বাফুফে সভাপতি কাজী সালাহউদ্দিনের একান্ত সাক্ষাৎকার

`সবাই জানে, আমাকে গালি দিলেই লোকে পড়বে`

বাফুফে সভাপতি কাজী সালাহউদ্দিনের একান্ত সাক্ষাৎকার

উৎপল শুভ্র

৭ এপ্রিল ২০২১

`সবাই জানে, আমাকে গালি দিলেই লোকে পড়বে`

বাফুফে সভাপতি কাজী সালাহউদ্দিন। ছবি: মোহাম্মদ মানিক

শুধু ফুটবলেরই নয়, সব খেলা মিলিয়েই বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের প্রথম সুপারস্টার তিনি। অনেকে যে সীমানাটা খেলার বাইরেও ছড়িয়ে দিতে চান। সেই কাজী মোহাম্মদ সালাহউদ্দিনই বাফুফে সভাপতি হওয়ার পর পরিণত হয়েছেন চরম সমালোচনার লক্ষ্যবস্তুতে। যে ফুটবল সালাহউদ্দিনকে সালাহউদ্দিন বানিয়েছে, সেই ফুটবল ধ্বংস করে দেওয়ার অপবাদও শুনতে হচ্ছে তাঁকে। এই সবকিছু নিয়েই কাজী সালাউদ্দিনের দীর্ঘ এই সাক্ষাৎকার। এখানে যার প্রথম পর্ব। যেটিতে বাফুফেতে আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ নিয়েই বেশি কথা হয়েছে।

উৎপল শুভ্র: আজকের দিনের সবচেয়ে জরুরি প্রশ্নটা দিয়েই শুরু করি। বিভিন্ন ওয়েবসাইটে, টেলিভিশনে দেখছি, আর্থিক অনিয়মের কারণে ফিফা থেকে বাফুফে যে টাকাটা পায়, তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কথাটা কি ঠিক?

কাজী সালাহউদ্দিন: ইট ইজ নট কারেক্ট। কোনো কিছুই বন্ধ হয় নাই। আসলে যা হয়েছে, ওরা আমাদের কাছে একটু সিস্টেমের বদল চায়, যেভাবে পৃথিবী চলে। আমাদের সিস্টেমের সাথে অন্যদের সিস্টেমটা মেলে না। ফিফা আমাদের একজন কনসালট্যান্ট দিতে চেয়েছে, যিনি আমাদের সিস্টেমটা দেখাবেন। ফিফার গাইডলাইন যেভাবে বলে আর কি! মিডিয়াতে যে কথাগুলো আসছে, সেগুলো সত্যি নয়। সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হলো, মিডিয়াতে হান্ড্রেড পারসেন্ট কনফার্ম না হয়ে খবর দিয়ে দেয় আর ফেসবুকে শুরু হয়ে যায় প্রচণ্ড গালাগালি। অথচ এ বিষয়টাই তো আমি দেখি না, এটা দেখাশোনার দায়িত্ব ফাইন্যান্স কমিটির। আর এখন যিনি ফাইন্যান্স কমিটির চেয়ারম্যান, তাঁর চেয়ে বেটার চেয়ারম্যান তো কেউ হতে পারে না। আর্থিক সব ব্যাপারেই তাঁর অনুমোদন লাগে৷ আর আমার মনে হয় না, সালাম মুর্শেদী এমন কোনো কাজ করবে, যা আমাদের জন্য সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। কিন্তু মিডিয়া তো হাফহার্টেড কিছু শুনেই নিউজ করে ফেলে, এখন তো আমরা কিছু বলতেও পারি না, কিছু করতেও পারি না। আজ (মঙ্গলবার) ফিফার ফাইন্যান্স কমিটির চেয়ারম্যান, চিফ অ্যাকাউন্ট্যান্ট এবং জেনারেল সেক্রেটারির সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। সেখানে আমাকে বলা হয়েছে, 'তোমরা যদি রাজি থাকো, তাহলে তোমাদের আমরা একজন কনসালট্যান্ট পাঠাব। যে তোমাদের শেখাবে, তোমাদের গাইড করবে। তোমাদের সিস্টেমটা আমাদের জানার দরকার আছে।' দিজ ইজ দ্য স্টোরি।

