সেই সেমিফাইনাল

ইউরো ২০১২ কড়চা-৩

উৎপল শুভ্র

২৭ জানুয়ারি ২০২১

সেই সেমিফাইনাল

ডর্টমুন্ডে ২০০৬ বিশ্বকাপে ইতালি-জার্মানি সেই সেমিফাইনাল শেষ হওয়ার পর....

জার্মানদের জন্য ফুটবল আসলেই নিষ্ঠুরতার চরমতম রূপ নিয়ে দেখা দিয়েছিল সেই রাতে। ১১৯ মিনিট পর্যন্ত ম্যাচ গোলশূন্য। সবাই যখন টাইব্রেকারের অপেক্ষায়, তখনই পরপর দুই মিনিটে ইতালির দুই গোল। ছয় বছর পর ইউরোতে দুদল আবার মুখোমুখি হওয়ায় ফিরে এসেছিল সেই স্মৃতি।

প্রথম প্রকাশ: ২৮ জুন, ২০১২। প্রথম আলো।

স্টেডিয়ামের মাথার ওপর অদ্ভুত কালচে নীলরঙা আকাশে তখন ঠিক অর্ধেকটা চাঁদ। তার নিচে জার্মানরা কাঁদছে।

এর মানে কী? আজকের সেমিফাইনাল নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী? আপনার মুখে কি ওটা ব্যঙ্গের হাসি—বিরাট জ্যোতিষী, আগেই জার্মানদের কান্নাকাটি পর্যন্ত দেখে ফেলছে!

না ভাই, ভবিষ্যদ্বাণী-টাণী নয়। শুরুর শূন্যস্থানে ‘ডর্টমুন্ড’ বসিয়ে আবার পড়ুন! এবার বুঝে ফেলার কথা, সেমিফাইনাল নিয়েই কথা হচ্ছে, তবে আজ রাতের সেমিফাইনাল নয়। ২০০৬ বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল।

সেই ম্যাচের কথা জার্মান কোচ জোয়াকিম লো মনে করতে চান না। ক্লোসা-পোডলস্কিদের কথাবার্তা শুনেও মনে হচ্ছে, পারলে ক্যালেন্ডার থেকে ২০০৬ সালের ৪ জুলাই তারিখটাই মুছে দেন! ডর্টমুন্ডের ওই আবেগময় রাতের প্রত্যক্ষদর্শী বলে এতে একটুও অবাক হচ্ছি না। কে হায়, হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে!

বেদনাও কি যেমন-তেমন! ওই ম্যাচ-উত্তর ডর্টমুন্ড স্টেডিয়ামের মতো মর্মস্পর্শী কিছু এই পেশাদার সাংবাদিক জীবনে আর দেখিনি। যেন এক মৃতপুরী। হু হু হাওয়াটাও কী কান্নাভেজা! শুরুর ওই দুটি লাইন ডর্টমুন্ডের ওই রাত নিয়ে প্রথম আলোয় ছাপা হওয়া আমার লেখা থেকেই তুলে দেওয়া। আরও কটি লাইনও না হয় তুলে দিই—

মাইকেল বালাক মাথা নিচু করে বসে। তাঁর চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে শুয়ে অনেকে। মাঠের অর্ধেকটায় আনন্দে উন্মাতাল ইতালিয়ানদের দিকে তাকাতে তাকাতে ক্লিন্সমান এক-এক করে হাত রাখলেন সবার পিঠে। বালাক জার্সি তুলে চোখ মুছলেন। 

নীল রঙের একটা অংশ শুধু নেচে যাচ্ছে, বাকি গ্যালারি নিশ্চুপ। দুই মিনিটের ওই নাটকটা ‘নাটকীয়তা’ শব্দটাকেও এমনই অপর্যাপ্ত মনে করাচ্ছে যে, দুঃখ-শোক-বিহ্বলতার চেয়েও বেশি অবিশ্বাস। আসলেই কি এমন হলো! ফুটবল এমন নিষ্ঠুর হতে পারে!

জার্মানদের জন্য ফুটবল আসলেই নিষ্ঠুরতার চরমতম রূপ নিয়ে দেখা দিয়েছিল সেই রাতে। ১১৯ মিনিট পর্যন্ত ম্যাচ গোলশূন্য। সবাই যখন টাইব্রেকারের অপেক্ষায়, তখনই পরপর দুই মিনিটে ইতালির দুই গোল। জয়টা অবশ্য যোগ্যতর দল হিসেবেই পেয়েছিল ইতালি। অতিরিক্ত সময়ে ইতালিয়ান কোচ আরেকজন স্ট্রাইকার নামাচ্ছেন মাঠে, এই অভাবনীয় দৃশ্য উপহার দেওয়ার পর মার্সেলো লিপ্পির জয়টা প্রাপ্যই ছিল। দ্বিতীয় গোলটা ওই বদলি স্ট্রাইকার আলেসান্দ্রো দেল পিয়েরোরই।

সেই বিশ্বকাপে তরুণ এক দল নিয়ে দুর্দান্ত খেলছিল জার্মানি। শেষ মুহূর্তে গোল খেয়ে অমন বিদায়...সেটিও কোন মাঠে! যে ডর্টমুন্ডে এর আগে ৭১ বছরে অপরাজিত জার্মানি। ১৪টি ম্যাচ খেলে ১৩টিতেই জয়, অন্যটি ড্র। কিন্তু অজেয় সেই দুর্গ ভেঙে পড়ল সেদিন। প্রতিপক্ষ যে ছিল ইতালি!

