কোপা-ইউরো, মেসি-রোনালদোর দলবদল...বছর শেষে আবার ম্যারাডোনা

কাশীনাথ ভট্টাচার্য

৩১ ডিসেম্বর ২০২১

কোপা-ইউরো, মেসি-রোনালদোর দলবদল...বছর শেষে আবার ম্যারাডোনা

বছরের সবচেয়ে বড় খবর মেসি ও রোনালদোর দলবদল

কোপা আমেরিকা জয়ের মাধ্যমে লিওনেল মেসির আন্তর্জাতিক ট্রফি জিততে না পারার আক্ষেপ ঘোচানো, ইতালির ইউরো জয়...মহাদেশীয় এই দুই টুর্নামেন্টকেও ছাপিয়ে সম্ভবত ২০২১ সালের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা দুটি দলবদল। মেসির বার্সেলোনা ছেড়ে যাওয়া আর রোনালদোর ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে ফেরা। আর কী কী আছে, মনে করে দেখুন তো!

মাভিস আলভারেজের বয়স এখন ৩৭। কিউবার মেয়েকে ২০০০ সালে হাভানায় ধর্ষণ করেছিলেন ম্যারাডোনা, অভিযোগ করেছেন মাভিস। তাঁকে কিউবা থেকে আর্জেন্টিনায়ও নিয়ে এসেছিলেন মারাদোনা। অভিযোগের সত্যতা প্রমাণসাপেক্ষ। মারাদোনার প্রাক্তন এজেন্ট গিলেরমো কপোলা অবশ্য জানিয়েছিলেন, সুন্দর প্রেমের সম্পর্ক দেখেছিলেন ম্যারাডোনা আর মাভিসের। আর মাভিস বলেছিলেন, তাঁর কিশোরীবেলা ধ্বংস করে দিয়েছেন প্রয়াত ম্যারাডোনা, কোনো এক ড্রাগ পুনর্বাসন কেন্দ্রে তাঁর মুখ চেপে রেখে ধর্ষণ করে। মুখে হাতচাপা দিয়ে রেখেছিলেন ম্যারাডোনা, কারণ, পাশের ঘরেই নাকি ছিলেন মাভিসের মা।

বছরের ফুটবল-পরিক্রমায় শুরুতেই এমন খবর ম্যারাডোনার কারণেই। মৃত্যু তাঁকে কেড়ে নিয়েছিল ২০২০ সালে। কিন্তু ধর্ষণের মতোই ম্যারাডোনাকে নিয়ে আরও একটি খবর প্রচারিত হয়েছে ফুটবলবিশ্বে। তাঁর পরিবার দেউলিয়া হয়ে নিলামের আয়োজন করেছিল। মৃত্যুর পরও জনপ্রিয়তা একটুও কমেনি, বারবার বলা ও লেখার পরও, সেই নিলাম চূড়ান্ত ব্যর্থ হওয়ায় ম্যারাডোনার পরিবারের প্রভূত ক্ষতিই হয়েছে। আর্জেন্টিনার সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলারের ব্যবহৃত বহু জিনিস অবিক্রিত থেকেছে নিলামে। কেন, বোঝা কঠিন শুধু নয়, অসম্ভবও।

২০২১ ফুটবল-বর্ষ এমন আরও বহু খবরের জন্ম দিয়েছে যেগুলো একেবারেই অপ্রত্যাশিত।

ইউরোতে ক্রিস্টিয়ান এরিকসেনের মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা বছরের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনাগুলোর একটিএক, ইউরোর শুরুতে ডেনমার্ক-ফিনল্যান্ড ম্যাচে ক্রিস্টিয়ান এরিকসেনের মাঠেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাওয়া দেখে শিউরে উঠেছিল মাঠের সঙ্গেই টেলি-দর্শকদেরও। প্রাণ হারানোর আশঙ্কা। কিন্তু রেফারির তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে চিকিৎসকদের দ্রুত মাঠে-আসা এবং সিপিআর পদ্ধতিতে এরিকসেনকে দ্রুত সারিয়ে তোলার পাশাপাশি মন ছুঁয়ে গিয়েছিল ড্যানিশ ফুটবলারদের আচরণ। প্রিয় এরিকসেনের চারপাশে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন সকলে। টেলিভিশন ক্যামেরাও ভেতরে কী হচ্ছে দেখায়নি। এরিকসেন সুস্থ হয়ে ফিরেছেন জীবনে। হয়ত ফুটবল আর খেলবেন না। কিন্তু, ইউরোর সেই ঘটনা ভুলতে পারেননি কেউই।