শুভ্র: এটাই যদি স্টোরি হয়, তাহলে মিডিয়াতে তা এভাবে এলো কেন? একটা কারণ তো থাকবে।

সালাহউদ্দিন: কারণ আর কি! এটা তো নতুন কিছু নয়। এর আগে অ্যান্টি-করাপশন নিয়েও তো অনেক মিডিয়াতে নিউজ হয়েছে, অনেক কথা হয়েছে, আমাকে অনেক গালাগাল দেয়া হয়েছে। কিন্তু দুর্নীতি দমন কমিশন এরই মধ্যে আমাদের চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে, তারা কোনো কিছু পায় নাই। কিচ্ছু না। ব্যাপারটা সম্ভবত আপনিও জানেন। আপনাদের কাছে তাই আমার রিকোয়েস্ট থাকবে, একটা খেলাকে আমরা এগিয়ে নিতে চাচ্ছি, আপনারা যদি হান্ড্রেড পার্সেন্ট কনফার্ম না হয়েই কোনো নিউজ করে ফেলেন, তাহলে ক্ষতিটা বাংলাদেশেরই হবে। আজকে আমি আছি, কাল হয়তো আরেকজন আসবে, কিন্তু কাজ করা সবার জন্যই কঠিন হবে।

শুভ্র: আচ্ছা, একটা বিষয় আমাকে বলেন তো, কিছুদিন পরপরই বাফুফের টাকা-পয়সা নিয়ে নয় ছয়, আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ তুলে এমন নিউজ হয় কেন?

সালাহউদ্দিন: আমি মনে করি, এটা ব্যক্তিগত শত্রুতা। যারা করে বা করায়, তারাও জানে, অ্যাকাউন্টস বিভাগটা আমি দেখি না। তারা জানে, এটার চেয়ারম্যান সালাম মুর্শেদী, চারজন সহ-সভাপতি হলেন ফাইন্যান্স কমিটির মেম্বার। আপনি যদি দেখেন, গত দেড়-দুবছরে যতগুলো অভিযোগ উঠেছে, ফিফায় চিঠি গেছে, এএফসিতে চিঠি গেছে, দুদকে চিঠি গেছে; একটা অভিযোগও কিন্তু প্রমাণ করতে পারে নাই কেউ। এজিএম থেকে শুরু করে সবখানেই আমাদের অডিট পাশ করা আছে। আমার মনে হচ্ছে, একটা গ্রুপ, এটা ফেডারেশনের ভেতরের কেউ হতে পারে, আবার বাইরে থেকেও কেউ হতে পারে, আবার দুপক্ষই হতে পারে, চেষ্টা করছে আমাকে সরাতে। কিন্তু আমাকে যখন কোনোভাবেই সরাতে পারছে না, তখন দুদিন পরপরই একটা করে অভিযোগ এনে মিডিয়ায় গুজব ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে। যদি এত কিছুই হতো, তাহলে তো আমি একদিনও থাকতে পারি না, তাই না? আমার সময়ে অনেকগুলো এজিএম হয়েছে, বারোটা অডিট হয়েছে, সবই পাশ হয়েছে। তারপরও আমাকে দুদিন পরপরই গালাগাল শুনতে হচ্ছে। অথচ এটার চেয়ারম্যানও কিন্তু আমি না।

বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন

শুভ্র: কমিটির চেয়ারম্যান কে, তাতে কিছু আসে যায় না। চেয়ারম্যান যে-ই হোক, বাফুফের সভাপতি হিসেবে ফুটবলের ভালোর কৃতিত্ব যদি আপনি পান, বাফুফেতে কোনো আর্থিক অনিয়ম হলে সেই দায়ও তো আপনাকে নিতে হবে…