ফুটবলের সবচেয়ে অবিশ্বাস্য পরিসংখ্যান বলতে হবে এটিকেই—বিশ্বকাপ বা ইউরোতে জার্মানি আজ পর্যন্ত ইতালিকে হারাতে পারেনি। বাকিদের অনেক পেছনে ফেলে ইউরোপের সফলতম দুই দল, অথচ তাদের দ্বৈরথ এমন একতরফা! রহস্য, এ এক মহারহস্য!

লেখাটা লিখতে লিখতে ডর্টমুন্ডের ওই ম্যাচ শেষে স্টেডিয়ামের লাউড স্পিকারে বাজানো গানটা কানে বাজছে। কথা বুঝিনি। কিন্তু সুরটা ঠিকই বুকে গিয়ে লেগেছে। বেদনার সুর। হারানোর সুর। চোখে ভাসছে ওই জার্মান বৃদ্ধের মুখ। জাতীয় পতাকা গোটাতে গোটাতে যিনি বলেছিলেন, ‘আমরা এত স্বপ্নের ঘোরে ছিলাম। সব শেষ হয়ে গেল!’ কণ্ঠে কী যে হাহাকার!

খালি দুঃখের কথা হচ্ছে, একটু আনন্দের কথাও বলি। ম্যাচের পরের অংশটা যেমন বেদনাবিধুর (অবশ্যই ইতালির জন্য নয়), আগের দুই দিন ছিল বড়ই মজার। এই ম্যাচের আগে রীতিমতো যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল দুই দলের মিডিয়ার মধ্যে। খেলোয়াড়েরাও তাতে গোলাবারুদ সরবরাহ করছিলেন। ঘটনার শুরু জার্মানি-আর্জেন্টিনা কোয়ার্টার ফাইনালের পর। ওই ম্যাচে টাইব্রেকার শেষে দুই দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে তুমুল মারামারি। তাতে সবচেয়ে সক্রিয় থাকার ‘পুরস্কার’ হিসেবে সেমিফাইনালে নিষিদ্ধ হলেন জার্মান মিডফিল্ডার টরস্টেন ফ্রিঞ্জ। জার্মানদের কাছে যা ছিল তাদের হীনবল করে দেওয়ার ইতালিয়ান ‘ষড়যন্ত্র’।

এখানে ইতালি কীভাবে আসছে? যোগসূত্রটা আবিষ্কার করেছিল বিখ্যাত জার্মান পত্রিকা বিল্ড। সদাতত্পরতার আরেকটি প্রমাণ রেখে তারাই জানায়, যে ভিডিও ক্লিপিংসের ভিত্তিতে ফ্রিঞ্জকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, সেটি ফিফাকে সরবরাহ করেছে ইতালিয়ান রাই টেলিভিশন। ওই ম্যাচের আগে তাই তুমুল উত্তেজনা। রেডিওর ফোন ইন প্রোগ্রামে উত্তেজিত সব কণ্ঠস্বর। ইতালিয়ান পিত্জা বর্জনের আহ্বান এবং সিদ্ধান্ত দুটিই সমানে আসতে লাগল। জার্মান কোন এক খেলোয়াড়ের উদ্ধৃতি দিয়ে বিল্ড ছাপল, যে ইতালিয়ানরা রাস্তার কিনারে একটু জায়গা পেলেই পিত্জার দোকান দিয়ে বসে, তাদের কাছ থেকে এমন আচরণ মোটেও অপ্রত্যাশিত নয়। এটা শুনে ইতালিয়ান মিডফিল্ডার জেনারো গাত্তুসো জবাব দিলেন, জার্মানদের এমন কথাবার্তায় তিনি একটুও অবাক হচ্ছেন না। কারণ ইতালিয়ান পেলেই তাঁর সঙ্গে জার্মানদের বউ ভেগে যাওয়ার ব্যাপারটা অনেক পুরোনো।

ম্যাচের প্রেক্ষাপটটাই বুঝিয়ে দিচ্ছে, ওই পরাজয়টা কেমন তীব্র হয়ে বেজেছিল জার্মানদের বুকে। ক্লোসা-পোডলস্কিরা যতই এটিকে ভুলে যাওয়ার ভান করুন, আজ জার্মানি জিতলে দেখবেন কেউ না কেউ বলছেন, ‘এটি ডর্টমুন্ডের প্রতিশোধ!’

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×