছয়বার ভারতের সোনা, অন্য দলগুলো তখন মাঠেই নামত রুপা পাওয়ার লক্ষ্য নিয়ে। কিন্তু এরপর আর মাত্র দুবারই হকিতে বেজেছে ভারতের জাতীয় সঙ্গীত, ১৯৬৪ সালে টোকিও আর ১৯৮০ সালে মস্কোতে। দ্বিতীয়বার বয়কটের আশীর্বাদে।

ধ্যানচাঁদের গল্প এখন রূপকথাই মনে হয়। ছবি: মুম্বাই মিরর

ভারতবর্ষ ভেঙে পাকিস্তান হলো। ভাগ হলো হকির শ্রেষ্ঠত্বও। ১৯৬০ সালে রোমে সোনা জিতে ভারতের একাধিপত্যের অবসান ঘটাল পাকিস্তান। ’৬৪-তে আবার ভারত, ’৬৮-তে আবার পাকিস্তান। হকি ভারতের ছিল, হলো ভারত-পাকিস্তানের। কব্জিতে হাড়ের বদলে ‘রাবার’, স্টিকে অদৃশ্য আঠায় আটকে থাকে বল। হকির শেষ কথা ভারত-পাকিস্তানই। 

তা যে নয়, তা এরই মধ্যে প্রমাণিত। ’৮০ সালে ভারত জিতেছিল, ’৮৪-তে পাকিস্তান। এরপর গত চারটি অলিম্পিকে সোনা তো নয়ই, উপমহাদেশের সেরা সাফল্য ’৯২-তে বার্সেলোনায় পাকিস্তানের জেতা ব্রোঞ্জ। হকি বদলে গেছে, ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের জায়গা নিয়েছে শারীরিক সক্ষমতা, গতি আর টিমওয়ার্ক। তারপরও কিছু জিনিস তো থেকেই যায়। গত পরশু ভারত-নেদারল্যান্ডস ম্যাচটি দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল ঠিক যেন ফুটবলের মতো দুটি ভিন্ন ঘরানা। কিন্তু ফুটবলে যেমন ইউরোপের সঙ্গে সমানে পাল্লা দিয়ে যাচ্ছে লাতিন আমেরিকা, হকির ‘লাতিন আমেরিকা’ তা পারছে কই? 

না পারার কারণ হিসেবে সবচেয়ে বেশি আসে অ্যাস্ট্রোটার্ফের কথা। উপমহাদেশে ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব খুব বাজার পায়। অ্যাস্ট্রোটার্ফ ভারত-পাকিস্তানের আধিপত্য ঘোচাতে ইউরোপের ষড়যন্ত্র—এই তত্ত্বও খুব জনপ্রিয়। হয়তো সত্যি নয়। তবে অ্যাস্ট্রোটার্ফ তো অবশ্যই একটা ব্যাপার। ভারত-পাকিস্তানের বেশির ভাগ খেলোয়াড়ের যেখানে ঘাসের মাঠেই হকিতে হাতেখড়ি, ইউরোপিয়ানদের সেটি শুধু অ্যাস্ট্রোটার্ফেই নয়, হকি মাঠ বলতে আর কিছু বোঝেই না তারা। অ্যাস্ট্রোটার্ফ-তত্ত্বের পক্ষে সবচেয়ে বড় প্রমাণ হয়ে আছে ১৯৭৬ মন্ট্রিয়ল অলিম্পিক। অ্যাস্ট্রোটার্ফে অলিম্পিক হকি সেবারই প্রথম, ভারতের সবচেয়ে খারাপ ফলও (সপ্তম) সেই অলিম্পিকেই।

জার্মানির কাছে এথেন্স অলিম্পিকে পাকিস্তান হেরেছিল ২-১ গোলে। ছবি: উলস্টেইন

নাইকির একটা বিজ্ঞাপন আছে, ‘ইফ কান্ট বিট দেম, জয়েন দেম’। ভারত-পাকিস্তানের টিম লিস্টের নিচের নাম দুটো দেখে মনে হলো উপমহাদেশের হকিও বোধ হয় এই বিজ্ঞাপনেই বিশ্বাস স্থাপন করে ফেলেছে। নইলে পাকিস্তানের কোচ ডাচ হবে কেন, ভারতের কেন জার্মান? প্রধান কোচ জার্মান, তবে ভারতীয় দলেও ডাচ আছে। গোলরক্ষকের জন্য হল্যান্ড থেকে কোচ আনা হয়েছে, এর সঙ্গে আরও দুজন জার্মান। পাকিস্তানের প্রথম বিদেশি কোচ রোনাল্ট ওল্টম্যানসের খেলোয়াড়-জীবনের মতো কোচ হিসেবেও উজ্জ্বল এক ক্যারিয়ার। তবে ভারতের দুই জার্মান কোচকে নিয়ে ভারতীয় সাংবাদিকদের বিস্তর রসিকতা করতে শুনলাম। কোচ হিসেবে কারোরই নাকি তেমন কোনো উজ্জ্বল বায়োডাটা নেই। উল্টো একজনের গায়ে ডোপ কেলেঙ্কারির ছাপ আছে, অন্যজন নাকি কর ফাঁকি দিয়ে জেল পর্যন্ত খেটেছেন। 

হকি স্টেডিয়ামে এক টুকরো উপমহাদেশের কথা বলছিলাম। পতাকার সংখ্যায় অনেক পেছনে, তবে জার্মান-ডাচরাও ছিল। ভারতের সঙ্গে ম্যাচে গ্যালারির অনেকটা অংশই হয়ে গিয়েছিল ‘কমলা’ রঙের। তবে চারপাশে ‘জিতেগা জিতেগা, ইন্ডিয়া জিতেগা’ বলে তীব্র চেঁচামেচির মধ্যেও ডাচ সমর্থকরা বলতে গেলে নীরবই হয়ে রইল। 

হয়তো হকিতে ভারত-পাকিস্তানের এখন ওটুকুই সম্বল, এটা জেনেই।

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×