সালাহউদ্দিন: আমি তো দায় নিচ্ছি, বারো বছর ধরেই নিচ্ছি। আমার সে সাহস আছে বলেই আমি নিতে পারি। ফিফার সঙ্গে মিটিংয়ে যেমন বলা হলো, আমাদের অ্যাকাউন্টস সেকশন যেভাবে চলে, ফিফা সেভাবে চায় না। আমাদের এজন্য ফিফা কনসালট্যান্ট দিতে চায়, যে আমাদের বুঝিয়ে দিতে পারবে। আমি বলেছি, 'ডেফিনিটলি। কনসালট্যান্ট দাও, আমাদেরও শেখার দরকার আছে।' আমি সালামকে বলেছি, সোহাগকে (বাফুফে সেক্রেটারি আবু নাইম) বলেছি, 'প্লিজ, অ্যাকসেপ্ট ইট।'

শুভ্র: কনসালট্যান্ট ফিফাই দেবে?

সালাহউদ্দিন: হ্যাঁ, ফিফাই দেবে। আমি ফিফাকে আরও বলেছি, 'প্লিজ, কালই দাও। ওরা মনিটর করে দেখুক। আমার লোকজনকে শিখিয়ে দিয়ে যাক।' এটা দুঃখের বিষয়, আমার বিরুদ্ধে একের পর এক কথা তোলা হচ্ছে। কিন্তু একটা অভিযোগও কেউ প্রমাণ করতে পারছে না। আপনি জানেন নিশ্চয়ই, দুদক থেকে ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট পাওয়া সহজ কোনো কাজ নয়।

শুভ্র: হ্যাঁ, তা তো বটেই। সেজন্য আপনাকে নিশ্চয়ই অনেক হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। হয়রানি বলছি এ কারণে, কাগজ-পত্র জোগাড় করো, হাজিরা দাও…

সালাহউদ্দিন: না, আমাকে একবারও যেতে হয় নাই। আমি সব অডিট রিপোর্ট পাঠিয়ে দিয়েছি, একদম বারো বছরের। আমাকে ব্যক্তিগতভাবে জিজ্ঞাসাবাদও করে নাই। এমনকি একবার ফোনও করে নাই, ডাকেও নাই। কাগজ দেখেই তারা যা করার করেছে। 

শুভ্র: এই যে বাফুফের আর্থিক ব্যাপার নিয়ে এত রকম কথাবার্তা হয়, আপনি একটা সংবাদ সম্মেলন ডেকে বলে দিতে পারেন না, আমরা ফিফা থেকে এই টাকা পাই, এএফসি থেকে এই টাকা পাই…তাহলেই তো সব পরিষ্কার হয়ে যায়।

সালাহউদ্দিন: একবার না, বহুবার বলা হয়েছে। প্রতিবার এজিএম শেষে আমরা অডিট করে কত টাকা পেলাম, কত টাকা দিলাম, সেটা একদম ১৪০ জনের (বাফুফে কাউন্সিলর) কাছে পৌঁছে দেয়া হয়। একদম ওপেন ডকুমেন্টস।

শুভ্র: সেটা তো শুধু বাফুফের কাউন্সিলররা পান।  আপনি যদি আমাকে এবং এই ইন্টারভিউয়ের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে আবার জানান, ফিফা থেকে বাফুফে আসলে কত টাকা পায়, ক্ষতি তো নাই। কখনো শুনি চার লাখ ডলার, কেউ বলে সাড়ে চার লাখ ডলার। আসলে কত?