দুই, ইউরোর ফাইনালে ইতালির জয় ছাপিয়ে ইংরেজ সমর্থকদের গুণ্ডামি এবং তিন কৃষ্ণাঙ্গ ইংরেজ ফুটবলারের বিরুদ্ধে বর্ণবাদী ইচ্ছে-করে-পেনাল্টি-মিস অভিযোগ বিশ্বজুড়ে শ্বেতাঙ্গ-ইউরোপীয় সমাজের বর্ণবৈষম্যমূলক আচরণের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে অন্য মাত্রা দিয়েছিল ব্ল্যাকলাইভসম্যাটার আন্দোলনকে। পেনাল্টি থেকে গোলের সুযোগ হারাননি, এমন ফুটবলার বিশ্বে বিরল। তবু ইউরো ফাইনালে ইতালির বিপক্ষে নিজেদের দেশের মাঠ ওয়েম্বলিতে টাইব্রেকারে সেই সুযোগ হারানোর জন্য বুকায়ো সাকা, জ্যাডন সাঞ্চো এবং মার্কাস র‍্যাশফোর্ডকে 'আসামি' বানিয়ে ফেলায় শ্বেতাঙ্গদের অন্ধ বর্ণবিদ্বেষ প্রকট হয়ে দেখা দেয়। যারা তেমন করেছিলেন, সেই ইংরেজ বা শ্বেতাঙ্গরা একবারও ক্ষমা প্রার্থনা করেননি। কর্তারা অবশ্য বিবৃতি দিয়েছিলেন, যা তাঁরা দিয়েই থাকেন। তাতে ফুটবল মাঠে বর্ণবৈষম্যমূলক ঘটনা কমেনি।

ইউরো ফাইনালে পেনাল্টি মিস করে বর্ণবিদ্বেষী আচরণের মুখে পড়েছিলেন ইংল্যান্ডের তিন কৃষ্ণাঙ্গ ফুটবলার তিন, বর্ণবাদ কতটা থাবা বসিয়ে রেখেছে ফুটবল-কর্তাদের মনে, আরও বড় উদাহরণ সামনে এসেছিল বছরের শেষ দিকে। ইপিএল-এর রেফারিদের ব্যাপারে। ইপিএল-এ কোনো কৃষ্ণাঙ্গ রেফারি নেই। কেন নেই? কারণ, রেফারিদের তুলে আনার কাজটা করে যে-কমিটি, সেখানে কেউ বিশ্বাসই করেন না যে, কৃষ্ণাঙ্গ রেফারিরা ইপিএল-এ ম্যাচ পরিচালনা করতে পারেন। তাঁদের চামড়ার রঙ যে কালো! দৌড়ন ভালো, বলের কাছাকাছি থাকেন...এ নিয়ে কর্তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। কিন্তু, কৃষ্ণাঙ্গরা ফুটবল বুদ্ধিতে শ্বেতাঙ্গদের ধারেকাছেও আসতে পারেন না, দৃঢ় বিশ্বাস তাঁদের। তাই তলার ডিভিশনগুলোয় কৃষ্ণাঙ্গ রেফারিরা বারবার ম্যাচ পরিচালনা করলেও প্রিমিয়ার ডিভিশনে তাঁদের সুযোগ দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না ওই শ্বেতাঙ্গকর্তাদের বিচারে। তাই সাদা চামড়ার রেফারিরা ইপিএল দাপিয়ে বেড়ানোর পাশাপাশি রোজগারও করেন প্রচুর। আর কৃষ্ণাঙ্গ রেফারিরা পর্যাপ্ত অর্থ এবং সম্মান না পেয়ে বিদায় জানাতে বাধ্য হন রেফারিং পেশাকেই।

যাক গে, বছর শেষে তিক্ত প্রসঙ্গগুলো বারবার তুলে না ধরে খেলার মাঠেই ফিরে যাওয়া যাক। আর নিশ্চিতভাবেই সেখানে সপ্তম ব্যালন ডি'অরজয়ী লিওনেল মেসির প্রাধান্য।

দেশের হয়ে ট্রফি জেতেননি, এই অভিযোগ খণ্ডনে মেসির হাতে উঠেছিল কোপা আমেরিকা, ২০২১ সালে। প্রতিযোগিতায় সর্বোচ্চ গোল, সর্বোচ্চ অ্যাসিস্টসহ সেরা ফুটবলারের পুরস্কার, যা তাঁকে বছরের সেরা ফুটবলারের পুরস্কারও এনে দিয়েছিল। তার চেয়েও বেশি কথা হয়েছে অবশ্য তাঁর বার্সেলোনা ছেড়ে পিএসজি আসা নিয়েও। তিনি আসতে চাননি, বার্সেলোনা কর্তৃপক্ষ জোর করে তাঁকে দল ছাড়তে বাধ্য করেও সমর্থকদের চোখে মেসিকে ভিলেন বানাতে চেয়ে বিবৃতিও দিয়েছিল যে, বিনে পয়সায় মেসি খেলবেন, এমনই নাকি তাঁদের আশা ছিল। সে আশায় জল ঢেলে নিজের পারিশ্রমিক বুঝে নিয়েই প্যারিস শহরে পাড়ি জমিয়েছেন মেসি।