সালাহউদ্দিন: আপনাকে একদম পুরোটা বুঝিয়ে বলি। আমাদের বার্ষিক ব্যয় ২০-২৫ কোটি টাকার বেশি। ফিফা থেকে আমরা চার লক্ষ কিংবা পাঁচ লক্ষ ডলার যা-ই পাই না কেন, বাকিটা কিন্তু ব্যক্তিগত খাত বা স্পন্সর থেকেই আসে। ফিফা থেকে আমরা যে টাকাটা পাই, আমরা তা দিয়ে কেবল কোচ-স্টাফদের বেতন পরিশোধ করতে পারি। কিন্তু একজ্যাক্ট অঙ্কটা যে কত, সেটা আমি জানি না। জিজ্ঞাসাও করি নাই কোনোদিন। তবে আমার অনুমান, সব মিলিয়ে দশ লাখ ডলারের কিছু বেশি পাই আমরা। হান্ড্রেড পার্সেন্ট অ্যাকুরেট অঙ্কটা বলতে পারছি না, অফিসে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলে বলতে পারব।

চতুর্থবারের মতো বাফুফে সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার সপারিষদ কাজী সালাউদ্দিন

শুভ্র: তাহলে কি আপনাকে একটু পরে ফোন করব? আমার মনে হয়, এটা সবাই জানলে এসব নিয়ে কথা কম হবে। আপনার যদি গোপন করার মতো কিছু না থাকে, বলতে সমস্যা কী?

সালাহউদ্দিন: কোনো সমস্যা নাই। আপনি আমাকে ২০-২৫ মিনিট পরে ফোন করেন, আমি জিজ্ঞাসা করে রাখব তাহলে।

(২০/২৫ মিনিট পর আর ফোন করা হয়নি। কাজী সালাহউদ্দিনকে ফোন করলাম আজ বুধবার দুপুরে। কথপোকথনের সেই অংশটা এখানে সেরে ফেলি)

শুভ্র: কাল বলেছিলেন, অফিস থেকে খোঁজ নিয়ে ফিফা থেকে কত টাকা পান, এটা জানাবেন। আমি আর ফোন করতে পারিনি।

সালাহউদ্দিন: আমি কালই জেনে রেখেছিলাম। আপনি লিখে নিতে পারেন। ফিফা থেকে আমরা বছরে পাই এক মিলিয়ন (দশ লাখ) ডলার। এএফসি থেকেও কিন্তু পাই। এএফসি থেকে বছরে হাফ অ্যা মিলিয়ন (পাঁচ লাখ ডলার)। খরচের হিসাবটাও আপনি নিতে পারেন। এই টাকার প্রায় সবটাই অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ খরচ, যেমন অফিস চালানো, কোচিং স্টাফ ও এমপ্লয়িদের বেতন, জাতীয় দলের পেছনে চলে যায়। তিনজন স্থায়ী কোচের বেতন মনে হয় সব মিলিয়ে মাসে ৩৬ হাজার ডলারের মতো। টুর্নামেন্টের আগে কখনো কখনো স্পেশালিস্ট কোচ আনা হয়, তার খরচ আছে। জাতীয় দল এখন ভালো ফ্যাসিলিটিজ পায়, ভালো হোটেলে থাকে, সারা বছরে জাতীয় দলের পেছনে আমার ধারণা, প্রায় ছয় লাখ ডলারের মতো খরচ হয়। সব তো আর মুখস্থ থাকে না। আপনি চাইলে অফিসে এসে অ্যাকাউন্টস দেখে যেতে পারেন।   

ও হ্যাঁ, আরেকটা কথা, এই যে ফিফা অনুদান বন্ধ করে দিয়েছে বলে নিউজ হলো, আজ সকালেই কিন্তু ফিফা থেকে বাফুফের অ্যাকাউন্টে এক লাখ ডলার পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।

শুভ্র: এই এক লাখ টাকা কোন মাসের? ফিফা কি বছরের পুরো টাকা একবারে দেয়, নাকি ইনস্টলমেন্টে দেয়?

সালাহউদ্দিন: মাস ধরে বলতে পারব না। তবে একটা কথা আপনাকে জানিয়ে দিই, ফিফা বা এএফসি যে টাকাই দিক, সেটি খরচের জন্য কিন্তু খাত নির্দিষ্ট করে দেয়। আপনি চাইলেও এক খাতের টাকা অন্য খাতে ব্যয় করতে পারবেন না। করলে ফিফার কাছে জবাবদিহি করতে হয়। মানে করারই সুযোগ নাই। বাফুফের টাকাপয়সা নিয়ে এই যে এত কথা হয়, অথচ বাফুফের আ্যাকাউন্টস কিন্তু তিনবার অডিট হয়। একটা ইন্টারনাল অডিট, যদিও ওটা আমি গোনায় ধরি না। আরেকটা প্রত্যেক এজিএমের আগে গভর্মেন্ট অ্যাপ্রুভড ফার্ম দিয়ে অডিট করানো হয়। এজিএমের এক মাস আগেই তা আমি সব কাউন্সিলরকে পাঠিয়ে দিই। কারও কোনো অবজার্ভেশন থাকলে তা জানাতে বলি। কই, বাফুফের আর্থিক অনিয়ম বা দুর্নীতি নিয়ে বাইরে অনেকে এত কথা বলে, কোনো এজিএমেই তো এমন হয় নাই যে, তা পাস হয় নাই। তিনটা অডিটের কথা বলছিলাম না, জুরিখ থেকে ফিফার লোক এসেও তো বাফুফেতে অডিট করে। আমাদের সিস্টেমের কিছু সমস্যার কথা ওরা বলেছে, কোনো দুর্নীতি তো পায় নাই।   

(বুধবার থেকে আবার মঙ্গলবারে)

শুভ্র: বাফুফে সভাপতির ইন্টারভিউ করছি, কোথায় ফুটবল নিয়ে কথা হবে, অথচ টাকাপয়সা নিয়ে কথা বলে এতটা সময় চলে গেল...

সালাহউদ্দিন: এসব নিয়ে কথা বলতে আমারও ভালো লাগে না। কিন্তু আপনিই তো জানতে চাইলেন।

শুভ্র:  জানতে চাইলাম তো সর্বশেষ নিউজটা দেখে। এবার তাহলে ফুটবল নিয়ে কথা বলি। আপনি বাফুফে সভাপতি হওয়ার আগে সালাহউদ্দিন নামটাই ছিল একটা ম্যাজিক। ফুটবলার সালাহউদ্দিনকে পছন্দ করেন না, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়াই তো কঠিন ছিল। কিন্তু এখন মানুষ উঠতে-বসতে আপনাকে গালি দেয়। এই জিনিসটা আপনার কাছে কেমন লাগে? প্রশ্নটা অবশ্য একটু নিষ্ঠুর হয়ে গেল, ভালো লাগার যেখানে কোনো কারণই নাই...

সালাহউদ্দিন: ইটস ভেরি স্যাড। আপনার মনে আছি কিনা জানি না, ২০০৮-য়ে আমি যখন প্রথমবার সভাপতি হই, আপনিই কোনো একটা টিভি শোত বলেছিলেন, 'উনি এই মরা হাতি টানতে আসলেন কেন?' কারণ তখন ফুটবলের অবস্থা মৃতপ্রায়। মাঠে খেলা নাই। আপনি তাই বলেছিলেন, আমি কেন আসলাম। ফুটবল মরে গেলে তো মরেই গেল, আমিও মরে যাব এর সাথে৷ কিন্তু আমি একটা চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলাম, আমি ফুটবলটাকে বাঁচিয়ে রাখব। আপনি যদি দেখেন, আমি কিন্তু ফুটবল মাঠে রেখেছি। এটাই আমার সমস্যা কি না জানি না, আমি কিন্তু অন্য ফেডারেশনগুলোর সভাপতির মতো না। আমি রাজনীতিবিদ কিংবা ব্যবসায়ী পরিচয়ে ফেডারেশনে আসিনি। আমি নির্বাচন করে এসেছি। ফুটবলার পরিচয়টাই আমার বায়োডাটা। কোনো ফেডারেশনে কিন্তু আমার মতো ব্যাকগ্রাউন্ডের কাউকে সভাপতি হিসেবে পাবেন না। খেলাটার জন্যে আমার ভালোবাসা তাই অন্য পর্যায়ের। আমি সংসদে ঢোকারও চেষ্টা করি না, মন্ত্রী হতেও চাই না। অন্য কোনো বোর্ডেও কিন্তু আমি ইন্টারফেয়ার করি না। আমি ফুটবল নিয়েই পড়ে আছি। যে ছেলেগুলো হয়তো আগে মালয়েশিয়া এয়ারপোর্টে কাজ করত, এখন ওরা ফুটবল খেলে ঘরে টাকা নিয়ে যাচ্ছে। এরাই আমার শক্তি। আমি সারাদিন বাফুফে নিয়ে পড়ে থাকি। অ্যাকাউন্টস ছাড়া ফুটবলের আর সব দিকই আমি দেখি।