সপ্তমবারের মতো ব্যালন ডি`অর ট্রফি হাতে নিয়েছেন লিওনেল মেসিভোটের বাজারে যেমন বলা বা লেখা হয়ে থাকে, মেসির ‘নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী’ ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোও দল বদলেছেন এই বছরেই। জুভেন্টাস থেকে প্রথমে বলা হয়েছিল ম্যানচেস্টার সিটি, এক রাতেই তা বদলে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। ইউনাইটেড সমর্থকেরা আশা করেছিলেন, ফিরে রোনালদো একাই বদলে দেবেন ইউনাইটেডের ভাগ্য। তা প্রথম মাস পাঁচেকে সম্ভব হয়নি, কারণ ইউনাইটেডের দলগঠনে সমস্যা। তবে হতাশায় মাথা গুঁজে বসে থাকার মতো কিছু এখনও হয়নি। ইপিএল-এ তো বটেই, চ্যাম্পিয়নস লিগেও নকআউটে আছে ইউনাইটেড। আর, কে না জানে, গত বেশ কয়েক বছর ধরেই মৌসুমের দ্বিতীয়ার্ধে রোনালদো নিজেকে ক্রমশ অপ্রতিরোধ্য স্তরে তুলে নিয়ে যান। এবারও তা না হওয়ার কোনো কারণ নেই। তাই নতুন বছরে ক্রিস্টিয়ানোকেও সহজাত ছন্দে দেখতে পাওয়া যাবে জার্মান কোচের অধীনে, নিঃসন্দেহ।

রবার্ট লেভানডফস্কিকে নিয়ে কথা হয়েছিল প্রচুর। কিন্তু পোল্যান্ড ইউরোজয়ের ধারেকাছেও যায়নি যেমন, বায়ার্নও ২০২০-২১ মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতেনি। মেসি ঠিকই বলেছিলেন, ২০১৯-২০ মৌসুমে সেরা ছিলেন লেভানডফস্কি, সেই বছরের ব্যালন ডি'অর ট্রফিটা তাঁকে না-দেওয়া অন্যায় হয়েছে, তাঁর বাড়িতে সেই ট্রফি পৌঁছে দেওয়া উচিত উয়েফার। কোভিডের কারণে সেই বছর ব্যালন ডি'অর পুরস্কার দেওয়াই হয়নি। অনুষ্ঠান না হতেই পারে, লেভানডফস্কির ২০২০ সালে এই পুরস্কার না-পাওয়া নিঃসন্দেহে অবিচার। এবারও গোলের মধ্যেই আছেন পোলিশ স্ট্রাইকার, বায়ার্নের হয়ে। বায়ার্নও আবার ইউরোপ-সেরা ক্লাবের ট্রফি পাওয়ার স্বপ্ন দেখছে।

কোপার ট্রফিটাই শুধু বড় না, লিওনেল মেসির অতৃপ্তি ঘোচানোর বাহন বলেও তা বড় হয়ে উঠেছে ইউরোর চেয়ে
মেসিকে ছেড়ে বার্সেলোনা ইউরোপের সর্বোচ্চ পর্যায়ে আর প্রতিদ্বন্দ্বিতার যোগ্যতাও অর্জন করতে পারছে না। এবার নেমে যেতে হয়েছে গ্রুপে তৃতীয় হয়ে ইউরোপা লিগে। কোচ হিসাবে শেষ মুহূর্তে জাভি হার্নান্দেজকে এনে চমক দিলেও বার্সেলোনার যুব-প্রতিভাদের এত তাড়াতাড়ি তৈরি করে রাতারাতি বিরাট পরিবর্তন আনা কঠিন। প্রাথমিক লক্ষ্য থাকা উচিত লা লিগায় প্রথম চারে থাকা, যাতে চ্যাম্পিয়নস লিগের গ্রুপ পর্যায়ে খেলতে পারে বার্সেলোনা।

২০২২-এ বিশ্বকাপ। এবার আবার নভেম্বর মাসে। তার আগে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিযোগিতা আছে, ম্যারাডোনা কাপ। এই ট্রফির জন্য লড়বে ইউরোজয়ী ইতালি আর কোপাজয়ী আর্জেন্টিনা। বিশ্বকাপের আগে এই ম্যাচ উত্তেজনা বাড়াবেই, ঠিক যেমন উত্তেজনার পারদ আকাশ ছোঁবে মার্চ মাসে বিশ্বকাপে জায়গা পাওয়ার লক্ষ্যে যখন পরস্পরের মুখোমুখি হবে ইতালি ও পর্তুগাল।

রোনালদোদের পর্তুগাল না দোনারুম্মাদের ইতালি, কাতারে বিশ্বকাপ কাদের দেখবে, আপাতত বর্ষশেষে এটাই নতুন বছরের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ!

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×