`ওরা এটা বোঝে না, সালাহউদ্দিনের কারণেই এই চেয়ারটা এমন গ্ল্যামারাস হয়েছে`

শুভ্র: অ্যাকাউন্টস ছাড়া বলছেন কেন? এটা কী অ্যাকাউন্টস নিয়ে কিছু দিন পরপরই কথা ওঠে, এ কারণে?

সালাহউদ্দিন: অ্যাকাউন্টস নিয়ে কথা তোলার মূল কারণটা হচ্ছে, ওরা আমাকে আঘাত করার আর কোনো জায়গা পাচ্ছে না। 'ভীষণ দুর্নীতি হচ্ছে বাফুফেতে' লোকে এসব গল্প বেশি খায়। দুদকে আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছিল, এক বছর ধরে অডিট-ফডিট করে দুদক আমাদের ক্লিন শিট দিয়েছে। আমি কিন্তু কোনো ইনফ্লুয়েন্স করার চেষ্টা করি নাই। সবসময় বলেছি, আমার কাগজপত্রই সব প্রমাণ করবে। কারণ আমি জানি, এখানে কোনো সমস্যা নেই। সিস্টেমের কিছু ভুল থাকতে পারে, কিন্তু এখানে চুরি-চামারি কিচ্ছু নাই।

শুভ্র: আপনি নির্বাচনে জিতেই প্রতিবার প্রেসিডেন্ট হয়েছেন মানে ফুটবল সংশ্লিষ্ট লোকজন আপনাকেই যোগ্য লোক মনে করেছে। কিন্তু এই যে 'সালাহউদ্দিনই ফুটবলটাকে ধ্বংস করল' বলে যে অপবাদ দেয়া হয়, এ ব্যাপারে কী বলবেন? একই সঙ্গে প্রশ্ন চলে আসে, এত লোক আপনার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেল কেন? আপনার বিরুদ্ধে যে ফুটবলাররা কথা বলেন, তাঁদের অনেককেই আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি। তাঁরা প্রত্যেকেই খেলোয়াড় সালাউদ্দিনের বিশাল ফ্যান ছিলেন। তাঁরা কেন আপনার বিরুদ্ধে চলে গেল? কেন তাঁরা বলে, আপনি ফুটবল ধ্বংস করে দিয়েছেন। তাঁদের স্বার্থটা কী?

সালাহউদ্দিন: ভেরি সিম্পল। এক নম্বর হলো, তারা ভেবেছে, আমাকে ধাক্কা দিলেই আমি পড়ে যাব। দুই নম্বর হলো, আমি বাফুফেতে আসার পরে যে গ্ল্যামার আর লাইমলাইট এসেছে, ওরা মনে করেছে, ওরা যদি আমার চেয়ারে বসে, তাহলে একই গ্ল্যামার আর লাইমলাইট পাবে। আরেকটা কারণ হলো, আমাকে সরিয়ে যারা প্রেসিডেন্ট হতে চেয়েছে, তারা সবাই ফাইনান্সিয়ালি ভেরি স্ট্রং। কিছু লোক তাই তাদের সঙ্গে গিয়ে জুটেছে। ওই লোকগুলাই ভেবেছে, টাকার জোরে আমরা যাকে খুশি বের করে দেব। আর আমার এই চেয়ারটা ভেরি গ্ল্যামারাস চেয়ার। বাট দে ডোন্ট রিয়ালাইজ ইটস্ সালাহউদ্দিন হু মেকস্ দ্য চেয়ার গ্ল্যামারাস। আমার আগেও তো দশজন সভাপতি ছিল, আমি জানি না, আপনি কয়জনের নাম বলতে পারবেন। স্যরি, আমাকে এভাবে বলতে হচ্ছে। কিন্তু ঘটনা তো এটাই যে, সবাই জানে, আমাকে গালি দিলেই লোকে পড়বে, এখন আপনি যদি রহিম-করিমকে গালি দেন, তাহলে তো টেলিভিশন আপনাকে টাকা দেবে না। এটা খুব দুঃখের ব্যাপার।

যে লোকগুলা আমার বিরোধিতা করে এসেছে টেলিভিশনে, বাইরেও আজেবাজে কথা বলেছে, এই লোকগুলাই এখন রোজ একবার আমাকে ফোন করে। জিজ্ঞাসা করে, ‘ব্রাদার, কেমন আছেন? হোয়াট ক্যান আই ডু ফর ইউ? দিস অ্যান্ড দ্যাট।'

শুভ্র: কিন্তু সাধারণ মানুষও তো এখন বলে, 'ফুটবলটাকে আপনি ধ্বংস করে দিয়েছেন'। আপনি যদি দাবি করেন, আসলে ধ্বংস করেন নাই, ১২ বছরে ফুটবলকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন, এর পক্ষে কী প্রমাণ আছে?

সালাহউদ্দিন: প্রথম প্রমাণ হলো, ১২ বছর ধরে মাঠে নিয়মিত খেলা আছে। আপনাকে একটা কথা বলি, বসুন্ধরা কিংসের যে নতুন স্প্যানিশ কোচ, সে তো ইন্ডিয়া-টিন্ডিয়াও ঘুরে এসেছে। তাঁর কথা হচ্ছে, বাংলাদেশ ফুটবল লিগ ইজ ওয়ান অব দ্য ফাইনেস্ট লিগ ইন সাউথ এশিয়া। এএফসি কাপে কিন্তু আমাদের দুইটা ক্লাব চান্স পায়। এটার কারণ রেগুলার ফুটবল। আমি রাজনীতি করি না, পাবলিসিটি করি না। টেলিভিশনে যাই খুব কম। এ জন্য আমার ওপর অনেকের খুব রাগ। আমি টিভি স্টার হতে চাই না। আমি একজন ফুটবলার, আমি ফুটবলের জন্যই কাজ করতে চাই। আমার ওপর যেহেতু অনেকের রাগ, তাদের বলছি, আপনারা ফুটবলের জন্য যা করতে চান, আমাকে বলেন। আমি আপনাদের সব রকম সাপোর্ট দেব। ফাইনান্স আনব। অর্গানাইজার হিসেবে আমি বারোটা বছর টানা লিগ, ফেডারেশন কাপ, ইন্ডিপেন্ডেন্স কাপ চালিয়ে গেছি। একবারও বাদ পড়েনি। আমি কিন্তু করোনার মধ্যেও বাংলাদেশের অন্য সব ফেডারেশনের আগে খেলা শুরু করেছি। আমি যদি রাজনীতিবিদের মতো হতাম, তাহলে মিডিয়ার সাথে প্রেম-ট্রেম করে নিজেকে সুপারস্টার বানাতে পারতাম। আমার তাই মনে হয়, আমার পিআরটা (জনসংযোগ) তত ভালো না। আমি কিন্তু কারও সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করি না, আমাকে কোনোদিনও কাউকে গালাগাল করতে শুনবেন না। আমাকে কিন্তু গালাগালি করেই যাচ্ছে। সবচেয়ে দুঃখের বিষয় কী জানেন, যে লোকগুলা আমার বিরোধিতা করে এসেছে টেলিভিশনে, বাইরেও আজেবাজে কথা বলেছে, এই লোকগুলাই এখন রোজ একবার আমাকে ফোন করে। জিজ্ঞাসা করে, ‘ব্রাদার, কেমন আছেন? হোয়াট ক্যান আই ডু ফর ইউ? দিস অ্যান্ড দ্যাট।'

শুভ্র: কিন্তু তাঁদের কিছু অভিযোগ তো সত্যি। যেমন সারা দেশে খেলা হয় না, সোহরাওয়ার্দী কাপ হয় না…

সালাহউদ্দিন: তারাই জানে, তারা মিথ্যা বলছে।

শুভ্র: মিথ্যা বলছে মানে? সোহরাওয়ার্দী কাপ তো আসলেই অনিয়মিত, যুব টুর্নামেন্টও...

সালাহউদ্দিন: সোহরাওয়ার্দী কাপ তো আমি করব না, আমি তো বঙ্গবন্ধু কাপ করি।

শুভ্র: বঙ্গবন্ধু কাপ বলতে কি আপনি স্কুল টুর্নামেন্ট বোঝাচ্ছেন? বঙ্গবন্ধু, বঙ্গমাতা...ওগুলো তো সরকার করে।

সালাহউদ্দিন: স্কুল টুর্নামেন্ট তো আছেই, সঙ্গে আমি নিজেও আরেকটা টুর্নামেন্ট করি। হোম অ্যান্ড অ্যাওয়ে। রংপুর চিটাগংয়ের সঙ্গে খেলে, চট্টগ্রাম রংপুরের সঙ্গে, হোম অ্যান্ড অ্যাওয়ে। আপনি যতগুলো জিনিস বললেন, আমি সব করি। বিএফএফ প্রেসিডেন্ট হিসেবে যেটা আমার করার না, সেটাও করি। বাট পাবলিসিটি ইজ লাইক দ্যাট। আমার বিগেস্ট উ‌ইকনেস হলো....কী যেন বলে ইংরেজিটা....

শুভ্র: পিআর, পাবলিক রিলেশন?

সালাহউদ্দিন: হ্যাঁ, আমার পিআরটা নাই।

শুভ্র: আমার তো বরং উল্টো মনে হয়। বাংলাদেশের সব বড় ব্যবসায়ী, শিল্পপতির বেশির ভাগই তো ফুটবলার সালাহউদ্দিনের ফ্যান ছিলেন। ফ্যান বলতে সেই রকম ফ্যান। সবার দুয়ারই আপনার জন্য খোলা, কারণ আপনি বাংলাদেশের স্পোর্টসের প্রথম সুপারস্টার। এমন কোনো সাংবাদিক নাই যে আপনার সঙ্গে সমীহ করে কথা বলে না। তা পেশাগত কারণে সে আপনার সম্পর্কে যা-ই লেখুক না কেন। আপনার আগের সভাপতিদের নিয়ে আপনিই যেমন বললেন, দায়িত্ব নিয়ে তাঁদের প্রথমে নিজেদের চেনাতে হয়েছে। যেটা আপনার লাগেনি, আপনি সুপারস্টার হিসেবেই বাফুফেতে এসেছেন। আপনার পিআর লাগবে কেন? আপনার জন্য তো কাজটা বরং অনেক সহজ ছিল। উল্টো আপনি এমন গণশত্রুতে পরিণত হলেন কেন?

সালাহউদ্দিন: দেখেন, আমি অনেকের শত্রু হয়ে গেছি তো এ কারণেই। ফিফা আর কয় টাকা দেয়! দুই-চার-পাঁচ টাকা দেয়। আমার ওই পরিচিতিটা ছিল বলেই তো এর থেকে অনেক বেশি পয়সা আমি আনি। এটা যেন বন্ধ হয়, এ জন্যই আমার অপোনেন্টরা এটা করে। আমি কোনো স্পন্সরের কাছে গেলে ওরা যেন চিন্তা করে, এত করাপশন শুনি ওখানে, এখানে যাব কি না? এটাই ওদের স্ট্র্যাটেজি।

(বাকি অংশ আগামীকাল)

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×